নয়ন-চয়নের নাও by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
হাঁটুপানি। অনেকে হেঁটেই পার হচ্ছেন। মেয়েরা এবং যাঁরা পায়ের জুতা খুলে পানিতে নামতে চাইছেন না, তাঁদের জন্য আছে নৌকা। নৌকার ওপর উঠে দাঁড়ালেই হাফপ্যান্ট পরা নয়ন, আর ফুল প্যান্ট পরা চয়ন—দুই ভাই পানিতে নেমে নৌকা টেনে ওপারে ভেড়াচ্ছে। একজন গলুইয়ের আগা ধরে টানছে, আরেকজন পিছে ঠেলছে। বড়জনের বয়স বড়জোর ১০ আর ছোটজনের ছয়-সাত। কাজ নেই। স্কুলেও যায় না। শুধু খেলেই বেড়ায়। পাড়ার এক মাতব্বর তাঁর পড়ে থাকা নৌকাখানা দিয়েছেন। তাই নিয়ে দুই ভাই সারা দিন এপার-ওপার করে। মালিককে কিছুই দিতে হয় না। তাই দুই টাকা পারানির পুরোটাই দুই ভাইয়ের।
রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধের বুলনপুর এলাকার নিচে পদ্মা নদীর খেয়াঘাটের এই হাঁটুপানিতে দুই ভাইয়ের নৌকা নিয়ে সারা দিনের লুটোপুটি। হাতে ক্যামেরা দেখে ছোট ভাই চয়ন ফোকলা দাঁতে ফিক করে হেসে বলে, ‘আমাদের একটা ছবি তোলেন না!’ জানতে চাই, সারা দিনে কত হয় ওদের। নয়ন নৌকা টানতে টানতে বলে, ‘ওই...হয়।’ বলতে চায় না, মোট কত ওঠে। চয়ন বলে, ‘১০০ টাকার মতো হয়।’ ‘কী করিস এত টাকা?’
নৌকায় ঠেলা দিয়ে দম ছাড়তে ছাড়তে চয়ন বলে, ‘মা কিস্তির লাইগ্যা দৌড়ে বেড়ায়।’ বুঝতে পারি, কিস্তি মানে এনজিও থেকে নেওয়া কিস্তিতে পরিশোধ্য ঋণ। এই টাকা নিয়ে ওরা কি বাড়িঘর বানিয়েছে? ঘাটে নেমে নয়নকে শুধাই, ‘বাবা কী করে রে?’ ‘রিস্কা চালায়।’ ‘নাম কী?’ ‘মাসুম।’ ‘মা কী করে?’ ‘কিছু না।’
এ সময় নৌকা থেকে নামছিলেন বুলনপুরের কৃষক দেলোয়ার হোসেন। আঙুল তুলে দেখালেন, ওই যে ওদের মা রিনা বেগম। দেখি, বাঁধের ওপর থেকে চোখেমুখে উত্কণ্ঠা নিয়ে একজন নারী নেমে আসছেন। বয়স ২৮-৩০ বছর হবে। কাছে এসে নিজের থেকেই জানতে চাইলেন, তাঁর ছেলেদের কিছু হয়েছে কি না। তাঁদের সংসারের খবর নিতে চাইলে ভয় পান। তারপর আস্তে আস্তে বলতে থাকলেন, ছেলের বাবার সঙ্গে মাসখানেক আগে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। ‘সে মাতাল। সারা দিন রিকশা চালিয়ে যা হয়, নিজেই হেরোইন খেয়ে শেষ করে দেয়। বলতে গেলেই বিপত্তি। বাড়িঘর নাই। এখানে বস্তিতে একাই বড় হয়েছে। যাওয়ার জায়গাও নাই।’ রিনা বেগমের গলায় বেশ বড় একটা আঁচড়ের দাগ দেখে মনে হলো, তিনি আত্মহত্যার জন্য গলায় দড়ি দিয়েছিলেন। কোনোভাবে হয়তো বেঁচে গেছেন। কিন্তু না, প্রসঙ্গ তুলতেই রিনা বেগমের মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে। তাড়াতাড়ি করে হাত দিয়ে দাগটা আড়াল করার চেষ্টা করেন। বললেন, ‘ওই শুইনেন না। স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার। নয়নের বাপের ঠেকেই একটু লেগেছিল।’ ‘কেন, আপনাদের না ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে?’
