সুশাসন কি নির্বাসনে যাবে -রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা by এ এম এম শওকত আলী
আইনশৃঙ্খলা ও সুশাসনের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এ সম্পর্কের ভিত্তি বহুমুখী। এক. জননিরাপত্তার স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত এবং সংবিধানে স্বীকৃত একাধিক বাহিনীকে আইন প্রয়োগ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। দুই. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রচলিত আইনের গণ্ডির মধ্যেই এ দায়িত্ব পালন করলে সুশাসন নিশ্চিত হয়। তিন. প্রচলিত আইনের পরিধি অতিক্রম করলে কী করা হবে সে বিষয়েও আইনি বিধান বিদ্যমান। চার. দেশের সব নাগরিক সংবিধান ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের পক্ষে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সহজ হয়। কিন্তু বাস্তবে এমনটি হয় না। কয়েক দশক ধরে প্রচলিত আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ অব্যাহতভাবে মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে। এ অভিযোগ মূলত দ্বিমুখী। এক. সাধারণ নাগরিক, বিত্তশালী ব্যক্তিসহ অপরাধীরা ক্রমাগত আইন ভঙ্গ করে চলেছেন। দুই. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইন লঙ্ঘন করছেন। বহুবিধ লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে এসব বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দৃশ্যমান তা হলো গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা। আইনের দৃষ্টিকোণে এ ধরনের নির্যাতন ও হত্যা প্রমাণ সাপেক্ষে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মানবিক দৃষ্টিকোণে এ অপরাধ নিন্দনীয় এবং সুশাসনের পরিপন্থী।
আমাদের সংবিধানসহ বিভিন্ন আইনে এ বিষয়ে অনুশাসন বিদ্যমান। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করা প্রয়োজন। এক. যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হলে তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পাদনের জন্য হাজির করতে হয়। দুই. বিনা অভিযোগে সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে কোনো ব্যক্তিকে ফৌজদারি কার্যবিধিমালার ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করলেও একই অনুশাসন অনুসরণযোগ্য অর্থাৎ গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে একই সময়ের মধ্যে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করতে হবে। তিন. গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকাকালীন তার ওপর কোনো নির্যাতন করা যাবে না। চার. আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে তদন্ত সম্পন্ন করার স্বার্থে তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না। হেফাজতে নেওয়ার আইনি নাম রিমান্ড।
বাস্তব চিত্র ভিন্নতর। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে হাজির হওয়ার বাধ্যবাধকতা-সংক্রান্ত অনুশাসন অনেক সময় অনুসরণ করা হয় না। এ জন্য পত্রিকান্তরে সংবাদ প্রকাশিত হলেও এ ধরনের ঘটনা বিরল নয়। প্রতিকার হিসেবে সংবিধানে রিট মামলা করার নাগরিক অধিকার স্বীকৃত। তবে অর্থের অভাব ও বিচারকার্য সম্পাদনে দীর্ঘসূত্রতার জন্য সংক্ষুব্ধ পরিবারের সদস্যরা এ অধিকার আদায়ে অনীহা প্রকাশ করে। বাস্তব চিত্রের অন্য একটি বিধান উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিষয়টি ফৌজদারি কার্যবিধিমালা ৫৪-এর আওতায় গ্রেপ্তার এবং রিমান্ড-সংক্রান্ত। ৫৪ ধারার আওতায় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে ক্ষেত্রবিশেষে নির্যাতন করা হয়। এর অন্য নাম তৃতীয় মাত্রা পদ্ধতি। ইংরেজিতে Third Degree Method। অনেক সময় এ ধরনের নির্যাতনে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে। এ ঘটনাকে বলা হয় হেফাজতে মৃত্যু। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির হেফাজত দুই ধরনের। একটি হলো পুলিশি হেফাজত এবং অন্যটি জেলের হেফাজত, যা জুডিশিয়াল হেফাজত নামে পরিচিত। যেকোনো ধরনের হেফাজতে মৃত্যু হলে আইন বা বিধিসম্মত প্রক্রিয়ায় তদন্তের বিধান রয়েছে। কিন্তু এ ধরনের তদন্ত আদৌ হয় কি না বা হয়ে থাকলে তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতে কী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে তা অজানাই থাকে, যা সুশাসনের পরিপন্থী।
৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতার অপব্যবহার সর্বজনবিদিত। জানা যায় যে অপব্যবহার রোধে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা রায়ের মাধ্যমে ১০ বা ১২ বছর আগে প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু এর পরও অপব্যবহারের ঘটনা সময় সময় পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। এর মূল কারণ নির্বাহী বিভাগ কখনো এ বিষয়ে সঠিক নির্দেশনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেয়নি। অথবা দিলেও সংশ্লিষ্ট বাহিনী নির্দেশনা মেনে চলার জন্য সচেষ্ট হয়নি। উল্লেখ্য যে ১৯২৪ সালে কলকাতা হাইকোর্টও এ ধরনের একটি অনুসরণীয় এক রায়ের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিল। সংশ্লিষ্ট নীতিমালা পুলিশ বিধিতেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু এর পরও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
জননিরাপত্তা শব্দটির বিভিন্ন ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এক. দেশের নাগরিকেরা কখনো নিরাপত্তাহীনতার শিকার হবে না। দুই. নিরাপত্তাহীনতা তখনই হয় যখন নাগরিকেরা নিঃশঙ্কচিত্তে চলাফেরা বা ঘুমাতে পারে না। সমস্ত অপরাধীদের অবাধ কার্যক্রম বিগত কিছু সময় ধরেই জননিরাপত্তা দারুণভাবে বিঘ্নিত করছে। সংবাদপত্র বা টিভি দেখলেই বিষয়টি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে যোগ করা যায় সড়ক দুর্ঘটনার অব্যাহত মৃত্যুর ধারা। শেষোক্ত বিষয়টির প্রতিরোধের জন্য সরকার একসময় জনপথ পুলিশ ব্যবস্থাপনার পদক্ষেপ নিয়েছিল। আশা করা হয়েছিল যে এ পদক্ষেপের ফলে নিরাপদ সড়ক অর্জনের পথ সুগম হবে। কিন্তু এখনো তা হয়নি। অর্থাৎ গাড়িচালকসহ সশস্ত্র অপরাধীরা একই মাত্রায় আইনের প্রতি দারুণ অবজ্ঞা প্রকাশ করছে। এ ধরনের পরিবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কতইবা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম?
অনেকেই মত প্রকাশ করে থাকেন যে কঠোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করলেই অপরাধ দমন সম্ভব। আদালতে বিভিন্ন পর্যায়ে কত লাখ মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় এবং কত বছর ধরে, তার এক পরিসংখ্যান পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছিল। মূল কারণ বলা হয়েছিল বিচারকদের অপ্রতুলতা। সুপ্রিম কোর্ট পর্যায়ে বিচারকদের সংখ্যা সম্প্রতি বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর সুফল ইতিমধ্যে কতটুকু অর্জন করা হয়েছে তা জনগণের জানা প্রয়োজন। এ কথা বলা নিষ্প্রয়োজন যে বিচারকদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কারণ বিচারব্যবস্থায় আরও অনেক প্রতিষ্ঠান জড়িত। যেমন তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান এবং আইনজীবী সম্প্রদায়। পুলিশকে শক্তিশালীকরণ প্রক্রিয়ায় সংখ্যা বৃদ্ধিসহ যানবাহন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে। তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ পুলিশ বা যে নামেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে অভিহিত করা হোক না কেন, যদি দক্ষ না হয় তাহলে ইপ্সিত সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য একসময় তদন্তকারী সংস্থাকে সাধারণ পুলিশ বাহিনী থেকে পৃথক্করণের বিষয়টিকেও সরকার বিবেচনা করেছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। অন্যদিকে রাষ্ট্রের পক্ষে যেসব আইনজীবী মামলা পরিচালনা করবেন, এঁদের জন্য পৃথক ক্যাডার সৃষ্টির কথাও বলা হয়েছিল। কার্যত তা হয়নি।
