আলোকের এই ঝর্ণাধারায় by শিখ্তী সানী
আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও।
আপনাকে এই লুকিয়ে-রাখা ধুলার ঢাকা ধুইয়ে দাও\
যেজন আমার মাঝে জড়িয়ে আছে ঘুমের জালে
আজ এই সকালে ধীরে ধীরে তার কপালে
এই অরুণ আলোর সোনার-কাঠি ছুঁইয়ে দাও...’
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজ পয়লা বৈশাখ, ১৪১৭। শুভ নববর্ষ। যা কিছু মলিন, পুরোনো ও গ্লানিময়—সব আজ ধুয়ে যাক, পয়লা বৈশাখের আনন্দ স্রোতে। আবহমান বাঙালির প্রাণের উৎসব আজ। আটপৌরে বেশ ছেড়ে আজ আমরা মেতে উঠব বর্ষবরণের বর্ণিল ও মহাআড়ম্বর উৎসবে। স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসে রব পড়ে যাবে বঙ্গদেশের সব প্রান্তরে। ঢোল বাজবে তাকদুম তাকদুম। লাল-সাদা রঙে ছেয়ে যাবে সবাই। ১৪১৬কে ফেলে নতুন বছরকে আমরা বরণ করে নেব সুরে, রঙে আর ঢঙে। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। বলা হয়, যে জাতির উৎসব নেই, সে জাতির কোনো প্রাণ নেই, চলার শক্তিও নেই। তাই বাঙালি হিসেবে আমাদের গর্বের শেষ নেই। ছয়টি ঋতু ঘিরে বাঙালির অসংখ্য উৎসব, আর উৎসব ঘিরে নানা আয়োজন। বর্ণ-গন্ধ-রঙে ছাপিয়ে যায় এখানকার উৎসবচর্চা।
চৈত্রের শুরু থেকে জানান দিতে থাকে বৈশাখ। তাপমাত্রা হয়ে যায় উত্তপ্ত। শীতের সোনালি সূর্যের কিরণ হয়ে দাঁড়ায় রক্তলাল। প্রকৃতির আশীর্বাদে বহুকাল থেকে বঙ্গদেশে ঋতুবৈচিত্র্য ছিল প্রাচুর্যময়। আজ যেন প্রকৃতিমাতাও বিরূপ। ভগ্ন প্রকৃতির মতো ভগ্নশরীর নিয়ে হাঁটছে বাংলাদেশও। তাই প্রকৃতিতে ঋতু পরিবর্তনের লক্ষণ বোঝা কঠিন। তবুও নগরে ফুটেছে কৃষ্ণচূড়া, স্বর্ণচূড়া, সোনালু আর নাগকেশর। অনুসন্ধানী চোখ শালের হলদে সাদা, নরম রোমশ ফুলের সন্ধানও পেতে পারে। পথতরুর এমন বর্ণিল আয়োজন আর আম্রমুকুলের ঘ্রাণ দিনকয়েক আগে থেকেই বলে দেয় বৈশাখের আগমনের কথা। তাড়া দেয় বৈশাখ উদ্যাপনের। গ্রামের ন্যায় ভাঁটফুলের সন্ধান মিলবে না খুব। তবুও রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া আর সোনালি স্বর্ণচূড়া-সোনালুদের ভালোবাসার তীব্র রং নববর্ষের আনন্দকে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। প্রকৃতির এ অকৃত্রিম উপঢৌকনের পাশাপাশি মানুষের ফুল-ব্যবসাও কম যায় না। পুরো শহর আর হরেক রকম ফুলের বিশাল পসরা নিয়ে বসেছে। এসব কিছু নিয়েই নগরের শাহবাগে বসবে লাল-সাদার মেলা, বেলীর সুগন্ধ আর সবার উচ্ছ্বাস।
