প্রান্তিকতা ও ভবিষ্যত্ প্রজন্মের অসুস্থতা -সমাজ ও নারী by বদিউল আলম মজুমদার
বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশেই স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুটি ‘প্যারাডক্স’ বা স্ববিরোধী বাস্তবতা লক্ষণীয়। একটি হলো যে এসব দেশে হূদরোগ ও বহুমূত্র রোগের হার ব্যাপক। এমনকি ক্যানসারের ব্যাপকতাও এসব দেশে তুলনামূলকভাবে বেশি। এসব দুরারোগ্য রোগবালাই সাধারণত প্রাচুর্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাই এগুলোকে ‘সমৃদ্ধির ব্যাধি’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি একটি পর্যায়ে পৌঁছালে, জীবনযাত্রা প্রণালি বদলে যায় এবং সচরাচর এসব ব্যাধি বিস্তার লাভ করতে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে এগুলো ক্রমাগতভাবে বাড়ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে। যেমন, এসব দেশে হূদরোগে মৃত্যুর হার পশ্চিমা দেশগুলোর থেকেও বেশি।
অনুন্নত দেশগুলোয় সাধারণত পানিবাহিত ও সংক্রামক ব্যাধি ব্যাপক। যেমন, বাংলাদেশে প্রতি বছর কয়েক লাখ শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মানুষ ‘অনুন্নয়নের ব্যাধি’র সঙ্গে সঙ্গে ‘সমৃদ্ধির ব্যাধি’তেও অধিক হারে আক্রান্ত হচ্ছে। অর্থাত্ এসব দেশে দুই ধরনের রোগই ‘ওভারল্যাপ’ বা যুগপত্ভাবে বিরাজ করছে। এ যেন এক বিরাট গোলক ধাঁধা!
দ্বিতীয় রহস্যটি হলো দক্ষিণ এশিয়ায়। বিশেষত বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে স্বল্প ওজনের শিশুর জন্মের হার ও শিশুদের মধ্যে পুষ্টিহীনতা ব্যাপক। এমনকি সাব-সাহারান আফ্রিকার তুলনায়ও। অর্থনৈতিক অনুন্নয়নের সঙ্গে পুষ্টিহীনতার একটি সম্পর্ক রয়েছে বলে সাধারণত ধরে নেওয়া হয়। অর্থাত্ অধিক উন্নত দেশে পুষ্টিহীনতার হার অপেক্ষাকৃত কম। সাব-সাহারান আফ্রিকার তুলনায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান অপেক্ষাকৃত উন্নত। তবুও পুষ্টির দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার এসব দেশ অনেক পেছনে, যা নিঃসন্দেহে রহস্যজনক।
বিজ্ঞানীদের মতে, এ দুটি রহস্যের—স্বল্প ওজনের শিশুর জন্ম ও পুষ্টিহীনতার হার এবং পরিণত বয়সে হূদরোগ, বহুমূত্র রোগ ও ক্যানসারের ব্যাপকতার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র রয়েছে। এগুলোর আরও যোগসূত্র রয়েছে সমাজে নারীর বিদ্যমান অবস্থার সঙ্গে। চিকিত্সা বিজ্ঞানীরা দাবি করেন, যেসব দেশে নারীদের অবস্থা যত বেশি প্রান্তিক, সেসব দেশে স্বল্প ওজনের শিশুর জন্মের ও শিশুর অপুষ্টির হার তত বেশি। আবার সেসব দেশের মানুষদের মধ্যেই হূদরোগ, বহুমূত্র রোগ ও ক্যানসারের ব্যাপকতাও বেশি। অন্যভাবে বলতে গেলে মায়ের সুস্বাস্থ্য আর সন্তানের ভবিষ্যত্ সুস্বাস্থ্য একই সুতায় গাঁথা। কিন্তু কেন? কীভাবে এ যোগসূত্রতার সৃষ্টি হয়?
