তথ্য অধিকার-চাই তথ্য অধিকার আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন by ইফতেখারুজ্জামান
২৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক তথ্য জানার অধিকার দিবস। তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে ২০০২ সালের এই দিনে বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের তথ্য আন্দোলনকর্মীরা একটি কর্মশালায় মিলিত হয়ে আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তখন থেকে প্রতিবছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ গুরুত্বের সঙ্গে দিবসটি উদ্যাপন করে আসছে। টিআইবিসহ বিভিন্ন সংগঠন ২০০৬ সাল থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশে দিবসটি পালন করে আসছে। এ দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার চাহিদা জোরদার করা, এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা, গোপনীয়তার সংস্কৃতি পরিহার এবং দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সরকার ও সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করা।
তথ্য অধিকার আইন
বাংলাদেশে ২০০৯ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে এমন কয়েকটি আইন ও বিধানের প্রাধান্য ছিল, যেগুলো অবাধ তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টিকারী। যেমন—দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন ১৯২৩, সাক্ষ্য আইন ১৮৭২, ফৌজদারি দণ্ডবিধি ১৯৬০, কার্যপ্রণাল বিধি ১৯৯৬, সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি ১৯৭৯ প্রভৃতি। এ আইনগুলোর কারণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তথ্য গোপন করার বা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল। একটি কার্যকর তথ্য অধিকার আইন ছাড়া এতগুলো আইনি বাধা পেরিয়ে এসব তথ্য জনগণের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না।
পৃথিবীর প্রায় ৭৫টি দেশে বর্তমানে তথ্য অধিকার আইন রয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে প্রেস কমিশন তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের ব্যাপারে আইন কমিশনের মাধ্যমে সুপারিশ জানায়। বাংলাদেশ আইন কমিশন ২০০২ সালে এ বিষয়ে একটি খসড়া কার্যপত্র প্রস্তাব করে, কিন্তু প্রক্রিয়াটি কয়েক বছর থেমে থাকে। ২০০৮ সালে সরকার তথ্য অধিকার অধ্যাদেশ জারি করে। চলতি বছরের ২৯ মার্চ জাতীয় সংসদে তথ্য অধিকার আইন পাস হয়। আইন অনুযায়ী ইতিমধ্যে সরকার তথ্য অধিকার কমিশন গঠন করেছে।
আইন বাস্তবায়নে মূল চ্যালেঞ্জগুলো
তথ্য অধিকার আইন গৃহীত হওয়া নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন। তবে কোনো আইন প্রণয়ন এবং তার যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকে। তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তথ্যের অবাধ আদান-প্রদানের মানসিকতা গড়ে তোলা। এ আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে সরকারের উচ্চপর্যায়সহ সব পক্ষের আন্তরিক সদিচ্ছা আরো গুরুত্বপূর্ণ।
একটি সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়ন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগে অগ্রসর হতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সুশীল সমাজ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও গণমাধ্যমসহ সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কৌশল প্রণীত হতে পারে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
তথ্য কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর স্বাধীনতা, সক্রিয়তা ও কার্যকারিতার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করবে। কমিশনারদের সক্রিয়তা, দক্ষতা, বিশ্বস্ততা ও যথাযথ নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা সৃষ্টি করতে হবে। কমিশনের পর্যাপ্ত জনবল, অর্থসম্পদ ও কারিগরি সক্ষমতা থাকা জরুরি।
তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে সরকারি কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ও সমর্থন এবং পর্যাপ্ত ও স্পষ্ট ধারণা লাভ ছাড়া এ আইনের সঠিক বাস্তবায়ন কঠিন হতে পারে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ অত্যন্ত প্রয়োজন।
