ব্যবসা করা মহা পাপ by রুশাদ ফরিদী
নিজেকে আমি ভাগ্যবান মনে করছি যে, আমি পেশায় কোনো ব্যবসায়ী নই। বিশেষত, কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যবসায়ী। তাহলে মনে হয়, এত দিনে সমাজে অপাঙেক্তয় হয়ে যেতাম। আজকে চালের দাম বাড়লে লোকজন বলত, ‘এই চালের ব্যবসায়ীদের কারসাজির জন্য গরিব লোকজন দুই মুঠো ভাত খেতে পারছে না।’ কালকে আলুর দাম বাড়লে লোকজন বলত, ‘ব্যাটা, তোর জন্য আলু খেতে পারছি না।’ আর চিনির ব্যবসায়ী হলে তো কথাই নেই। এতক্ষণে ফেরারি আসামি হয়ে আত্মগোপন করে থাকতে হতো!
এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পত্রপত্রিকা সরগরম চিনির বাজার নিয়ে। প্রায় প্রতিদিনই শিরোনামে চিনির বাজারের খবর। অবশ্যম্ভাবীভাবেই ব্যবসায়ীদের দায়ী করা হচ্ছিল চিনির অস্বাভাবিক দাম বাড়ার জন্য, যার পরিণতিতে আমরা দেখতে পেলাম, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করা হলো।
কোনো দ্রব্যের দাম বাড়লে তাতে অবশ্যই ব্যবসায়ীদের হাত থাকে। তবে সেটা বাজারের নিয়মে হচ্ছে, নাকি কোনো অসদুপায় অবলম্বন করে করা হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা জরুরি। যদি বলা হয়, অসদুপায় অবলম্বন করে দাম বাড়ানো হয়েছে, তাহলে সে অসদুপায়টি সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা দরকার। চিনির দাম বাড়ার পেছনে ব্যবসায়ীরা আসলেই দায়ী থাকতে পারেন। কিন্তু তা প্রকৃতভাবে চিহ্নিত না করে তাঁদের হয়রানি করলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। চিনির ক্ষেত্রে যে অভিযোগটা এসেছে, সেটা হলো, ব্যবসায়ীরা চিনি মজুদ করে দাম বাড়িয়েছেন। কথা হলো, ব্যবসায়ীরা যদি এত সহজেই চিনির দাম বাড়াতে পারেন, তাহলে তাঁরা তা প্রতিবছর এক-দুবার করেন না কেন। চাইলেই তো তাঁরা সেটা পারেন। অসুবিধা কী?
শেষবার চিনির এ রকম অস্বাভাবিক দাম বেড়েছিল ২০০৬ এর এপ্রিলে। এর পর থেকে তিন বছরে চিনির কেজি ৪০ টাকার ওপরে আর ওঠেনি, বলতে গেলে এ বছরের মে মাসের আগ পর্যন্ত।
একজন ব্যবসায়ী, তিনি যে পরিমাণ টাকাই বিনিয়োগ করেন না কেন, তিনি কিন্তু একটা ঝুঁকি নিয়েছেন। ব্যবসা করা মানেই কাড়ি কাড়ি টাকা চলে আসবে, তা কিন্তু নয়। হিসাবে সামান্য ভুলের জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা চলে যাওয়ারও যথেষ্ট আশঙ্কা আছে। একজন ব্যবসায়ী টাকা বিনিয়োগ করেছেন মুনাফা করার জন্য, দাতব্য প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য নয়। সে জন্য ব্যবসায়ীকে মুনাফাখোর বলে গালি দেওয়াটা অযৌক্তিক। মুনাফার টাকা দিয়েই তো তাঁকে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে।