অপেক্ষমাণ মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি অধস্তন আদালতের বিচারকদের একটি উপদেশ দিয়েছেন। মামলার শুনানির পরিবর্তনের তারিখ যেন বিচারকেরা উপযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য কারণ ব্যতিরেকে প্রত্যাখ্যান করেন। বলা নিষ্প্রয়োজন যে এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদেরও একটি সম্পূরক দায়িত্ব রয়েছে। তাঁরা যদি যথাযোগ্য কারণ ব্যতিরেকে আদালতে আবেদন পেশ করা থেকে বিরত থাকেন। অন্যদিকে পুলিশ যদি নির্ধারিত তারিখে সংশ্লিষ্ট সাক্ষীদের সময়মতো আদালতে হাজির করার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তাহলেও শুনানির তারিখ পরিবর্তন করতে আদালত বাধ্য হবে।
ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত অধস্তন আদালতের বিচারপ্রক্রিয়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যাতে নিষ্পন্ন হয় সে লক্ষ্যে হাইকোর্টের নিবিড় পরিবীক্ষণ ব্যবস্থাপনা চালু ছিল। এ পরিবীক্ষণের ফলাফল হাইকোর্টের বাৎসরিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হতো। বিচারকেরাও এ জন্য সতর্কতার সঙ্গে মামলা নিষ্পত্তির জন্য সচেষ্ট ছিল। এ ব্যবস্থাপনা যদি এখনো চালু থাকে তাহলে বলতে হবে, এটা দুর্বল হয়ে গেছে। এ ব্যবস্থাপনাকে অধিকতর শক্তিশালী করা প্রয়োজন। একইভাবে প্রয়োজন তদন্তকারী সংস্থাসহ মামলা নিষ্পত্তির দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থাকে শক্তিশালী করা। মিডিয়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সুশাসনের বেহাল দৃশ্য প্রকাশে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে। সরকারের কিছু নীতিনির্ধারকসহ সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বক্তব্য ভিন্নতর। এ ব্যবধান আশঙ্কাজনক। নাগরিকেরা প্রকৃত তথ্যই জানতে ইচ্ছুক।
ফেরা যাক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আইন লঙ্ঘনের প্রশ্নে। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী বিগত ছয় বছরে ৬২২ জন ক্রসফায়ারে মৃত্যুবরণ করেছে। এ ধরনের ঘটনার জন্য সরকারের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল যে এ বিষয়ে শূন্য সহনশীলতার নীতি মেনে চলা হবে। অর্থাৎ আইনি কাঠামোর আওতায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। প্রতিশ্রুত আইনি তদন্তের সংখ্যা ও ফল এ পর্যন্ত জনগণ জানতে সক্ষম হয়নি। অনেকের মতে, এতে সরকার ও নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার ব্যবধান ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা কোনো পক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক নয়।
সুশাসনের পরিধি ব্যাপক। বিষয়টি সার্বিকভাবে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। রাষ্ট্রের তিনটি প্রধান অঙ্গই এ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত এবং নাগরিকদের কাছে দায়বদ্ধ। তিনটি অঙ্গের দায়বদ্ধতার বিষয়টি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। প্রধান তিনটি অঙ্গসহ সরকারবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টাই সুশাসনকে সুসংহত করতে সক্ষম। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে এ প্রক্রিয়ায় নির্বাহী অঙ্গের দায়িত্ব অধিকতর। কারণ, সর্বক্ষেত্রে সমভাবে আইন প্রয়োগের ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের।
এ এম এম শওকত আলী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা; সাবেক সচিব।
আমাদের সংবিধানসহ বিভিন্ন আইনে এ বিষয়ে অনুশাসন বিদ্যমান। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করা প্রয়োজন। এক. যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হলে তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পাদনের জন্য হাজির করতে হয়। দুই. বিনা অভিযোগে সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে কোনো ব্যক্তিকে ফৌজদারি কার্যবিধিমালার ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করলেও একই অনুশাসন অনুসরণযোগ্য অর্থাৎ গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে একই সময়ের মধ্যে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করতে হবে। তিন. গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকাকালীন তার ওপর কোনো নির্যাতন করা যাবে না। চার. আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে তদন্ত সম্পন্ন করার স্বার্থে তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না। হেফাজতে নেওয়ার আইনি নাম রিমান্ড।