গোপনীয়তার সংস্কৃতি পরিহার করতে হবে। বর্তমানে তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে যে অনীহা রয়েছে, তা অতিক্রম করা সহজ নয়, তবে অসম্ভবও নয়। বিশেষ করে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তথ্য প্রকাশের মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।
তথ্যপ্রাপ্তি, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের একটি কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। অনুরোধ করা কোনো তথ্য যথাসময়ে খুঁজে পাওয়া না গেলে সময়মতো আবেদনের উত্তর দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। অদক্ষভাবে তথ্য সংরক্ষণের কারণে যদি অনুসন্ধান করা তথ্যগুলো পরীক্ষা করা বা অনুলিপি তৈরি করার উপযোগী না থাকে, তবে তা এ আইনকে উপেক্ষিত করে তুলবে। সে জন্য তথ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন জরুরি। তথ্য সংরক্ষণ ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন প্রয়োজন। তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে সরকারি অফিসগুলোকে আধুনিকায়ন করাও জরুরি, যাতে জনগণ প্রয়োজনীয় তথ্য দ্রুত পেতে পারে।
বর্তমানে যেসব আইন ও বিধি অবাধ তথ্যপ্রবাহে বাধা সৃষ্টিকারী, সেগুলো বাতিল, পরিবর্তন কিংবা সংশোধন করতে হবে। তা না হলে জনগণের তথ্য জানার অধিকার পুরোপুরি নিশ্চিত হবে না।
নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রচার সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে। তাই তথ্য প্রচার ও প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো বাধা-বিপত্তি থাকা উচিত নয়। বিশেষ করে গণমাধ্যমের কর্মীরা যাতে নির্ভয়ে এবং নির্বিঘ্নে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন, এ ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করা একান্ত জরুরি।
তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থাকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। তথ্য অধিকারের বিষয়টি সম্পর্কে যখনই জনগণ সচেতন হবে, তখনই তারা এর সুবিধাদি ভোগ করতে পারবে।
পথটা সহজ নয়, চাই সবার সদিচ্ছা
তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে বাধা আসাটাও অসম্ভব কিছু নয়। অবাধ তথ্যপ্রবাহের কারণে যখন সরকারি কর্মকর্তাদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস পাবে, তখন তাঁরা এ ক্ষেত্রে বাধার কারণ হতে পারেন। একই কারণে রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকেও বাধা আসতে পারে। গোপনীয়তার সংস্কৃতির কারণে বেসরকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং তথ্য প্রদানে অনীহার কারণে এনজিওগুলো এর সফল প্রয়োগে বাধার কারণ হতে পারে। বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির জন্য ক্ষেত্র বিশেষে গণমাধ্যম তথ্যের অপব্যবহার করতে পারে। বিচার বিভাগ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্বলতার কারণে তথ্য অধিকার আইনের সঠিক বাস্তবায়ন প্রলম্বিত হতে পারে। সর্বোপরি, সুশীল সমাজের মধ্যে অনৈক্য, অসুস্থ প্রতিযোগিতা, স্বেচ্ছায় ও স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে তথ্য প্রকাশে অনীহাও বাধার কারণ হতে পারে।
দুর্নীতি রোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশে একটি কার্যকর তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের কোনো বিকল্প ছিল না। তথ্যের আবদ্ধতায় জনগণ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়তই শিকার হয় দুর্নীতি, শোষণ ও প্রতারণার। সরকারি কর্মকর্তাদের কার কী দায়দায়িত্ব, নাগরিক সুযোগ-সুবিধাগুলো কী কী, কোন খাতে কত টাকা বরাদ্দ আছে, তা কীভাবে খরচ করার কথা, খরচ হচ্ছে কীভাবে, জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে কী আলোচনা বা সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে কোন প্রক্রিয়ায় ও কিসের ভিত্তিতে এবং কীভাবে—তথ্য অধিকার আইনানুযায়ী এসব তথ্য জনগণ এখন সহজেই জানতে পারবে। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া কঠিন হবে। আইনটির যথাযথ বাস্তবায়ন করা হলে জনগণের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা বাড়বে। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হবে প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা। তথ্য অধিকার আইন যে অপার সম্ভাবনা ও সুযোগ সৃষ্টি করেছে, বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ যেন তা প্রতিহত না করতে পারে, সে জন্য একটি সমন্বিত উদ্যোগের দরকার, যা তথ্যদাতা ও গ্রহীতা উভয়ের স্বার্থকে সংরক্ষণ করবে। এ জন্য দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার দরকার। পাশাপাশি আইন বাস্তবায়নে প্রয়োজন শক্তিশালী নেতৃত্ব। আমরা তথ্য অধিকার আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন চাই।