একজন ব্যবসায়ী যখন ঝুঁকি নিয়েছেন, তখন তিনি যথাসম্ভব লাভ করার চেষ্টা করবেন। তাঁর উদ্দেশ্য থাকবে, কম দামে দ্রব্য কিনে বেশি দামে বিক্রি করা। বেশি দামে বিক্রি করার যেকোনো সুযোগ তিনি নেওয়ার চেষ্টা করবেন। আমাদের চিনি ব্যবসায়ীর কথায় ফিরে আসি। ধরা যাক, আজ তিনি ৫০ বস্তা চিনি কিনলেন। এক সপ্তাহ পর খবর এল, আগামী মাস থেকে দাম বাড়বে। কারণ, বিশ্ববাজারে চিনির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। ওই ব্যবসায়ী তখন অবশ্যই কিছু পরিমাণ চিনি বিক্রি না করে রেখে দেবেন আগামী মাসে বিক্রি করার জন্য। এটা ব্যবসার জন্য কি খুব স্বাভাবিক ব্যাপার নয়? অনেক ব্যবসায়ী যখন একসঙ্গে ব্যাপারটা করবেন (এবং এটা করার জন্য তাঁদের মধ্যে কোনো সলাপরামর্শ বা তথাকথিত সিন্ডিকেট করার দরকার হবে না, ব্যবসার সহজাত প্রতিক্রিয়া হিসেবে সবাই এটা করবেন), তখন বাজারে সরবরাহ কমে যাবে এবং চিনির দাম বেড়ে যাবে। তখনি আমরা দেখতে পাব, বাজারে চিনির স্বল্পতা এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে মজুদ করার প্রবণতা বাড়ছে। এটাকে কোন হিসেবে অপরাধ বলব, তা কিন্তু বলা মুশকিল।
যে ঘটনার কথা বললাম, সেটার কিন্তু উল্টোটাও ঘটতে পারে। দেখা গেল, ব্রাজিলে চিনির বাম্পার ফলনের ফলে বিশ্ববাজারে এর দাম কমার সম্ভাবনা দেখা দিল। তখন কিন্তু সেই ব্যবসায়ী তড়িঘড়ি করে চিনি বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। ফলে বাজারে চিনির আধিক্য দেখা দেবে এবং চিনির দাম কমে যাবে। তখন যদি ওই ব্যবসায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হন, তখন কি সরকার তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে? ক্ষতি হলে ব্যবসায়ী একা সামলাবেন, আর লাভ করতে গেলে সেটা মহা পাপ হয়ে যাবে—এ রকম মনোভাব ও আচরণ কি ব্যবসায়ীদের প্রতি অবিচার হয়ে যায় না?
আকস্মিক মূল্য পরিবর্তনের ব্যাপারগুলো তখনি ঘটে, যখন ব্যবসায়ীদের ভবিষ্যতের মূল্য সম্বন্ধে প্রত্যাশা পরিবর্তিত হয়। সরকারের যদি কোনো ব্যবস্থা নিতে হয়, তাহলে কীভাবে এই মূল্য প্রত্যাশা তৈরি হচ্ছে, সেটা বুঝতে হবে। ভারত একটি অন্যতম বৃহত্ চিনি উত্পাদনকারী দেশ, যেখানে এ মৌসুমে চিনির উত্পাদন ৪৫ ভাগ কমে গেছে। এটা মূলত হয়েছে অনাবৃষ্টি এবং চাষীদের অন্যান্য শস্যের প্রতি বেশি ঝুঁকে যাওয়ার ফলে। সে জন্য এ বছরের শুরু থেকেই চিনির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তে শুরু করেছে। এই জানুয়ারিতে চিনির দাম যেখানে ছিল সাড়ে ১২ সেন্ট/পাউন্ড, সেখানে জুন মাসের মধ্যে তা বেড়ে প্রায় সাড়ে ১৮ সেন্ট/পাউন্ড হয়ে গেছে। অর্থাত্ আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম প্রায় ৫০ ভাগ বেড়েছে। আমাদের দেশের চিনির চাহিদার ৯০ ভাগ আমদানি করা এবং স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববাজারের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। সুতরাং এটা খুবই স্বাভাবিক যে, ব্যবসায়ীদের মূল্য বৃদ্ধির প্রত্যাশা থেকে স্থানীয় বাজারেও মূল্য বাড়তে শুরু করবে। এর পরও একই সময়ে আমাদের দেশীয় বাজারে কিন্তু চিনির দাম সেভাবে বাড়েনি, বেড়েছে ২৫ ভাগের বেশি নয়। পরবর্তী সময়ে অবশ্য চিনির দাম পর্যায়ক্রমে আরও বাড়ে।