বাংলা নববর্ষ পালনের রীতি অনেক পুরোনো। কালে কালে তাতে পরিবর্তনের অনেক হাওয়া লেগেছে। বদলে গেছে বাঙালি সাজে, আচরণে, সংস্কৃতিতে। তবে প্রাণের আবেগ আর উদ্দীপনার কমতি ছিল না কোনো কালেই। মোগল সম্রাট আকবরের সময় থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। সেকালে কৃষিকাজের সুবিধার জন্য সম্রাট এ নতুন সনের ঘোষণা দেন। হিজরি চান্দ্র সন ও বাংলা পৌর সনকে ভিত্তি করেই প্রবর্তিত হয় বাংলা সন। প্রথমে এ সনটি পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা বঙ্গাব্দ হিসেবে নাম পায়। পালাবদলে নতুন বছর এলে মানুষ মেতে উঠত নানা আয়োজনে। জমিদারি প্রথায় প্রজারা নতুন বছরের প্রথম দিনের আগে নিজ নিজ ভূস্বামীদের খাজনা দিত। পরদিন ভুস্বামীরা তাদের মিষ্টি খাওয়াত। একে ঘিরে ওই অঞ্চলে বসত মেলা, নানা লোকউৎসব, সংগীত ও পালাগানচর্চা। নতুন বছরের প্রথম দিন ঘিরে আরও পালন করা হতো ‘হালখাতা’ হালখাতার সেই রেশ আজ অবধি চলে আসছে। আজও ব্যবসায়ীরা পুরোনো হিসাবনিকাশের পাট চুকিয়ে বছরের প্রথম দিন নতুন খাতা খোলে। পুরোনো খদ্দেরদের নিয়ে আজও পড়ে মিষ্টি খাওয়ার ধুম। নববর্ষের এ উৎসব চর্চায় বাংলার গ্রামীণ জীবন-জীবিকা আর সংস্কৃতির একটা গভীর বন্ধন আছে। আজকাল এ বদলের দুনিয়ায় গ্রামের চেয়ে শহুরে নববর্ষের রঙ্গ অনেক বেশি, রূপ অনেক জাঁকজমকপূর্ণ। তাই চাকচিক্যের ঝলকানির ধাঁধায় ফেলে দেয় আমাদের। কিন্তু যে বর্ণে আর ঢঙেই শহুরে বর্ষবরণ সাজুক না কেন, তার সবকিছুই চিরায়ত গ্রামীণ সংস্কৃতিরই অবিচ্ছেদ্য উপাদান। শহুরে বর্ষবরণের হাজারও আয়োজন-আত্তির মূল সুর গ্রামের লোকজ সংস্কৃতির মাঝেই আটকে গেছে।
গ্রামের বর্ষবরণের প্রাণ হলো মেলা, লোকজ নানা উৎসব আর বহুকাল ধরে চলে আসা নানা লোকরীতির ধারা। সবার প্রত্যাশা থাকে অনেক, বছরের প্রথম দিনটিতে ভালো খাওয়া, ভালো থাকা আর ভালো কিছু পরার মধ্য দিয়ে আশা করা হয় বছরের বাকি দিনগুলোও তেমনই যাবে। আমরাও তাই বছরের প্রথম দিনটি ধুমধাম করে বরণ করে নিতে চাই। সে জন্যই আমরা রমনার বটমূলে ভোরের প্রথম সূর্যরশ্মির ছোঁয়ায় বৈশাখকে বরণ করে নেব। তারপর চারুকলার বর্ণিল শোভাযাত্রায় প্রাণের ডাকে মিলে দূর করে দেব আমরা সব অমঙ্গল আর অশুভ শক্তিকে। সঙ্গে মেলার হইরই তো আছেই।
প্রতিটি বছর শুরু হয় এক একটি স্বপ্ন নিয়ে। সেই স্বপ্ন নিয়েই বছরটির এক-দুই করে দিন চলতে থাকে। আমাদের সব স্বপ্নের শতভাগ বাস্তবায়িত হোক ১৪১৭তে। সব অশুভ শক্তিকে হটিয়ে আমরা বাঙালি চেতনার জয়গান গাইতে চাই। প্রাণের মাঝে ধারণ করতে চাই শতবর্ষের এ বাঙালি সংস্কৃতিকে। পয়লা বৈশাখের শুভেচ্ছা সবাইকে।
আপনাকে এই লুকিয়ে-রাখা ধুলার ঢাকা ধুইয়ে দাও\
যেজন আমার মাঝে জড়িয়ে আছে ঘুমের জালে
আজ এই সকালে ধীরে ধীরে তার কপালে
এই অরুণ আলোর সোনার-কাঠি ছুঁইয়ে দাও...’
