কেউ কি শুনতে পাচ্ছে তাঁদের কান্না by জাহীদ রেজা নূর
পরিবেশটাই ছিল শোকের। অসহায়ত্বের। কিন্তু এই শোক, এই অসহায়ত্ব থেকে বেরিয়ে আসার প্রতিশ্রুতিও ছিল তাতে।
সেদিন সব কথা হলো শেখরকে নিয়ে। রকীব নেওয়াজ শেখর—ফ্যাশন হাউস চিলেকোঠার অন্যতম কর্ণধার। দেশি কাপড় নিয়ে রকমারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিল ছেলেটি। কিন্তু হঠাৎ একদিন, ২০০৯ সালের ১৬ নভেম্বর হারিয়ে গেল ও। মোহাম্মদপুরের নিজের বাড়ি থেকে ও যাচ্ছিল উত্তরায় শ্বশুরবাড়ি। রাত ১১টার দিকে বেরিয়েছিল। এত রাতে ড্রাইভারকে ডাকতে চায়নি বলে গাড়ি নিয়ে বের হয়নি। একটি সিএনজিতে করে মহাখালী, তারপর একটি মাইক্রোবাসে উঠে পড়ে উত্তরার পথে। এর পর থেকে ওকে আর পাওয়া যায়নি।
পরদিন গাজীপুরে পাওয়া যায় ওর লাশ।
এ ঘটনার বিবরণ অনেকেই দেখেছেন পত্রিকায়। তবে গত ২৬ মার্চ কারওয়ান বাজারের পূবালী ভবনে যে শোকসভা হয়ে গেল, তাতে যেমন এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল, তেমনি কী করে এ ধরনের অপমৃত্যু রোধ করা যায়, সে সমাধানের পথ খোঁজা নিয়েও হলো আলোচনা।
সেদিন এখানে এসেছিলেন ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন, বিচারপতি গোলাম রাব্বানী, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুর রেজ্জাক খান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নজরুল ইসলাম, কণ্ঠশীলনের গোলাম সারোয়ার, সাদা-কালোর আজহারুল হক। আমিও ছিলাম তাঁদের সঙ্গে।
কী নিয়ে কথা হলো? কী বেরিয়ে এল এই শোকসভা থেকে?
এখন যে তথ্য দেওয়া হবে, তাতে ঘাবড়ে যাবেন না। নিহত শেখরের বাড়িতে একদিন এসে হাজির তদন্ত অফিসার। বেশ কিছু প্রশ্ন করলেন তিনি। বোঝা গেল, মামলাটি নিয়ে ভাবছেন তিনি। কিন্তু পরদিন খবরের কাগজ খুলে শেখরের বোন দীপা অবাক! আরে! ছিনতাইকারী হিসেবে কার ছবি ছাপা হয়েছে কাগজে? এ তো সেই পুলিশ অফিসার, যিনি কাল এসেছিলেন ছিনতাই আর হত্যা নিয়ে কথা বলতে!
