স্মরণ মুক্তিযুদ্ধের বীর মেজর নাজমুল নাসির উদ্দিন হায়দার
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া মোটরস্টেশন থেকে পশ্চিমে এঁকেবেঁকে চলে গেছে ছোট্ট একটি মেঠোপথ। আধ কিলোমিটার হাঁটলেই রাস্তার বাঁ পাশে একটি ছোট্ট একতলা বাড়ি, নামফলকে লেখা ‘স্মরণিকা’। বাড়িটির ঠিক দক্ষিণে পুকুরপাড়ে ‘শহীদ মেজর নাজমুল হক রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়’।
লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার শহীদ মেজর নাজমুল হকের স্মৃতি বহন করছে এই বিদ্যালয়টি। মুক্তিসংগ্রামের এই বীরসেনানির আর কোনো স্মৃতি নেই গোটা গ্রামে।
গ্রামের লোকজনই বা কতটুকু জানে তাঁর সম্পর্কে?
বটতলী মোটরস্টেশনে কথা হয় স্থানীয় কয়েকজন যুবকের সঙ্গে। ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলা উদ্দীন বললেন, ‘মেজর নাজমুল হক যে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন সেটা তো জানতাম না। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিরক্ষায় এলাকায় কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। নতুন প্রজন্মও তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না।’
তাঁর কথার সত্যতা পাওয়া গেল কলেজছাত্র নুরুল ইসলামের কথায়, ‘আমাদের গ্রামে একজন সেক্টর কমান্ডারের জন্ম, এ কথা শিক্ষকেরা কখনোই আমাদের বলেননি।’
মেজর নাজমুল হক রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা পারভিন আকতার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘স্বাধীনতার ৩৭ বছর পরও পাঠ্যবইয়ে সেক্টর কমান্ডারদের কোনো পরিচিতি সংযুক্ত করা হয়নি। পঞ্চম শ্রেণীর সমাজ বইয়ে নামটা উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র। প্রতিবছর নীরবে চলে যায় মেজর নাজমুলের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী।’
হ্যাঁ, আজ আমরা বলছি, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার শহীদ মেজর নাজমুল হকের কথা, যিনি ছিলেন ৭ নম্বর সেক্টরের প্রথম কমান্ডার। ১৯৭১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মিত্রবাহিনীর সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক শেষে ভারতের শিলিগুড়ি ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় অকালেই প্রাণ হারান মেজর নাজমুল। আজ তাঁর ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী।
মেজর নাজমুলের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১ আগস্ট লোহাগাড়ার আমিরাবাদ গ্রামে। তাঁর বাবা অ্যাডভোকেট হাফেজ আহমদ, মা জয়নাব বেগম।
মেজর নাজমুল হক কৃতিত্বের সঙ্গে কুমিল্লার পেশোয়ারা পাঠশালা থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ও ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট) দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময়ই যোগ দেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে।
সমগ্র রাজশাহী-ঠাকুরগাঁও বাদে দিনাজপুরের বাকি অংশ, ব্রহ্মপুত্র-তীরবর্তী এলাকা ব্যতীত সমগ্র বগুড়া ও পাবনা জেলা ছিল ৭ নম্বর সেক্টরের অধীন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কিছু দিন আগে ১৮ মার্চ মেজর নাজমুল হককে নওগাঁয় ৭ ইপিআর উইংয়ের অধিনায়ক করে পাঠানো হয়। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা শুরু হলে পরদিন স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে নওগাঁ মহকুমাকে শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলার অংশ ঘোষণা করেন মেজর নাজমুল হক। স্থানীয় যুবকদের হাতে তিনি তুলে দেন অস্ত্র। স্বেচ্ছাসেবক যুবকদের নিয়ে গঠন করেন ইপিআর মুজাহিদ বাহিনী। সেই বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে প্রথমেই তিনি নওগাঁ ও বগুড়ার পাকিস্তানি হানাদারদের ক্যাম্প দখল করে শত্রুমুক্ত করেন গোটা বগুড়া জেলা। ২৮ মার্চ তাঁর বাহিনীর দ্বিমুখী আক্রমণে রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে হানাদাররা। দিনাজপুরের ধনধনিয়াপাড়ায় ১৮ জুন বড় রকমের এক যুদ্ধের পর ওই এলাকা মেজর নাজমুলের বাহিনীর দখলে আসে। এতে ১৪ জন পাকিস্তানি সেনা মারা যায়।
