সবার জন্য শিক্ষা কীভাবে হবে -প্রান্তকথা by শান্ত নূরুননবী
কুড়িগ্রাম শহর পেরিয়ে ধরলা সেতুর দিকে না গিয়ে বাঁয়ে সোজা রাস্তা ধরে এগোলেই সিঅ্যান্ডবি ঘাট। ধরলা সেতু হওয়ার আগ পর্যন্ত, এই তো কিছুদিন আগেও, জমজমাট পারাপার হতো। সারি সারি নৌকা অপেক্ষা করত বাস ও ট্রাকের যাত্রীর জন্য। এখন সুনসান। কিন্তু এখনো ‘ঘাট’ নামটি রয়ে গেছে।
ঘাটের কাছাকাছি একটি মসজিদ। এর পাশে পৌর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সন্ধ্যার শান্ত বাতাসে ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসে শিশুদের ক্লান্ত কণ্ঠস্বর। পড়াশোনা চলছে ভেতরে। রাতের স্কুল। স্বল্প আলোয় কয়েকজন মলিন মুখের জীর্ণ পোশাকের শ্রমজীবী শিশুকে পড়াচ্ছেন লুঙ্গি পরিহিত একজন মাঝবয়সী মানুষ।
বুকের ভেতরে লেখাপড়া শেখার স্বপ্ন নিয়ে এখানে আসে শাহিনুর, লতিফ, আমারুল, জানু, জাহাঙ্গীরসহ ২৩ জন শিশু। ১০ থেকে ১৪-এর মধ্যে বয়স ওদের। কেউ গরু চরায়, কেউ কাঠমিস্ত্রির জোগালি, কেউ ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ান, পানের দোকানের কর্মচারী কেউ, কেউ বা সাইকেল মেকানিকের সহকারী, কেউ কাজ না পেয়ে আলুর মৌসুম বা ধানের মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করে। পিতৃহীন জানুর মা খড়ি কুড়িয়ে বিক্রি করে, মাটি কাটার কাজ করে যা রোজগার করেন, তা দিয়ে খাওয়াই জোটে না, জানুর তাই স্কুলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখার সাহসই হয়নি! কিন্তু যাঁরা ওদের কাজে নিয়োগ দিয়েছেন, তাঁদের ইচ্ছাতেই ওদের এই লেখাপড়া শেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। কুড়িগ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ছোট ছোট দোকানের মালিকদের অনুরোধে তাঁদের শিশু কর্মচারীদের লিখতে ও পড়তে শেখার ব্যবস্থা করতে এগিয়ে এসেছে স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থা।
খুব বড় কোনো স্বপ্ন নেই এই শিশুদের। কৃষিজমিতে কামলা দিয়ে পরিবারের আয়ে অংশ নেওয়া শিশুশ্রমিক আনিসুর বলে, ‘এইখানে পড়া শিখতেছি, লেখা শিখতেছি, যাতে বড় হয়া নিজের জমি করবের পারি, দলিলে কী ল্যাখা থাকে, বুজবের পারি। কেউ য্যান ঠকাইতে না পারে, সেই হিসাব করাটাই শিখতেছি।’ তাঁদের পড়া শেখাচ্ছেন রিয়াজুল করিম নামের একজন বেসরকারি মাদ্রাসার শিক্ষক। উন্নয়ন সংস্থা আরডিআরএস তাঁকে মাসে এক হাজার টাকা ভাতা দেয়। তা থেকেও কিছুটা তাঁকে খরচ করতে হয় মোমবাতি ও পেন্সিল কিনতে। খাতা-কলমও বিনামূল্যে পায় শিশুরা, তবে তা যথেষ্ট নয় বলে রিয়াজুল মন্তব্য করেন। রিয়াজুল বলেন, ‘২৩ জন শিশু কোনো দিনই উপস্থিত থাকতে পারে না। স্কুল শুরু হয় সন্ধ্যা সাতটায়, কিন্তু দোকান বন্ধ হয় আটটায়। শিশুরা আসে এরপর। কেউ কেউ, বিশেষ করে যারা কাঠমিস্ত্রির জোগালি, দূরে কাজ করতে গেলে আর আসতেই পারে না কয়েক দিন। ফলে চার-পাঁচজন ছাড়া কেউই ভালোভাবে শিখতে পারে না কিছু। ওদের জোর করে তো স্কুলে আনতে পারি না। ওদের পেটের ভাত জোগানোর সাধ্য তো আমার নেই।’ পাশের মসজিদ থেকে ইলেকট্রিক তার টেনে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে স্কুলটিতে। আর পৌর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা সবাই মিলে শ্রমজীবী শিশুদের জন্য এই বেড়ার ঘরটি করে দিয়েছেন।