দুষ্কৃতকারীরের ছড়ানো জাল কতটা বিস্তৃত, তা আমরা অনেকেই জানি না। কারা এই জালে নিজেদের জড়িয়ে রেখেছে, জানি না সেটাও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা যাদের দায়িত্ব, তাদেরই কেউ কেউ যখন বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় দৃষ্কৃতকারীদের দিকে, তখন কেমন হয়, যেমন ঘটেছে শেখরের মামলা নিয়ে আসা তদন্ত অফিসারের বেলায়? একজন অসহায় মানুষ যাচ্ছেন পুলিশের কাছে সাহায্য পাবেন বলে, কিন্তু দেখা গেল, যেকোনো কারণেই হোক, ঠিকমতো সাড়া মিলছে না পুলিশের। আবার কখনো কখনো ত্বরিতগতিতে পুলিশ ধরে ফেলছে অপরাধীকে। কেন পুলিশের কাজে এ রকম বৈপরীত্য থাকে, তা নিয়ে ভেবে দেখার কথা বললেন আলোচকদের কেউ কেউ। সাধারণ মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্যই তৈরি করা হয়েছে পুলিশ বাহিনী। পুলিশের ভেতর থেকেও সে কাজটি করার চেষ্টা হচ্ছে অবিরত। কিন্তু কোথায় যেন একটি ফাঁক থেকে যাচ্ছে। সে কারণেই কোনো কোনো কাজে তাদের কাছে গিয়ে আস্থা পায় না মানুষ।
ত্রুটিপূর্ণ তদন্তব্যবস্থার কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধের প্রতিকার হয় না। অপরাধীরা শাস্তি পায় না। বললেন আবদুর রেজ্জাক খান।
বিচারপতি গোলাম রাব্বানী বললেন, ছিনতাই, রাহাজানিসহ যাবতীয় দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা খুবই জরুরি। রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ স্বতন্ত্র ও সম্মিলিতভাবে সক্রিয় হলে দুর্বৃত্তায়ন দূর করা সম্ভব।
ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ধরলেন সমস্যার অন্য একটি দিক। বললেন, আইনই যথেষ্ট নয়, এর পেছনে রয়েছে অপসংস্কৃতি। সুস্থ সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে জীবন প্রবাহিত হলে মানববিনাশী সকল আচরণ দূর করা সম্ভব। আমাদের সমাজে সহিষ্ণুতার বড় অভাব।
ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন বলেন, আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে প্রকৃত অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র এসব অপরাধের প্রতিকার করতে পারছে না। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই আবর্জনার স্তূপ হবে আমাদের পরিণতি।
এখানে আমরা একটু দাঁড়াই। সত্যিই কি আবর্জনার স্তূপে পরিণত হতে চাই আমরা?
ঘুরেফিরে আলোচনায় আসছিল শেখর নামের যে ছেলেটি, সে কি এই আলোচনা থেকে কিছু পেল? ওকে যখন খুন করছিল কয়েকটি দুষ্কৃতকারী, তখন কেমন ছিল ওর অনুভূতি? স্রেফ কয়েকটি টাকা আর একটি মোবাইল ফোনসেট হয়ে গেল মানুষের জীবনের চেয়ে দামি? শেখরের বাবা-মা, স্ত্রী, ভাইবোন, সন্তানকে কোথায় এনে দাঁড় করাল এই দুষ্কৃতকারীরা? সবাই জানি, আইনের হাত লম্বা। কিন্তু কত লম্বা? সত্যিই কি সেই হাত ধরে আনতে পারে ছিনতাইকারীকে, দুষ্কৃতকারীকে, হত্যাকারীকে?
শেখরের মোবাইল ফোনসেট যারা কেড়ে নিয়েছিল, যারা বিক্রি করেছিল, তারা ধরা পড়েছে। কিন্তু তাদের কি আদৌ ধরে রাখা যাবে? তাদের কাছ থেকে কি স্বীকারোক্তি আদায় করা যাবে? শেখর তো একা নয়, ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে অনেকেই আহত হচ্ছেন, নিহত হচ্ছেন। কী হবে তাঁদের, তাঁদের স্বজনদের? শোকসভায় কথা বলতে গিয়ে কাঁদছিলেন শেখরের বাবা, ডাকসাঁইটে আইনজীবী গরীব নেওয়াজ। কাঁদছিলেন তাঁর ভাই সেনাবাহিনীর মেজর পল্লব। একজন আইনজীবী, একজন সামরিক কর্মকর্তা, কিন্তু তাঁরাও এখন অসহায় হয়ে কাঁদছেন।
কেউ কি শুনতে পাচ্ছে তাঁদের কান্না?