মনে রাখা প্রয়োজন যে দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে পুরুষতন্ত্রের মানসিকতা অত্যন্ত প্রকট। ফলে এসব দেশে নারীরা অপেক্ষাকৃত অধিক অধঃস্তন। তারা অধিকতর বঞ্চিত, নিপীড়িত ও অবহেলিত। উদাহরণস্বরূপ, জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (রিপোর্ট) সর্বশেষ ‘বংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০০৭’ অনুযায়ী, বাংলাদেশের শতকরা ৬০ ভাগ নারী বিবাহিত জীবনে স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত হন। তারা অধিক হারে বৈষম্যেরও শিকার। অর্থাত্ এসব দেশে নারীদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক —এক কথায় প্রান্তিক।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নারী-পুরুষের বৈষম্য শুরু হয় বাল্যকাল থেকেই। উদাহরণস্বরূপ এসব দেশে পাঁচ বছরের নিচের কন্যাশিশুদের অপুষ্টির হার ছেলে শিশুদের তুলনায় অধিক। এসব অপুষ্ট শিশুদের অনেকেই, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে, বাল্যকালেই মৃত্যুবরণ করে। কন্যাশিশুদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকে তাদের অনেকে কিশোরী বয়সে শিক্ষা, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত হয়। বঞ্চিত হয় চলাফেরার স্বাধীনতা ও বিনোদন থেকে। বিশেষত গ্রামীণ সমাজে অনেকে চার দেয়ালের মধ্যে আটকা পড়ে যায় এবং পারিবারিক ও গৃহস্থালির কার্যক্রমে জড়িত হতে বাধ্য হয়।
বয়ঃসন্ধিক্ষণেই কিশোরীদের অনেকের বিয়ে হয়ে যায়। যেমন, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৬৬ শতাংশ। আর এদের অধিকাংশই দ্রুত, পরিণত বয়সের আগেই গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এসব গর্ভবতী মায়েরা নিজেরাও অপুষ্টিতে ভোগে এবং নিজেরা শারীরিক এবং মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়ার আগেই মা হয়ে যায়। আর এসব অপুষ্ট ও অধিকারবঞ্চিত মায়েরাই পরবর্তী সময়ে স্বল্প ওজনের শিশুর জন্ম দেয়। এভাবে আমাদের সমাজে একটি ‘অপুষ্টির দুষ্টচক্র’ সৃষ্টি হয় এবং আজন্ম বঞ্চনার কারণে দুর্ভাগ্যবশত নারীরাই হয়ে পড়ে এ দুষ্টচক্রের অনাগ্রহী উত্স। অর্থাত্ পুষ্টিবঞ্চিত নারীরাই স্বল্প ওজনের শিশুর জন্ম দেয় এবং এসব স্বল্প ওজনের শিশুর অনেকেই, বিশেষত কন্যাশিশুরা অপুষ্টি নিয়েই বড় হয়।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে অপুষ্ট নারীরা শুধু অপুষ্ট কন্যাশিশুই নয়, অপুষ্ট পুত্রশিশুরও জন্ম দেয়। অর্থাত্ নারীদের বঞ্চিত রাখার ফলে তাদের গর্ভে জন্ম নেয়া শুধু কন্যাশিশুরাই নয়, পুত্রশিশুরাও ঝুঁকি মাথায় নিয়ে পৃথিবীতে আসে। এভাবে কন্যাশিশু তথা নারীদের বঞ্চিত রাখার মাশুল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পুরো জাতিকেই গুণতে হয়।