সেভ দ্য চিলড্রেন ইউকে একটা করে বই সরবরাহ করে এসেছে এত দিন এই শিশুদের জন্য। কিন্তু তাদের নাকি আগামী বছর থেকে বই সরবরাহ করার উপায় থাকবে না। রিয়াজুল বলেন, ‘বই না হলে আর স্কুলটা চালানো সম্ভব হবে না।’ এটা এমন একটা বই, যাতে ভাষা ও গণিতের প্রাথমিক পাঠগুলো আছে। আরও আছে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য পরিচর্যা, বাল্যবিবাহের কুফল ইত্যাদি পাঠ। রিয়াজুলকে বললাম, বই ছাড়াও তো এগুলো শেখানো যায়। তিনি বললেন, ‘বই শিশুদের মনে যে আগ্রহ তৈরি করে, বই ছাড়া সেটা তৈরি করা কঠিন।’
এ রকম আরও দুটি স্কুল আছে কুড়িগ্রামে। কুড়িগ্রামের শিশুশ্রমিক নিয়োগকারীদের আগ্রহেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলো। একটি শহরের পূর্ব দিকে চরহরিকেশে, আরেকটি শহরের ভেতরে। বিড়িশ্রমিক, দর্জির দোকানের সহকারী, মত্স্য শিকারি, মুরগির দোকানদার, আচার বিক্রেতা, পিঠা বিক্রেতা, ফল বিক্রেতা, রেস্তোরাঁশ্রমিক শিশুরা পড়ে এসব স্কুলে। সব মিলে ৬০ জন শিশুশিক্ষার্থী। এখন এই ডিসেম্বরের পর স্কুল তিনটি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট এনজিওগুলো সহায়তা করতে পারছে না বলে। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, এনজিওগুলো দায়িত্ব নেবেই বা কেন, যখন রাষ্ট্র সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে ওয়াদাবদ্ধ?
কুড়িগ্রাম পৌর এলাকায় তিন হাজার শ্রমজীবী শিশু আছে। ২০০৬ সালে কুড়িগ্রাম জেলার পৌরসভা ও হলোখানা ইউনিয়নে এক হাজার ১০০ জন শিশুশ্রমিকের কাজের ক্ষেত্র ঝুঁকিমুক্ত করার আহ্বানে যখন শিশুশ্রমিক নিয়োগকারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্মত হয়, তখন তারা উদ্যোক্তা এনজিওর কাছে শর্ত দেন, তাঁদের নিয়োজিত শিশুশ্রমিকদের লেখাপড়া শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। নিজেদের পরিকল্পনা না থাকলেও এই শর্ত পূরণের অঙ্গীকার করেন উদ্যোক্তারা। এক বছরের শিক্ষা নিয়ে লিখতে-পড়তে পারা ও যোগ-বিয়োগের দক্ষতা অর্জন করতে পারার কথা শ্রমজীবী শিশুদের। কিন্তু দিনমান কায়িক পরিশ্রমের পর খুব কমসংখ্যক শিশুই স্কুলে নিয়মিত উপস্থিত হয়। বাস্তবতার চাপে যারা অনিয়মিত, তাদের শিখন পরিস্থিতি কিছুটা হতাশাজনক।
একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর ঝরেপড়া হারুন মিয়া (১৪) ২০০৮ সালে সিঅ্যান্ডবি ঘাটের শ্রমজীবী স্কুলে লিখতে-পড়তে শিখে সরাসরি সিঅ্যান্ডবি ঘাট রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এ বছর পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছে। বানিয়াপাড়া গ্রামের ইসলাম (১৫) ২০০৮ সালে পড়েছে কুড়িগ্রাম পৌরবাজার শ্রমজীবী শিশু স্কুলে। একটা জুয়েলারি দোকানের মালিক এখন তার ওপর মাপজোক ও হিসাব-নিকাশের দায়িত্ব নিশ্চিন্তেই ছেড়ে দিয়েছেন। চরহরিকেশের লিপি (১৫) আগে বাঁধার কাজ করত। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সেও দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে ঝরে পড়েছিল। ২০০৭ সালে চরহরিকেশ শ্রমজীবী শিশু স্কুলে পড়ে সে আবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পঞ্চম শ্রেণী পাস করে। এ বছর চরহরিকেশ উচ্চবিদ্যালয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছে। বৃষ্টিও (১৫) পড়েছে চরহরিকেশ শ্রমজীবী শিশু স্কুলে। এখন সে একটা মুদির দোকান চালায়। তার খালা তাকে করে দিয়েছে এই দোকান।
কুড়িগ্রাম জেলা বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ এলাকার একটি। বলা হয়ে থাকে, এনজিওগুলোর দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের একটি আকর্ষণীয় পরীক্ষাগার এই জেলা। সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টার পাশাপাশি কত এনজিও যে কাজ করে এখানে, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু দারিদ্র্যের কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ে না। তাই এখনো শত শত শিশুকে শ্রমিকের জীবন বেছে নিতে হয় এখানে। এদের অনেকেই প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয় শিশুসুলভ স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণী শেষ না করতেই নেমে পড়তে হয় পেটের ধান্ধায়। আর পরিবার-পরিকল্পনা বিভাগের চোখের সামনে নদীভাঙনের শিকার দরিদ্র দম্পতিদের সন্তানসংখ্যা বাড়তেই থাকে বছরের পর বছর, বাড়তে থাকে শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যাও। যেন শ্রমজীবী মানুষ শ্রমজীবী সন্তান জন্ম দেবে—এটাই নিয়ম। এই শিশুদের অন্তত প্রাথমিক শিক্ষা প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাহীন, নিশ্চয়তাহীন খণ্ডকালীন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কি সম্ভব? এদের বাইরে রেখেই কি আমরা ২০১৫ সালের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষা অর্জন করতে চাই?
শান্ত নূরুননবী: লেখক ও উন্নয়নকর্মী।
ঘাটের কাছাকাছি একটি মসজিদ। এর পাশে পৌর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সন্ধ্যার শান্ত বাতাসে ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসে শিশুদের ক্লান্ত কণ্ঠস্বর। পড়াশোনা চলছে ভেতরে। রাতের স্কুল। স্বল্প আলোয় কয়েকজন মলিন মুখের জীর্ণ পোশাকের শ্রমজীবী শিশুকে পড়াচ্ছেন লুঙ্গি পরিহিত একজন মাঝবয়সী মানুষ।
বুকের ভেতরে লেখাপড়া শেখার স্বপ্ন নিয়ে এখানে আসে শাহিনুর, লতিফ, আমারুল, জানু, জাহাঙ্গীরসহ ২৩ জন শিশু। ১০ থেকে ১৪-এর মধ্যে বয়স ওদের। কেউ গরু চরায়, কেউ কাঠমিস্ত্রির জোগালি, কেউ ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ান, পানের দোকানের কর্মচারী কেউ, কেউ বা সাইকেল মেকানিকের সহকারী, কেউ কাজ না পেয়ে আলুর মৌসুম বা ধানের মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করে। পিতৃহীন জানুর মা খড়ি কুড়িয়ে বিক্রি করে, মাটি কাটার কাজ করে যা রোজগার করেন, তা দিয়ে খাওয়াই জোটে না, জানুর তাই স্কুলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখার সাহসই হয়নি! কিন্তু যাঁরা ওদের কাজে নিয়োগ দিয়েছেন, তাঁদের ইচ্ছাতেই ওদের এই লেখাপড়া শেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। কুড়িগ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ছোট ছোট দোকানের মালিকদের অনুরোধে তাঁদের শিশু কর্মচারীদের লিখতে ও পড়তে শেখার ব্যবস্থা করতে এগিয়ে এসেছে স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থা।