শুরুতেই বলেছি, পরিবেশ ছিল শোকের, অসহায়ত্বের।
সে রকমই কি থাকবে পরিবেশ, নাকি পাল্টে যাবে ভালোর দিকে? কেউ কি সে গ্যারান্টি দিতে পারবে?
সেদিন সব কথা হলো শেখরকে নিয়ে। রকীব নেওয়াজ শেখর—ফ্যাশন হাউস চিলেকোঠার অন্যতম কর্ণধার। দেশি কাপড় নিয়ে রকমারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিল ছেলেটি। কিন্তু হঠাৎ একদিন, ২০০৯ সালের ১৬ নভেম্বর হারিয়ে গেল ও। মোহাম্মদপুরের নিজের বাড়ি থেকে ও যাচ্ছিল উত্তরায় শ্বশুরবাড়ি। রাত ১১টার দিকে বেরিয়েছিল। এত রাতে ড্রাইভারকে ডাকতে চায়নি বলে গাড়ি নিয়ে বের হয়নি। একটি সিএনজিতে করে মহাখালী, তারপর একটি মাইক্রোবাসে উঠে পড়ে উত্তরার পথে। এর পর থেকে ওকে আর পাওয়া যায়নি।
পরদিন গাজীপুরে পাওয়া যায় ওর লাশ।
এ ঘটনার বিবরণ অনেকেই দেখেছেন পত্রিকায়। তবে গত ২৬ মার্চ কারওয়ান বাজারের পূবালী ভবনে যে শোকসভা হয়ে গেল, তাতে যেমন এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল, তেমনি কী করে এ ধরনের অপমৃত্যু রোধ করা যায়, সে সমাধানের পথ খোঁজা নিয়েও হলো আলোচনা।
সেদিন এখানে এসেছিলেন ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন, বিচারপতি গোলাম রাব্বানী, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুর রেজ্জাক খান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নজরুল ইসলাম, কণ্ঠশীলনের গোলাম সারোয়ার, সাদা-কালোর আজহারুল হক। আমিও ছিলাম তাঁদের সঙ্গে।
কী নিয়ে কথা হলো? কী বেরিয়ে এল এই শোকসভা থেকে?
এখন যে তথ্য দেওয়া হবে, তাতে ঘাবড়ে যাবেন না। নিহত শেখরের বাড়িতে একদিন এসে হাজির তদন্ত অফিসার। বেশ কিছু প্রশ্ন করলেন তিনি। বোঝা গেল, মামলাটি নিয়ে ভাবছেন তিনি। কিন্তু পরদিন খবরের কাগজ খুলে শেখরের বোন দীপা অবাক! আরে! ছিনতাইকারী হিসেবে কার ছবি ছাপা হয়েছে কাগজে? এ তো সেই পুলিশ অফিসার, যিনি কাল এসেছিলেন ছিনতাই আর হত্যা নিয়ে কথা বলতে!