স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশুরা—অর্থাত্ আড়াই কেজি ওজনের কমের নবজাতকেরা কেন পরবর্তী জীবনে দুরারোগ্য ব্যাধিতে অধিক হারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে? এর মূল কারণ হলো, ভ্রূণ অবস্থায় বঞ্চনা। মায়ের প্রতি বঞ্চনার কারণে যেসব ভ্রূণ মাতৃগর্ভে অপুষ্ট পরিবেশে বেড়ে ওঠে, তারা একটি বিশেষ জৈবিক প্রক্রিয়ায় কম পুষ্টি গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সীমিত পুষ্টি তারা সেসব কাজেই ব্যবহার করে যা তাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। এর ফলে অনেকগুলো প্রক্রিয়া (যেমন: ডায়রিয়া প্রতিরোধ প্রক্রিয়া) অবশ্য উপেক্ষিত থেকে যায়। স্বল্প পুষ্টি গ্রহণে এ অভ্যস্ততার কারণে জন্মের পর অধিক পুষ্টি পেলেও তা তারা কাজে লাগাতে সক্ষম হয় না। বরং এমন অধিক পুষ্টি তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এগুলো তাদের জন্য উচ্চ রক্তচাপ ও বহুমূত্র রোগের সূত্রপাত ঘটায়।
স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করা ব্যক্তিদের বেলায় এসব দুরারোগ্য ব্যাধি সৃষ্টির জন্য অস্বাভাবিক পরিমাণের পুষ্টি গ্রহণ প্রয়োজন হয় না। একজন উঠতি বয়সের তরুণ কিংবা বয়স্ক ব্যক্তির জন্য যে স্বাভাবিক পরিমাণের পুষ্টি প্রয়োজন তাও তাদের জন্য ঝুঁকির সৃষ্টি করে। অর্থাত্ স্বাভাবিক পরিমাণের পুষ্টিই তাদের জন্য অস্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। এর কারণ হলো তাদের ভ্রূণ অবস্থায় কম পুষ্টি গ্রহণে অভ্যস্ততা। এ অভ্যস্ততার ফলে স্বাভাবিক পরিমাণের পুষ্টিও তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে পড়ে।
উল্লেখ্য যে স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশুদের পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আরেকভাবেও সৃষ্টি হয়। স্বল্প ওজনের শিশুরা সাধারণত শৈশবেও পুষ্টিহীনতায় ভোগে, যার ফলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যথাযথভাবে গড়ে ওঠে না। শৈশবের অপুষ্টির এ ক্ষতিকর দিক তাদের সারা জীবন বহন করতে হয়, যা তাদের জন্য বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
ভ্রূণের স্বাস্থ্যের সঙ্গে জন্মের পরবর্তী সময়ের, বিশেষত পরিণত বয়সের অসুস্থতার এ যোগসূত্রকে বিজ্ঞানীরা ‘ফিটাল প্রোগ্রামিং’ (fetal programming) বলে আখ্যায়িত করেন। অর্থাত্ ভ্রূণ থেকেই একজন ব্যক্তির ভবিষ্যত্ নিয়তি, বিশেষত ভবিষ্যত্ অসুস্থতা একটি জৈব প্রক্রিয়ায় ‘প্রোগ্রামড’ বা নির্ধারিত হয়ে যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিচালিত অনেকগুলো গবেষণার মাধ্যমে এ ধারণা আজ চিকিত্সা বিজ্ঞানে পরীক্ষিত সত্য বলে প্রমাণিত।