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে এই মূল্য বৃদ্ধির প্রত্যাশাটা তৈরি হতো না, যদি সরকার ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের মাধ্যমে পর্যাপ্ত চিনি আমদানি করতে পারত। তাহলে বাজারে মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা অনেকাংশেই স্তিমিত হয়ে আসত এবং ব্যবসায়ীরাও তখন মজুদ করার কোনো প্রয়োজনীয়তা বোধ করতেন না। সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে, কী ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণে ব্যবসায়ীরা মজুদ করছেন। তা না করে দাম বাড়লেই ব্যবসায়ীদের পেছনে লাগা, তাঁদের ধরার জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা খুবই অপরিপক্ব বাণিজ্যনীতির পরিচায়ক। এতে ব্যবসায়ীদের আস্থা কমে যায় এবং দীর্ঘ মেয়াদে এর ক্ষতিকর প্রভাব অর্থনীতিতে পড়তে পারে।
বাংলাদেশের কোনো আইনে মজুদদারির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট কোনো কিছু বলা নেই। Anti hoarding act 1953-এ যেটা বলা আছে, সেটা হলো—কোনো প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে উল্লেখ করতে হবে, কত দিন ধরে মজুদ করলে সেটা অপরাধ বলে গণ্য হবে। সে ধরনের কিছু এখানে হয়নি। আর প্রজ্ঞাপন জারি করাটাও সহজ নয়। মজুদ কীভাবে অন্যায় হবে, সেটা সংজ্ঞায়িত করাও খুব সহজ নয়। একজন খুচরা বিক্রেতা আর একজন পাইকারি বিক্রেতার মজুদ অবশ্যই এক হবে না। শুধু তা-ই নয়, দুজন পাইকারি বিক্রেতার মধ্যেও অনেক পার্থক্য হতে পারে, যেটা নির্ভর করবে ব্যবসার আকারের ওপর। সুতরাং আইন করে বলে দেওয়া যে এত দিনের বেশি মজুদ রাখলে অপরাধ হবে, সেটা খুবই অকার্যকর একটা পদ্ধতি হবে।
এটা ধারণা করা যায়, মজুদ সম্বন্ধে আইনি দুর্বলতার কারণেই কিছুদিন আগে যশোরের অভয়নগরে ১৪ জন চিনি ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা করা হলো বিশেষ ক্ষমতা আইনে। বিশেষ ক্ষমতা আইনের সুবিধা হলো, এখানে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনার দরকার হয় না। রাষ্ট্র যদি কাউকে ক্ষতিকর কোনো কাজে জড়িত বলে মনে করে, তা হলেই এ আইনে ধরতে পারবে। যেহেতু আর কোনো উপায়ে ব্যবসায়ীদের ধরা সম্ভব নয়; ধারণা করছি, সে জন্যই এ আইনের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এভাবে ব্যবসায়ীদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া হয়রানি করা খুবই বিপজ্জনক। যেই ৭৪ হাজার বস্তা চিনি আটক করা হয়েছে, সেটা কোন আইনের কোন অধ্যাদেশ অনুযায়ী হয়েছে, সেটা ব্যবসায়ী-মহলের জানার অধিকার রয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেল, তখন একইভাবে ব্যবসায়ীদের হয়রানি আর গ্রেপ্তার করে ব্যবসায়ী-সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হলো। ফলে বাজারে দাম তো কমেইনি, উল্টো আরও বেড়ে গিয়েছিল। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে তা করতে হবে বাজারের নিয়মেই। বাজারের অদৃশ্য হাত কোনো দৃশ্যমান শক্তির হুমকির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যে কতটা কঠিন, সেটা আমাদের নীতিনির্ধারকেরা একেবারেই মনে রাখেন না।