নিউজ উইকের সাংবাদিক মিলান কে কিউবিক ভারত সীমান্ত দিয়ে ঢুকে মেজর নাজমুলের একটি সাক্ষাত্কার নেন। ১৯৭১ সালের ১০ মে ছাপা হয় সেই সাক্ষাত্কার। মিলান কে কিউবিক লেখেন, “চলে আসার সময় হক (মেজর নামজুল হক) বললেন, ‘চার মাস পর যদি আবার আসেন, তখন আপনাকে কিছু অ্যাকশন দেখাব।’ আমার বিশ্বাস, তিনি এটা ঠিকই করতে পারবেন।”
বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর যুদ্ধ করেছেন মেজর নাজমুলের ৭ নম্বর সেক্টরেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সোনামসজিদ প্রাঙ্গণে ঘুমিয়ে আছেন বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও তাঁর প্রিয় কমান্ডার মেজর নাজমুল হক।
গ্রামের কিছু মানুষ মেজর নাজমুলের স্মৃতিরক্ষায় কাজ করেছেন। ১৯৮৮ সালে এস এম মঞ্জুরুল হক, আহমেদ মনির (সাংবাদিক), গাজী খায়ের আহমেদ ও শামীম আহমদের প্রচেষ্টায় আমিরাবাদ গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মেজর নাজমুল হক প্রাথমিক বিদ্যালয়’। ১৯৯১ সালে বিদ্যালয়টি নিবন্ধিত হলেও এখনো সরকারি করা হয়নি।
মেজর নাজমুল হকের দুই মেয়ে ইশরাত জাহান সুরভী ও নওরীন সাবা শিউলী। সুরভী স্বামীর সঙ্গে আমেরিকায় থাকেন, শিউলী থাকেন ঢাকার উত্তরায়।
নওরীন সাবা শিউলী বলেন, ‘বাবা যখন মারা যান, তখন আমার বয়স মাত্র ১১ মাস। শুনেছি বাবা আমাকে খুব আদর করতেন।’
তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘আমার বাবা একজন সেক্টর কমান্ডার, অথচ তাঁকে রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করা হয়নি। তাঁর নামটাও এখন উচ্চারিত হয় না রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে—এটা খুব কষ্ট দেয় আমাদের। বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির সরকারীকরণে অনেক চেষ্টা করেছি। এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছেও গিয়েছিলাম, কাজ হয়নি।’
মেজর নাজমুলের ভাই আজিজুল হক বলেন, ‘গত ৩৭ বছরে কোনো সরকারই মেজর নাজমুলের পরিবারের খোঁজ নেয়নি। ১৯৭২ সালে অনেক চেষ্টা করে ১৩০ টাকা পেনশন জোগাড় করেছিলাম। এরপর আর কেউ খবর রাখেনি।’
লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার শহীদ মেজর নাজমুল হকের স্মৃতি বহন করছে এই বিদ্যালয়টি। মুক্তিসংগ্রামের এই বীরসেনানির আর কোনো স্মৃতি নেই গোটা গ্রামে।
গ্রামের লোকজনই বা কতটুকু জানে তাঁর সম্পর্কে?
বটতলী মোটরস্টেশনে কথা হয় স্থানীয় কয়েকজন যুবকের সঙ্গে। ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলা উদ্দীন বললেন, ‘মেজর নাজমুল হক যে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন সেটা তো জানতাম না। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিরক্ষায় এলাকায় কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। নতুন প্রজন্মও তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না।’
তাঁর কথার সত্যতা পাওয়া গেল কলেজছাত্র নুরুল ইসলামের কথায়, ‘আমাদের গ্রামে একজন সেক্টর কমান্ডারের জন্ম, এ কথা শিক্ষকেরা কখনোই আমাদের বলেননি।’
মেজর নাজমুল হক রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা পারভিন আকতার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘স্বাধীনতার ৩৭ বছর পরও পাঠ্যবইয়ে সেক্টর কমান্ডারদের কোনো পরিচিতি সংযুক্ত করা হয়নি। পঞ্চম শ্রেণীর সমাজ বইয়ে নামটা উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র। প্রতিবছর নীরবে চলে যায় মেজর নাজমুলের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী।’
হ্যাঁ, আজ আমরা বলছি, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার শহীদ মেজর নাজমুল হকের কথা, যিনি ছিলেন ৭ নম্বর সেক্টরের প্রথম কমান্ডার। ১৯৭১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মিত্রবাহিনীর সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক শেষে ভারতের শিলিগুড়ি ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় অকালেই প্রাণ হারান মেজর নাজমুল। আজ তাঁর ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী।
মেজর নাজমুলের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১ আগস্ট লোহাগাড়ার আমিরাবাদ গ্রামে। তাঁর বাবা অ্যাডভোকেট হাফেজ আহমদ, মা জয়নাব বেগম।
মেজর নাজমুল হক কৃতিত্বের সঙ্গে কুমিল্লার পেশোয়ারা পাঠশালা থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ও ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট) দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময়ই যোগ দেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে।
সমগ্র রাজশাহী-ঠাকুরগাঁও বাদে দিনাজপুরের বাকি অংশ, ব্রহ্মপুত্র-তীরবর্তী এলাকা ব্যতীত সমগ্র বগুড়া ও পাবনা জেলা ছিল ৭ নম্বর সেক্টরের অধীন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কিছু দিন আগে ১৮ মার্চ মেজর নাজমুল হককে নওগাঁয় ৭ ইপিআর উইংয়ের অধিনায়ক করে পাঠানো হয়। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা শুরু হলে পরদিন স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে নওগাঁ মহকুমাকে শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলার অংশ ঘোষণা করেন মেজর নাজমুল হক। স্থানীয় যুবকদের হাতে তিনি তুলে দেন অস্ত্র। স্বেচ্ছাসেবক যুবকদের নিয়ে গঠন করেন ইপিআর মুজাহিদ বাহিনী। সেই বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে প্রথমেই তিনি নওগাঁ ও বগুড়ার পাকিস্তানি হানাদারদের ক্যাম্প দখল করে শত্রুমুক্ত করেন গোটা বগুড়া জেলা। ২৮ মার্চ তাঁর বাহিনীর দ্বিমুখী আক্রমণে রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে হানাদাররা। দিনাজপুরের ধনধনিয়াপাড়ায় ১৮ জুন বড় রকমের এক যুদ্ধের পর ওই এলাকা মেজর নাজমুলের বাহিনীর দখলে আসে। এতে ১৪ জন পাকিস্তানি সেনা মারা যায়।
নিউজ উইকের সাংবাদিক মিলান কে কিউবিক ভারত সীমান্ত দিয়ে ঢুকে মেজর নাজমুলের একটি সাক্ষাত্কার নেন। ১৯৭১ সালের ১০ মে ছাপা হয় সেই সাক্ষাত্কার। মিলান কে কিউবিক লেখেন, “চলে আসার সময় হক (মেজর নামজুল হক) বললেন, ‘চার মাস পর যদি আবার আসেন, তখন আপনাকে কিছু অ্যাকশন দেখাব।’ আমার বিশ্বাস, তিনি এটা ঠিকই করতে পারবেন।”
বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর যুদ্ধ করেছেন মেজর নাজমুলের ৭ নম্বর সেক্টরেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সোনামসজিদ প্রাঙ্গণে ঘুমিয়ে আছেন বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও তাঁর প্রিয় কমান্ডার মেজর নাজমুল হক।
গ্রামের কিছু মানুষ মেজর নাজমুলের স্মৃতিরক্ষায় কাজ করেছেন। ১৯৮৮ সালে এস এম মঞ্জুরুল হক, আহমেদ মনির (সাংবাদিক), গাজী খায়ের আহমেদ ও শামীম আহমদের প্রচেষ্টায় আমিরাবাদ গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মেজর নাজমুল হক প্রাথমিক বিদ্যালয়’। ১৯৯১ সালে বিদ্যালয়টি নিবন্ধিত হলেও এখনো সরকারি করা হয়নি।
মেজর নাজমুল হকের দুই মেয়ে ইশরাত জাহান সুরভী ও নওরীন সাবা শিউলী। সুরভী স্বামীর সঙ্গে আমেরিকায় থাকেন, শিউলী থাকেন ঢাকার উত্তরায়।
নওরীন সাবা শিউলী বলেন, ‘বাবা যখন মারা যান, তখন আমার বয়স মাত্র ১১ মাস। শুনেছি বাবা আমাকে খুব আদর করতেন।’
তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘আমার বাবা একজন সেক্টর কমান্ডার, অথচ তাঁকে রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করা হয়নি। তাঁর নামটাও এখন উচ্চারিত হয় না রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে—এটা খুব কষ্ট দেয় আমাদের। বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির সরকারীকরণে অনেক চেষ্টা করেছি। এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছেও গিয়েছিলাম, কাজ হয়নি।’
মেজর নাজমুলের ভাই আজিজুল হক বলেন, ‘গত ৩৭ বছরে কোনো সরকারই মেজর নাজমুলের পরিবারের খোঁজ নেয়নি। ১৯৭২ সালে অনেক চেষ্টা করে ১৩০ টাকা পেনশন জোগাড় করেছিলাম। এরপর আর কেউ খবর রাখেনি।’
No comments