প্রসঙ্গত, একজন অপুষ্ট মায়ের গর্ভে থাকা ভ্রূণের জন্য কম পুষ্টি গ্রহণে অভ্যস্ততার সমস্যা গর্ভকালীন সময়ে মায়ের জন্য শুধু অধিক পুষ্টির যোগান দিয়ে পুরোপুরিভাবে সমাধান করা সম্ভব নয়। এ জন্য আরও প্রয়োজন মায়ের দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টিহীনতার (chronic persistent hunger) সমস্যার অবসান। অর্থাত্ ভ্রূণের অপুষ্টি এবং এ অপুষ্টির কারণে সৃষ্ট ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য সমস্যার বা অসুস্থতার সমাধান একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এ সমস্যা সমাধানের জন্য অন্তত দুই পুরুষকাল সময় প্রয়োজন। অর্থাত্ বিজ্ঞানীদের মতে, একজন পরিণত বয়সের ব্যক্তির সুস্বাস্থ্য নির্ভর করে তার নানির গর্ভে তার মায়ের ভ্রূণাবস্থায় এবং জন্ম-পরবর্তীকালের সুস্বাস্থ্যের ওপর। তার মা স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ না করলে এবং জন্ম পরবর্তীকালে পরিমিত পুষ্টি পেয়ে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হলেই তার পরিণত বয়সে হূদরোগ, বহুমূত্র রোগ ও ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস পাবে।
পরিশেষে এটি সুস্পষ্ট যে মায়ের প্রান্তিকতা ও সন্তানের ভবিষ্যত্ অসুস্থতার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র বিরাজমান। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় মায়েরা অধিক হারে অপুষ্টিতে ভোগে, তারা অধিক হারে স্বল্প ওজনের শিশুর জন্ম দেয় এবং একটি জৈবিক প্রক্রিয়ায়—বিজ্ঞানীরা যাকে ‘ফিটাল প্রোগ্রামিং’ বলে আখ্যায়িত করেন—পরবর্তী জীবনে তারা অধিক হারে হূদরোগ, বহুমূত্র ও ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। তাই আশ্চার্যান্বিত হওয়ার কারণ নেই যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এসব সমৃদ্ধির ব্যাধির ব্যাপকতা উন্নত দেশগুলোর তুলনায়ও বেশি। অর্থাত্ এসব দেশের সমৃদ্ধির ব্যাধির অপেক্ষাকৃত অধিক হারের ব্যাখ্যা মেলে বিরাজমান নারীর প্রান্তিক অবস্থা থেকে। তাই এটি এখন আর একটি ‘প্যারাডক্স’ বা রহস্যজনক বিষয় নয়। এটি আরও রহস্যের বিষয় নয় যে দক্ষিণ এশিয়া তুলনামূলকভাবে সাব-সাহারান আফ্রিকা থেকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হলেও স্বল্প ওজনের শিশুর জন্মের এবং শিশুদের অপুষ্টির হার এসব দেশে অপেক্ষাকৃত বেশি। এর কারণ দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের অপেক্ষাকৃত নাজুক অবস্থা। তাই আমাদের ভবিষ্যত্ বংশধরদের সুস্বাস্থ্য তথা জাতির সুস্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার স্বার্থে নারীদের প্রতি বৈষম্য-বঞ্চনার অবসানের দিকে আজ আমাদের জরুরিভিত্তিতে মনোনিবেশ করতে হবে। বিশেষত নজর দিতে হবে কন্যাশিশুদের প্রতি।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশ
অনুন্নত দেশগুলোয় সাধারণত পানিবাহিত ও সংক্রামক ব্যাধি ব্যাপক। যেমন, বাংলাদেশে প্রতি বছর কয়েক লাখ শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মানুষ ‘অনুন্নয়নের ব্যাধি’র সঙ্গে সঙ্গে ‘সমৃদ্ধির ব্যাধি’তেও অধিক হারে আক্রান্ত হচ্ছে। অর্থাত্ এসব দেশে দুই ধরনের রোগই ‘ওভারল্যাপ’ বা যুগপত্ভাবে বিরাজ করছে। এ যেন এক বিরাট গোলক ধাঁধা!
