তবুও বৈসাবি হোক পাহাড়ে -দেশহীন মানুষের কথা by সঞ্জীব দ্রং
চারুকলার সামনে দেখা পাহাড়ি মেয়েটি কি আসামের ভূপেন হাজারিকার ওই গানটি শুনেছে, ‘পাহাড় এসে সমতলে বাজায় করতালি/বিহুর সাথে মিশে গেছে কখন ভাটিয়ালী?’ আমি জানি না। আমাদের জন্মভূমিতে এ রকম হয় না। রাষ্ট্রই তার অলিখিত নীতির মাধ্যমে পাহাড়ি-বাঙালি অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্ব জাগিয়ে রাখে। এখানে পাহাড় ও সমতলের গান বাজে না, বরং মানুষে মানুষে সন্দেহ ও অবিশ্বাস বেড়ে চলে। এখানে মহাশ্বেতা দেবীর কথা রাষ্ট্রের কানে পৌঁছায় না, ‘বহু বছর ধরে আদিবাসীদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে মূল স্রোত। মূল স্রোতের নিদারুণ অবজ্ঞা-উপেক্ষা ও অজ্ঞতার জন্য আদিবাসী সমাজের সঙ্গে মূল স্রোতের মধ্যে এই সমান্তরতার ব্যবধান, যে ব্যবধান ঘোচানোর দায় মূল স্রোতের ছিল। তারা যে সভ্য, উন্নত, শ্রদ্ধেয়, মূল স্রোত সেটা জানার চেষ্টাই করল না। এর দাম আমাদের দিয়ে যেতে হচ্ছে, হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মূল স্রোতকেই তো বিচ্ছিন্নতাবাদী বলতে হয় তাহলে। আসলে এখন নম্র, অনুতপ্ত, চিন্তাশীল, আত্মানুসন্ধানী হবার সময়। ক্রুদ্ধ গর্জন ও কথার কচকচির সময় নয়।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর সময় যখন ‘রিপোর্ট অব দি শিডিউলড ট্রাইবস কমিশন’ হয়, তখন কমিটির সদস্য ভেরিয়ার এলুইন তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর আদিবাসী পলিসির সবটাই একটি শব্দে ব্যক্ত করা যায়—নম্রতা।’ এই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ‘আদিবাসীদের জমি নিঃশর্তে ওদেরই থাকবে। বহিরাগতদের কাছে আদিবাসী জমি হস্তান্তর বন্ধ করতে হবে, ওদের অরণ্যের অধিকার মেনে নিতে হবে আর সারা ভারতে অরণ্য অধিকর্তারা ওদের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবেন (আদিবাসী জগত, ভেরিয়ার এলুইন)।’ কবে আমাদের দেশে এ রকম হবে? সভ্যতায়, শিক্ষায়, ভদ্রতা ও নম্রতায়, উদারতা ও বিশালতায় আমাদের রাষ্ট্র ও মূল স্রোত সমব্যথী ও দুঃখিত হবেন আদিবাসী পাহাড়িদের কষ্ট ও বেদনায়? কাপ্তাই বাঁধের কারণে রাজবাড়িসহ ডুবে গেল পাহাড়িদের বাড়িঘর, ধানক্ষেত, শস্যের সবচেয়ে ভালো জমি। ওরা চোখের জলে উদ্বাস্তু হলো। কিছুদিন আগে আবার তানভীর মোকাম্মেলের কর্ণফুলীর কান্না ছবি দেখলাম। ছবিতে গৌতম দেওয়ান বলছেন, পাহাড়ি না হয়ে এটি যদি মুসলিম অধ্যুষিত হতো, তবে এভাবে আমাদের ডুবিয়ে দেওয়া সম্ভব হতো না।
আমি জানি না কবে এই ধারণা দূর হবে পাহাড়ে যে রাষ্ট্র ও শাসকগোষ্ঠী শাসন করছে না পাহাড়িদের, ওরা শাসিত মানুষ। বাঘাইছড়ির পাহাড়িরাও প্রজাতন্ত্রের মালিক, তারা শাসিত নয়। পাহাড় ও সমতলের বন্ধন ও ঐক্য কবে প্রতিষ্ঠা পাবে?