খুব বড় কোনো স্বপ্ন নেই এই শিশুদের। কৃষিজমিতে কামলা দিয়ে পরিবারের আয়ে অংশ নেওয়া শিশুশ্রমিক আনিসুর বলে, ‘এইখানে পড়া শিখতেছি, লেখা শিখতেছি, যাতে বড় হয়া নিজের জমি করবের পারি, দলিলে কী ল্যাখা থাকে, বুজবের পারি। কেউ য্যান ঠকাইতে না পারে, সেই হিসাব করাটাই শিখতেছি।’ তাঁদের পড়া শেখাচ্ছেন রিয়াজুল করিম নামের একজন বেসরকারি মাদ্রাসার শিক্ষক। উন্নয়ন সংস্থা আরডিআরএস তাঁকে মাসে এক হাজার টাকা ভাতা দেয়। তা থেকেও কিছুটা তাঁকে খরচ করতে হয় মোমবাতি ও পেন্সিল কিনতে। খাতা-কলমও বিনামূল্যে পায় শিশুরা, তবে তা যথেষ্ট নয় বলে রিয়াজুল মন্তব্য করেন। রিয়াজুল বলেন, ‘২৩ জন শিশু কোনো দিনই উপস্থিত থাকতে পারে না। স্কুল শুরু হয় সন্ধ্যা সাতটায়, কিন্তু দোকান বন্ধ হয় আটটায়। শিশুরা আসে এরপর। কেউ কেউ, বিশেষ করে যারা কাঠমিস্ত্রির জোগালি, দূরে কাজ করতে গেলে আর আসতেই পারে না কয়েক দিন। ফলে চার-পাঁচজন ছাড়া কেউই ভালোভাবে শিখতে পারে না কিছু। ওদের জোর করে তো স্কুলে আনতে পারি না। ওদের পেটের ভাত জোগানোর সাধ্য তো আমার নেই।’ পাশের মসজিদ থেকে ইলেকট্রিক তার টেনে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে স্কুলটিতে। আর পৌর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা সবাই মিলে শ্রমজীবী শিশুদের জন্য এই বেড়ার ঘরটি করে দিয়েছেন।
সেভ দ্য চিলড্রেন ইউকে একটা করে বই সরবরাহ করে এসেছে এত দিন এই শিশুদের জন্য। কিন্তু তাদের নাকি আগামী বছর থেকে বই সরবরাহ করার উপায় থাকবে না। রিয়াজুল বলেন, ‘বই না হলে আর স্কুলটা চালানো সম্ভব হবে না।’ এটা এমন একটা বই, যাতে ভাষা ও গণিতের প্রাথমিক পাঠগুলো আছে। আরও আছে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য পরিচর্যা, বাল্যবিবাহের কুফল ইত্যাদি পাঠ। রিয়াজুলকে বললাম, বই ছাড়াও তো এগুলো শেখানো যায়। তিনি বললেন, ‘বই শিশুদের মনে যে আগ্রহ তৈরি করে, বই ছাড়া সেটা তৈরি করা কঠিন।’
এ রকম আরও দুটি স্কুল আছে কুড়িগ্রামে। কুড়িগ্রামের শিশুশ্রমিক নিয়োগকারীদের আগ্রহেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলো। একটি শহরের পূর্ব দিকে চরহরিকেশে, আরেকটি শহরের ভেতরে। বিড়িশ্রমিক, দর্জির দোকানের সহকারী, মত্স্য শিকারি, মুরগির দোকানদার, আচার বিক্রেতা, পিঠা বিক্রেতা, ফল বিক্রেতা, রেস্তোরাঁশ্রমিক শিশুরা পড়ে এসব স্কুলে। সব মিলে ৬০ জন শিশুশিক্ষার্থী। এখন এই ডিসেম্বরের পর স্কুল তিনটি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট এনজিওগুলো সহায়তা করতে পারছে না বলে। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, এনজিওগুলো দায়িত্ব নেবেই বা কেন, যখন রাষ্ট্র সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে ওয়াদাবদ্ধ?