বাস্তব চিত্র ভিন্নতর। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে হাজির হওয়ার বাধ্যবাধকতা-সংক্রান্ত অনুশাসন অনেক সময় অনুসরণ করা হয় না। এ জন্য পত্রিকান্তরে সংবাদ প্রকাশিত হলেও এ ধরনের ঘটনা বিরল নয়। প্রতিকার হিসেবে সংবিধানে রিট মামলা করার নাগরিক অধিকার স্বীকৃত। তবে অর্থের অভাব ও বিচারকার্য সম্পাদনে দীর্ঘসূত্রতার জন্য সংক্ষুব্ধ পরিবারের সদস্যরা এ অধিকার আদায়ে অনীহা প্রকাশ করে। বাস্তব চিত্রের অন্য একটি বিধান উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিষয়টি ফৌজদারি কার্যবিধিমালা ৫৪-এর আওতায় গ্রেপ্তার এবং রিমান্ড-সংক্রান্ত। ৫৪ ধারার আওতায় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে ক্ষেত্রবিশেষে নির্যাতন করা হয়। এর অন্য নাম তৃতীয় মাত্রা পদ্ধতি। ইংরেজিতে Third Degree Method। অনেক সময় এ ধরনের নির্যাতনে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে। এ ঘটনাকে বলা হয় হেফাজতে মৃত্যু। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির হেফাজত দুই ধরনের। একটি হলো পুলিশি হেফাজত এবং অন্যটি জেলের হেফাজত, যা জুডিশিয়াল হেফাজত নামে পরিচিত। যেকোনো ধরনের হেফাজতে মৃত্যু হলে আইন বা বিধিসম্মত প্রক্রিয়ায় তদন্তের বিধান রয়েছে। কিন্তু এ ধরনের তদন্ত আদৌ হয় কি না বা হয়ে থাকলে তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতে কী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে তা অজানাই থাকে, যা সুশাসনের পরিপন্থী।
৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতার অপব্যবহার সর্বজনবিদিত। জানা যায় যে অপব্যবহার রোধে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা রায়ের মাধ্যমে ১০ বা ১২ বছর আগে প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু এর পরও অপব্যবহারের ঘটনা সময় সময় পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। এর মূল কারণ নির্বাহী বিভাগ কখনো এ বিষয়ে সঠিক নির্দেশনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেয়নি। অথবা দিলেও সংশ্লিষ্ট বাহিনী নির্দেশনা মেনে চলার জন্য সচেষ্ট হয়নি। উল্লেখ্য যে ১৯২৪ সালে কলকাতা হাইকোর্টও এ ধরনের একটি অনুসরণীয় এক রায়ের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিল। সংশ্লিষ্ট নীতিমালা পুলিশ বিধিতেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু এর পরও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
জননিরাপত্তা শব্দটির বিভিন্ন ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এক. দেশের নাগরিকেরা কখনো নিরাপত্তাহীনতার শিকার হবে না। দুই. নিরাপত্তাহীনতা তখনই হয় যখন নাগরিকেরা নিঃশঙ্কচিত্তে চলাফেরা বা ঘুমাতে পারে না। সমস্ত অপরাধীদের অবাধ কার্যক্রম বিগত কিছু সময় ধরেই জননিরাপত্তা দারুণভাবে বিঘ্নিত করছে। সংবাদপত্র বা টিভি দেখলেই বিষয়টি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে যোগ করা যায় সড়ক দুর্ঘটনার অব্যাহত মৃত্যুর ধারা। শেষোক্ত বিষয়টির প্রতিরোধের জন্য সরকার একসময় জনপথ পুলিশ ব্যবস্থাপনার পদক্ষেপ নিয়েছিল। আশা করা হয়েছিল যে এ পদক্ষেপের ফলে নিরাপদ সড়ক অর্জনের পথ সুগম হবে। কিন্তু এখনো তা হয়নি। অর্থাৎ গাড়িচালকসহ সশস্ত্র অপরাধীরা একই মাত্রায় আইনের প্রতি দারুণ অবজ্ঞা প্রকাশ করছে। এ ধরনের পরিবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কতইবা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম?