চারুকলার সামনে দেখা পাহাড়ি মেয়ের কথা বলছিলাম। আমি তার নাম জিজ্ঞেস করিনি। ওকে দেখে মনে হয়েছে ও সাধারণ পরিবারের মেয়ে, পরনে সাধারণ পোশাক। ও হাসিমুখী না হলেও মুখে অতটা মলিনতা চোখে পড়েনি। ওর বাড়ি হতে পারে বাঘাইছড়ি, সাজেকের বাঘাইহাটের কাছে অথবা দীঘিনালা, ভাইবোনছড়া, লোগাং-মাইনী-চেংগী নদীতীরে কোনো গ্রামে? এই শহরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে, চারুকলায় পথ চললেও ওর মন হয়তো পড়ে থাকে দূর পাহাড়ের দেশে যেখানে ওর বাবা-মা স্বজনেরা ভালো নেই, যেখানে জীবন ভেঙে গেছে। সংসারের সুখ একটু বাড়ানোর জন্য, একটু সচ্ছলতা, একটু উপার্জনের জন্য, শিক্ষা নিয়ে মানুষ হওয়ার জন্য, সমাজে ফিরে গিয়ে চিরবঞ্চিত আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করার স্বপ্ন নিয়ে নিশ্চয় এই শহরে এসেছে মেয়েটি। মেয়েটির মুখ এখনো চোখে ভাসে আমার। আমার মন উথালপাথাল করে। কত দুঃখেকষ্টে থাকে পাহাড়ি মানুষ এই শহরেও? পড়াশোনার বাইরে তার অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা নিয়ে কত সংকট? ভবিষ্যৎ কত অনিশ্চিত? মেয়েটি দ্রুত হেঁটে কাগজ বিলি করছিল দর্শকদের জন্য, যারা চারুকলায় বাঘাইছড়িতে পাহাড়িদের ওপর আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞের ওপর নির্মিত ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখতে এসেছেন। ওই কাগজে ওরা বলছে, পাহাড়িরা যেন এবার বৈসুক-সাংগ্রাই-বিজু ৭(বৈসাবি) উৎসব বর্জন করে। এই দুঃখকষ্টের মধ্যে কীভাবে বিজু হয়, উৎসব হয়? আক্রমণ, হত্যা, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া দেখে, অপমান, প্রশাসনের সাম্প্রদায়িক আচরণ, পাহাড়ি নাগরিকদের মানুষ মনে না করা, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য হুমকি, সরকারের অবহেলা ও ক্ষমতাসীন শক্তিমানদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কীভাবে প্রার্থনা-গান-উৎসব হয়?
আমি এই তরুণ সমাজের ক্ষোভ ও কষ্ট অনুভব করার চেষ্টা করি। এই মেয়ের বাড়ি কি বাঘাইছড়ি? সিজক নদীর তীরে? দুসর বা রাঙাদূরছড়ির গ্রামে? অথবা গঙ্গারামমুখ? অথবা তুলাবান, মগবান, দেবাছড়ি, নলবুনিয়া, উগলছড়ি? আমি তো ওর মতো ভুক্তভোগী নই। ওদের সব কষ্ট কি উপলব্ধি করা সম্ভব? ধ্বংসযজ্ঞের কত ছবি পাঠিয়েছেন পাহাড়িরা দেশেবিদেশে। কত ছবি ছড়িয়ে গেছে, জাপান, ফ্রান্স, লন্ডন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা কত জায়গায়।
মন খুব ভালো নেই। কত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে আদিবাসী জীবনে। অপমান সয়ে বেঁচে আছে আদিবাসী পাহাড়ি মানুষ নিজবাসভূমে। অসহায়ের মতো বাঘাইছড়ির মানুষেরা ফোন করেছিলেন আমাকে যখন তাদের জীবন জ্বলেপুড়ে যাচ্ছিল। কীই বা করতে পারি আমরা? আমাদের রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মর্যাদা, নিরাপত্তা, সম্মান রক্ষা করতে পারে না, তাতে সে লজ্জিতও হয় না। তাই মন খুব খারাপ অনেক দিন ধরে। তবুও বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে হয়। জীবনকে সুন্দর করার সংগ্রাম চলমান রাখতে হয়। আমাদের ভবিষ্যৎ শিশুদের কথা ভাবতে হয়। ওদের জন্য এই ভূমি, এই পাহাড়, এই সিজক-মাইনী-চেংগি নদী, ফুরামন পাহাড় নিরাপদ বাসযোগ্য থাকবে তো?
আমার অনুরোধ করতে ইচ্ছে করে, ওই মেয়েটিকেও বলি, আসুন এই দুঃখকষ্টের মধ্যেও বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুক-বিহু পালন করি। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসার, সুন্দরের ও স্বপ্নের কথা বলি, আগামী দিনের কথা বলি। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেছেন, ‘এ জগতে যা কিছু সম্ভব হয়েছে, সব হয়েছে আশার কারণে।’ আমরাও আশাবাদী হই। আমরা যদি বিজু-বৈসুক-সাংগ্রাই বর্জন করি, তবে তো ওই বিরুদ্ধশক্তিরই লাভ। একদিন আমাদের সন্তানেরা ধীরে ধীরে ওদের পরিচয়, সংস্কৃতি, উৎসব, গেংখুলী ভুলে যাবে। শক্তিমানেরা এই-ই চায়। বরং আমাদের তরুণ সমাজ জেগে উঠুক। শ্যামল মিত্রের একটি গান আছে, ‘কণ্ঠ জড়ায়ে ধরে বলি যেতে দিয়ো না আমায়।’ আমরাই তাই করতে চাই। অন্ধকার, মৃত্যু, অপমান, সাম্প্রদায়িকতা, পাশবিক শক্তি প্রদর্শন, হিংসাকে জয় করতে চাই। আমরা বিজুতে নতুন প্রাণের সঞ্চার করতে চাই এমন এক ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি নিয়ে যেখানে অতীতের মতো কোনো অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি আর ঘটবে না।
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।
আমি জানি না কবে এই ধারণা দূর হবে পাহাড়ে যে রাষ্ট্র ও শাসকগোষ্ঠী শাসন করছে না পাহাড়িদের, ওরা শাসিত মানুষ। বাঘাইছড়ির পাহাড়িরাও প্রজাতন্ত্রের মালিক, তারা শাসিত নয়। পাহাড় ও সমতলের বন্ধন ও ঐক্য কবে প্রতিষ্ঠা পাবে?
চারুকলার সামনে দেখা পাহাড়ি মেয়ের কথা বলছিলাম। আমি তার নাম জিজ্ঞেস করিনি। ওকে দেখে মনে হয়েছে ও সাধারণ পরিবারের মেয়ে, পরনে সাধারণ পোশাক। ও হাসিমুখী না হলেও মুখে অতটা মলিনতা চোখে পড়েনি। ওর বাড়ি হতে পারে বাঘাইছড়ি, সাজেকের বাঘাইহাটের কাছে অথবা দীঘিনালা, ভাইবোনছড়া, লোগাং-মাইনী-চেংগী নদীতীরে কোনো গ্রামে? এই শহরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে, চারুকলায় পথ চললেও ওর মন হয়তো পড়ে থাকে দূর পাহাড়ের দেশে যেখানে ওর বাবা-মা স্বজনেরা ভালো নেই, যেখানে জীবন ভেঙে গেছে। সংসারের সুখ একটু বাড়ানোর জন্য, একটু সচ্ছলতা, একটু উপার্জনের জন্য, শিক্ষা নিয়ে মানুষ হওয়ার জন্য, সমাজে ফিরে গিয়ে চিরবঞ্চিত আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করার স্বপ্ন নিয়ে নিশ্চয় এই শহরে এসেছে মেয়েটি। মেয়েটির মুখ এখনো চোখে ভাসে আমার। আমার মন উথালপাথাল করে। কত দুঃখেকষ্টে থাকে পাহাড়ি মানুষ এই শহরেও? পড়াশোনার বাইরে তার অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা নিয়ে কত সংকট? ভবিষ্যৎ কত অনিশ্চিত? মেয়েটি দ্রুত হেঁটে কাগজ বিলি করছিল দর্শকদের জন্য, যারা চারুকলায় বাঘাইছড়িতে পাহাড়িদের ওপর আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞের ওপর নির্মিত ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখতে এসেছেন। ওই কাগজে ওরা বলছে, পাহাড়িরা যেন এবার বৈসুক-সাংগ্রাই-বিজু ৭(বৈসাবি) উৎসব বর্জন করে। এই দুঃখকষ্টের মধ্যে কীভাবে বিজু হয়, উৎসব হয়? আক্রমণ, হত্যা, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া দেখে, অপমান, প্রশাসনের সাম্প্রদায়িক আচরণ, পাহাড়ি নাগরিকদের মানুষ মনে না করা, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য হুমকি, সরকারের অবহেলা ও ক্ষমতাসীন শক্তিমানদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কীভাবে প্রার্থনা-গান-উৎসব হয়?