ড. ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।
তথ্য অধিকার আইন
বাংলাদেশে ২০০৯ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে এমন কয়েকটি আইন ও বিধানের প্রাধান্য ছিল, যেগুলো অবাধ তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টিকারী। যেমন—দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন ১৯২৩, সাক্ষ্য আইন ১৮৭২, ফৌজদারি দণ্ডবিধি ১৯৬০, কার্যপ্রণাল বিধি ১৯৯৬, সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি ১৯৭৯ প্রভৃতি। এ আইনগুলোর কারণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তথ্য গোপন করার বা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল। একটি কার্যকর তথ্য অধিকার আইন ছাড়া এতগুলো আইনি বাধা পেরিয়ে এসব তথ্য জনগণের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না।
পৃথিবীর প্রায় ৭৫টি দেশে বর্তমানে তথ্য অধিকার আইন রয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে প্রেস কমিশন তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের ব্যাপারে আইন কমিশনের মাধ্যমে সুপারিশ জানায়। বাংলাদেশ আইন কমিশন ২০০২ সালে এ বিষয়ে একটি খসড়া কার্যপত্র প্রস্তাব করে, কিন্তু প্রক্রিয়াটি কয়েক বছর থেমে থাকে। ২০০৮ সালে সরকার তথ্য অধিকার অধ্যাদেশ জারি করে। চলতি বছরের ২৯ মার্চ জাতীয় সংসদে তথ্য অধিকার আইন পাস হয়। আইন অনুযায়ী ইতিমধ্যে সরকার তথ্য অধিকার কমিশন গঠন করেছে।
আইন বাস্তবায়নে মূল চ্যালেঞ্জগুলো
তথ্য অধিকার আইন গৃহীত হওয়া নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন। তবে কোনো আইন প্রণয়ন এবং তার যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকে। তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তথ্যের অবাধ আদান-প্রদানের মানসিকতা গড়ে তোলা। এ আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে সরকারের উচ্চপর্যায়সহ সব পক্ষের আন্তরিক সদিচ্ছা আরো গুরুত্বপূর্ণ।
একটি সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়ন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগে অগ্রসর হতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সুশীল সমাজ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও গণমাধ্যমসহ সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কৌশল প্রণীত হতে পারে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
তথ্য কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর স্বাধীনতা, সক্রিয়তা ও কার্যকারিতার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করবে। কমিশনারদের সক্রিয়তা, দক্ষতা, বিশ্বস্ততা ও যথাযথ নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা সৃষ্টি করতে হবে। কমিশনের পর্যাপ্ত জনবল, অর্থসম্পদ ও কারিগরি সক্ষমতা থাকা জরুরি।
তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে সরকারি কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ও সমর্থন এবং পর্যাপ্ত ও স্পষ্ট ধারণা লাভ ছাড়া এ আইনের সঠিক বাস্তবায়ন কঠিন হতে পারে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ অত্যন্ত প্রয়োজন।
গোপনীয়তার সংস্কৃতি পরিহার করতে হবে। বর্তমানে তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে যে অনীহা রয়েছে, তা অতিক্রম করা সহজ নয়, তবে অসম্ভবও নয়। বিশেষ করে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তথ্য প্রকাশের মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।
তথ্যপ্রাপ্তি, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের একটি কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। অনুরোধ করা কোনো তথ্য যথাসময়ে খুঁজে পাওয়া না গেলে সময়মতো আবেদনের উত্তর দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। অদক্ষভাবে তথ্য সংরক্ষণের কারণে যদি অনুসন্ধান করা তথ্যগুলো পরীক্ষা করা বা অনুলিপি তৈরি করার উপযোগী না থাকে, তবে তা এ আইনকে উপেক্ষিত করে তুলবে। সে জন্য তথ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন জরুরি। তথ্য সংরক্ষণ ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন প্রয়োজন। তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে সরকারি অফিসগুলোকে আধুনিকায়ন করাও জরুরি, যাতে জনগণ প্রয়োজনীয় তথ্য দ্রুত পেতে পারে।
বর্তমানে যেসব আইন ও বিধি অবাধ তথ্যপ্রবাহে বাধা সৃষ্টিকারী, সেগুলো বাতিল, পরিবর্তন কিংবা সংশোধন করতে হবে। তা না হলে জনগণের তথ্য জানার অধিকার পুরোপুরি নিশ্চিত হবে না।
নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রচার সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে। তাই তথ্য প্রচার ও প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো বাধা-বিপত্তি থাকা উচিত নয়। বিশেষ করে গণমাধ্যমের কর্মীরা যাতে নির্ভয়ে এবং নির্বিঘ্নে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন, এ ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করা একান্ত জরুরি।
তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থাকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। তথ্য অধিকারের বিষয়টি সম্পর্কে যখনই জনগণ সচেতন হবে, তখনই তারা এর সুবিধাদি ভোগ করতে পারবে।
পথটা সহজ নয়, চাই সবার সদিচ্ছা
তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে বাধা আসাটাও অসম্ভব কিছু নয়। অবাধ তথ্যপ্রবাহের কারণে যখন সরকারি কর্মকর্তাদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস পাবে, তখন তাঁরা এ ক্ষেত্রে বাধার কারণ হতে পারেন। একই কারণে রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকেও বাধা আসতে পারে। গোপনীয়তার সংস্কৃতির কারণে বেসরকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং তথ্য প্রদানে অনীহার কারণে এনজিওগুলো এর সফল প্রয়োগে বাধার কারণ হতে পারে। বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির জন্য ক্ষেত্র বিশেষে গণমাধ্যম তথ্যের অপব্যবহার করতে পারে। বিচার বিভাগ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্বলতার কারণে তথ্য অধিকার আইনের সঠিক বাস্তবায়ন প্রলম্বিত হতে পারে। সর্বোপরি, সুশীল সমাজের মধ্যে অনৈক্য, অসুস্থ প্রতিযোগিতা, স্বেচ্ছায় ও স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে তথ্য প্রকাশে অনীহাও বাধার কারণ হতে পারে।
দুর্নীতি রোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশে একটি কার্যকর তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের কোনো বিকল্প ছিল না। তথ্যের আবদ্ধতায় জনগণ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়তই শিকার হয় দুর্নীতি, শোষণ ও প্রতারণার। সরকারি কর্মকর্তাদের কার কী দায়দায়িত্ব, নাগরিক সুযোগ-সুবিধাগুলো কী কী, কোন খাতে কত টাকা বরাদ্দ আছে, তা কীভাবে খরচ করার কথা, খরচ হচ্ছে কীভাবে, জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে কী আলোচনা বা সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে কোন প্রক্রিয়ায় ও কিসের ভিত্তিতে এবং কীভাবে—তথ্য অধিকার আইনানুযায়ী এসব তথ্য জনগণ এখন সহজেই জানতে পারবে। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া কঠিন হবে। আইনটির যথাযথ বাস্তবায়ন করা হলে জনগণের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা বাড়বে। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হবে প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা। তথ্য অধিকার আইন যে অপার সম্ভাবনা ও সুযোগ সৃষ্টি করেছে, বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ যেন তা প্রতিহত না করতে পারে, সে জন্য একটি সমন্বিত উদ্যোগের দরকার, যা তথ্যদাতা ও গ্রহীতা উভয়ের স্বার্থকে সংরক্ষণ করবে। এ জন্য দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার দরকার। পাশাপাশি আইন বাস্তবায়নে প্রয়োজন শক্তিশালী নেতৃত্ব। আমরা তথ্য অধিকার আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন চাই।
ড. ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।
No comments