তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন -শ্রদ্ধাঞ্জলি by মুহম্মদ সবুর
কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, ছিলেন যিনি সাহসিকতার প্রতীক, উদ্দীপনার অগ্রনায়ক। জীবন-মরণের সীমানা ছাড়িয়ে দেদীপ্যমান হয়ে আছেন এই ভূখণ্ডে। তিনি কখনো ‘প্রস্থান’-এর গান কিংবা গল্প শোনাননি। বরং জীবনকে প্রাণবন্ত, আরও সজীব, কর্মময়, আলোকিত, বিকশিত, প্রস্ফুটিত করার প্রেরণাই জুগিয়েছেন নিরন্তর।
সাহস তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে একুশের প্রথম কবিতা, ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’। ’৪৭ সালে দেশবিভাগ, ’৫০-এর দাঙ্গা, পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী স্বাক্ষর সংগ্রহ, বিশ্বশান্তির জন্য পরিষদ গঠন—সবকিছুতেই সাহসের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে কঠিন বাধা অতিক্রম করেছেন। অতি তরুণ বয়সেই প্রকাশ করেছেন সাহিত্য পত্রিকা সীমান্ত। চট্টগ্রামে তাঁর উত্থানকালে ছিলেন তিনি প্রাগ্রসর এক প্রগতিমনস্ক সমাজ-সংগঠক। রাজনীতিতেও ছিল নিবেদন। দৈনিক সংবাদপত্রও প্রকাশ করেছেন। গান, নাচ, নাটক, আবৃত্তি—সবখানেই ছিলেন উদ্যোক্তা-সংগঠক। নিজে গান লিখে গেয়েছেনও। মানবকল্যাণের ব্রত তাঁকে সম্পন্ন মানবের অবয়ব দিয়েছিল বৈকি।
একুশ মানে যে মাথা নত না করা, তা দেখেছি কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর জীবনে। অন্যায়ের কাছে, সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার, হীনম্মন্যতা, ধর্মান্ধতার কাছে নত বা আপস নয়; বরং এসবের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর নিরন্তর লড়াই। সাংগঠনিক শক্তিমত্তার পাশাপাশি লেখনীসত্তাকেও এগিয়ে নিয়ে গেছেন। শাসক বা প্রাতিষ্ঠানিকতার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মানুষ ছিলেন না, বরং সাহসের সঙ্গে কুশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। হুলিয়া মাথায় নিয়েও স্তব্ধ হয়ে যাননি। সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকার তাঁকে অনেক দুর্গম পথ পাড়ি দিতে উত্সাহ জুগিয়েছে।
এমনই মানুষ কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী যে, বয়সের পার্থক্যরেখা তাঁর জন্য কোনো বাধা ছিল না। অনায়াসে শিশু থেকে প্রবীণ যে কারও সঙ্গেই সাবলীলভাবে মিশে যেতে পারতেন। প্রখর স্মৃতি-সম্পর্ক রক্ষার ব্রতকে সবল করেছে। একবার দেখা হওয়া মানুষকে সহজে ভুলে যেতেন না। যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করতেন নিজে থেকেই।
শিশুর সরল হাসিটি তাঁর মুখে লেগে থাকত পরিণত বয়সেও। শিশুদের জন্য ছড়া লেখার কাজটিও তিনি করেছেন সযত্নে। ছেলে ভোলানো নয়, ছেলে জাগার এবং যুদ্ধে যাওয়ার ছড়া লিখেছেন। সংবেদনশীল কবিসত্তার অধিকারী মানুষটির সান্নিধ্য মিলেছে যতক্ষণ, পুরোটাতেই থাকত নিত্যনতুন স্বপ্নের কথকতা, সেই সঙ্গে অতীতের স্মৃতিময় ইতিহাসবাহী দিনগুলো। নির্যাস মিলত অনেক অজানা, অদেখা, অচেনা মানুষ ও ঘটনার। যাঁরা মূর্ত হয়ে উঠতেন কবির বর্ণনায়।