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজ পয়লা বৈশাখ, ১৪১৭। শুভ নববর্ষ। যা কিছু মলিন, পুরোনো ও গ্লানিময়—সব আজ ধুয়ে যাক, পয়লা বৈশাখের আনন্দ স্রোতে। আবহমান বাঙালির প্রাণের উৎসব আজ। আটপৌরে বেশ ছেড়ে আজ আমরা মেতে উঠব বর্ষবরণের বর্ণিল ও মহাআড়ম্বর উৎসবে। স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসে রব পড়ে যাবে বঙ্গদেশের সব প্রান্তরে। ঢোল বাজবে তাকদুম তাকদুম। লাল-সাদা রঙে ছেয়ে যাবে সবাই। ১৪১৬কে ফেলে নতুন বছরকে আমরা বরণ করে নেব সুরে, রঙে আর ঢঙে। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। বলা হয়, যে জাতির উৎসব নেই, সে জাতির কোনো প্রাণ নেই, চলার শক্তিও নেই। তাই বাঙালি হিসেবে আমাদের গর্বের শেষ নেই। ছয়টি ঋতু ঘিরে বাঙালির অসংখ্য উৎসব, আর উৎসব ঘিরে নানা আয়োজন। বর্ণ-গন্ধ-রঙে ছাপিয়ে যায় এখানকার উৎসবচর্চা।
চৈত্রের শুরু থেকে জানান দিতে থাকে বৈশাখ। তাপমাত্রা হয়ে যায় উত্তপ্ত। শীতের সোনালি সূর্যের কিরণ হয়ে দাঁড়ায় রক্তলাল। প্রকৃতির আশীর্বাদে বহুকাল থেকে বঙ্গদেশে ঋতুবৈচিত্র্য ছিল প্রাচুর্যময়। আজ যেন প্রকৃতিমাতাও বিরূপ। ভগ্ন প্রকৃতির মতো ভগ্নশরীর নিয়ে হাঁটছে বাংলাদেশও। তাই প্রকৃতিতে ঋতু পরিবর্তনের লক্ষণ বোঝা কঠিন। তবুও নগরে ফুটেছে কৃষ্ণচূড়া, স্বর্ণচূড়া, সোনালু আর নাগকেশর। অনুসন্ধানী চোখ শালের হলদে সাদা, নরম রোমশ ফুলের সন্ধানও পেতে পারে। পথতরুর এমন বর্ণিল আয়োজন আর আম্রমুকুলের ঘ্রাণ দিনকয়েক আগে থেকেই বলে দেয় বৈশাখের আগমনের কথা। তাড়া দেয় বৈশাখ উদ্যাপনের। গ্রামের ন্যায় ভাঁটফুলের সন্ধান মিলবে না খুব। তবুও রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া আর সোনালি স্বর্ণচূড়া-সোনালুদের ভালোবাসার তীব্র রং নববর্ষের আনন্দকে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। প্রকৃতির এ অকৃত্রিম উপঢৌকনের পাশাপাশি মানুষের ফুল-ব্যবসাও কম যায় না। পুরো শহর আর হরেক রকম ফুলের বিশাল পসরা নিয়ে বসেছে। এসব কিছু নিয়েই নগরের শাহবাগে বসবে লাল-সাদার মেলা, বেলীর সুগন্ধ আর সবার উচ্ছ্বাস।
