মালিককে মেঝেতে পুঁতে কর্মচারীদের নির্বিকার বসবাস

রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে ভাণ্ডারীর মোড়ে কাপড়ের স্কিন প্রিন্টের ব্যবসা করতেন নূর-এ-আলম। পরিবারের সদস্যরা ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে থাকলেও কাজের সুবাদে কর্মচারীদের সঙ্গে কারখানাতেই থাকতেন তিনি। কারখানার ভেতরে জুয়া খেলতে নিষেধ করায় তাকে হত্যার পর বাথরুমে নিয়ে লাশ দুইভাগ করে কারখানার মেঝেতে পুঁতে রাখে তারই কর্মচারীরা। লাশ ঘরের মধ্যে পুঁতে রেখে কিছু না জানার অভিনয় করে সেখানেই খাবার খাওয়া, ঘুমানোসহ নিত্যদিনের কাজ করে যাচ্ছিল কর্মচারী মিরাজ ও তার সঙ্গী রিফাত, সম্রাট, জিহাদরা। স্বজনদের অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযুক্ত তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। নিহতের লাশও উদ্ধার করা হয়েছে মাটি খুঁড়ে।

নিহত নূর-এ-আলমের জামাতা আতাউল্লাহ খান সজীব বলেন, কামরাঙ্গীরচরের হাসান নগরে এক বছর আগে একটি কাপড়ের কারখানা স্থাপন করেন তার শ্বশুর নূর আলম। সেখানেই তিনি থাকতেন। গত শুক্রবার তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে যাওয়ার কথা ছিল। তার আগেই বৃহস্পতিবার ভোররাত ৪টা ৩৫ মিনিটে আলমের ফোন থেকে তার স্ত্রীর ফোনে একটি কল আসে। কল রিসিভ করার পর আলম কোনো কথা না বললেও তার আশপাশে চিল্লাচিল্লির শব্দ শোনা যায়। এরপর থেকেই তার ব্যবহৃত ফোনটি বন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। পরের দিন বাড়িতে না ফেরায় আমরা ঢাকা-ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ শুরু করি। কিন্তু কোনোভাবেই তার সন্ধান পাইনি। কারখানায় গিয়ে কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করলে তারা কিছুই জানে না বলে জানায়। উপায় না পেয়ে আমি একপর্যায়ে কামরাঙ্গীরচর থানায় যোগাযোগ করি। পরে ফোনকল এবং অন্যান্য প্রমাণ বিশ্লেষণ করে পুলিশ মঙ্গলবার ওই কারখানা থেকে প্রথমে নূর-এ-আলমের কর্মচারী মিরাজ মিয়াকে (২০) আটক করে। তার মাধ্যমে কামরাঙ্গীরচরের ঝাউরাহাটি থেকে মো. রিফাত (১৯) ও কোতোয়ালি থানার সদরঘাট থেকে মো. শিপন ওরফে সম্রাটকে (২৫) আটক করা হয়।

এদিকে গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এই হত্যাকাণ্ডের তথ্য তুলে ধরে ডিএমপি’র লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার মো. জসিম উদ্দিন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা নূর-এ-আলমকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। তারা বলেছেন, বৃহস্পতিবার ভোররাতে শিপন, মিরাজ, রিফাত ও জিহাদসহ আরও ২ থেকে ৩ জন মিলে কারখানার মধ্যে জুয়া খেলছিল। তখন কারখানার মালিক নূর-এ-আলম টের পেয়ে তাদের বকাঝকা করেন ও কারখানার মধ্যে জুয়া খেলতে নিষেধ করেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। একপর্যায়ে নূর আলম ফোন দিয়ে তার পরিবারকে জানায় তিনি বাড়ি যাবেন। জুয়া খেলার কথা বাইরে বলে দেয়ার ভয়ে তারা নূর আলমের মাথায় পেছন থেকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে। আরেকজন তার বুকে, গলায়সহ শরীরের বিভিন্নস্থানে ছুরি দিয়ে আঘাত করতে থাকে। এতে ঘটনাস্থলেই নূর-এ-আলমের মৃত্যু হয়। তখন লাশ কারখানার ভিতরের বাথরুমে নিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে দু’টি পলিথিন ও কাপড় দিয়ে আলাদা আলাদা করে পেঁচিয়ে একটি বস্তায় ভরে কারখানার ভেতরে টেবিলের নিচের মেঝে ভেঙে মাটিতে দুই ফুট গর্ত করে চাপা দিয়ে দেয় তারা। কেউ যেন বুঝতে না পারে এজন্য খনন করা জায়গাটি বালু ও সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করে দেয়া হয়।

এ বিষয়ে বুধবার কামরাঙ্গীরচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিরুল ইসলাম বলেন, নূর-এ-আলম কারখানার মালিক। ওই কারখানার এক কর্মচারী মিরাজ।  সে ওই কারখানায় থাকে। মিরাজ গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে আরও তিনজন বহিরাগতকে নিয়ে কারখানায় জুয়া খেলছিল। পাশের কক্ষ থেকে মালিক নূর-এ-আলম টের পেয়ে তাদের বকাঝকা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে একজন আলমকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে এবং আরেকজন তার বুকে ছুরিকাঘাত করে। ঘটনাস্থলেই নূর-এ-আলমের মৃত্যু হয়। এরপর হত্যাকারীরা মরদেহ টুকরো টুকরো করে ফ্যাক্টরির মাটির নিচে গভীর গর্ত খুঁড়ে তা পুঁতে রাখে এবং সিমেন্ট দিয়ে সেই স্থান ঢেকে দেয়। এই ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই সঙ্গে হত্যার কাজে ব্যবহৃত একটি হাতুড়ি, একটি কাঁচি ও দু’টি চাকু উদ্ধারসহ অন্যান্য আলামত পুলিশ উদ্ধার করেছে। তদন্তের জন্য লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। এ ঘটনায় নিহতের জামাতা আতাউল্লাহ খান সজীবের দায়ের করা হত্যা মামলায় আসামিদের চালান করা হয়েছে। আমরা তাদের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়েছিলাম আদালত ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অন্যদেরকেও গ্রেপ্তারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে বলেও জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.