ছিলাম যারা নানা সময়ে কাছাকাছি, সান্নিধ্যের উষ্ণতায় তৃপ্ত, জীবনের জয়গানে উদ্দীপ্ত, তাদের কাছে ছিলেন তিনি হিমালয়সম এক মানব। হূদয়ের দুকূল ছাপিয়ে অজান্তে টেনে নিতেন কাছাকাছি। জীবনের সফলতা তাঁর কাছে অন্য রকম। সে তাঁর ১৯৫৭ সালে লেখা কবিতায় এসেছেও। অর্থ, খ্যাতি এসব সাফল্য হিসেবে তাঁর কাছে ধরা পড়ত না। কাদা ঘেঁটে জীবনের দীর্ঘপথ হাঁটার আগ্রহী ছিলেন না। সমাজের রূপান্তর চেয়েছিলেন বুঝি। এক জীবনে অনেক কিছু করার যে ক্ষমতা, তা মাহবুব উল আলম চৌধুরী পেরেছেন নিজস্ব আত্মশক্তির উদ্বোধনে। হয়েছেন নিজেই তাই একটি প্রতিষ্ঠান, একটি ইতিহাস। সেই তিনি, নতুন কবিতা লেখা হলে টেলিফোনে শোনাতেন স্বজন, প্রিয়জন, ঘনিষ্ঠজনকে। মতামত নিতেন। একেকটি সৃষ্টির পেছনে তাঁর নিবেদন ছিল অনেক বেশি। কবিতা নিয়ে ভাবনাটা ভিন্নরকমই ছিল। চল্লিশের দশক থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। যে কারণে সে সময়ই চট্টগ্রাম থেকে বের করেছিলেন সীমান্ত নামে সাহিত্যপত্র; উনিশ বছর বয়সেই।
পরিণত বয়সে এসে মৃত্যুর কথা যে ভাবতেন না, তা নয়। মানবজীবনের এই অনিবার্য পরিণতির বিষয়ে হা-হুতাশ ছিল না। তবে বীরের মতো মৃত্যুকে বরণ করার আকাঙ্ক্ষা ছিল। ২০০৭ সালের ঈদুল আজহার পর চলে গেলেন তিনি। আকস্মিক এই বিদায়ের জন্য কি ছিল কোনো পূর্বপ্রস্তুতি? তবে বছরখানেক আগেই মৃত্যুকে নিয়ে তাঁর কথকতা-ভাবনাকে পাওয়া গিয়েছিল। নতুন কবিতা লেখা হলে মাঝেমধ্যে যেমন শোনাতেন নিবিষ্ট শ্রোতাদের, সে রকম ২০০৬ সালের ঈদুল আজহার আগে শুনিয়েছিলেন কবিতা। যেখানে এই চলে যাওয়ার চিত্রটা তুলে এনেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন বোধহয়; যাওয়ার দিনগুলো ক্রমশ এগিয়ে আসছে। তাই আকাঙ্ক্ষাগুলো যেন প্রকাশিত হয়েছিল এই বিদায়ের শিল্পিত সুষমায়।
কবি মাহবুব ভাই, যিনি আমাদের তারুণ্যের সময় প্রেরণা জোগাতেন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি। যাঁকে কাছ থেকে, দূর থেকে দীর্ঘদিন দেখে এসেছি। ‘কুয়াশায় বীজ বুনে চলে গেছে চাষা’র মতো উল্লেখযোগ্য লাইনের লেখক মাহবুব ভাই বোধহয় বুঝতেন, তাঁর বুনে যাওয়া বীজে অঙ্কুরিত বৃক্ষগুলো ছায়া দেবে মানুষকে। যে মানুষের জন্য তাঁর প্রাণের আকুতি তীব্র।
হ্যাঁ, তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকবেন এ দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতির ইতিহাসজুড়ে।
