বিএনপি সংসদে যাবে কি যাবে না by সোহরাব হাসান
সরকারি ও বিরোধী দলের সক্রিয় অংশগ্রহণে জাতীয় সংসদ কার্যকর হবে, সেখানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও আইন পাস হবে—এটাই সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল কথা। অথচ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো, ক্ষমতায় থাকতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সবকিছু করা, আর বিরোধী দলে গিয়ে সংসদকে পরিত্যক্ত ভাবা। বিএনপির শাসনামলে আওয়ামী লীগ সংসদবিমুখ, আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপি সংসদবিমুখ।
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ সব দলই সংসদকে রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র করা হবে বলে দেশবাসীর কাছে অঙ্গীকার করেছিল। কীভাবে সংসদ কার্যকর হতে পারে, কীভাবে সরকারি ও বিরোধী দল সংসদে কাজ করতে পারে, তার একটি রূপরেখাও তারা তুলে ধরেছিল। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলনকেন্দ্রে আয়োজিত জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বিরোধী দল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার নেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সংসদের প্রথম অধিবেশনের দিনই দেশবাসী হোঁচট খেল, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার—দুজনকেই সরকারি দল থেকে নেওয়ায়। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পরে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তাও গ্রহণযোগ্য নয়।
তার পরও উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাংসদদের উপস্থিতি জনমনে কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করেছিল। তারা ভেবেছিল, হয়তো রাজনৈতিক দলগুলো সংসদকে কার্যকর করতে সচেষ্ট হবে; অতীতের বর্জন-সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসবে।
গত এক বছরে তার কোনো লক্ষণ নেই। দেশবাসী গভীর উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠার সঙ্গে প্রত্যক্ষ করল, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তার দুই সহযোগী জামায়াতে ইসলামী ও বিজেপির সাংসদেরা সামনের সারিতে আসন বাড়ানোর দাবিতে সেই যে অধিবেশনকক্ষ ত্যাগ করলেন, আর ফিরে এলেন না। এরপর সময় যত গড়াতে থাকল, তাঁদের দাবির তালিকাও দীর্ঘ হতে লাগল। আর সে তালিকা বাড়াতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অবদানও কম নয়। যেমন, আইনের খুঁটিনাটি বিষয় যাচাই না করেই খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাড়ি ছাড়তে নোটিশ জারি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারে বৈষম্যমূলক নীতি, বিরোধীদলীয় নেতার নিরাপত্তা বাহিনীর জনবল কমানো, তাঁর সেনানিবাসের বাড়িতে দর্শনার্থীদের যেতে বাধাদান। বিএনপির আমলে সরকারের যেসব গণবিরোধী ও হয়রানিমূলক পদক্ষেপের কঠোর সমালোচনা করেছে আওয়ামী লীগ, ক্ষমতায় গিয়ে তারাও যদি একই কাজ করে, সেগুলো জনগণ কীভাবে নেবে?
কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই বিএনপি সংসদ বর্জন করে চলেছে। এমনকি ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনেও তারা যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। জাতীয় সংসদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন হলো বাজেট অধিবেশন। এতে বেশির ভাগ সাংসদ বাজেট নিয়ে যেমন আলোচনার সুযোগ পান, তেমনি নিজ এলাকার জনগণের অভাব-অভিযোগও তুলে ধরতে পারেন। যে এলাকাবাসী তাদের পক্ষে কথা বলার জন্য জনপ্রতিনিধিদের সংসদে পাঠিয়েছে, তাদের বঞ্চিত করার অধিকার তাঁদের নেই।
সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি যেসব অভিযোগ এনেছে, সেগুলো সর্বাংশে সত্য হলেও লাগাতার সংসদ বর্জনের কোনো যুক্তি নেই। তাঁরা সংসদেও যাবেন না, আবার এলাকার জনপ্রতিনিধিও থাকবেন—এই স্ববিরোধী নীতি চলতে পারে না। বিএনপির অভিযোগ, সরকার বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। সংসদে বিরোধী দলকে অযথা গালাগাল করা হয়, সরকারি দল বিভিন্ন স্থানে তাদের সভা-সমাবেশ পণ্ড করে দিচ্ছে। এসব অন্যায়ের প্রতিকার চাইতেও বিএনপির সাংসদদের উচিত সংসদে গিয়ে কথা বলা, প্রতিবাদ করা। বর্তমান জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের আসন খুব কম হলেও বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ ও বর্ষীয়ান সাংসদ আছেন। তত্কালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলের আসন ছিল আরও কম। তার পরও সরকারের কোনো আইন বা পদক্ষেপকে তারা বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশেও বাহাত্তরে গণপরিষদ মাতিয়ে রেখেছিলেন বিরোধী পক্ষের মাত্র দুজন সাংসদ, ন্যাপের সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতা) ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। ঊনআশিতে গঠিত জিয়াউর রহমানের সংসদেও আওয়ামী লীগের ৩৯ জন সাংসদ সরকারি দলকে স্বস্তিতে থাকতে দেননি। আসলে, বিরোধী দলের সদস্যসংখ্যা নয়, সংসদের প্রতি তাঁদের আস্থা আছে কি না, তার ওপরই সংসদের কার্যকারিতা নির্ভর করে। বিগত দুটি সংসদেই বিরোধীদলীয় নেতার (যথাক্রমে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা) কাছে দলীয় সাংসদেরা পদত্যাগপত্র জমা রেখে দিয়েছিলেন, যাতে কেউ দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করতে না পারেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে, অনেকে একে সাংসদদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ বলেও মনে করেন। কিন্তু বিরোধী দলে থাকতে দলীয় নেতার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে রাখাকে কীভাবে দেখা যায়? প্রথমটি ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ হলে, দ্বিতীয়টি দাস্য মনোবৃত্তির পরিচায়ক।
জাতীয় সংসদের অধিবেশন যত ঘনিয়ে আসছে, সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে বাগ্যুদ্ধও তত তীব্র হচ্ছে। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দেখে নেওয়ার এবং দেখিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ইঙ্গিত দিয়েছেন, সরকার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না করলে তাঁরা আগামী অধিবেশনে যাবেন না। দলের নতুন জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব ও ভবিষ্যত্ মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে নতুন ধারার রাজনীতি শুরু করার কথাও বলেছেন। সংসদে না গিয়ে কি সেটি সম্ভব?
প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপি সংসদে যাবে কি যাবে না। বিএনপির নেতারা সংসদে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যেসব শর্ত পূরণের কথা বলেছেন, তা আসল দাবি নয় বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন। নানা শর্তের আড়ালে বিএনপি দুটো দাবি নিয়েই এগোচ্ছে। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহার; দুই. দেশে ফেরার পর তারেক রহমানকে হয়রানি বা গ্রেপ্তার না করা।