বাংলা নববর্ষ পালনের রীতি অনেক পুরোনো। কালে কালে তাতে পরিবর্তনের অনেক হাওয়া লেগেছে। বদলে গেছে বাঙালি সাজে, আচরণে, সংস্কৃতিতে। তবে প্রাণের আবেগ আর উদ্দীপনার কমতি ছিল না কোনো কালেই। মোগল সম্রাট আকবরের সময় থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। সেকালে কৃষিকাজের সুবিধার জন্য সম্রাট এ নতুন সনের ঘোষণা দেন। হিজরি চান্দ্র সন ও বাংলা পৌর সনকে ভিত্তি করেই প্রবর্তিত হয় বাংলা সন। প্রথমে এ সনটি পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা বঙ্গাব্দ হিসেবে নাম পায়। পালাবদলে নতুন বছর এলে মানুষ মেতে উঠত নানা আয়োজনে। জমিদারি প্রথায় প্রজারা নতুন বছরের প্রথম দিনের আগে নিজ নিজ ভূস্বামীদের খাজনা দিত। পরদিন ভুস্বামীরা তাদের মিষ্টি খাওয়াত। একে ঘিরে ওই অঞ্চলে বসত মেলা, নানা লোকউৎসব, সংগীত ও পালাগানচর্চা। নতুন বছরের প্রথম দিন ঘিরে আরও পালন করা হতো ‘হালখাতা’ হালখাতার সেই রেশ আজ অবধি চলে আসছে। আজও ব্যবসায়ীরা পুরোনো হিসাবনিকাশের পাট চুকিয়ে বছরের প্রথম দিন নতুন খাতা খোলে। পুরোনো খদ্দেরদের নিয়ে আজও পড়ে মিষ্টি খাওয়ার ধুম। নববর্ষের এ উৎসব চর্চায় বাংলার গ্রামীণ জীবন-জীবিকা আর সংস্কৃতির একটা গভীর বন্ধন আছে। আজকাল এ বদলের দুনিয়ায় গ্রামের চেয়ে শহুরে নববর্ষের রঙ্গ অনেক বেশি, রূপ অনেক জাঁকজমকপূর্ণ। তাই চাকচিক্যের ঝলকানির ধাঁধায় ফেলে দেয় আমাদের। কিন্তু যে বর্ণে আর ঢঙেই শহুরে বর্ষবরণ সাজুক না কেন, তার সবকিছুই চিরায়ত গ্রামীণ সংস্কৃতিরই অবিচ্ছেদ্য উপাদান। শহুরে বর্ষবরণের হাজারও আয়োজন-আত্তির মূল সুর গ্রামের লোকজ সংস্কৃতির মাঝেই আটকে গেছে।
গ্রামের বর্ষবরণের প্রাণ হলো মেলা, লোকজ নানা উৎসব আর বহুকাল ধরে চলে আসা নানা লোকরীতির ধারা। সবার প্রত্যাশা থাকে অনেক, বছরের প্রথম দিনটিতে ভালো খাওয়া, ভালো থাকা আর ভালো কিছু পরার মধ্য দিয়ে আশা করা হয় বছরের বাকি দিনগুলোও তেমনই যাবে। আমরাও তাই বছরের প্রথম দিনটি ধুমধাম করে বরণ করে নিতে চাই। সে জন্যই আমরা রমনার বটমূলে ভোরের প্রথম সূর্যরশ্মির ছোঁয়ায় বৈশাখকে বরণ করে নেব। তারপর চারুকলার বর্ণিল শোভাযাত্রায় প্রাণের ডাকে মিলে দূর করে দেব আমরা সব অমঙ্গল আর অশুভ শক্তিকে। সঙ্গে মেলার হইরই তো আছেই।
প্রতিটি বছর শুরু হয় এক একটি স্বপ্ন নিয়ে। সেই স্বপ্ন নিয়েই বছরটির এক-দুই করে দিন চলতে থাকে। আমাদের সব স্বপ্নের শতভাগ বাস্তবায়িত হোক ১৪১৭তে। সব অশুভ শক্তিকে হটিয়ে আমরা বাঙালি চেতনার জয়গান গাইতে চাই। প্রাণের মাঝে ধারণ করতে চাই শতবর্ষের এ বাঙালি সংস্কৃতিকে। পয়লা বৈশাখের শুভেচ্ছা সবাইকে।
No comments