সেই বায়ান্ন সালে একুশের প্রথম কবিতায়ই তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাদের আশা অগ্নিশিখার মতো জ্বলবে/ প্রতিরোধ এবং বিজয়ের আনন্দে।’ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস যত দিন থাকবে, তত দিন অম্লান থাকবে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী ও তাঁর সৃষ্টি। আমাদের প্রাণের পতাকাজুড়েও পতপত করে উড়বে তাঁর অমর কাব্য।
সাহস তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে একুশের প্রথম কবিতা, ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’। ’৪৭ সালে দেশবিভাগ, ’৫০-এর দাঙ্গা, পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী স্বাক্ষর সংগ্রহ, বিশ্বশান্তির জন্য পরিষদ গঠন—সবকিছুতেই সাহসের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে কঠিন বাধা অতিক্রম করেছেন। অতি তরুণ বয়সেই প্রকাশ করেছেন সাহিত্য পত্রিকা সীমান্ত। চট্টগ্রামে তাঁর উত্থানকালে ছিলেন তিনি প্রাগ্রসর এক প্রগতিমনস্ক সমাজ-সংগঠক। রাজনীতিতেও ছিল নিবেদন। দৈনিক সংবাদপত্রও প্রকাশ করেছেন। গান, নাচ, নাটক, আবৃত্তি—সবখানেই ছিলেন উদ্যোক্তা-সংগঠক। নিজে গান লিখে গেয়েছেনও। মানবকল্যাণের ব্রত তাঁকে সম্পন্ন মানবের অবয়ব দিয়েছিল বৈকি।
একুশ মানে যে মাথা নত না করা, তা দেখেছি কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর জীবনে। অন্যায়ের কাছে, সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার, হীনম্মন্যতা, ধর্মান্ধতার কাছে নত বা আপস নয়; বরং এসবের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর নিরন্তর লড়াই। সাংগঠনিক শক্তিমত্তার পাশাপাশি লেখনীসত্তাকেও এগিয়ে নিয়ে গেছেন। শাসক বা প্রাতিষ্ঠানিকতার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মানুষ ছিলেন না, বরং সাহসের সঙ্গে কুশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। হুলিয়া মাথায় নিয়েও স্তব্ধ হয়ে যাননি। সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকার তাঁকে অনেক দুর্গম পথ পাড়ি দিতে উত্সাহ জুগিয়েছে।
এমনই মানুষ কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী যে, বয়সের পার্থক্যরেখা তাঁর জন্য কোনো বাধা ছিল না। অনায়াসে শিশু থেকে প্রবীণ যে কারও সঙ্গেই সাবলীলভাবে মিশে যেতে পারতেন। প্রখর স্মৃতি-সম্পর্ক রক্ষার ব্রতকে সবল করেছে। একবার দেখা হওয়া মানুষকে সহজে ভুলে যেতেন না। যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করতেন নিজে থেকেই।
শিশুর সরল হাসিটি তাঁর মুখে লেগে থাকত পরিণত বয়সেও। শিশুদের জন্য ছড়া লেখার কাজটিও তিনি করেছেন সযত্নে। ছেলে ভোলানো নয়, ছেলে জাগার এবং যুদ্ধে যাওয়ার ছড়া লিখেছেন। সংবেদনশীল কবিসত্তার অধিকারী মানুষটির সান্নিধ্য মিলেছে যতক্ষণ, পুরোটাতেই থাকত নিত্যনতুন স্বপ্নের কথকতা, সেই সঙ্গে অতীতের স্মৃতিময় ইতিহাসবাহী দিনগুলো। নির্যাস মিলত অনেক অজানা, অদেখা, অচেনা মানুষ ও ঘটনার। যাঁরা মূর্ত হয়ে উঠতেন কবির বর্ণনায়।