তারেক রহমানের ব্যাপারে বিএনপিতে মতদ্বৈধ আগেও ছিল, এখনো আছে। দলের অপেক্ষাকৃত উদারপন্থীরা চেয়েছিলেন, আরও কিছু সময় পর তাঁকে সামনে নিয়ে আসতে। কিন্তু কট্টরপন্থীরা কাউন্সিলের মাধ্যমেই তারেককে বিকল্প নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। সাড়ম্বরে জন্মদিন পালন, পোস্টারে সবার আগে ছবি বসানো, ভিডিও কনফারেন্সে বক্তৃতার আয়োজন—সবই ছিল তাঁর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের অংশ। দলের কট্টরপন্থী অংশ তারেককে কো-চেয়ারম্যান করার প্রস্তাবও দিয়েছিল, অবশ্য কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার মৃদু আপত্তিতে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদেই সন্তুষ্ট থাকেন।
৮ ডিসেম্বরের কাউন্সিলের আগে তারেক রহমান ছিলেন দলের চেয়ারপারসনের জ্যেষ্ঠ পুত্র ও সাবেক জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব। কাউন্সিলে সর্বসম্মতিক্রমে তাঁকে নতুন পদে বরণ করায় তাঁর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব সবাইকে মানতে হবে। এখন তারেকের বিরুদ্ধে মামলা হলে বা দেশে ফিরতে তাঁকে বাধা দেওয়া হলে বিএনপি অনায়াসে তাঁকে আন্দোলনের ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে।
বিএনপির এই রাজনৈতিক চালকে সরকার কীভাবে নেয়, তার ওপরই রাজনীতির গতিবিধি নির্ধারিত হবে। সরকারি দলের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক জবাব না পাওয়া গেলেও প্রধানমন্ত্রীসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তা কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়। তারেক রহমান বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার এক দিন পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সমাবেশে কারও নাম উল্লেখ না করে বলেছেন, ‘কোনো দুর্নীতিবাজ ও অর্থ পাচারকারীকে রেহাই দেওয়া হবে না।’ দলের সাধারণ সম্পাদক ও মুখপাত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, দুর্নীতিবাজ ও গ্রেনেড-বোমা হামলার হোতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে জয়ের তুলনা করা চলে না। এই বাগ্যুদ্ধটা রাজপথে স্থানান্তরিত হলে আবার দেশবাসীকে হরতাল ও অবরোধের যুগে ফিরে যেতে হবে।
নির্বাচনের পর থেকেই বিএনপি সংসদের ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে আসছিল। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচনী ফলাফলও মানতে চাননি। তবে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা যখন নির্বাচনকে আগের সব নির্বাচনের চেয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে সার্টিফিকেট দিলেন, তখন তিনি অবস্থান বদলাতে বাধ্য হন। তা ছাড়া সে সময় দলের সাংগঠনিক অবস্থা এতটাই নাজুক ছিল যে ‘ফলাফল মানি না’ বলে রাজপথ গরম করাও কঠিন ছিল। গত এক বছরে বিএনপি অনেকটাই গুছিয়ে নিতে পেরেছে; বিশেষ করে, ৮ ডিসেম্বরের কাউন্সিল সামনে রেখে তারা তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক শক্তি বাড়িয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের কারণে কারাগারে আটক ছিলেন এমন নেতারা বাইরে এসে আন্দোলনের কর্মসূচি নিতে শীর্ষ নেতৃত্বকে চাপ দিচ্ছেন। কথিত সংস্কারপন্থীরা আরও কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।