আমি এই তরুণ সমাজের ক্ষোভ ও কষ্ট অনুভব করার চেষ্টা করি। এই মেয়ের বাড়ি কি বাঘাইছড়ি? সিজক নদীর তীরে? দুসর বা রাঙাদূরছড়ির গ্রামে? অথবা গঙ্গারামমুখ? অথবা তুলাবান, মগবান, দেবাছড়ি, নলবুনিয়া, উগলছড়ি? আমি তো ওর মতো ভুক্তভোগী নই। ওদের সব কষ্ট কি উপলব্ধি করা সম্ভব? ধ্বংসযজ্ঞের কত ছবি পাঠিয়েছেন পাহাড়িরা দেশেবিদেশে। কত ছবি ছড়িয়ে গেছে, জাপান, ফ্রান্স, লন্ডন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা কত জায়গায়।
মন খুব ভালো নেই। কত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে আদিবাসী জীবনে। অপমান সয়ে বেঁচে আছে আদিবাসী পাহাড়ি মানুষ নিজবাসভূমে। অসহায়ের মতো বাঘাইছড়ির মানুষেরা ফোন করেছিলেন আমাকে যখন তাদের জীবন জ্বলেপুড়ে যাচ্ছিল। কীই বা করতে পারি আমরা? আমাদের রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মর্যাদা, নিরাপত্তা, সম্মান রক্ষা করতে পারে না, তাতে সে লজ্জিতও হয় না। তাই মন খুব খারাপ অনেক দিন ধরে। তবুও বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে হয়। জীবনকে সুন্দর করার সংগ্রাম চলমান রাখতে হয়। আমাদের ভবিষ্যৎ শিশুদের কথা ভাবতে হয়। ওদের জন্য এই ভূমি, এই পাহাড়, এই সিজক-মাইনী-চেংগি নদী, ফুরামন পাহাড় নিরাপদ বাসযোগ্য থাকবে তো?
আমার অনুরোধ করতে ইচ্ছে করে, ওই মেয়েটিকেও বলি, আসুন এই দুঃখকষ্টের মধ্যেও বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুক-বিহু পালন করি। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসার, সুন্দরের ও স্বপ্নের কথা বলি, আগামী দিনের কথা বলি। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেছেন, ‘এ জগতে যা কিছু সম্ভব হয়েছে, সব হয়েছে আশার কারণে।’ আমরাও আশাবাদী হই। আমরা যদি বিজু-বৈসুক-সাংগ্রাই বর্জন করি, তবে তো ওই বিরুদ্ধশক্তিরই লাভ। একদিন আমাদের সন্তানেরা ধীরে ধীরে ওদের পরিচয়, সংস্কৃতি, উৎসব, গেংখুলী ভুলে যাবে। শক্তিমানেরা এই-ই চায়। বরং আমাদের তরুণ সমাজ জেগে উঠুক। শ্যামল মিত্রের একটি গান আছে, ‘কণ্ঠ জড়ায়ে ধরে বলি যেতে দিয়ো না আমায়।’ আমরাই তাই করতে চাই। অন্ধকার, মৃত্যু, অপমান, সাম্প্রদায়িকতা, পাশবিক শক্তি প্রদর্শন, হিংসাকে জয় করতে চাই। আমরা বিজুতে নতুন প্রাণের সঞ্চার করতে চাই এমন এক ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি নিয়ে যেখানে অতীতের মতো কোনো অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি আর ঘটবে না।
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।
No comments