ছিলাম যারা নানা সময়ে কাছাকাছি, সান্নিধ্যের উষ্ণতায় তৃপ্ত, জীবনের জয়গানে উদ্দীপ্ত, তাদের কাছে ছিলেন তিনি হিমালয়সম এক মানব। হূদয়ের দুকূল ছাপিয়ে অজান্তে টেনে নিতেন কাছাকাছি। জীবনের সফলতা তাঁর কাছে অন্য রকম। সে তাঁর ১৯৫৭ সালে লেখা কবিতায় এসেছেও। অর্থ, খ্যাতি এসব সাফল্য হিসেবে তাঁর কাছে ধরা পড়ত না। কাদা ঘেঁটে জীবনের দীর্ঘপথ হাঁটার আগ্রহী ছিলেন না। সমাজের রূপান্তর চেয়েছিলেন বুঝি। এক জীবনে অনেক কিছু করার যে ক্ষমতা, তা মাহবুব উল আলম চৌধুরী পেরেছেন নিজস্ব আত্মশক্তির উদ্বোধনে। হয়েছেন নিজেই তাই একটি প্রতিষ্ঠান, একটি ইতিহাস। সেই তিনি, নতুন কবিতা লেখা হলে টেলিফোনে শোনাতেন স্বজন, প্রিয়জন, ঘনিষ্ঠজনকে। মতামত নিতেন। একেকটি সৃষ্টির পেছনে তাঁর নিবেদন ছিল অনেক বেশি। কবিতা নিয়ে ভাবনাটা ভিন্নরকমই ছিল। চল্লিশের দশক থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। যে কারণে সে সময়ই চট্টগ্রাম থেকে বের করেছিলেন সীমান্ত নামে সাহিত্যপত্র; উনিশ বছর বয়সেই।
পরিণত বয়সে এসে মৃত্যুর কথা যে ভাবতেন না, তা নয়। মানবজীবনের এই অনিবার্য পরিণতির বিষয়ে হা-হুতাশ ছিল না। তবে বীরের মতো মৃত্যুকে বরণ করার আকাঙ্ক্ষা ছিল। ২০০৭ সালের ঈদুল আজহার পর চলে গেলেন তিনি। আকস্মিক এই বিদায়ের জন্য কি ছিল কোনো পূর্বপ্রস্তুতি? তবে বছরখানেক আগেই মৃত্যুকে নিয়ে তাঁর কথকতা-ভাবনাকে পাওয়া গিয়েছিল। নতুন কবিতা লেখা হলে মাঝেমধ্যে যেমন শোনাতেন নিবিষ্ট শ্রোতাদের, সে রকম ২০০৬ সালের ঈদুল আজহার আগে শুনিয়েছিলেন কবিতা। যেখানে এই চলে যাওয়ার চিত্রটা তুলে এনেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন বোধহয়; যাওয়ার দিনগুলো ক্রমশ এগিয়ে আসছে। তাই আকাঙ্ক্ষাগুলো যেন প্রকাশিত হয়েছিল এই বিদায়ের শিল্পিত সুষমায়।
কবি মাহবুব ভাই, যিনি আমাদের তারুণ্যের সময় প্রেরণা জোগাতেন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি। যাঁকে কাছ থেকে, দূর থেকে দীর্ঘদিন দেখে এসেছি। ‘কুয়াশায় বীজ বুনে চলে গেছে চাষা’র মতো উল্লেখযোগ্য লাইনের লেখক মাহবুব ভাই বোধহয় বুঝতেন, তাঁর বুনে যাওয়া বীজে অঙ্কুরিত বৃক্ষগুলো ছায়া দেবে মানুষকে। যে মানুষের জন্য তাঁর প্রাণের আকুতি তীব্র।
হ্যাঁ, তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকবেন এ দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতির ইতিহাসজুড়ে।
সেই বায়ান্ন সালে একুশের প্রথম কবিতায়ই তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাদের আশা অগ্নিশিখার মতো জ্বলবে/ প্রতিরোধ এবং বিজয়ের আনন্দে।’ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস যত দিন থাকবে, তত দিন অম্লান থাকবে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী ও তাঁর সৃষ্টি। আমাদের প্রাণের পতাকাজুড়েও পতপত করে উড়বে তাঁর অমর কাব্য।
No comments