অনেকেই মত প্রকাশ করে থাকেন যে কঠোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করলেই অপরাধ দমন সম্ভব। আদালতে বিভিন্ন পর্যায়ে কত লাখ মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় এবং কত বছর ধরে, তার এক পরিসংখ্যান পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছিল। মূল কারণ বলা হয়েছিল বিচারকদের অপ্রতুলতা। সুপ্রিম কোর্ট পর্যায়ে বিচারকদের সংখ্যা সম্প্রতি বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর সুফল ইতিমধ্যে কতটুকু অর্জন করা হয়েছে তা জনগণের জানা প্রয়োজন। এ কথা বলা নিষ্প্রয়োজন যে বিচারকদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কারণ বিচারব্যবস্থায় আরও অনেক প্রতিষ্ঠান জড়িত। যেমন তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান এবং আইনজীবী সম্প্রদায়। পুলিশকে শক্তিশালীকরণ প্রক্রিয়ায় সংখ্যা বৃদ্ধিসহ যানবাহন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে। তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ পুলিশ বা যে নামেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে অভিহিত করা হোক না কেন, যদি দক্ষ না হয় তাহলে ইপ্সিত সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য একসময় তদন্তকারী সংস্থাকে সাধারণ পুলিশ বাহিনী থেকে পৃথক্করণের বিষয়টিকেও সরকার বিবেচনা করেছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। অন্যদিকে রাষ্ট্রের পক্ষে যেসব আইনজীবী মামলা পরিচালনা করবেন, এঁদের জন্য পৃথক ক্যাডার সৃষ্টির কথাও বলা হয়েছিল। কার্যত তা হয়নি।
অপেক্ষমাণ মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি অধস্তন আদালতের বিচারকদের একটি উপদেশ দিয়েছেন। মামলার শুনানির পরিবর্তনের তারিখ যেন বিচারকেরা উপযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য কারণ ব্যতিরেকে প্রত্যাখ্যান করেন। বলা নিষ্প্রয়োজন যে এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদেরও একটি সম্পূরক দায়িত্ব রয়েছে। তাঁরা যদি যথাযোগ্য কারণ ব্যতিরেকে আদালতে আবেদন পেশ করা থেকে বিরত থাকেন। অন্যদিকে পুলিশ যদি নির্ধারিত তারিখে সংশ্লিষ্ট সাক্ষীদের সময়মতো আদালতে হাজির করার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তাহলেও শুনানির তারিখ পরিবর্তন করতে আদালত বাধ্য হবে।
ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত অধস্তন আদালতের বিচারপ্রক্রিয়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যাতে নিষ্পন্ন হয় সে লক্ষ্যে হাইকোর্টের নিবিড় পরিবীক্ষণ ব্যবস্থাপনা চালু ছিল। এ পরিবীক্ষণের ফলাফল হাইকোর্টের বাৎসরিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হতো। বিচারকেরাও এ জন্য সতর্কতার সঙ্গে মামলা নিষ্পত্তির জন্য সচেষ্ট ছিল। এ ব্যবস্থাপনা যদি এখনো চালু থাকে তাহলে বলতে হবে, এটা দুর্বল হয়ে গেছে। এ ব্যবস্থাপনাকে অধিকতর শক্তিশালী করা প্রয়োজন। একইভাবে প্রয়োজন তদন্তকারী সংস্থাসহ মামলা নিষ্পত্তির দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থাকে শক্তিশালী করা। মিডিয়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সুশাসনের বেহাল দৃশ্য প্রকাশে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে। সরকারের কিছু নীতিনির্ধারকসহ সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বক্তব্য ভিন্নতর। এ ব্যবধান আশঙ্কাজনক। নাগরিকেরা প্রকৃত তথ্যই জানতে ইচ্ছুক।
ফেরা যাক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আইন লঙ্ঘনের প্রশ্নে। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী বিগত ছয় বছরে ৬২২ জন ক্রসফায়ারে মৃত্যুবরণ করেছে। এ ধরনের ঘটনার জন্য সরকারের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল যে এ বিষয়ে শূন্য সহনশীলতার নীতি মেনে চলা হবে। অর্থাৎ আইনি কাঠামোর আওতায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। প্রতিশ্রুত আইনি তদন্তের সংখ্যা ও ফল এ পর্যন্ত জনগণ জানতে সক্ষম হয়নি। অনেকের মতে, এতে সরকার ও নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার ব্যবধান ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা কোনো পক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক নয়।
সুশাসনের পরিধি ব্যাপক। বিষয়টি সার্বিকভাবে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। রাষ্ট্রের তিনটি প্রধান অঙ্গই এ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত এবং নাগরিকদের কাছে দায়বদ্ধ। তিনটি অঙ্গের দায়বদ্ধতার বিষয়টি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। প্রধান তিনটি অঙ্গসহ সরকারবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টাই সুশাসনকে সুসংহত করতে সক্ষম। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে এ প্রক্রিয়ায় নির্বাহী অঙ্গের দায়িত্ব অধিকতর। কারণ, সর্বক্ষেত্রে সমভাবে আইন প্রয়োগের ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের।
এ এম এম শওকত আলী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা; সাবেক সচিব।
No comments