রাজর্ষি হাসন রাজা ও তাঁর জীবন by সৌমিত্র দেব
গতকাল ৭ পৌষ ছিল হাসন রাজার ১৫৫তম জন্মদিন। তিনি রাজপরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁরা ছিলেন এক হিন্দু রাজবংশের উত্তরাধিকারী। সিলেটের রামপাশা ও সুনামগঞ্জের লক্ষ্মণশ্রী মিলে বিস্তৃত ছিল তাঁর রাজত্ব। কিন্তু অন্য রাজাদের থেকে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর ভেতরে ছিল মরমি চেতনা। রাজকীয় আড়ম্বরে চলাফেরা তাঁর খুব অপছন্দ ছিল। তিনি প্রাচীন ঋষিদের মতো শব্দ নিয়ে খেলা করতেন। সে কারণে তাঁকে রাজর্ষি বলা যায়। তবে ঋষিদের শব্দব্রহ্ম ছিল মূলত ঈশ্বর ও অতীন্দ্রিয় জগত্ নিয়ে। হাসন রাজারও সে রকম ভাবনা ছিল। পাশাপাশি তাঁর ভাবনা ছিল মানুষ, জীবন ও জগত্ নিয়ে। আর সেখানেই রয়েছে তাঁর দার্শনিক পটভূমি। রাজর্ষি হাসনকে সেখানে দার্শনিক হাসন রাজা হিসেবেও বিচার করা যায়। তাঁর গান বা কবিতায় ছত্রে ছত্রে রয়েছে এই দর্শন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই দর্শনকে উপলব্ধি করেছেন। আন্তর্জাতিক পরিসরে বক্তৃতা করতে গিয়ে তিনি হাসন রাজার এই দর্শনের কথা তুলে ধরেছেন। গ্রাম্য কবির এই দার্শনিক চিন্তাকে তিনি ভূয়সী প্রশংসা করেছেন সেখানে। হাসন রাজার দর্শন সুফিবাদ-প্রভাবিত ছিল। তিনি যখন বলেন, ‘মম আঁখি হইতে পয়দা হইলো আসমান জমিন।’ সেটা স্মরণ করিয়ে দেয় সুফি দার্শনিকের ‘আইনাল হক’। কথিত আছে, তিনি চিশতিয়া তরিকার এক আধ্যাত্মিক গুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। হয়তো জীবনযাপনেও তার প্রভাব পড়েছিল। শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণব মতবাদেও প্রভাবিত ছিলেন হাসন। রাধা-কৃষ্ণ নিয়ে বহু গান রচনা করেছেন তিনি। শ্রীচৈতন্যের পিতৃভূমি ছিল সিলেটের ঢাকা দক্ষিণ। সিলেট বিভাগের জল হাওয়ায় এমনিতেই তাঁর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। তার ওপর সারা বাংলার ভাব আন্দোলনেই প্রাণপুরুষ হিসেবে বিবেচিত হন শ্রীচৈতন্য। মধ্যযুগে বৈষ্ণব কবিতা ও গান, বাংলা সাহিত্যকে প্রেম-ধর্মের বন্যায় ভাসিয়ে নিয়েছিল। হাসন রাজার প্রেমিকসত্তায়ও কৃষ্ণের অনুভূতি ছিল প্রবল। এ ছাড়া তিনি আকৃষ্ট ছিলেন বাংলার বাউল ধারায়।
তিনি নিজেই তাঁর গানে বলেছেন, ‘বাউলা কে বানাইলো রে, হাসন রাজারে বাউলা কে বানাইলো রে।’ হাসন রাজার জীবনযাত্রা মোটেও বাউলদের মতো ছিল না। তিনি গৃহী ছিলেন, সংসারী ছিলেন। বৈষয়িক জ্ঞানও যে তাঁর খুব কম ছিল, সেটা বলা যাবে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি ছিলেন বাউল। সহজ-সরল অনাড়ম্বর চলাফেরায় তিনি বাউলদের নৈকট্য অনুভব করতেন। সামন্তবাদী পারিবারিক কাঠামোয় বাউলদের জীবনপদ্ধতি অনুসরণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। হাসন রাজার দৌহিত্র দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বলেছেন, বাউল-ভাবনা থাকলেও হাসন রাজা বাউল ছিলেন না। কিন্তু বাউলদর্শন যে তাঁকে প্রভাবিত করেছিল, সেটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তিনি অস্বীকার করেছিলেন। মোল্লা-মুনশির বিপক্ষে তিনি অনেক গান রচনা করেছেন। তিনি কোনো মাধ্যম ধরতে চাননি। সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সুফিবাদী চিন্তা লালন করেছেন। বলেছেন, ‘আমি যাইমু গো যাইমু আল্লাহর সনে।’ বলেছেন আল্লাহর রূপ ও আল্লাহর রঙের কথা। এ কথাগুলো শরিয়তের সঙ্গে খাপ খায় না। মারফতি তত্ত্বের সঙ্গে মেলে। তবে এসব তত্ত্বই ভাববাদী দর্শন। এর মধ্যে ফুটে উঠেছে অসার সংসার, ক্ষণস্থায়ী জীবন ও জগতের নিষ্ফল আনন্দ। তিনি জীবনের প্রয়োজনে একাধিক বিয়ে করেছেন। সেসব নিয়ে আত্মসমালোচনা করতে ছাড়েননি। বলেছেন, ‘আর করবায়নি হাসন রাজা দেশও দেশও বিয়া।’ একাধিক গানে তাঁর ছড়িয়ে আছে মৃত্যুচেতনা। তিনি মৃত্যুকে বন্দনা করেছেন। জানতেন, মৃত্যু তাঁর কাছ থেকে প্রিয় জমিদারি লক্ষ্মণশ্রী রামপাশা সব কেড়ে নেবে। তবে তাঁর এই কবিতা ও গানকে বস্তুবাদী দর্শন দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায়। এর মধ্য দিয়ে তিনি জীবনের নিরর্থকতা যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি সেই নিরর্থকতাকে তাত্পর্যপূর্ণ করে তুলতে চেয়েছেন তাঁর জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে। হাসন রাজা নদী পছন্দ করতেন। হাওর পছন্দ করতেন। ভালোবাসতেন নৌবিহার। তাঁর গানের দল নিয়ে বজরায় ভেসে যেতেন। সুনসান জ্যোত্স্না রাতে চলত হাসন রাজার নৌবিহার। তাঁর সফরসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন দিলারাম ও উদাই জমাদার। দিলারাম অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন। তাঁকে নিয়ে হাসন রাজা গানও লিখেছেন। উদাই জমাদারের সঙ্গেই বিয়ে হয়েছিল দিলারামের। এভাবেই জীবনকে উপভোগ করতেন হাসন রাজা। মানুষ ও প্রকৃতি—দুটোই তাঁকে আকৃষ্ট করত।
হাসন রাজা পাকাবাড়ি পছন্দ করতেন না। সাদাসিধা ঘর ছিল তাঁর। এ নিয়ে গানেই বলেছেন, ‘লোকে বলে বলে রে, ঘরবাড়ি ভালা নাই আমার। কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার...।’ কথিত আছে, এক অতিথি তাঁকে তাঁর ঘর কোথায় জিজ্ঞেস করলে তিনি কবরখানা দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
আরেকবার তিনি এলাকার বাইরে সফরে থাকা অবস্থায় তাঁর ইংরেজ কর্মচারী পাকাঘর বানানোর চেষ্টা চালায়। ফিরে এসে এটা দেখে তিনি তত্ক্ষণাত্ সেটা ভেঙে ফেলার হুকুম দেন এবং ইংরেজ কর্মচারীকে বরখাস্ত করেন। এগুলো পর্যালোচনা করলে হাসন রাজার পাকা ঘরে নিরাসক্তির কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। মনে হয় তিনি হয়তো ভাবের ঘোরে এসব কাজ করেছেন। বাস্তবে এর অন্য কারণও আবিষ্কৃত হয়েছে। হাসন রাজার ছেলেবেলায় সিলেটে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল।
তিনি দেখেছিলেন পাকা বাড়ি ধসে পড়া। ঘটনাটি তাঁর কিশোরমনে রেখাপাত করতে পারে। আর সে কারণেই হয়তো পাকা বাড়ি দেখলে তিনি ভীত হয়ে পড়তেন। আবার বাউলচিন্তাও যে কাজ করেনি, এ ব্যাপারে সেটাও বলা যাবে না। মোট কথা, তিনি ধর্মীয় দর্শনের দিক থেকে যেমন সমন্বয়বাদী চিন্তা করেছেন, তেমনি বস্তু ও ভাবের মধ্যেও সমন্বয় করেছেন।
সে কারণে হাসন রাজা যেমন গানের রাজা, তেমনি লোকেরও রাজা। লোক বলতে এখানে লোকসাহিত্য বোঝানো হচ্ছে। তাঁর জীবনদর্শন আলোচনা করলে একই সঙ্গে একজন রাজা এবং একজন ঋষিকে খুঁজে পাওয়া যায়।
তিনি নিজেই তাঁর গানে বলেছেন, ‘বাউলা কে বানাইলো রে, হাসন রাজারে বাউলা কে বানাইলো রে।’ হাসন রাজার জীবনযাত্রা মোটেও বাউলদের মতো ছিল না। তিনি গৃহী ছিলেন, সংসারী ছিলেন। বৈষয়িক জ্ঞানও যে তাঁর খুব কম ছিল, সেটা বলা যাবে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি ছিলেন বাউল। সহজ-সরল অনাড়ম্বর চলাফেরায় তিনি বাউলদের নৈকট্য অনুভব করতেন। সামন্তবাদী পারিবারিক কাঠামোয় বাউলদের জীবনপদ্ধতি অনুসরণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। হাসন রাজার দৌহিত্র দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বলেছেন, বাউল-ভাবনা থাকলেও হাসন রাজা বাউল ছিলেন না। কিন্তু বাউলদর্শন যে তাঁকে প্রভাবিত করেছিল, সেটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তিনি অস্বীকার করেছিলেন। মোল্লা-মুনশির বিপক্ষে তিনি অনেক গান রচনা করেছেন। তিনি কোনো মাধ্যম ধরতে চাননি। সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সুফিবাদী চিন্তা লালন করেছেন। বলেছেন, ‘আমি যাইমু গো যাইমু আল্লাহর সনে।’ বলেছেন আল্লাহর রূপ ও আল্লাহর রঙের কথা। এ কথাগুলো শরিয়তের সঙ্গে খাপ খায় না। মারফতি তত্ত্বের সঙ্গে মেলে। তবে এসব তত্ত্বই ভাববাদী দর্শন। এর মধ্যে ফুটে উঠেছে অসার সংসার, ক্ষণস্থায়ী জীবন ও জগতের নিষ্ফল আনন্দ। তিনি জীবনের প্রয়োজনে একাধিক বিয়ে করেছেন। সেসব নিয়ে আত্মসমালোচনা করতে ছাড়েননি। বলেছেন, ‘আর করবায়নি হাসন রাজা দেশও দেশও বিয়া।’ একাধিক গানে তাঁর ছড়িয়ে আছে মৃত্যুচেতনা। তিনি মৃত্যুকে বন্দনা করেছেন। জানতেন, মৃত্যু তাঁর কাছ থেকে প্রিয় জমিদারি লক্ষ্মণশ্রী রামপাশা সব কেড়ে নেবে। তবে তাঁর এই কবিতা ও গানকে বস্তুবাদী দর্শন দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায়। এর মধ্য দিয়ে তিনি জীবনের নিরর্থকতা যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি সেই নিরর্থকতাকে তাত্পর্যপূর্ণ করে তুলতে চেয়েছেন তাঁর জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে। হাসন রাজা নদী পছন্দ করতেন। হাওর পছন্দ করতেন। ভালোবাসতেন নৌবিহার। তাঁর গানের দল নিয়ে বজরায় ভেসে যেতেন। সুনসান জ্যোত্স্না রাতে চলত হাসন রাজার নৌবিহার। তাঁর সফরসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন দিলারাম ও উদাই জমাদার। দিলারাম অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন। তাঁকে নিয়ে হাসন রাজা গানও লিখেছেন। উদাই জমাদারের সঙ্গেই বিয়ে হয়েছিল দিলারামের। এভাবেই জীবনকে উপভোগ করতেন হাসন রাজা। মানুষ ও প্রকৃতি—দুটোই তাঁকে আকৃষ্ট করত।
হাসন রাজা পাকাবাড়ি পছন্দ করতেন না। সাদাসিধা ঘর ছিল তাঁর। এ নিয়ে গানেই বলেছেন, ‘লোকে বলে বলে রে, ঘরবাড়ি ভালা নাই আমার। কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার...।’ কথিত আছে, এক অতিথি তাঁকে তাঁর ঘর কোথায় জিজ্ঞেস করলে তিনি কবরখানা দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
আরেকবার তিনি এলাকার বাইরে সফরে থাকা অবস্থায় তাঁর ইংরেজ কর্মচারী পাকাঘর বানানোর চেষ্টা চালায়। ফিরে এসে এটা দেখে তিনি তত্ক্ষণাত্ সেটা ভেঙে ফেলার হুকুম দেন এবং ইংরেজ কর্মচারীকে বরখাস্ত করেন। এগুলো পর্যালোচনা করলে হাসন রাজার পাকা ঘরে নিরাসক্তির কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। মনে হয় তিনি হয়তো ভাবের ঘোরে এসব কাজ করেছেন। বাস্তবে এর অন্য কারণও আবিষ্কৃত হয়েছে। হাসন রাজার ছেলেবেলায় সিলেটে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল।
তিনি দেখেছিলেন পাকা বাড়ি ধসে পড়া। ঘটনাটি তাঁর কিশোরমনে রেখাপাত করতে পারে। আর সে কারণেই হয়তো পাকা বাড়ি দেখলে তিনি ভীত হয়ে পড়তেন। আবার বাউলচিন্তাও যে কাজ করেনি, এ ব্যাপারে সেটাও বলা যাবে না। মোট কথা, তিনি ধর্মীয় দর্শনের দিক থেকে যেমন সমন্বয়বাদী চিন্তা করেছেন, তেমনি বস্তু ও ভাবের মধ্যেও সমন্বয় করেছেন।
সে কারণে হাসন রাজা যেমন গানের রাজা, তেমনি লোকেরও রাজা। লোক বলতে এখানে লোকসাহিত্য বোঝানো হচ্ছে। তাঁর জীবনদর্শন আলোচনা করলে একই সঙ্গে একজন রাজা এবং একজন ঋষিকে খুঁজে পাওয়া যায়।
No comments