এ অবস্থায় বিএনপি কী করবে? তারা কি সংসদে গিয়ে সরকারকে আরও কিছুটা সময় দেবে, না এখনই আন্দোলনের প্রস্তুতি নেবে? এ নিয়ে দলের মধ্যে মতভেদ আছে। দলের উদারপন্থী অংশ সরকারকে সময় দেওয়ার পক্ষপাতী। কট্টরপন্থী অংশ কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়। তারা ধরেই নিয়েছে, সরকার তাদের দাবি মানবে না, অতএব সংসদেও যাওয়ার প্রশ্ন নেই। তবে এ মুহূর্তে বিএনপি স্থায়ী বর্জন বা পদত্যাগের চিন্তাও করছে না। সংবিধান অনুযায়ী, একজন সাংসদ একনাগাড়ে ৯০ দিন অনুপস্থিত থাকলে তাঁর সদস্যপদ বাতিল হবে। সেই ৯০ দিন পূরণ হওয়ার আগেই তাঁরা এক দিন সংসদে হাজিরা দিয়ে নিজেদের সদস্যপদ রক্ষা করবেন।
অর্থাত্ বিএনপি সংসদ কার্যকর করার বদলে নিয়ম রক্ষার নীতি নিয়ে এগোতে চাইছে। তাতে সদস্যপদও বাঁচবে, স্থায়ী বর্জনের অপবাদ থেকেও রেহাই পাওয়া যাবে।
সম্ভবত সেটাই হবে খ্রিষ্টীয় নতুন বছরে দেশবাসী ও গণতন্ত্রের সঙ্গে বিএনপির ‘শ্রেষ্ঠ তামাশা’।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ সব দলই সংসদকে রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র করা হবে বলে দেশবাসীর কাছে অঙ্গীকার করেছিল। কীভাবে সংসদ কার্যকর হতে পারে, কীভাবে সরকারি ও বিরোধী দল সংসদে কাজ করতে পারে, তার একটি রূপরেখাও তারা তুলে ধরেছিল। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলনকেন্দ্রে আয়োজিত জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বিরোধী দল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার নেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সংসদের প্রথম অধিবেশনের দিনই দেশবাসী হোঁচট খেল, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার—দুজনকেই সরকারি দল থেকে নেওয়ায়। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পরে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তাও গ্রহণযোগ্য নয়।
তার পরও উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাংসদদের উপস্থিতি জনমনে কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করেছিল। তারা ভেবেছিল, হয়তো রাজনৈতিক দলগুলো সংসদকে কার্যকর করতে সচেষ্ট হবে; অতীতের বর্জন-সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসবে।
গত এক বছরে তার কোনো লক্ষণ নেই। দেশবাসী গভীর উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠার সঙ্গে প্রত্যক্ষ করল, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তার দুই সহযোগী জামায়াতে ইসলামী ও বিজেপির সাংসদেরা সামনের সারিতে আসন বাড়ানোর দাবিতে সেই যে অধিবেশনকক্ষ ত্যাগ করলেন, আর ফিরে এলেন না। এরপর সময় যত গড়াতে থাকল, তাঁদের দাবির তালিকাও দীর্ঘ হতে লাগল। আর সে তালিকা বাড়াতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অবদানও কম নয়। যেমন, আইনের খুঁটিনাটি বিষয় যাচাই না করেই খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাড়ি ছাড়তে নোটিশ জারি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারে বৈষম্যমূলক নীতি, বিরোধীদলীয় নেতার নিরাপত্তা বাহিনীর জনবল কমানো, তাঁর সেনানিবাসের বাড়িতে দর্শনার্থীদের যেতে বাধাদান। বিএনপির আমলে সরকারের যেসব গণবিরোধী ও হয়রানিমূলক পদক্ষেপের কঠোর সমালোচনা করেছে আওয়ামী লীগ, ক্ষমতায় গিয়ে তারাও যদি একই কাজ করে, সেগুলো জনগণ কীভাবে নেবে?
কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই বিএনপি সংসদ বর্জন করে চলেছে। এমনকি ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনেও তারা যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। জাতীয় সংসদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন হলো বাজেট অধিবেশন। এতে বেশির ভাগ সাংসদ বাজেট নিয়ে যেমন আলোচনার সুযোগ পান, তেমনি নিজ এলাকার জনগণের অভাব-অভিযোগও তুলে ধরতে পারেন। যে এলাকাবাসী তাদের পক্ষে কথা বলার জন্য জনপ্রতিনিধিদের সংসদে পাঠিয়েছে, তাদের বঞ্চিত করার অধিকার তাঁদের নেই।
সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি যেসব অভিযোগ এনেছে, সেগুলো সর্বাংশে সত্য হলেও লাগাতার সংসদ বর্জনের কোনো যুক্তি নেই। তাঁরা সংসদেও যাবেন না, আবার এলাকার জনপ্রতিনিধিও থাকবেন—এই স্ববিরোধী নীতি চলতে পারে না। বিএনপির অভিযোগ, সরকার বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। সংসদে বিরোধী দলকে অযথা গালাগাল করা হয়, সরকারি দল বিভিন্ন স্থানে তাদের সভা-সমাবেশ পণ্ড করে দিচ্ছে। এসব অন্যায়ের প্রতিকার চাইতেও বিএনপির সাংসদদের উচিত সংসদে গিয়ে কথা বলা, প্রতিবাদ করা। বর্তমান জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের আসন খুব কম হলেও বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ ও বর্ষীয়ান সাংসদ আছেন। তত্কালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলের আসন ছিল আরও কম। তার পরও সরকারের কোনো আইন বা পদক্ষেপকে তারা বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশেও বাহাত্তরে গণপরিষদ মাতিয়ে রেখেছিলেন বিরোধী পক্ষের মাত্র দুজন সাংসদ, ন্যাপের সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতা) ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। ঊনআশিতে গঠিত জিয়াউর রহমানের সংসদেও আওয়ামী লীগের ৩৯ জন সাংসদ সরকারি দলকে স্বস্তিতে থাকতে দেননি। আসলে, বিরোধী দলের সদস্যসংখ্যা নয়, সংসদের প্রতি তাঁদের আস্থা আছে কি না, তার ওপরই সংসদের কার্যকারিতা নির্ভর করে। বিগত দুটি সংসদেই বিরোধীদলীয় নেতার (যথাক্রমে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা) কাছে দলীয় সাংসদেরা পদত্যাগপত্র জমা রেখে দিয়েছিলেন, যাতে কেউ দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করতে না পারেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে, অনেকে একে সাংসদদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ বলেও মনে করেন। কিন্তু বিরোধী দলে থাকতে দলীয় নেতার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে রাখাকে কীভাবে দেখা যায়? প্রথমটি ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ হলে, দ্বিতীয়টি দাস্য মনোবৃত্তির পরিচায়ক।
জাতীয় সংসদের অধিবেশন যত ঘনিয়ে আসছে, সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে বাগ্যুদ্ধও তত তীব্র হচ্ছে। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দেখে নেওয়ার এবং দেখিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ইঙ্গিত দিয়েছেন, সরকার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না করলে তাঁরা আগামী অধিবেশনে যাবেন না। দলের নতুন জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব ও ভবিষ্যত্ মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে নতুন ধারার রাজনীতি শুরু করার কথাও বলেছেন। সংসদে না গিয়ে কি সেটি সম্ভব?
প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপি সংসদে যাবে কি যাবে না। বিএনপির নেতারা সংসদে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যেসব শর্ত পূরণের কথা বলেছেন, তা আসল দাবি নয় বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন। নানা শর্তের আড়ালে বিএনপি দুটো দাবি নিয়েই এগোচ্ছে। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহার; দুই. দেশে ফেরার পর তারেক রহমানকে হয়রানি বা গ্রেপ্তার না করা।
তারেক রহমানের ব্যাপারে বিএনপিতে মতদ্বৈধ আগেও ছিল, এখনো আছে। দলের অপেক্ষাকৃত উদারপন্থীরা চেয়েছিলেন, আরও কিছু সময় পর তাঁকে সামনে নিয়ে আসতে। কিন্তু কট্টরপন্থীরা কাউন্সিলের মাধ্যমেই তারেককে বিকল্প নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। সাড়ম্বরে জন্মদিন পালন, পোস্টারে সবার আগে ছবি বসানো, ভিডিও কনফারেন্সে বক্তৃতার আয়োজন—সবই ছিল তাঁর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের অংশ। দলের কট্টরপন্থী অংশ তারেককে কো-চেয়ারম্যান করার প্রস্তাবও দিয়েছিল, অবশ্য কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার মৃদু আপত্তিতে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদেই সন্তুষ্ট থাকেন।