কুড়িগ্রাম পৌর এলাকায় তিন হাজার শ্রমজীবী শিশু আছে। ২০০৬ সালে কুড়িগ্রাম জেলার পৌরসভা ও হলোখানা ইউনিয়নে এক হাজার ১০০ জন শিশুশ্রমিকের কাজের ক্ষেত্র ঝুঁকিমুক্ত করার আহ্বানে যখন শিশুশ্রমিক নিয়োগকারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্মত হয়, তখন তারা উদ্যোক্তা এনজিওর কাছে শর্ত দেন, তাঁদের নিয়োজিত শিশুশ্রমিকদের লেখাপড়া শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। নিজেদের পরিকল্পনা না থাকলেও এই শর্ত পূরণের অঙ্গীকার করেন উদ্যোক্তারা। এক বছরের শিক্ষা নিয়ে লিখতে-পড়তে পারা ও যোগ-বিয়োগের দক্ষতা অর্জন করতে পারার কথা শ্রমজীবী শিশুদের। কিন্তু দিনমান কায়িক পরিশ্রমের পর খুব কমসংখ্যক শিশুই স্কুলে নিয়মিত উপস্থিত হয়। বাস্তবতার চাপে যারা অনিয়মিত, তাদের শিখন পরিস্থিতি কিছুটা হতাশাজনক।
একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর ঝরেপড়া হারুন মিয়া (১৪) ২০০৮ সালে সিঅ্যান্ডবি ঘাটের শ্রমজীবী স্কুলে লিখতে-পড়তে শিখে সরাসরি সিঅ্যান্ডবি ঘাট রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এ বছর পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছে। বানিয়াপাড়া গ্রামের ইসলাম (১৫) ২০০৮ সালে পড়েছে কুড়িগ্রাম পৌরবাজার শ্রমজীবী শিশু স্কুলে। একটা জুয়েলারি দোকানের মালিক এখন তার ওপর মাপজোক ও হিসাব-নিকাশের দায়িত্ব নিশ্চিন্তেই ছেড়ে দিয়েছেন। চরহরিকেশের লিপি (১৫) আগে বাঁধার কাজ করত। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সেও দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে ঝরে পড়েছিল। ২০০৭ সালে চরহরিকেশ শ্রমজীবী শিশু স্কুলে পড়ে সে আবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পঞ্চম শ্রেণী পাস করে। এ বছর চরহরিকেশ উচ্চবিদ্যালয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছে। বৃষ্টিও (১৫) পড়েছে চরহরিকেশ শ্রমজীবী শিশু স্কুলে। এখন সে একটা মুদির দোকান চালায়। তার খালা তাকে করে দিয়েছে এই দোকান।
কুড়িগ্রাম জেলা বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ এলাকার একটি। বলা হয়ে থাকে, এনজিওগুলোর দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের একটি আকর্ষণীয় পরীক্ষাগার এই জেলা। সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টার পাশাপাশি কত এনজিও যে কাজ করে এখানে, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু দারিদ্র্যের কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ে না। তাই এখনো শত শত শিশুকে শ্রমিকের জীবন বেছে নিতে হয় এখানে। এদের অনেকেই প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয় শিশুসুলভ স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণী শেষ না করতেই নেমে পড়তে হয় পেটের ধান্ধায়। আর পরিবার-পরিকল্পনা বিভাগের চোখের সামনে নদীভাঙনের শিকার দরিদ্র দম্পতিদের সন্তানসংখ্যা বাড়তেই থাকে বছরের পর বছর, বাড়তে থাকে শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যাও। যেন শ্রমজীবী মানুষ শ্রমজীবী সন্তান জন্ম দেবে—এটাই নিয়ম। এই শিশুদের অন্তত প্রাথমিক শিক্ষা প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাহীন, নিশ্চয়তাহীন খণ্ডকালীন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কি সম্ভব? এদের বাইরে রেখেই কি আমরা ২০১৫ সালের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষা অর্জন করতে চাই?
শান্ত নূরুননবী: লেখক ও উন্নয়নকর্মী।
No comments