দ্বিতীয় রহস্যটি হলো দক্ষিণ এশিয়ায়। বিশেষত বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে স্বল্প ওজনের শিশুর জন্মের হার ও শিশুদের মধ্যে পুষ্টিহীনতা ব্যাপক। এমনকি সাব-সাহারান আফ্রিকার তুলনায়ও। অর্থনৈতিক অনুন্নয়নের সঙ্গে পুষ্টিহীনতার একটি সম্পর্ক রয়েছে বলে সাধারণত ধরে নেওয়া হয়। অর্থাত্ অধিক উন্নত দেশে পুষ্টিহীনতার হার অপেক্ষাকৃত কম। সাব-সাহারান আফ্রিকার তুলনায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান অপেক্ষাকৃত উন্নত। তবুও পুষ্টির দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার এসব দেশ অনেক পেছনে, যা নিঃসন্দেহে রহস্যজনক।
বিজ্ঞানীদের মতে, এ দুটি রহস্যের—স্বল্প ওজনের শিশুর জন্ম ও পুষ্টিহীনতার হার এবং পরিণত বয়সে হূদরোগ, বহুমূত্র রোগ ও ক্যানসারের ব্যাপকতার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র রয়েছে। এগুলোর আরও যোগসূত্র রয়েছে সমাজে নারীর বিদ্যমান অবস্থার সঙ্গে। চিকিত্সা বিজ্ঞানীরা দাবি করেন, যেসব দেশে নারীদের অবস্থা যত বেশি প্রান্তিক, সেসব দেশে স্বল্প ওজনের শিশুর জন্মের ও শিশুর অপুষ্টির হার তত বেশি। আবার সেসব দেশের মানুষদের মধ্যেই হূদরোগ, বহুমূত্র রোগ ও ক্যানসারের ব্যাপকতাও বেশি। অন্যভাবে বলতে গেলে মায়ের সুস্বাস্থ্য আর সন্তানের ভবিষ্যত্ সুস্বাস্থ্য একই সুতায় গাঁথা। কিন্তু কেন? কীভাবে এ যোগসূত্রতার সৃষ্টি হয়?
মনে রাখা প্রয়োজন যে দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে পুরুষতন্ত্রের মানসিকতা অত্যন্ত প্রকট। ফলে এসব দেশে নারীরা অপেক্ষাকৃত অধিক অধঃস্তন। তারা অধিকতর বঞ্চিত, নিপীড়িত ও অবহেলিত। উদাহরণস্বরূপ, জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (রিপোর্ট) সর্বশেষ ‘বংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০০৭’ অনুযায়ী, বাংলাদেশের শতকরা ৬০ ভাগ নারী বিবাহিত জীবনে স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত হন। তারা অধিক হারে বৈষম্যেরও শিকার। অর্থাত্ এসব দেশে নারীদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক —এক কথায় প্রান্তিক।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নারী-পুরুষের বৈষম্য শুরু হয় বাল্যকাল থেকেই। উদাহরণস্বরূপ এসব দেশে পাঁচ বছরের নিচের কন্যাশিশুদের অপুষ্টির হার ছেলে শিশুদের তুলনায় অধিক। এসব অপুষ্ট শিশুদের অনেকেই, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে, বাল্যকালেই মৃত্যুবরণ করে। কন্যাশিশুদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকে তাদের অনেকে কিশোরী বয়সে শিক্ষা, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত হয়। বঞ্চিত হয় চলাফেরার স্বাধীনতা ও বিনোদন থেকে। বিশেষত গ্রামীণ সমাজে অনেকে চার দেয়ালের মধ্যে আটকা পড়ে যায় এবং পারিবারিক ও গৃহস্থালির কার্যক্রমে জড়িত হতে বাধ্য হয়।