বেশ আহ্লাদ ভরা কণ্ঠে এবার রিনা বেগম বলেন, ‘তাও আসে। জোর করে ভাত খেয়ে যায়। না দিতে চাইলেই ঝামেলা করে। সংসারে কোনো খরচও দেয় না।’
কথা বলতে বলতে আমরা বাঁধের ওপরে উঠে আসি। বটগাছের পাশে খোলা জায়গায় একটা ভাতের হাঁড়ি থেকে মাড় গড়িয়ে পড়ছে। দৌড়ে গিয়ে রিনা বেগম হাঁড়ি সামলাতে লাগলেন। পাশেই তিন দিকে ইট দিয়ে ঘেরা ওপরে কয়খান টিনে ছাওয়া একটা ঘর। চৌকিতে একটা বিছানা। রিনা বেগম বললেন, ‘আমিনুল ব্যাপারির ঘর। পড়েই থাকে। আমাদের কাছ থেকে ভাড়া নেয় না। এখানেই থাকি। বাসাবাড়িতে কাজ করি।’
সুযোগ বুঝে কথা তুললাম, ‘বিনা ভাড়ায় থাকেন, তো কিস্তির টাকা তুলে কী করেছেন?’ ‘মিথ্যা কথা বলব না,’ রিনা বেগম গরগর করে বলতে লাগলেন, ‘আমার একটা মেয়ে আছে। নাম টুকটুকি। ১৪ বছর বয়স। বিয়ে দিয়েছি।’
মনে হলো, এনজিও থেকে টাকা তুলে রিনা বেগম মেয়ের বিয়েতে খরচ করেছেন, কিন্তু বললেন অন্য কথা। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে তাঁর মেয়েটা ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজে গিয়েছিল। ওখান থেকে বান্ধবীদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে রাজবাড়ীতে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। এখন হাজতে আছে। ‘এখন আমি মা হয়ে জাবিন চাচ্ছি, ম্যাসটেট জাবিন দিচ্ছে না। মেয়েকে বের করার জন্য গ্রামীণ শক্তি এনজিও থেকে ছয় হাজার টাকা তুলেছিনু। সব খরচ হয়ে যাচ্ছে। মেয়েকে বের করতে পারছি না।’ বলতে বলতে চোখ ভিজে ওঠে তাঁর। ‘মেয়ের ছবি আছে। দেখেন, আমার ছোট মেয়ে, কিচ্ছু বোঝে না।’ ঘরের ভেতর থেকে একটা ছবি বের করে আনলেন রিনা বেগম, কিন্তু ছবিটার অর্ধেক ছেঁড়া। জিজ্ঞেস করার আগেই রিনা বেগম বললেন, জামাই-মেয়ে একসঙ্গে ছবি তুলেছিল। সেদিন রাগ করে জামাই মাঝখান দিয়ে ছিঁড়ে আলাদা করে দিয়ে গেছে। রিনা বেগমকে হালকা করার জন্য বলি, ‘আপনার ভাত তো হয়ে গেছে, আজকেও নয়নের বাবা খেতে আসবে নাকি?’
এবার একগাল হেসে রিনা বেগম হাত তুলে বললেন, ‘ওই দেখেন, নয়নের বাপ নদীতে গোসল করছে। যাইয়ে শুধান খাবে নাকি।’ বলতে বলতে আবার রিনা বেগমের মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। আমাদের পাশেই নয়ন-চয়ন দাঁড়িয়ে ছিল। এই ফাঁকে দেখি, ওরা নৌকা টানতে টানতে আবার ওপারে চলে গেছে। মনে হলো, হায় রে পদ্মা নদী, নয়ন-চয়নের সংসারের মতোই তোমার অবস্থা!
রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধের বুলনপুর এলাকার নিচে পদ্মা নদীর খেয়াঘাটের এই হাঁটুপানিতে দুই ভাইয়ের নৌকা নিয়ে সারা দিনের লুটোপুটি। হাতে ক্যামেরা দেখে ছোট ভাই চয়ন ফোকলা দাঁতে ফিক করে হেসে বলে, ‘আমাদের একটা ছবি তোলেন না!’ জানতে চাই, সারা দিনে কত হয় ওদের। নয়ন নৌকা টানতে টানতে বলে, ‘ওই...হয়।’ বলতে চায় না, মোট কত ওঠে। চয়ন বলে, ‘১০০ টাকার মতো হয়।’ ‘কী করিস এত টাকা?’
