ফ্রান্সে স্বামীর প্ররোচনায় স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছেন ৫০ পুরুষ, রায় আগামী সপ্তাহে

কেউ তরুণ, কেউ বৃদ্ধ, কেউ দশাসই, কেউ আবার শীর্ণকায়, কেউ সাদা, কেউ শ্বেতাঙ্গ, কেউ-বা কৃষ্ণাঙ্গ। তাঁদের মধ্যে কেউ গাড়িচালক, কেউ দমকল কর্মকর্তা, কেউ সেনাসদস্য, কেউ-বা নিরাপত্তারক্ষী। এমনকি একজন সাংবাদিক ও একজন ডিজেও রয়েছেন।

এসব পুরুষের সংখ্যা ৫০। তাঁরা ফ্রান্সের আলোচিত গিস লে পেলিকোতকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত। অভিযোগ, গিস লে-এর স্বামী ৭২ বছর বয়সী ডোমিনিক পেলিকোত তাঁকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করতেন। এরপর অন্য পুরুষ দিয়ে স্ত্রীকে ধর্ষণ করাতেন। এভাবে চলেছিল প্রায় এক দশক।

গত সেপ্টেম্বর থেকে এই মামলার বিচার চলছে। আগামী সপ্তাহে মামলার বিচার শেষে রায় হতে পারে। যদি তাঁরা দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে সম্মিলিতভাবে তাঁদের সাজার মেয়াদ হবে ৬০০ বছরের বেশি।

বিচার চলাকালে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কয়েকজন বেশ প্রতিবাদ জানান। কিন্তু তাঁদের বেশির ভাগই যখন বিচারকের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন, তখন তাঁদের চোখ ছিল মাটির দিকে। মাঝেমধ্যে শুধু নিজের আইনজীবীর দিকে তাকিয়েছেন, তবে সে তাকানোয় ছিল একধরনের আশ্বাস পাওয়ার আকুতি।

অভিযুক্ত এই ৫০ ব্যক্তির বেশির ভাগই এসেছেন গিস লে–র গ্রাম মাজানের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যকার ছোট শহর ও গ্রাম থেকে।

৬৯ বছর বয়সী জোসেফ সি নামের একজন অবসরপ্রাপ্ত ক্রীড়া কোচ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একজন। তিনি যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে তাঁর চার বছরের কারাদণ্ড হবে। আইনজীবীরা যে দণ্ড দাবি করেছেন, তার মধ্যে এটি সবচেয়ে কম। অন্যদিকে আরেকজন হলেন ৬৩ বছর বয়সী রোমেইন ভি। তিনি দোষী সাব্যস্ত হলে ১৮ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।

রোমেইন ভি নিজে এইচআইভি সংক্রমিত ছিলেন জানার পরও গিস লে-কে বিভিন্ন সময় ছয়বার ধর্ষণ করেছেন। এ সময় তিনি কোনো সুরক্ষা নেননি। যদিও তাঁর আইনজীবী জানিয়েছেন, তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাই তাঁর মাধ্যমে এই ভাইরাস সংক্রমিত না–ও হতে পারে।

আইনজীবীরা এই মামলায় বিশদ তথ্যপ্রমাণ পেয়েছেন। কারণ, গিস লে-এর স্বামী ডোমিনিক পেলিকোত এক দশকের বেশি সময় ধরে স্ত্রীকে ধর্ষণ করানোর ঘটনাগুলো ভিডিও করে রেখেছেন। তিনি নিজেও আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ স্বীকার করেছেন। এবং আদালতকে বলেছেন, তাঁর সহ-অভিযুক্ত এই ৫০ জনই দোষী।

ফ্রান্সে ধর্ষণবিরোধী আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘সহিংসতা, জবরদস্তি, হুমকি বা আকস্মিকভাবে’ কোনো যৌন নির্যাতন করা হলে তাকে ধর্ষণ বলা যাবে। এতে ভুক্তভোগীর অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনের কথা বলা হয়নি।

এই আইনের ভিত্তিতে বিবাদীদের আইনজীবীরা যুক্তি তুলে ধরে বলেন, গিস লে অনুমতি দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিলেন না। এটা তাঁরা জানতেন না। তাই ওই ঘটনা ধর্ষণ হতে পারে না। এক বিবাদীর আইনজীবী বলেন, ইচ্ছে করে ধর্ষণ না করে থাকলে সেটা কোনো অপরাধ হতে পারে না।

স্বেচ্ছাসেবী একজন দমকলকর্মী ক্রিশ্চিয়ান এল বলেন, ‘আমার শরীর তাঁকে ধর্ষণ করেছে, কিন্তু আমার মস্তিষ্ক এতে সায় দেয়নি।’

অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একজন ৬৩ বছর বয়সী জেন-পিয়ারি। তাঁকে বলা হচ্ছে ডোমিনিকের শিষ্য। কীভাবে নিজের স্ত্রীকে ওষুধ দিয়ে অচেতন করে অপব্যবহার করবেন, সেই শিক্ষা তিনি ডোমিনিকের কাছ থেকে শিখেছেন। এটা তিনি পাঁচ বছর ধরে করেছেন বলেও স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ডোমিনিকের সঙ্গে দেখা করাটাই তাঁর অপরাধ ছিল। ডোমিনিক তাঁকে নিজের ভাইয়ের (কাজিন) মতো কাছে টেনে নিয়েছিল। আইনজীবীরা তাঁর ১৭ বছরের কারাদণ্ড চেয়েছেন।