৮ ডিসেম্বরের কাউন্সিলের আগে তারেক রহমান ছিলেন দলের চেয়ারপারসনের জ্যেষ্ঠ পুত্র ও সাবেক জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব। কাউন্সিলে সর্বসম্মতিক্রমে তাঁকে নতুন পদে বরণ করায় তাঁর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব সবাইকে মানতে হবে। এখন তারেকের বিরুদ্ধে মামলা হলে বা দেশে ফিরতে তাঁকে বাধা দেওয়া হলে বিএনপি অনায়াসে তাঁকে আন্দোলনের ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে।
বিএনপির এই রাজনৈতিক চালকে সরকার কীভাবে নেয়, তার ওপরই রাজনীতির গতিবিধি নির্ধারিত হবে। সরকারি দলের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক জবাব না পাওয়া গেলেও প্রধানমন্ত্রীসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তা কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়। তারেক রহমান বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার এক দিন পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সমাবেশে কারও নাম উল্লেখ না করে বলেছেন, ‘কোনো দুর্নীতিবাজ ও অর্থ পাচারকারীকে রেহাই দেওয়া হবে না।’ দলের সাধারণ সম্পাদক ও মুখপাত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, দুর্নীতিবাজ ও গ্রেনেড-বোমা হামলার হোতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে জয়ের তুলনা করা চলে না। এই বাগ্যুদ্ধটা রাজপথে স্থানান্তরিত হলে আবার দেশবাসীকে হরতাল ও অবরোধের যুগে ফিরে যেতে হবে।
নির্বাচনের পর থেকেই বিএনপি সংসদের ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে আসছিল। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচনী ফলাফলও মানতে চাননি। তবে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা যখন নির্বাচনকে আগের সব নির্বাচনের চেয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে সার্টিফিকেট দিলেন, তখন তিনি অবস্থান বদলাতে বাধ্য হন। তা ছাড়া সে সময় দলের সাংগঠনিক অবস্থা এতটাই নাজুক ছিল যে ‘ফলাফল মানি না’ বলে রাজপথ গরম করাও কঠিন ছিল। গত এক বছরে বিএনপি অনেকটাই গুছিয়ে নিতে পেরেছে; বিশেষ করে, ৮ ডিসেম্বরের কাউন্সিল সামনে রেখে তারা তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক শক্তি বাড়িয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের কারণে কারাগারে আটক ছিলেন এমন নেতারা বাইরে এসে আন্দোলনের কর্মসূচি নিতে শীর্ষ নেতৃত্বকে চাপ দিচ্ছেন। কথিত সংস্কারপন্থীরা আরও কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।
এ অবস্থায় বিএনপি কী করবে? তারা কি সংসদে গিয়ে সরকারকে আরও কিছুটা সময় দেবে, না এখনই আন্দোলনের প্রস্তুতি নেবে? এ নিয়ে দলের মধ্যে মতভেদ আছে। দলের উদারপন্থী অংশ সরকারকে সময় দেওয়ার পক্ষপাতী। কট্টরপন্থী অংশ কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়। তারা ধরেই নিয়েছে, সরকার তাদের দাবি মানবে না, অতএব সংসদেও যাওয়ার প্রশ্ন নেই। তবে এ মুহূর্তে বিএনপি স্থায়ী বর্জন বা পদত্যাগের চিন্তাও করছে না। সংবিধান অনুযায়ী, একজন সাংসদ একনাগাড়ে ৯০ দিন অনুপস্থিত থাকলে তাঁর সদস্যপদ বাতিল হবে। সেই ৯০ দিন পূরণ হওয়ার আগেই তাঁরা এক দিন সংসদে হাজিরা দিয়ে নিজেদের সদস্যপদ রক্ষা করবেন।
অর্থাত্ বিএনপি সংসদ কার্যকর করার বদলে নিয়ম রক্ষার নীতি নিয়ে এগোতে চাইছে। তাতে সদস্যপদও বাঁচবে, স্থায়ী বর্জনের অপবাদ থেকেও রেহাই পাওয়া যাবে।
সম্ভবত সেটাই হবে খ্রিষ্টীয় নতুন বছরে দেশবাসী ও গণতন্ত্রের সঙ্গে বিএনপির ‘শ্রেষ্ঠ তামাশা’।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments