আমার মামা মোহাম্মদ ফরহাদ by মমতাজ আকসাদ
কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক, আমার মেজ মামা। ১৯৩৮ সালের ৫ জুলাই বৃষ্টির রাতে জন্মেছিলেন বলে নাম রাখা হয়েছিল বাদল। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুমহলে ওই নামেই তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন। আমার থেকে বয়সে কিছুটা বড় হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন আমার বন্ধুর মতো। তাঁকে ঘিরে আমার মনে যত স্মৃতি রয়েছে, তা অল্প কথায় বলে শেষ করার নয়। আজ তাঁর ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী।
আমার নানা আহমেদ সাদাকাতুল বারী ছিলেন একজন অতি সত্ চরিত্রের মানুষ। আমি তাঁকে সব সময় শিক্ষকতা করতেই দেখেছি। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। কোনো দিন তাঁকে রাগ করতে দেখিনি। বহু ছাত্রছাত্রীকে তিনি বিনা পয়সায় পাঠদান করতেন। ছাত্রছাত্রীদের সন্তানতুল্য ভালোবাসতেন। অভাব-অনটনের মধ্যে থেকেও তিনি কখনো আদর্শচ্যুত হননি। মেজ মামা বাদল ছিলেন নানার মতোই। ছোটবেলায় মেজ মামা সংসারের অনেক কাজ করতেন। সম্ভবত ১৯৫৪ সালে তিনি যে দিন প্রথম গ্রেপ্তার হন, সে দিনও বাজারে গিয়েছিলেন। তখন তিনি স্কুলের ছাত্র। বাজার থেকে দৌড়ে বাসায় আসেন এবং নানির সামনে বাজারের ব্যাগ রেখে ভাঙতি পয়সা নানির হাতে গুঁজে দিয়ে ঝড়ের বেগে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। পুলিশ তাঁকে খুঁজছে জেনেও বাজারের পয়সা খরচ করে দ্রুত বাসায় ফেরেননি। ওই বয়সেও এতটাই মিতব্যয়ী বা হিসাবী ছিলেন তিনি।
বেলা ১১টার দিকে আমরা খবর পেলাম যে মেজ মামাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে দিনাজপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে গেছে। এই খবর শুনে আমাদের সবার সে কী অবস্থা। নানা অস্থির। নানি কাঁদছেন। দুই খালাও অসম্ভব বিচলিত। আমি আর বাবলু অস্থির হয়ে বারবার রাস্তায় যাচ্ছি আর বাসায় ফিরছি। সে সময় আমার কেবল মনে হয়েছে, পৃথিবীর যেকোনো কিছুর বিনিময়ে যদি মামাকে মুক্ত করতে পারতাম! সপ্তাহখানেক পর জেলখানায় মামার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি পেয়ে নানির সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম জেল গেটে। আমার তখন রাজনীতি সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। আমি মনে করেছিলাম, আমার কোনো প্রিয় জিনিস মামাকে দিতে চাইলেই তিনি আমাদের সঙ্গে চলে আসবেন। আমার তখন একটা সুন্দর সাইকেল ছিল। সাইকেলটি ছিল আমার অতি প্রিয়। নিজের হাতে প্রতিদিন ওটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতাম। জেল গেটে মামাকে বললাম, তুমি যদি এখনই বাসায় চলে আসো, তাহলে তোমাকে আমার সাইকেল চালাতে দেব। মেজ মামা সে দিন কিছু বলেননি, শুধু একটু মুচকি হাসি দিয়েছিলেন। খুব মন খারাপ করে মেজ মামাকে সঙ্গে না নিয়েই সে দিন আমরা বাসায় ফিরেছিলাম।
মেজ মামার রাজনীতিতে যুক্ত হওয়াটা নানি খুব একটা পছন্দ করতেন না। মাঝেমধ্যে এ জন্য নানি মেজ মামাকে বকাঝকা করতেন। সে জন্য মামা রাগ করে দু-তিন দিন হয়তো বাসায় ভাতও খেতেন না। মেজ মামার জন্য আমার খুব কষ্ট হতো। তখন আমার মাটির ব্যাংক ভেঙে যা পয়সা পেতাম তার সবটাই মামাকে দিয়ে দিতাম। মেজ মামার জন্য আমার অন্তরের টান ছিল অতি গভীর।
মেজ মামার কাছ থেকেই আমি সর্বপ্রথম কমিউনিজমের ধারণা পাই। তিনিই আমাকে ‘দুনিয়ার মজদুর ভাই সব, আয় এক মিছিলে দাঁড়া/নয়া জামানার ডাক এসেছে, এক সাথে দে সাড়া’ বিখ্যাত গানটি শিখিয়েছিলেন।
আমি যখন ঢাকায় এমএ পড়তে আসি, তখন আমার পরিচয় হয় মেজ মামার সহকর্মী কমরেড আলী আকসাদের সঙ্গে। আলী আকসাদ যখন আমার মায়ের কাছে আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন, তখন স্বভাবতই আমার মা খুব ভয় পেয়েছিলেন। কারণ তখন কমিউনিজম সম্পর্কে ধারণা ছিল যে, তাদের জীবন অত্যন্ত কষ্টের। জেল-জুলুম, অভাব-অনটন নিত্যসঙ্গী। যা হোক, আম্মা আলী আকসাদের প্রস্তাবের ব্যাপারে মেজ মামার মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মেয়ে হলে আমি তাকে আলী আকসাদের সঙ্গে বিয়ে দিতাম। তোর মেয়ে তুই বুঝে দেখ। তবে আকসাদ ছেলে খারাপ না।’ মামার এই কথার পর আম্মা আমাদের বিয়ের ব্যাপারে আর আপত্তি করেননি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় লোক পাঠিয়ে মেজ মামা আমাকে সরকারিভাবে ভারতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। কলকাতার বালিগঞ্জে আমরা তিনটি পরিবার মিলে একটি বাসা ভাড়া করেছিলাম। বসার ঘরটি ছিল যথেষ্ট বড়। মেজ মামা মাঝেমধ্যে সাত-আটজন সহকর্মীকে নিয়ে দুপুর বেলায় আমার বাসায় চলে আসতেন। অতিথিরা খুব সংকোচ বোধ করতেন। মামা হাসিমুখে বলতেন, ‘আরে, ভয় পাবেন না, আমার ভাগ্নি সাক্ষাত্ লক্ষ্মী, ও ঠিক ম্যানেজ করে নেবে।’
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে আসে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির তখন সামর্থ্য ছিল না এই অতিথিদের হোটেলে রাখার। মেজ মামা এসে ওই কমরেডদের আমার বাসায় রাখার জন্য বললে আমি সানন্দে রাজি হয়েছিলাম। আর আমার স্বামী আলী আকসাদ তো আনন্দে নেচে উঠলেন। কিন্তু সমস্যা হলো, সে সময় আমাদেরও তেমন টাকা-পয়সা ছিল না। ১০-১২ জন লোককে ছয়-সাত দিন খাওয়ানোর সামর্থ্য আমাদেরও ছিল না। মেজ মামা আমাকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘ভয় পাস না, আমাদের পার্টির লোকেরাই প্রতিদিনের বাজার করে দিয়ে যাবে, তুই শুধু লিস্ট করে দিবি।’ ভারতীয় প্রতিনিধিদলে ছিলেন কমরেড রাজেশ্বর রাও, কমরেড ভবানী সেন, কমরেড চিত্ত বিশ্বাস প্রমুখ। এই কমরেডরা পরবর্তী সময়ে আমাদের আতিথেয়তার প্রশংসা করেছিলেন বলে শুনেছি।
আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেই শেষ করব। সম্ভবত ১৯৫৪ সালে সারা দেশে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। বন্যাদুর্গতদের সাহায্য করার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে একটি নাটক মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বড়োবাড়ি নামের নাটকটিতে দিনাজপুরে প্রথমবারের মতো নারী ও পুরুষ একত্রে অভিনয় করেছিলেন নানার আপত্তি সত্ত্বেও। ওই নাটকে মেজ মামা আমাকে দিয়ে একটি চরিত্রে অভিনয় করিয়েছিলেন। নাটকটি খুবই ভালো হয়েছিল এবং প্রচুর পয়সা উঠেছিল। মেজ মামা প্রতিদিন রিকশায় করে আমাকে রিহার্সেল হলে নিয়ে যেতেন। দুই-তিন ঘণ্টা সেখানে বসে থেকে রিহার্সেল শেষে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে তারপর অন্য কাজে যেতেন। পুরুষদের সঙ্গে সহ-অভিনয়ে নিজের ভাগ্নিকে নিয়ে মেজ মামা সে সময় যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। অন্যের পরিবারের মেয়েদের দিয়ে অভিনয় করাব আর নিজের পরিবারের সদস্যদের আড়ালে রাখব, এমন বিপরীতমুখী নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না তিনি। কথা ও কাজের অভিন্নতা ছিল মামার জীবনের বড় বৈশিষ্ট্য। তিনি যে দেশের রাজনীতিতে এক বিশাল ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন, তা সম্ভব হয়েছিল তাঁর সততা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও আদর্শ-নিষ্ঠার জন্যই।
আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু হূদয়ের মণিকোঠায় তিনি চিরদিন জ্যোতির্ময় নক্ষত্রের মতো বিরাজ করবেন।
আমার নানা আহমেদ সাদাকাতুল বারী ছিলেন একজন অতি সত্ চরিত্রের মানুষ। আমি তাঁকে সব সময় শিক্ষকতা করতেই দেখেছি। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। কোনো দিন তাঁকে রাগ করতে দেখিনি। বহু ছাত্রছাত্রীকে তিনি বিনা পয়সায় পাঠদান করতেন। ছাত্রছাত্রীদের সন্তানতুল্য ভালোবাসতেন। অভাব-অনটনের মধ্যে থেকেও তিনি কখনো আদর্শচ্যুত হননি। মেজ মামা বাদল ছিলেন নানার মতোই। ছোটবেলায় মেজ মামা সংসারের অনেক কাজ করতেন। সম্ভবত ১৯৫৪ সালে তিনি যে দিন প্রথম গ্রেপ্তার হন, সে দিনও বাজারে গিয়েছিলেন। তখন তিনি স্কুলের ছাত্র। বাজার থেকে দৌড়ে বাসায় আসেন এবং নানির সামনে বাজারের ব্যাগ রেখে ভাঙতি পয়সা নানির হাতে গুঁজে দিয়ে ঝড়ের বেগে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। পুলিশ তাঁকে খুঁজছে জেনেও বাজারের পয়সা খরচ করে দ্রুত বাসায় ফেরেননি। ওই বয়সেও এতটাই মিতব্যয়ী বা হিসাবী ছিলেন তিনি।
বেলা ১১টার দিকে আমরা খবর পেলাম যে মেজ মামাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে দিনাজপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে গেছে। এই খবর শুনে আমাদের সবার সে কী অবস্থা। নানা অস্থির। নানি কাঁদছেন। দুই খালাও অসম্ভব বিচলিত। আমি আর বাবলু অস্থির হয়ে বারবার রাস্তায় যাচ্ছি আর বাসায় ফিরছি। সে সময় আমার কেবল মনে হয়েছে, পৃথিবীর যেকোনো কিছুর বিনিময়ে যদি মামাকে মুক্ত করতে পারতাম! সপ্তাহখানেক পর জেলখানায় মামার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি পেয়ে নানির সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম জেল গেটে। আমার তখন রাজনীতি সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। আমি মনে করেছিলাম, আমার কোনো প্রিয় জিনিস মামাকে দিতে চাইলেই তিনি আমাদের সঙ্গে চলে আসবেন। আমার তখন একটা সুন্দর সাইকেল ছিল। সাইকেলটি ছিল আমার অতি প্রিয়। নিজের হাতে প্রতিদিন ওটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতাম। জেল গেটে মামাকে বললাম, তুমি যদি এখনই বাসায় চলে আসো, তাহলে তোমাকে আমার সাইকেল চালাতে দেব। মেজ মামা সে দিন কিছু বলেননি, শুধু একটু মুচকি হাসি দিয়েছিলেন। খুব মন খারাপ করে মেজ মামাকে সঙ্গে না নিয়েই সে দিন আমরা বাসায় ফিরেছিলাম।
মেজ মামার রাজনীতিতে যুক্ত হওয়াটা নানি খুব একটা পছন্দ করতেন না। মাঝেমধ্যে এ জন্য নানি মেজ মামাকে বকাঝকা করতেন। সে জন্য মামা রাগ করে দু-তিন দিন হয়তো বাসায় ভাতও খেতেন না। মেজ মামার জন্য আমার খুব কষ্ট হতো। তখন আমার মাটির ব্যাংক ভেঙে যা পয়সা পেতাম তার সবটাই মামাকে দিয়ে দিতাম। মেজ মামার জন্য আমার অন্তরের টান ছিল অতি গভীর।
মেজ মামার কাছ থেকেই আমি সর্বপ্রথম কমিউনিজমের ধারণা পাই। তিনিই আমাকে ‘দুনিয়ার মজদুর ভাই সব, আয় এক মিছিলে দাঁড়া/নয়া জামানার ডাক এসেছে, এক সাথে দে সাড়া’ বিখ্যাত গানটি শিখিয়েছিলেন।
আমি যখন ঢাকায় এমএ পড়তে আসি, তখন আমার পরিচয় হয় মেজ মামার সহকর্মী কমরেড আলী আকসাদের সঙ্গে। আলী আকসাদ যখন আমার মায়ের কাছে আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন, তখন স্বভাবতই আমার মা খুব ভয় পেয়েছিলেন। কারণ তখন কমিউনিজম সম্পর্কে ধারণা ছিল যে, তাদের জীবন অত্যন্ত কষ্টের। জেল-জুলুম, অভাব-অনটন নিত্যসঙ্গী। যা হোক, আম্মা আলী আকসাদের প্রস্তাবের ব্যাপারে মেজ মামার মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মেয়ে হলে আমি তাকে আলী আকসাদের সঙ্গে বিয়ে দিতাম। তোর মেয়ে তুই বুঝে দেখ। তবে আকসাদ ছেলে খারাপ না।’ মামার এই কথার পর আম্মা আমাদের বিয়ের ব্যাপারে আর আপত্তি করেননি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় লোক পাঠিয়ে মেজ মামা আমাকে সরকারিভাবে ভারতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। কলকাতার বালিগঞ্জে আমরা তিনটি পরিবার মিলে একটি বাসা ভাড়া করেছিলাম। বসার ঘরটি ছিল যথেষ্ট বড়। মেজ মামা মাঝেমধ্যে সাত-আটজন সহকর্মীকে নিয়ে দুপুর বেলায় আমার বাসায় চলে আসতেন। অতিথিরা খুব সংকোচ বোধ করতেন। মামা হাসিমুখে বলতেন, ‘আরে, ভয় পাবেন না, আমার ভাগ্নি সাক্ষাত্ লক্ষ্মী, ও ঠিক ম্যানেজ করে নেবে।’
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে আসে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির তখন সামর্থ্য ছিল না এই অতিথিদের হোটেলে রাখার। মেজ মামা এসে ওই কমরেডদের আমার বাসায় রাখার জন্য বললে আমি সানন্দে রাজি হয়েছিলাম। আর আমার স্বামী আলী আকসাদ তো আনন্দে নেচে উঠলেন। কিন্তু সমস্যা হলো, সে সময় আমাদেরও তেমন টাকা-পয়সা ছিল না। ১০-১২ জন লোককে ছয়-সাত দিন খাওয়ানোর সামর্থ্য আমাদেরও ছিল না। মেজ মামা আমাকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘ভয় পাস না, আমাদের পার্টির লোকেরাই প্রতিদিনের বাজার করে দিয়ে যাবে, তুই শুধু লিস্ট করে দিবি।’ ভারতীয় প্রতিনিধিদলে ছিলেন কমরেড রাজেশ্বর রাও, কমরেড ভবানী সেন, কমরেড চিত্ত বিশ্বাস প্রমুখ। এই কমরেডরা পরবর্তী সময়ে আমাদের আতিথেয়তার প্রশংসা করেছিলেন বলে শুনেছি।
আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেই শেষ করব। সম্ভবত ১৯৫৪ সালে সারা দেশে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। বন্যাদুর্গতদের সাহায্য করার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে একটি নাটক মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বড়োবাড়ি নামের নাটকটিতে দিনাজপুরে প্রথমবারের মতো নারী ও পুরুষ একত্রে অভিনয় করেছিলেন নানার আপত্তি সত্ত্বেও। ওই নাটকে মেজ মামা আমাকে দিয়ে একটি চরিত্রে অভিনয় করিয়েছিলেন। নাটকটি খুবই ভালো হয়েছিল এবং প্রচুর পয়সা উঠেছিল। মেজ মামা প্রতিদিন রিকশায় করে আমাকে রিহার্সেল হলে নিয়ে যেতেন। দুই-তিন ঘণ্টা সেখানে বসে থেকে রিহার্সেল শেষে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে তারপর অন্য কাজে যেতেন। পুরুষদের সঙ্গে সহ-অভিনয়ে নিজের ভাগ্নিকে নিয়ে মেজ মামা সে সময় যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। অন্যের পরিবারের মেয়েদের দিয়ে অভিনয় করাব আর নিজের পরিবারের সদস্যদের আড়ালে রাখব, এমন বিপরীতমুখী নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না তিনি। কথা ও কাজের অভিন্নতা ছিল মামার জীবনের বড় বৈশিষ্ট্য। তিনি যে দেশের রাজনীতিতে এক বিশাল ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন, তা সম্ভব হয়েছিল তাঁর সততা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও আদর্শ-নিষ্ঠার জন্যই।
আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু হূদয়ের মণিকোঠায় তিনি চিরদিন জ্যোতির্ময় নক্ষত্রের মতো বিরাজ করবেন।
No comments