দুষ্কৃতকারীরের ছড়ানো জাল কতটা বিস্তৃত, তা আমরা অনেকেই জানি না। কারা এই জালে নিজেদের জড়িয়ে রেখেছে, জানি না সেটাও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা যাদের দায়িত্ব, তাদেরই কেউ কেউ যখন বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় দৃষ্কৃতকারীদের দিকে, তখন কেমন হয়, যেমন ঘটেছে শেখরের মামলা নিয়ে আসা তদন্ত অফিসারের বেলায়? একজন অসহায় মানুষ যাচ্ছেন পুলিশের কাছে সাহায্য পাবেন বলে, কিন্তু দেখা গেল, যেকোনো কারণেই হোক, ঠিকমতো সাড়া মিলছে না পুলিশের। আবার কখনো কখনো ত্বরিতগতিতে পুলিশ ধরে ফেলছে অপরাধীকে। কেন পুলিশের কাজে এ রকম বৈপরীত্য থাকে, তা নিয়ে ভেবে দেখার কথা বললেন আলোচকদের কেউ কেউ। সাধারণ মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্যই তৈরি করা হয়েছে পুলিশ বাহিনী। পুলিশের ভেতর থেকেও সে কাজটি করার চেষ্টা হচ্ছে অবিরত। কিন্তু কোথায় যেন একটি ফাঁক থেকে যাচ্ছে। সে কারণেই কোনো কোনো কাজে তাদের কাছে গিয়ে আস্থা পায় না মানুষ।
ত্রুটিপূর্ণ তদন্তব্যবস্থার কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধের প্রতিকার হয় না। অপরাধীরা শাস্তি পায় না। বললেন আবদুর রেজ্জাক খান।
বিচারপতি গোলাম রাব্বানী বললেন, ছিনতাই, রাহাজানিসহ যাবতীয় দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা খুবই জরুরি। রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ স্বতন্ত্র ও সম্মিলিতভাবে সক্রিয় হলে দুর্বৃত্তায়ন দূর করা সম্ভব।
ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ধরলেন সমস্যার অন্য একটি দিক। বললেন, আইনই যথেষ্ট নয়, এর পেছনে রয়েছে অপসংস্কৃতি। সুস্থ সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে জীবন প্রবাহিত হলে মানববিনাশী সকল আচরণ দূর করা সম্ভব। আমাদের সমাজে সহিষ্ণুতার বড় অভাব।
ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন বলেন, আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে প্রকৃত অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র এসব অপরাধের প্রতিকার করতে পারছে না। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই আবর্জনার স্তূপ হবে আমাদের পরিণতি।
এখানে আমরা একটু দাঁড়াই। সত্যিই কি আবর্জনার স্তূপে পরিণত হতে চাই আমরা?
ঘুরেফিরে আলোচনায় আসছিল শেখর নামের যে ছেলেটি, সে কি এই আলোচনা থেকে কিছু পেল? ওকে যখন খুন করছিল কয়েকটি দুষ্কৃতকারী, তখন কেমন ছিল ওর অনুভূতি? স্রেফ কয়েকটি টাকা আর একটি মোবাইল ফোনসেট হয়ে গেল মানুষের জীবনের চেয়ে দামি? শেখরের বাবা-মা, স্ত্রী, ভাইবোন, সন্তানকে কোথায় এনে দাঁড় করাল এই দুষ্কৃতকারীরা? সবাই জানি, আইনের হাত লম্বা। কিন্তু কত লম্বা? সত্যিই কি সেই হাত ধরে আনতে পারে ছিনতাইকারীকে, দুষ্কৃতকারীকে, হত্যাকারীকে?
শেখরের মোবাইল ফোনসেট যারা কেড়ে নিয়েছিল, যারা বিক্রি করেছিল, তারা ধরা পড়েছে। কিন্তু তাদের কি আদৌ ধরে রাখা যাবে? তাদের কাছ থেকে কি স্বীকারোক্তি আদায় করা যাবে? শেখর তো একা নয়, ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে অনেকেই আহত হচ্ছেন, নিহত হচ্ছেন। কী হবে তাঁদের, তাঁদের স্বজনদের? শোকসভায় কথা বলতে গিয়ে কাঁদছিলেন শেখরের বাবা, ডাকসাঁইটে আইনজীবী গরীব নেওয়াজ। কাঁদছিলেন তাঁর ভাই সেনাবাহিনীর মেজর পল্লব। একজন আইনজীবী, একজন সামরিক কর্মকর্তা, কিন্তু তাঁরাও এখন অসহায় হয়ে কাঁদছেন।
কেউ কি শুনতে পাচ্ছে তাঁদের কান্না?
শুরুতেই বলেছি, পরিবেশ ছিল শোকের, অসহায়ত্বের।
সে রকমই কি থাকবে পরিবেশ, নাকি পাল্টে যাবে ভালোর দিকে? কেউ কি সে গ্যারান্টি দিতে পারবে?
No comments