সময়চিত্র আসিফ নজরুল সংবিধান সংশোধনের চিন্তা কেন
আইন-গবেষক হিসেবে কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে আমাদের। বাংলাদেশে গণতন্ত্রচর্চা নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের বিপুল আগ্রহ রয়েছে। গত নির্বাচনের সময় এঁদের কেউ কেউ একনিষ্ঠ সমর্থকের মতো কোনো একটি দলের বিজয় কামনা করেছেন। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর দেখা গেল, এঁরা বেশ আনন্দিত, কিন্তু একই সঙ্গে কিছুটা চিন্তিতও। কারণ, এর মধ্যে তাঁরা জেনেছেন যে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশেই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা (সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়) নিয়ে আসা সরকারের পরিণতি ভালো হয়নি।
এটি নিয়ে আমি নিজেও আগে লিখেছি। যা লিখিনি তা হচ্ছে, এই পরিণতির একটি বড় কারণ সংবিধান সংশোধনের চিন্তা। প্রতিটি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার তার পতন ত্বরান্বিত বা অবধারিত করেছে এই চিন্তাকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে। উদাহরণ দেওয়ার আগে প্রথমে বলে রাখি, সংবিধান সংশোধন এমনিতে খারাপ কিছু নয়। আমেরিকায় প্রথম দিককার সংশোধনীগুলোর মধ্য দিয়ে মানবাধিকারের প্রসার ঘটানো হয়েছে। ইউরোপে বেশ কিছু দেশে সামপ্রতিক সংশোধনীগুলো আনা হয়েছে মানবাধিকার শক্তিশালীকরণ বা নাগরিকদের তথ্য অধিকারকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। ভারতে গত ষাট বছরে শ খানেক সংশোধনীর মধ্যে বেশ কয়েকটি ছিল জনস্বার্থমূলক। যেমন—নিম্ন বর্ণ ও গোত্রের মানুষের জন্য জাতীয় কমিশন গঠন করা, স্থানীয় শাসন জোরদার করা, মন্ত্রিসভার আয়তন সীমিত করা, স্পিকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা এবং জরুরি অবস্থা জারিকে আরও নিয়ন্ত্রিত করা। দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৯৬ সালে যে নতুন সংবিধান গ্রহণ করেছে, তাকে পৃথিবীর অন্যতম প্রগতিশীল একটি সংবিধান হিসেবে অভিহিত করা হয়।
পৃথিবীতে এমন বহু দেশে সংবিধানে সংশোধনী আনা হয়েছে নাগরিক অধিকার ও স্বার্থকে সুনিশ্চিত করার জন্য, সুশাসনের সম্ভাবনা সুদৃঢ় করার জন্য। এর ব্যতিক্রমও আছে। এই ব্যতিক্রম দক্ষিণ এশিয়ায় কম নয়। আমাদের দেশেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ বৃদ্ধির জন্য বা অবৈধ ক্ষমতা আইনানুগ করার জন্য। আশ্চর্য নয়, এর মধ্যে সবচেয়ে আপত্তিকর সংশোধনগুলো করা হয়েছে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসা সরকারগুলোর সময়ে।
২.
বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে কার্যত এক ব্যক্তির সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার বা মৌলিক কাঠামোই বদলে দেওয়া হয় (দেখুন: মাহমুদুল ইসলাম, কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা: ৪০৬)। অনেক পরে একটি মামলায় হাইকোর্ট সংশোধনীটির তীব্র সমালোচনা করলেও এটিকে অবৈধ ঘোষণা করা থেকে অযৌক্তিকভাবে বিরত থাকেন (৩৩ ডিএলআর ৩৮১)।
জিয়াউর রহমানের আমলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদ সংযোজন করে সামরিক শাসনামলের আইনকানুন, সংবিধান সংশোধনীসহ সবকিছু বৈধতা দেওয়া হয়। পঞ্চম সংশোধনী নামে বহুল পরিচিত এই সংবিধান সংশোধনীও ছিল সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার বা মূল কাঠামোবিরোধী। ২০০৫ সালে হাইকোর্টের রায়ে এটিকে তাই অবৈধ ঘোষণা করা হয়। একইভাবে পরে এরশাদ সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসনের সুযোগে সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে তাঁর সামরিক শাসনকে বৈধ করে নেন। এটিও সংবিধানের মৌলিক কাঠামোবিরোধী ছিল। আমার ধারণা, আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হলে এটিও অবৈধ বলে ঘোষিত হবে। এরশাদ সংবিধানের যে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে হাইকোর্টকে অঞ্চলভিত্তিকভাবে ভাগ করার চেষ্টা করেন, তা অবশ্য উচ্চ আদালতে অনেক আগেই অবৈধ ঘোষিত হয়েছে।
অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ে সার্বভৌমত্ব, আইনের শাসন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, ক্ষমতার পৃথক্করণ, এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো হিসেবে উল্লেখ করা হয়। রায়ে বলা হয়, (নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও) কোনো সংসদের মাধ্যমে সংবিধানের এসব মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করা হলে তা হবে অবৈধ। এই রায়ের আলোকে ১৯৯০ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আগে প্রতিটি সরকার অবৈধভাবে সংবিধান সংশোধন করেছিল বলা যায়।
১৯৯০ সালের পর প্রথম নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ২০০১ সালের বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। জোট সরকারের চতুর্দশ সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামোবিরোধী ছিল না। কিন্তু পছন্দসই একজন সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার লক্ষ্যে এই সংশোধনীটি করা হয়েছিল বলে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়। এটি নৈতিকভাবে বিপুলসংখ্যক মানুষের বিরোধিতারও সম্মুখীন হয়। সংবিধান সংশোধনীকে তাই আগের আমলের নিরঙ্কুশ সরকারগুলোর মতো বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারেরও পতনের বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে একটি দলের পক্ষে এককভাবে সংবিধান পরিবর্তন করা সম্ভব। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা বাংলাদেশের সংবিধান ও মানুষের জন্য কোনো দিন কল্যাণ বয়ে আনেনি। বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীরা সংবিধান সংশোধনের কথা জোরেশোরে বলা শুরু করা মাত্র তাই বিভিন্ন মহলে দুর্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এই দুর্ভাবনা অপরিণত এমনকি কারও কারও ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হতে পারে। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে একে অযৌক্তিক মনে করার কোনো কারণ নেই।
৩.
বাংলাদেশের বহু নিরপেক্ষ মহল মনে করে, আমাদের সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। সংবিধানের ত্রুটিগুলো লক্ষ করলেই তা বোঝা যাবে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারগুলো আমাদের সংবিধানে যথেষ্টভাবে বর্ণিত হয়নি। লিগ্যাল এইড, শ্রমিকদের জীবনধারণক্ষম ন্যূনতম মজুরি, মা ও শিশুদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা, পরিবেশ রক্ষা, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর সাংসৃ্কতিক অধিকারের কোনো উল্লেখ নেই সেখানে। ধর্ম পালনের অধিকারের ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে আমাদের সংবিধানে। আমাদের সংবিধানে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান ভারত বা পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর ও স্বৈরতান্ত্রিক। সংবিধানে সংসদের ন্যূনতম অধিবেশন বা কার্যদিবসের কথা বলা হয়নি; বরং অনুমতি না নিয়ে একাদিক্রমে সংসদের ৮৯ বৈঠক দিবসে অনুপস্থিত থাকার সুযোগ রয়েছে সাংসদদের। আবার সরকারি দল কোনো কালো আইন পাস করতে চাইলে এর বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার, এমনকি ভোটদানে বিরত থাকার অধিকার সরকারি দলের সাংসদদের নেই। গত অন্তত পাঁচ বছরে নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী, গণমাধ্যম, এমনকি বড় দুই দলের কিছু নেতাও এসব বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনের কথা বলেছেন।
আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা সংবিধান সংশোধনের কথা বলতে গিয়ে এসব বিষয়ের অবতারণা করেননি। তাঁরা বরং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলুপ্তি এবং সরকারের মেয়াদ হ্রাসের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে সংবিধান পরিবর্তনের চিন্তার কথা বলেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাংলাদেশের সংবিধানে সংযোজন করা হয়েছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছে, তা আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় শ্রেয়তর হিসেবে দেশে-বিদেশে স্বীকৃত হয়েছে। এই সরকারগুলোর আমলে সংবাদপত্রের সুরক্ষা, নির্বাচনী আইনের সংস্কার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা শক্তিশালীকরণ-সংক্রান্ত বিভিন্ন জনস্বার্থমূলক আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।
সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমাদের কিছু খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছিল, এটিও সত্যি। কিন্তু নজিরবিহীন যে জরুরি অবস্থার জোয়াল জাতির কাঁধে ওই সময়ে চেপে বসে, তার প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল মূলত রাজনৈতিক দলগুলোই। সেই সময়ের খারাপ অভিজ্ঞতা স্মরণে রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা ও মেয়াদ সুনির্দিষ্টকরণের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনের চিন্তা করা যেতে পারে। কিন্তু এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল করার উদ্যোগ নিলে এর পেছনের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে বিতর্ক উঠবে। বর্তমান সরকার তার পূর্বসূরির মতো প্রশাসনে যে নগ্ন দলীয়করণ শুরু করেছে, এতে এই সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার পদক্ষেপ নিলে তা আরও একটি ভয়াবহ রাজনৈতিক বিরোধ ডেকে আনতে পারে দেশে।
সরকারের মেয়াদ হ্রাস করে চার বছর করার চিন্তাটি নিয়েও আরও ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। এটি প্রশংসনীয় চিন্তা, তবে এ ক্ষেত্রেও সরকারের উচিত হবে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে এগোনো। রাজনৈতিক সমঝোতার পাশাপাশি সংবিধানের আপাদমস্তক পূর্ণপাঠ, পর্যালোচনা ও পরিবর্তনের জন্য একটি স্থায়ী কমিশন গঠনের চিন্তাও সরকার করতে পারে।
আমার ধারণা, বাংলাদেশের তিনজন অতি শ্রদ্ধেয় সাবেক প্রধান বিচারপতিকে (সাহাবুদ্দীন আহমদ, মোস্তফা কামাল ও মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান) রাজি করিয়ে তাঁদের নিয়ে এই কমিশন গঠন করা হলে এবং কমিশনের মতামতের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিলে রাজনৈতিক সমঝোতা স্থাপন অনেক সহজতর হবে। সংবিধান সংশোধন নিয়ে আমাদের দুর্ভাবনাও এতে বহুলাংশে হ্রাস পাবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এটি নিয়ে আমি নিজেও আগে লিখেছি। যা লিখিনি তা হচ্ছে, এই পরিণতির একটি বড় কারণ সংবিধান সংশোধনের চিন্তা। প্রতিটি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার তার পতন ত্বরান্বিত বা অবধারিত করেছে এই চিন্তাকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে। উদাহরণ দেওয়ার আগে প্রথমে বলে রাখি, সংবিধান সংশোধন এমনিতে খারাপ কিছু নয়। আমেরিকায় প্রথম দিককার সংশোধনীগুলোর মধ্য দিয়ে মানবাধিকারের প্রসার ঘটানো হয়েছে। ইউরোপে বেশ কিছু দেশে সামপ্রতিক সংশোধনীগুলো আনা হয়েছে মানবাধিকার শক্তিশালীকরণ বা নাগরিকদের তথ্য অধিকারকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। ভারতে গত ষাট বছরে শ খানেক সংশোধনীর মধ্যে বেশ কয়েকটি ছিল জনস্বার্থমূলক। যেমন—নিম্ন বর্ণ ও গোত্রের মানুষের জন্য জাতীয় কমিশন গঠন করা, স্থানীয় শাসন জোরদার করা, মন্ত্রিসভার আয়তন সীমিত করা, স্পিকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা এবং জরুরি অবস্থা জারিকে আরও নিয়ন্ত্রিত করা। দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৯৬ সালে যে নতুন সংবিধান গ্রহণ করেছে, তাকে পৃথিবীর অন্যতম প্রগতিশীল একটি সংবিধান হিসেবে অভিহিত করা হয়।
পৃথিবীতে এমন বহু দেশে সংবিধানে সংশোধনী আনা হয়েছে নাগরিক অধিকার ও স্বার্থকে সুনিশ্চিত করার জন্য, সুশাসনের সম্ভাবনা সুদৃঢ় করার জন্য। এর ব্যতিক্রমও আছে। এই ব্যতিক্রম দক্ষিণ এশিয়ায় কম নয়। আমাদের দেশেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ বৃদ্ধির জন্য বা অবৈধ ক্ষমতা আইনানুগ করার জন্য। আশ্চর্য নয়, এর মধ্যে সবচেয়ে আপত্তিকর সংশোধনগুলো করা হয়েছে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসা সরকারগুলোর সময়ে।
২.
বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে কার্যত এক ব্যক্তির সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার বা মৌলিক কাঠামোই বদলে দেওয়া হয় (দেখুন: মাহমুদুল ইসলাম, কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা: ৪০৬)। অনেক পরে একটি মামলায় হাইকোর্ট সংশোধনীটির তীব্র সমালোচনা করলেও এটিকে অবৈধ ঘোষণা করা থেকে অযৌক্তিকভাবে বিরত থাকেন (৩৩ ডিএলআর ৩৮১)।
জিয়াউর রহমানের আমলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদ সংযোজন করে সামরিক শাসনামলের আইনকানুন, সংবিধান সংশোধনীসহ সবকিছু বৈধতা দেওয়া হয়। পঞ্চম সংশোধনী নামে বহুল পরিচিত এই সংবিধান সংশোধনীও ছিল সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার বা মূল কাঠামোবিরোধী। ২০০৫ সালে হাইকোর্টের রায়ে এটিকে তাই অবৈধ ঘোষণা করা হয়। একইভাবে পরে এরশাদ সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসনের সুযোগে সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে তাঁর সামরিক শাসনকে বৈধ করে নেন। এটিও সংবিধানের মৌলিক কাঠামোবিরোধী ছিল। আমার ধারণা, আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হলে এটিও অবৈধ বলে ঘোষিত হবে। এরশাদ সংবিধানের যে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে হাইকোর্টকে অঞ্চলভিত্তিকভাবে ভাগ করার চেষ্টা করেন, তা অবশ্য উচ্চ আদালতে অনেক আগেই অবৈধ ঘোষিত হয়েছে।
অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ে সার্বভৌমত্ব, আইনের শাসন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, ক্ষমতার পৃথক্করণ, এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো হিসেবে উল্লেখ করা হয়। রায়ে বলা হয়, (নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও) কোনো সংসদের মাধ্যমে সংবিধানের এসব মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করা হলে তা হবে অবৈধ। এই রায়ের আলোকে ১৯৯০ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আগে প্রতিটি সরকার অবৈধভাবে সংবিধান সংশোধন করেছিল বলা যায়।
১৯৯০ সালের পর প্রথম নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ২০০১ সালের বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। জোট সরকারের চতুর্দশ সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামোবিরোধী ছিল না। কিন্তু পছন্দসই একজন সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার লক্ষ্যে এই সংশোধনীটি করা হয়েছিল বলে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়। এটি নৈতিকভাবে বিপুলসংখ্যক মানুষের বিরোধিতারও সম্মুখীন হয়। সংবিধান সংশোধনীকে তাই আগের আমলের নিরঙ্কুশ সরকারগুলোর মতো বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারেরও পতনের বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে একটি দলের পক্ষে এককভাবে সংবিধান পরিবর্তন করা সম্ভব। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা বাংলাদেশের সংবিধান ও মানুষের জন্য কোনো দিন কল্যাণ বয়ে আনেনি। বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীরা সংবিধান সংশোধনের কথা জোরেশোরে বলা শুরু করা মাত্র তাই বিভিন্ন মহলে দুর্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এই দুর্ভাবনা অপরিণত এমনকি কারও কারও ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হতে পারে। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে একে অযৌক্তিক মনে করার কোনো কারণ নেই।
৩.