ড. রুশাদ ফরিদী: সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
rushad@econdu.ac.bd
এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পত্রপত্রিকা সরগরম চিনির বাজার নিয়ে। প্রায় প্রতিদিনই শিরোনামে চিনির বাজারের খবর। অবশ্যম্ভাবীভাবেই ব্যবসায়ীদের দায়ী করা হচ্ছিল চিনির অস্বাভাবিক দাম বাড়ার জন্য, যার পরিণতিতে আমরা দেখতে পেলাম, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করা হলো।
কোনো দ্রব্যের দাম বাড়লে তাতে অবশ্যই ব্যবসায়ীদের হাত থাকে। তবে সেটা বাজারের নিয়মে হচ্ছে, নাকি কোনো অসদুপায় অবলম্বন করে করা হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা জরুরি। যদি বলা হয়, অসদুপায় অবলম্বন করে দাম বাড়ানো হয়েছে, তাহলে সে অসদুপায়টি সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা দরকার। চিনির দাম বাড়ার পেছনে ব্যবসায়ীরা আসলেই দায়ী থাকতে পারেন। কিন্তু তা প্রকৃতভাবে চিহ্নিত না করে তাঁদের হয়রানি করলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। চিনির ক্ষেত্রে যে অভিযোগটা এসেছে, সেটা হলো, ব্যবসায়ীরা চিনি মজুদ করে দাম বাড়িয়েছেন। কথা হলো, ব্যবসায়ীরা যদি এত সহজেই চিনির দাম বাড়াতে পারেন, তাহলে তাঁরা তা প্রতিবছর এক-দুবার করেন না কেন। চাইলেই তো তাঁরা সেটা পারেন। অসুবিধা কী?
শেষবার চিনির এ রকম অস্বাভাবিক দাম বেড়েছিল ২০০৬ এর এপ্রিলে। এর পর থেকে তিন বছরে চিনির কেজি ৪০ টাকার ওপরে আর ওঠেনি, বলতে গেলে এ বছরের মে মাসের আগ পর্যন্ত।
একজন ব্যবসায়ী, তিনি যে পরিমাণ টাকাই বিনিয়োগ করেন না কেন, তিনি কিন্তু একটা ঝুঁকি নিয়েছেন। ব্যবসা করা মানেই কাড়ি কাড়ি টাকা চলে আসবে, তা কিন্তু নয়। হিসাবে সামান্য ভুলের জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা চলে যাওয়ারও যথেষ্ট আশঙ্কা আছে। একজন ব্যবসায়ী টাকা বিনিয়োগ করেছেন মুনাফা করার জন্য, দাতব্য প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য নয়। সে জন্য ব্যবসায়ীকে মুনাফাখোর বলে গালি দেওয়াটা অযৌক্তিক। মুনাফার টাকা দিয়েই তো তাঁকে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে।
একজন ব্যবসায়ী যখন ঝুঁকি নিয়েছেন, তখন তিনি যথাসম্ভব লাভ করার চেষ্টা করবেন। তাঁর উদ্দেশ্য থাকবে, কম দামে দ্রব্য কিনে বেশি দামে বিক্রি করা। বেশি দামে বিক্রি করার যেকোনো সুযোগ তিনি নেওয়ার চেষ্টা করবেন। আমাদের চিনি ব্যবসায়ীর কথায় ফিরে আসি। ধরা যাক, আজ তিনি ৫০ বস্তা চিনি কিনলেন। এক সপ্তাহ পর খবর এল, আগামী মাস থেকে দাম বাড়বে। কারণ, বিশ্ববাজারে চিনির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। ওই ব্যবসায়ী তখন অবশ্যই কিছু পরিমাণ চিনি বিক্রি না করে রেখে দেবেন আগামী মাসে বিক্রি করার