নৌকায় ঠেলা দিয়ে দম ছাড়তে ছাড়তে চয়ন বলে, ‘মা কিস্তির লাইগ্যা দৌড়ে বেড়ায়।’ বুঝতে পারি, কিস্তি মানে এনজিও থেকে নেওয়া কিস্তিতে পরিশোধ্য ঋণ। এই টাকা নিয়ে ওরা কি বাড়িঘর বানিয়েছে? ঘাটে নেমে নয়নকে শুধাই, ‘বাবা কী করে রে?’ ‘রিস্কা চালায়।’ ‘নাম কী?’ ‘মাসুম।’ ‘মা কী করে?’ ‘কিছু না।’
এ সময় নৌকা থেকে নামছিলেন বুলনপুরের কৃষক দেলোয়ার হোসেন। আঙুল তুলে দেখালেন, ওই যে ওদের মা রিনা বেগম। দেখি, বাঁধের ওপর থেকে চোখেমুখে উত্কণ্ঠা নিয়ে একজন নারী নেমে আসছেন। বয়স ২৮-৩০ বছর হবে। কাছে এসে নিজের থেকেই জানতে চাইলেন, তাঁর ছেলেদের কিছু হয়েছে কি না। তাঁদের সংসারের খবর নিতে চাইলে ভয় পান। তারপর আস্তে আস্তে বলতে থাকলেন, ছেলের বাবার সঙ্গে মাসখানেক আগে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। ‘সে মাতাল। সারা দিন রিকশা চালিয়ে যা হয়, নিজেই হেরোইন খেয়ে শেষ করে দেয়। বলতে গেলেই বিপত্তি। বাড়িঘর নাই। এখানে বস্তিতে একাই বড় হয়েছে। যাওয়ার জায়গাও নাই।’ রিনা বেগমের গলায় বেশ বড় একটা আঁচড়ের দাগ দেখে মনে হলো, তিনি আত্মহত্যার জন্য গলায় দড়ি দিয়েছিলেন। কোনোভাবে হয়তো বেঁচে গেছেন। কিন্তু না, প্রসঙ্গ তুলতেই রিনা বেগমের মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে। তাড়াতাড়ি করে হাত দিয়ে দাগটা আড়াল করার চেষ্টা করেন। বললেন, ‘ওই শুইনেন না। স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার। নয়নের বাপের ঠেকেই একটু লেগেছিল।’ ‘কেন, আপনাদের না ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে?’
বেশ আহ্লাদ ভরা কণ্ঠে এবার রিনা বেগম বলেন, ‘তাও আসে। জোর করে ভাত খেয়ে যায়। না দিতে চাইলেই ঝামেলা করে। সংসারে কোনো খরচও দেয় না।’
কথা বলতে বলতে আমরা বাঁধের ওপরে উঠে আসি। বটগাছের পাশে খোলা জায়গায় একটা ভাতের হাঁড়ি থেকে মাড় গড়িয়ে পড়ছে। দৌড়ে গিয়ে রিনা বেগম হাঁড়ি সামলাতে লাগলেন। পাশেই তিন দিকে ইট দিয়ে ঘেরা ওপরে কয়খান টিনে ছাওয়া একটা ঘর। চৌকিতে একটা বিছানা। রিনা বেগম বললেন, ‘আমিনুল ব্যাপারির ঘর। পড়েই থাকে। আমাদের কাছ থেকে ভাড়া নেয় না। এখানেই থাকি। বাসাবাড়িতে কাজ করি।’
সুযোগ বুঝে কথা তুললাম, ‘বিনা ভাড়ায় থাকেন, তো কিস্তির টাকা তুলে কী করেছেন?’ ‘মিথ্যা কথা বলব না,’ রিনা বেগম গরগর করে বলতে লাগলেন, ‘আমার একটা মেয়ে আছে। নাম টুকটুকি। ১৪ বছর বয়স। বিয়ে দিয়েছি।’
মনে হলো, এনজিও থেকে টাকা তুলে রিনা বেগম মেয়ের বিয়েতে খরচ করেছেন, কিন্তু বললেন অন্য কথা। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে তাঁর মেয়েটা ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজে গিয়েছিল। ওখান থেকে বান্ধবীদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে রাজবাড়ীতে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। এখন হাজতে আছে। ‘এখন আমি মা হয়ে জাবিন চাচ্ছি, ম্যাসটেট জাবিন দিচ্ছে না। মেয়েকে বের করার জন্য গ্রামীণ শক্তি এনজিও থেকে ছয় হাজার টাকা তুলেছিনু। সব খরচ হয়ে যাচ্ছে। মেয়েকে বের করতে পারছি না।’ বলতে বলতে চোখ ভিজে ওঠে তাঁর। ‘মেয়ের ছবি আছে। দেখেন, আমার ছোট মেয়ে, কিচ্ছু বোঝে না।’ ঘরের ভেতর থেকে একটা ছবি বের করে আনলেন রিনা বেগম, কিন্তু ছবিটার অর্ধেক ছেঁড়া। জিজ্ঞেস করার আগেই রিনা বেগম বললেন, জামাই-মেয়ে একসঙ্গে ছবি তুলেছিল। সেদিন রাগ করে জামাই মাঝখান দিয়ে ছিঁড়ে আলাদা করে দিয়ে গেছে। রিনা বেগমকে হালকা করার জন্য বলি, ‘আপনার ভাত তো হয়ে গেছে, আজকেও নয়নের বাবা খেতে আসবে নাকি?’
এবার একগাল হেসে রিনা বেগম হাত তুলে বললেন, ‘ওই দেখেন, নয়নের বাপ নদীতে গোসল করছে। যাইয়ে শুধান খাবে নাকি।’ বলতে বলতে আবার রিনা বেগমের মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। আমাদের পাশেই নয়ন-চয়ন দাঁড়িয়ে ছিল। এই ফাঁকে দেখি, ওরা নৌকা টানতে টানতে আবার ওপারে চলে গেছে। মনে হলো, হায় রে পদ্মা নদী, নয়ন-চয়নের সংসারের মতোই তোমার অবস্থা!
No comments