আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হলো কার -স্মরণ by শারমিনী আব্বাসী
দক্ষিণের আকাশে মেঘ ডাকলে নদীর কোল ভরে ওঠে। আকাশের দ্রিম দ্রিম শব্দে ছোট মাছের বুক কাঁপে। খোলা পাটক্ষেতে পট পট শব্দে পাট ভাঙার শব্দ ভাসে। ভোররাত থেকে ঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছে কৃষাণীরা। তার ছন্দময় লয় শোনা যায়। নতুন বউ বাপের বাড়ি যাচ্ছে। তার নতুন শাড়ির পাড়েরও তো একটা খসসর-মসসর শব্দ আছে, ছন্দ আছে। আর কালজানির বিস্তীর্ণ জলরাশিজুড়ে সুরের সাম্পান। সবই আমোঘ অলৌকিক অতিন্দ্রীয় হয়ে ধরা পড়ে কিশোর আব্বাসের শ্রবণেন্দ্রিয়ের সঞ্চয়ে। তাই সে স্কুল ফিরতি পথে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে কণ্ঠে তুলে নেয় সুর। সেই আব্বাসই কালের কপোলতলে সুরসম্রাট আব্বাসউদ্দিন আহমদ, সংগীতের জাদুস্পর্শে যিনি একদা পশ্চাত্পদ তত্কালীন মুসলমান সমাজে কুসংস্কার ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ঘটিয়েছিলেন রক্তহীন বিপ্লব, সুর ও বাণীর মায়া দিয়ে। আজকের বাংলাদেশ তাই তাঁর কাছে চিরঋণী; আজকের সংগীত বিস্তৃত নীলাকাশ, খোলা পরিসর পেয়েছে যে একজন কিংবদন্তির সংগীত প্রতিভার বিরল সংগ্রামে, বেগবান হয়েছে সংগীতের খরস্রোতা নদী যাঁর কল্যাণে।
তাই আজ তাঁর জন্মের ১০৮ বছর পরও পদ্মা নদীর ওপর ছইতোলা নৌকার লাউড স্পিকারে যখন বাজে:
‘তোরষা নদীর উথাল পাথাল
কার চলে বা নাও
সোনা বন্ধুর বাদে রে মোর
কেমন করে গাও’
অমনি চকিতে বাংলার মানুষ চিনে নেয়, ওই তো আব্বাসের গান। তেমনি সময়ের সুকণ্ঠ অর্ণবের টাটকা সিডিতে যখন বাজে ‘নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে’...ভক্তহূদয় চিনে নেয়, এ যে ‘উড়ালি বিড়ালী’ আব্বাসেরই গান।
আমার দাদু আব্বাসউদ্দিনকে আমি পাইনি, পেয়েছি তাঁর হাসিভরা ছবি। পেয়েছি তাঁর অমর লেখা জীবনীগ্রন্থ আমার শিল্পী জীবন-এর কথা, যেখানে পাওয়া যায় কলকাতা থেকে বঙ্গভঙ্গের পর বাংলাদেশে এলে পুরানা পল্টনের বাড়িতে তাঁর পরিবার নিয়ে পুনর্বার সংসার পাতার রোজনামচা।
বাড়ির সামনে ছিল অপূর্ব কেয়ারি করা ইউরোপীয় ধাঁচের লন। তাতে নানা ফুলের সমাহার। এই সবুজের মালাকার আর কেউ নন, আব্বাস। পেয়েছি তাঁর রেখে যাওয়া প্রায় ৭০০ গানের বাণী ও রেকর্ড। আমাদের পুরোনা গ্রামোফোনটি, যেটি দাদু পেয়েছিলেন গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে তাঁর ফেলে আসা গানের পুরস্কার হিসেবে, আজ তা ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে সজ্জিত।
পুরানা পল্টনের বাড়িতে প্রতিটি ঘরে শোভা পেত তাঁর শিল্পীজীবনের অনুরণন, যেন সে বাড়ির কড়ি-বরগা-অলিন্দ থেকে উত্সারিত হতো সুরের ধারা। এই সুর হূদয়ের গহিন থেকে, কল্পলোকের বিস্তার থেকে, সাধনার বেদিমূলে অঙ্কুরিত। চেনা জীবনের অচেনা স্টেশনে গ্রথিত যে সংগীত, সেই সংগীতের কথা বলছি। ঘরে ঘরে কৃতী সংগীতজ্ঞদের ছবি শোভা পেত। আঙ্গুরবালা দেবী, কৃষ্ণচন্দ্র দে, কাজী নজরুলের ঝাঁকড়া চুল আন্দোলিত হতো।
আজ অবশ্য সংগীত শব্দটি প্রতিস্থাপিত হয়েছে মিউজিক দিয়ে। আব্বাসউদ্দিন বলে গিয়েছিলেন, সংগীতের ইতিহাস আছে, ভূগোল নেই। তাই সংগীত না মিউজিক, সে বিতর্কের অবকাশ নেই। আছে শুধু সমর্পণের স্তব্ধতা নিয়ে আজকের শিল্পী হওয়া মানে ‘যাকে খুঁজে ফেরে বাংলাদেশ’। সঙ্গে শিল্পীর করুণ আবেদন, আমাকে প্লিজ ‘এসএমএস’ করুন। সাজসজ্জা আর যন্ত্রের অনুষঙ্গকে তীব্র করে যে পাঁচ মিনিটের মাদকতা, তাতে চোখ তৃপ্ত হয়, হূদয় নয়।
এসবের একটি গান একটি বছর পরিক্রমণেও কেউ মনে রাখে না। কিন্তু আব্বাসউদ্দিনের গান শত বছর পরও গাইছে বাংলার মানুষ, গাইছে শচীনদেব বর্মণের গান, ফেলে যাওয়া লালন ফকিরের সুর।
‘আমার নেভা ছিল মনের আগুন
জ্বালাইয়া গেলি
আমায় এত রাতে কেনে ডাক দিলি।’
হ্যাঁ দাদু, আজ রাতের শেষে আশ্বিনের বৃষ্টি ধোয়া সকালে তোমার জন্মদিনে তোমায় মনে করছি। প্রার্থনা করছি, আমাদের রুক্ষ জনপদে, বিভ্রান্ত উদাস সময়ের পেরিয়ে যাওয়া দাম্ভিক দিনলিপিতে আবার যেন সংগীতের মধুর উদ্ভাসিত দিনগুলো ফিরে আসে, ফিরে আসে সুরের স্বপ্ন সবার প্রাণে।
তাই আজ তাঁর জন্মের ১০৮ বছর পরও পদ্মা নদীর ওপর ছইতোলা নৌকার লাউড স্পিকারে যখন বাজে:
‘তোরষা নদীর উথাল পাথাল
কার চলে বা নাও
সোনা বন্ধুর বাদে রে মোর
কেমন করে গাও’
অমনি চকিতে বাংলার মানুষ চিনে নেয়, ওই তো আব্বাসের গান। তেমনি সময়ের সুকণ্ঠ অর্ণবের টাটকা সিডিতে যখন বাজে ‘নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে’...ভক্তহূদয় চিনে নেয়, এ যে ‘উড়ালি বিড়ালী’ আব্বাসেরই গান।
আমার দাদু আব্বাসউদ্দিনকে আমি পাইনি, পেয়েছি তাঁর হাসিভরা ছবি। পেয়েছি তাঁর অমর লেখা জীবনীগ্রন্থ আমার শিল্পী জীবন-এর কথা, যেখানে পাওয়া যায় কলকাতা থেকে বঙ্গভঙ্গের পর বাংলাদেশে এলে পুরানা পল্টনের বাড়িতে তাঁর পরিবার নিয়ে পুনর্বার সংসার পাতার রোজনামচা।
বাড়ির সামনে ছিল অপূর্ব কেয়ারি করা ইউরোপীয় ধাঁচের লন। তাতে নানা ফুলের সমাহার। এই সবুজের মালাকার আর কেউ নন, আব্বাস। পেয়েছি তাঁর রেখে যাওয়া প্রায় ৭০০ গানের বাণী ও রেকর্ড। আমাদের পুরোনা গ্রামোফোনটি, যেটি দাদু পেয়েছিলেন গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে তাঁর ফেলে আসা গানের পুরস্কার হিসেবে, আজ তা ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে সজ্জিত।
পুরানা পল্টনের বাড়িতে প্রতিটি ঘরে শোভা পেত তাঁর শিল্পীজীবনের অনুরণন, যেন সে বাড়ির কড়ি-বরগা-অলিন্দ থেকে উত্সারিত হতো সুরের ধারা। এই সুর হূদয়ের গহিন থেকে, কল্পলোকের বিস্তার থেকে, সাধনার বেদিমূলে অঙ্কুরিত। চেনা জীবনের অচেনা স্টেশনে গ্রথিত যে সংগীত, সেই সংগীতের কথা বলছি। ঘরে ঘরে কৃতী সংগীতজ্ঞদের ছবি শোভা পেত। আঙ্গুরবালা দেবী, কৃষ্ণচন্দ্র দে, কাজী নজরুলের ঝাঁকড়া চুল আন্দোলিত হতো।
আজ অবশ্য সংগীত শব্দটি প্রতিস্থাপিত হয়েছে মিউজিক দিয়ে। আব্বাসউদ্দিন বলে গিয়েছিলেন, সংগীতের ইতিহাস আছে, ভূগোল নেই। তাই সংগীত না মিউজিক, সে বিতর্কের অবকাশ নেই। আছে শুধু সমর্পণের স্তব্ধতা নিয়ে আজকের শিল্পী হওয়া মানে ‘যাকে খুঁজে ফেরে বাংলাদেশ’। সঙ্গে শিল্পীর করুণ আবেদন, আমাকে প্লিজ ‘এসএমএস’ করুন। সাজসজ্জা আর যন্ত্রের অনুষঙ্গকে তীব্র করে যে পাঁচ মিনিটের মাদকতা, তাতে চোখ তৃপ্ত হয়, হূদয় নয়।
এসবের একটি গান একটি বছর পরিক্রমণেও কেউ মনে রাখে না। কিন্তু আব্বাসউদ্দিনের গান শত বছর পরও গাইছে বাংলার মানুষ, গাইছে শচীনদেব বর্মণের গান, ফেলে যাওয়া লালন ফকিরের সুর।
‘আমার নেভা ছিল মনের আগুন
জ্বালাইয়া গেলি
আমায় এত রাতে কেনে ডাক দিলি।’
হ্যাঁ দাদু, আজ রাতের শেষে আশ্বিনের বৃষ্টি ধোয়া সকালে তোমার জন্মদিনে তোমায় মনে করছি। প্রার্থনা করছি, আমাদের রুক্ষ জনপদে, বিভ্রান্ত উদাস সময়ের পেরিয়ে যাওয়া দাম্ভিক দিনলিপিতে আবার যেন সংগীতের মধুর উদ্ভাসিত দিনগুলো ফিরে আসে, ফিরে আসে সুরের স্বপ্ন সবার প্রাণে।
No comments