জন্য। এটা ব্যবসার জন্য কি খুব স্বাভাবিক ব্যাপার নয়? অনেক ব্যবসায়ী যখন একসঙ্গে ব্যাপারটা করবেন (এবং এটা করার জন্য তাঁদের মধ্যে কোনো সলাপরামর্শ বা তথাকথিত সিন্ডিকেট করার দরকার হবে না, ব্যবসার সহজাত প্রতিক্রিয়া হিসেবে সবাই এটা করবেন), তখন বাজারে সরবরাহ কমে যাবে এবং চিনির দাম বেড়ে যাবে। তখনি আমরা দেখতে পাব, বাজারে চিনির স্বল্পতা এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে মজুদ করার প্রবণতা বাড়ছে। এটাকে কোন হিসেবে অপরাধ বলব, তা কিন্তু বলা মুশকিল।
যে ঘটনার কথা বললাম, সেটার কিন্তু উল্টোটাও ঘটতে পারে। দেখা গেল, ব্রাজিলে চিনির বাম্পার ফলনের ফলে বিশ্ববাজারে এর দাম কমার সম্ভাবনা দেখা দিল। তখন কিন্তু সেই ব্যবসায়ী তড়িঘড়ি করে চিনি বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। ফলে বাজারে চিনির আধিক্য দেখা দেবে এবং চিনির দাম কমে যাবে। তখন যদি ওই ব্যবসায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হন, তখন কি সরকার তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে? ক্ষতি হলে ব্যবসায়ী একা সামলাবেন, আর লাভ করতে গেলে সেটা মহা পাপ হয়ে যাবে—এ রকম মনোভাব ও আচরণ কি ব্যবসায়ীদের প্রতি অবিচার হয়ে যায় না?
আকস্মিক মূল্য পরিবর্তনের ব্যাপারগুলো তখনি ঘটে, যখন ব্যবসায়ীদের ভবিষ্যতের মূল্য সম্বন্ধে প্রত্যাশা পরিবর্তিত হয়। সরকারের যদি কোনো ব্যবস্থা নিতে হয়, তাহলে কীভাবে এই মূল্য প্রত্যাশা তৈরি হচ্ছে, সেটা বুঝতে হবে। ভারত একটি অন্যতম বৃহত্ চিনি উত্পাদনকারী দেশ, যেখানে এ মৌসুমে চিনির উত্পাদন ৪৫ ভাগ কমে গেছে। এটা মূলত হয়েছে অনাবৃষ্টি এবং চাষীদের অন্যান্য শস্যের প্রতি বেশি ঝুঁকে যাওয়ার ফলে। সে জন্য এ বছরের শুরু থেকেই চিনির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তে শুরু করেছে। এই জানুয়ারিতে চিনির দাম যেখানে ছিল সাড়ে ১২ সেন্ট/পাউন্ড, সেখানে জুন মাসের মধ্যে তা বেড়ে প্রায় সাড়ে ১৮ সেন্ট/পাউন্ড হয়ে গেছে। অর্থাত্ আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম প্রায় ৫০ ভাগ বেড়েছে। আমাদের দেশের চিনির চাহিদার ৯০ ভাগ আমদানি করা এবং স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববাজারের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। সুতরাং এটা খুবই স্বাভাবিক যে, ব্যবসায়ীদের মূল্য বৃদ্ধির প্রত্যাশা থেকে স্থানীয় বাজারেও মূল্য বাড়তে শুরু করবে। এর পরও একই সময়ে আমাদের দেশীয় বাজারে কিন্তু চিনির দাম সেভাবে বাড়েনি, বেড়েছে ২৫ ভাগের বেশি নয়। পরবর্তী সময়ে অবশ্য চিনির দাম পর্যায়ক্রমে আরও বাড়ে।