বয়ঃসন্ধিক্ষণেই কিশোরীদের অনেকের বিয়ে হয়ে যায়। যেমন, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৬৬ শতাংশ। আর এদের অধিকাংশই দ্রুত, পরিণত বয়সের আগেই গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এসব গর্ভবতী মায়েরা নিজেরাও অপুষ্টিতে ভোগে এবং নিজেরা শারীরিক এবং মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়ার আগেই মা হয়ে যায়। আর এসব অপুষ্ট ও অধিকারবঞ্চিত মায়েরাই পরবর্তী সময়ে স্বল্প ওজনের শিশুর জন্ম দেয়। এভাবে আমাদের সমাজে একটি ‘অপুষ্টির দুষ্টচক্র’ সৃষ্টি হয় এবং আজন্ম বঞ্চনার কারণে দুর্ভাগ্যবশত নারীরাই হয়ে পড়ে এ দুষ্টচক্রের অনাগ্রহী উত্স। অর্থাত্ পুষ্টিবঞ্চিত নারীরাই স্বল্প ওজনের শিশুর জন্ম দেয় এবং এসব স্বল্প ওজনের শিশুর অনেকেই, বিশেষত কন্যাশিশুরা অপুষ্টি নিয়েই বড় হয়।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে অপুষ্ট নারীরা শুধু অপুষ্ট কন্যাশিশুই নয়, অপুষ্ট পুত্রশিশুরও জন্ম দেয়। অর্থাত্ নারীদের বঞ্চিত রাখার ফলে তাদের গর্ভে জন্ম নেয়া শুধু কন্যাশিশুরাই নয়, পুত্রশিশুরাও ঝুঁকি মাথায় নিয়ে পৃথিবীতে আসে। এভাবে কন্যাশিশু তথা নারীদের বঞ্চিত রাখার মাশুল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পুরো জাতিকেই গুণতে হয়।
স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশুরা—অর্থাত্ আড়াই কেজি ওজনের কমের নবজাতকেরা কেন পরবর্তী জীবনে দুরারোগ্য ব্যাধিতে অধিক হারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে? এর মূল কারণ হলো, ভ্রূণ অবস্থায় বঞ্চনা। মায়ের প্রতি বঞ্চনার কারণে যেসব ভ্রূণ মাতৃগর্ভে অপুষ্ট পরিবেশে বেড়ে ওঠে, তারা একটি বিশেষ জৈবিক প্রক্রিয়ায় কম পুষ্টি গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সীমিত পুষ্টি তারা সেসব কাজেই ব্যবহার করে যা তাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। এর ফলে অনেকগুলো প্রক্রিয়া (যেমন: ডায়রিয়া প্রতিরোধ প্রক্রিয়া) অবশ্য উপেক্ষিত থেকে যায়। স্বল্প পুষ্টি গ্রহণে এ অভ্যস্ততার কারণে জন্মের পর অধিক পুষ্টি পেলেও তা তারা কাজে লাগাতে সক্ষম হয় না। বরং এমন অধিক পুষ্টি তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এগুলো তাদের জন্য উচ্চ রক্তচাপ ও বহুমূত্র রোগের সূত্রপাত ঘটায়।
স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করা ব্যক্তিদের বেলায় এসব দুরারোগ্য ব্যাধি সৃষ্টির জন্য অস্বাভাবিক পরিমাণের পুষ্টি গ্রহণ প্রয়োজন হয় না। একজন উঠতি বয়সের তরুণ কিংবা বয়স্ক ব্যক্তির জন্য যে স্বাভাবিক পরিমাণের পুষ্টি প্রয়োজন তাও তাদের জন্য ঝুঁকির সৃষ্টি করে। অর্থাত্ স্বাভাবিক পরিমাণের পুষ্টিই তাদের জন্য অস্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। এর কারণ হলো তাদের ভ্রূণ অবস্থায় কম পুষ্টি গ্রহণে অভ্যস্ততা। এ অভ্যস্ততার ফলে স্বাভাবিক পরিমাণের পুষ্টিও তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে পড়ে।
উল্লেখ্য যে স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশুদের পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আরেকভাবেও সৃষ্টি হয়। স্বল্প ওজনের শিশুরা সাধারণত শৈশবেও পুষ্টিহীনতায় ভোগে, যার ফলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যথাযথভাবে গড়ে ওঠে না। শৈশবের অপুষ্টির এ ক্ষতিকর দিক তাদের সারা জীবন বহন করতে হয়, যা তাদের জন্য বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