ডোমিনিক প্রতারণা করেছেন

৫৪ বছরের আহমেদ টি পেশায় পানির পাইপের মিস্ত্রি। ছোটবেলার প্রেমিকাকে বিয়ে করে ৩০ বছরের সংসার তাঁদের। তিনি বলেন, তিনি যদি ধর্ষণ করতেই চাইতেন, তাহলে ষাটোর্ধ্ব কাউকে নয় নিশ্চয়ই।

রেদোয়ান এ একজন বেকার মানুষ। ৪০ বছরের এই ব্যক্তি বলেন, তিনি যদি ধর্ষণই করতেন, তাহলে নিশ্চয়ই ডোমিনিককে সেই দৃশ্য ধারণ করার অনুমতি দিতেন না।

কেউ কেউ আবার বলেছেন, ডোমিনিক তাঁদের এমনটা করতে ভয় দেখিয়েছিলেন। আইনজীবী বিবিসিকে বলেন, ডোমিনিক হলেন জঘন্য চরিত্রের মানুষ।

পুরুষ নার্স রেদোয়ান ই আদালতকক্ষে বলেন, শোবার ঘর ছেড়ে যাওয়ার সময় তিনি অনেক ভয় পেয়েছিলেন।

অন্যরা যুক্তি দেন, ডোমিনিক তাঁদের পানীয় পান করিয়েছিলেন। সেখানে মাদক বা অন্য কিছু মেশানো ছিল। তাই তাঁরা কী হয়েছিল, তা মনে করতে পারছেন না। যদিও ডোমিনিক এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

বেশির ভাগই বলেন, ডোমিনিক তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা বা কৌশল খাটিয়েছেন। ডোমিনিক তাঁদের বুঝিয়েছিলেন, তাঁরা এই দম্পতির সঙ্গে একটি ‘যৌন খেলায়’ অংশ নিচ্ছেন।

অভিযুক্ত ক্রিস্টোফ ব্রুচি, জোসেফ সির আইনজীবী বিবিসিকে বলেন, তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। তবে ডোমিনিক বরাবরই বলে আসছেন, তাঁর স্ত্রী যে বিষয়টি জানেন না, তিনি ওই ব্যক্তিদের কাছে সেই বিষয়টি অনেকবার স্পষ্ট করেছেন।

ডোমিনিক তাঁদের বলেছেন, তাঁর স্ত্রী যেন কোনোভাবেই জেগে না ওঠেন বা তাঁরা যেন এমন কিছু ফেলে না যান, যাতে তাঁদের শনাক্ত করা যায়। যেমন গিস লে-কে স্পর্শ করার আগে তাঁদের হাত গরম করে নিতে বলতেন। তাঁরা যেন কোনো ধরনের সুগন্ধি ব্যবহার না করেন বা ধূমপান না করে আসেন। কারণ, এর ঘ্রাণ থেকে গেলে গিস লে-এর মনে সন্দেহ তৈরি হতে পারে। তাঁরা সবাই এটা জানতেন।

গত সেপ্টেম্বর থেকে একের পর এক এই ৫০ জনকে অ্যাভিগনন শহরে আদালতে হাজির করা হচ্ছে। সাধারণত ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিষয়ে তদন্ত করতে কয়েক দিন লাগে। কিন্তু এই মামলার বিচারে বিবাদীর সংখ্যাটি বেশি হওয়ায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের জড়ো করা হয়।

গিস লে পেলিকোত: তাঁরা সজ্ঞানে আমাকে ধর্ষণ করেছিলেন

অনেক বিবাদীর বর্তমান ও সাবেক নারী সঙ্গীর স্বাস্থ্যগত পরীক্ষা করা হয়েছে। তাঁদের সঙ্গেও গিস লে-এর মতো হয়েছে কি না, তা যাচাই করতে এই পরীক্ষা করা হয়। তাঁদের মধ্যে একজন নারী বলেন, তাঁর মধ্যে এখন থেকে তীব্র সন্দেহ থাকবে, ‘শ্রদ্ধাশীল, চিন্তাশীল ও মিষ্টি এই মানুষটা’ তাঁকে কখনো তাঁর অজান্তে এমন খারাপ কিছু করেছেন কি না।

এই মামলার বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একই সুতায় গাঁথতে এমন একটি উপাদান খুঁজে পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হচ্ছিল।

গিস লে-এর আইনজীবীরা বলেন, সেখানে সবার ক্ষেত্রে যা পাওয়া গেছে, তা হলো প্রত্যেকে নিজের ইচ্ছেতেই গিস লে–র বাড়িতে গেছেন, এমনটা এখনো দেখা যায়নি। তবে সবার মধ্যে একটি বিষয়ে মিল রয়েছে, তা হলো তাঁরা সবাই সচেতনভাবে পুলিশের কাছে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

বিচার কার্যক্রম শুরুর হওয়ার প্রথম দিকে গিস লে-এর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তিনি কি মনে করেন বিবাদীরা তাঁর স্বামীর কারসাজির শিকার। জবাবে গিস লে মাথা নেড়ে বলেছিলেন, তাঁকে ধর্ষণের জন্য কেউ তাঁদের মাথায় বন্দুক ধরেননি। তাঁরা পূর্ণজ্ঞানে তাঁকে ধর্ষণ করেছেন। তিনি উল্টো জানতে চান, তাঁরা কেন পুলিশের কাছে গেলেন না? এমনকি একটি বেনামে কলও তাঁর জীবন রক্ষা করতে পারত। কিন্তু একজনও তা করেননি।

আদালতে আইনজীবীর সঙ্গে গিস লে পেলিকোত। ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
আদালতে আইনজীবীর সঙ্গে গিস লে পেলিকোত। ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.