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে এই মূল্য বৃদ্ধির প্রত্যাশাটা তৈরি হতো না, যদি সরকার ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের মাধ্যমে পর্যাপ্ত চিনি আমদানি করতে পারত। তাহলে বাজারে মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা অনেকাংশেই স্তিমিত হয়ে আসত এবং ব্যবসায়ীরাও তখন মজুদ করার কোনো প্রয়োজনীয়তা বোধ করতেন না। সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে, কী ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণে ব্যবসায়ীরা মজুদ করছেন। তা না করে দাম বাড়লেই ব্যবসায়ীদের পেছনে লাগা, তাঁদের ধরার জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা খুবই অপরিপক্ব বাণিজ্যনীতির পরিচায়ক। এতে ব্যবসায়ীদের আস্থা কমে যায় এবং দীর্ঘ মেয়াদে এর ক্ষতিকর প্রভাব অর্থনীতিতে পড়তে পারে।
বাংলাদেশের কোনো আইনে মজুদদারির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট কোনো কিছু বলা নেই। Anti hoarding act 1953-এ যেটা বলা আছে, সেটা হলো—কোনো প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে উল্লেখ করতে হবে, কত দিন ধরে মজুদ করলে সেটা অপরাধ বলে গণ্য হবে। সে ধরনের কিছু এখানে হয়নি। আর প্রজ্ঞাপন জারি করাটাও সহজ নয়। মজুদ কীভাবে অন্যায় হবে, সেটা সংজ্ঞায়িত করাও খুব সহজ নয়। একজন খুচরা বিক্রেতা আর একজন পাইকারি বিক্রেতার মজুদ অবশ্যই এক হবে না। শুধু তা-ই নয়, দুজন পাইকারি বিক্রেতার মধ্যেও অনেক পার্থক্য হতে পারে, যেটা নির্ভর করবে ব্যবসার আকারের ওপর। সুতরাং আইন করে বলে দেওয়া যে এত দিনের বেশি মজুদ রাখলে অপরাধ হবে, সেটা খুবই অকার্যকর একটা পদ্ধতি হবে।
এটা ধারণা করা যায়, মজুদ সম্বন্ধে আইনি দুর্বলতার কারণেই কিছুদিন আগে যশোরের অভয়নগরে ১৪ জন চিনি ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা করা হলো বিশেষ ক্ষমতা আইনে। বিশেষ ক্ষমতা আইনের সুবিধা হলো, এখানে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনার দরকার হয় না। রাষ্ট্র যদি কাউকে ক্ষতিকর কোনো কাজে জড়িত বলে মনে করে, তা হলেই এ আইনে ধরতে পারবে। যেহেতু আর কোনো উপায়ে ব্যবসায়ীদের ধরা সম্ভব নয়; ধারণা করছি, সে জন্যই এ আইনের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এভাবে ব্যবসায়ীদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া হয়রানি করা খুবই বিপজ্জনক। যেই ৭৪ হাজার বস্তা চিনি আটক করা হয়েছে, সেটা কোন আইনের কোন অধ্যাদেশ অনুযায়ী হয়েছে, সেটা ব্যবসায়ী-মহলের জানার অধিকার রয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেল, তখন একইভাবে ব্যবসায়ীদের হয়রানি আর গ্রেপ্তার করে ব্যবসায়ী-সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হলো। ফলে বাজারে দাম তো কমেইনি, উল্টো আরও বেড়ে গিয়েছিল। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে তা করতে হবে বাজারের নিয়মেই। বাজারের অদৃশ্য হাত কোনো দৃশ্যমান শক্তির হুমকির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যে কতটা কঠিন, সেটা আমাদের নীতিনির্ধারকেরা একেবারেই মনে রাখেন না।
ড. রুশাদ ফরিদী: সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
rushad@econdu.ac.bd
No comments