ভ্রূণের স্বাস্থ্যের সঙ্গে জন্মের পরবর্তী সময়ের, বিশেষত পরিণত বয়সের অসুস্থতার এ যোগসূত্রকে বিজ্ঞানীরা ‘ফিটাল প্রোগ্রামিং’ (fetal programming) বলে আখ্যায়িত করেন। অর্থাত্ ভ্রূণ থেকেই একজন ব্যক্তির ভবিষ্যত্ নিয়তি, বিশেষত ভবিষ্যত্ অসুস্থতা একটি জৈব প্রক্রিয়ায় ‘প্রোগ্রামড’ বা নির্ধারিত হয়ে যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিচালিত অনেকগুলো গবেষণার মাধ্যমে এ ধারণা আজ চিকিত্সা বিজ্ঞানে পরীক্ষিত সত্য বলে প্রমাণিত।
প্রসঙ্গত, একজন অপুষ্ট মায়ের গর্ভে থাকা ভ্রূণের জন্য কম পুষ্টি গ্রহণে অভ্যস্ততার সমস্যা গর্ভকালীন সময়ে মায়ের জন্য শুধু অধিক পুষ্টির যোগান দিয়ে পুরোপুরিভাবে সমাধান করা সম্ভব নয়। এ জন্য আরও প্রয়োজন মায়ের দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টিহীনতার (chronic persistent hunger) সমস্যার অবসান। অর্থাত্ ভ্রূণের অপুষ্টি এবং এ অপুষ্টির কারণে সৃষ্ট ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য সমস্যার বা অসুস্থতার সমাধান একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এ সমস্যা সমাধানের জন্য অন্তত দুই পুরুষকাল সময় প্রয়োজন। অর্থাত্ বিজ্ঞানীদের মতে, একজন পরিণত বয়সের ব্যক্তির সুস্বাস্থ্য নির্ভর করে তার নানির গর্ভে তার মায়ের ভ্রূণাবস্থায় এবং জন্ম-পরবর্তীকালের সুস্বাস্থ্যের ওপর। তার মা স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ না করলে এবং জন্ম পরবর্তীকালে পরিমিত পুষ্টি পেয়ে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হলেই তার পরিণত বয়সে হূদরোগ, বহুমূত্র রোগ ও ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস পাবে।
পরিশেষে এটি সুস্পষ্ট যে মায়ের প্রান্তিকতা ও সন্তানের ভবিষ্যত্ অসুস্থতার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র বিরাজমান। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় মায়েরা অধিক হারে অপুষ্টিতে ভোগে, তারা অধিক হারে স্বল্প ওজনের শিশুর জন্ম দেয় এবং একটি জৈবিক প্রক্রিয়ায়—বিজ্ঞানীরা যাকে ‘ফিটাল প্রোগ্রামিং’ বলে আখ্যায়িত করেন—পরবর্তী জীবনে তারা অধিক হারে হূদরোগ, বহুমূত্র ও ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। তাই আশ্চার্যান্বিত হওয়ার কারণ নেই যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এসব সমৃদ্ধির ব্যাধির ব্যাপকতা উন্নত দেশগুলোর তুলনায়ও বেশি। অর্থাত্ এসব দেশের সমৃদ্ধির ব্যাধির অপেক্ষাকৃত অধিক হারের ব্যাখ্যা মেলে বিরাজমান নারীর প্রান্তিক অবস্থা থেকে। তাই এটি এখন আর একটি ‘প্যারাডক্স’ বা রহস্যজনক বিষয় নয়। এটি আরও রহস্যের বিষয় নয় যে দক্ষিণ এশিয়া তুলনামূলকভাবে সাব-সাহারান আফ্রিকা থেকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হলেও স্বল্প ওজনের শিশুর জন্মের এবং শিশুদের অপুষ্টির হার এসব দেশে অপেক্ষাকৃত বেশি। এর কারণ দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের অপেক্ষাকৃত নাজুক অবস্থা। তাই আমাদের ভবিষ্যত্ বংশধরদের সুস্বাস্থ্য তথা জাতির সুস্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার স্বার্থে নারীদের প্রতি বৈষম্য-বঞ্চনার অবসানের দিকে আজ আমাদের জরুরিভিত্তিতে মনোনিবেশ করতে হবে। বিশেষত নজর দিতে হবে কন্যাশিশুদের প্রতি।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশ
No comments