বাংলাদেশের বহু নিরপেক্ষ মহল মনে করে, আমাদের সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। সংবিধানের ত্রুটিগুলো লক্ষ করলেই তা বোঝা যাবে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারগুলো আমাদের সংবিধানে যথেষ্টভাবে বর্ণিত হয়নি। লিগ্যাল এইড, শ্রমিকদের জীবনধারণক্ষম ন্যূনতম মজুরি, মা ও শিশুদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা, পরিবেশ রক্ষা, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর সাংসৃ্কতিক অধিকারের কোনো উল্লেখ নেই সেখানে। ধর্ম পালনের অধিকারের ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে আমাদের সংবিধানে। আমাদের সংবিধানে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান ভারত বা পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর ও স্বৈরতান্ত্রিক। সংবিধানে সংসদের ন্যূনতম অধিবেশন বা কার্যদিবসের কথা বলা হয়নি; বরং অনুমতি না নিয়ে একাদিক্রমে সংসদের ৮৯ বৈঠক দিবসে অনুপস্থিত থাকার সুযোগ রয়েছে সাংসদদের। আবার সরকারি দল কোনো কালো আইন পাস করতে চাইলে এর বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার, এমনকি ভোটদানে বিরত থাকার অধিকার সরকারি দলের সাংসদদের নেই। গত অন্তত পাঁচ বছরে নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী, গণমাধ্যম, এমনকি বড় দুই দলের কিছু নেতাও এসব বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনের কথা বলেছেন।
আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা সংবিধান সংশোধনের কথা বলতে গিয়ে এসব বিষয়ের অবতারণা করেননি। তাঁরা বরং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলুপ্তি এবং সরকারের মেয়াদ হ্রাসের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে সংবিধান পরিবর্তনের চিন্তার কথা বলেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাংলাদেশের সংবিধানে সংযোজন করা হয়েছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছে, তা আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় শ্রেয়তর হিসেবে দেশে-বিদেশে স্বীকৃত হয়েছে। এই সরকারগুলোর আমলে সংবাদপত্রের সুরক্ষা, নির্বাচনী আইনের সংস্কার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা শক্তিশালীকরণ-সংক্রান্ত বিভিন্ন জনস্বার্থমূলক আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।
সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমাদের কিছু খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছিল, এটিও সত্যি। কিন্তু নজিরবিহীন যে জরুরি অবস্থার জোয়াল জাতির কাঁধে ওই সময়ে চেপে বসে, তার প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল মূলত রাজনৈতিক দলগুলোই। সেই সময়ের খারাপ অভিজ্ঞতা স্মরণে রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা ও মেয়াদ সুনির্দিষ্টকরণের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনের চিন্তা করা যেতে পারে। কিন্তু এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল করার উদ্যোগ নিলে এর পেছনের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে বিতর্ক উঠবে। বর্তমান সরকার তার পূর্বসূরির মতো প্রশাসনে যে নগ্ন দলীয়করণ শুরু করেছে, এতে এই সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার পদক্ষেপ নিলে তা আরও একটি ভয়াবহ রাজনৈতিক বিরোধ ডেকে আনতে পারে দেশে।
সরকারের মেয়াদ হ্রাস করে চার বছর করার চিন্তাটি নিয়েও আরও ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। এটি প্রশংসনীয় চিন্তা, তবে এ ক্ষেত্রেও সরকারের উচিত হবে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে এগোনো। রাজনৈতিক সমঝোতার পাশাপাশি সংবিধানের আপাদমস্তক পূর্ণপাঠ, পর্যালোচনা ও পরিবর্তনের জন্য একটি স্থায়ী কমিশন গঠনের চিন্তাও সরকার করতে পারে।
আমার ধারণা, বাংলাদেশের তিনজন অতি শ্রদ্ধেয় সাবেক প্রধান বিচারপতিকে (সাহাবুদ্দীন আহমদ, মোস্তফা কামাল ও মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান) রাজি করিয়ে তাঁদের নিয়ে এই কমিশন গঠন করা হলে এবং কমিশনের মতামতের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিলে রাজনৈতিক সমঝোতা স্থাপন অনেক সহজতর হবে। সংবিধান সংশোধন নিয়ে আমাদের দুর্ভাবনাও এতে বহুলাংশে হ্রাস পাবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments