তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ৮ বছর আগে, কী ঘটেছে ৩ তরুণের ভাগ্যে by আব্দুল কুদ্দুস ও গিয়াস উদ্দিন
নিখোঁজ তিন তরুণ হলেন মো. আবদুল্লাহ (২৬), মো. জয়নাল (২৫) ও জাহেদ হোসেন ওরফে জাকু (২৬)। আবদুল্লাহ ও জাহেদের বাড়ি টেকনাফ সদরের জাহালিয়া পাড়ায়, জয়নালের বাড়ি সেন্ট মার্টিন দ্বীপে।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১৩ জানুয়ারি সকালে দুই বন্ধু আবদুল্লাহ ও জয়নাল পোলট্রি খামারের জন্য মুরগির খাদ্য কিনতে ৯৪ কিলোমিটার দূরের কক্সবাজার শহরতলির লিংকরোড এলাকায় গিয়েছিলেন। সেখানে একটি দোকানের সামনে পৌঁছামাত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে সাদাপোশাকের কয়েকজন ব্যক্তি দুজনকে একটি গাড়িতে তুলে নেন। পরদিন ১৪ জানুয়ারি রাতে শহরের কলাতলী এলাকার একটি হোটেল থেকে একইভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তাঁদের বন্ধু জাহেদ হোসেনকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে তিনজনের আর খোঁজ মেলেনি।
টেকনাফ পৌরসভার বাসস্টেশন থেকে পশ্চিম দিকে পাঁচ কিলোমিটার গেলে জাহালিয়া পাড়া। ওই গ্রামেই নিখোঁজ আবদুল্লাহর বাড়ি। সম্প্রতি বাড়িতে গিয়ে কথা হয় আবদুল্লাহর মা রহিমা খাতুনের (৫৮) সঙ্গে। ছেলের কথা বলতেই কান্না যেন থামে না রহিমার। হাতে ছেলের বাঁধাই করা ছবি নিয়ে বলেন, ‘তোমরা আমার ছেলে রে এনে দাও। আমার ছেলে কোনো অপরাধ করেনি। তবু তাকে গুম করেছে। ছেলেকে ছাড়া আমি বাঁচব না।’
কিছুক্ষণ পর ঘরে আসেন আবদুল্লাহর বাবা সামশু মিয়া (৭৮)। তিনি বলেন, ছয় সন্তানের মধ্যে চতুর্থ আবদুল্লাহ। তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। থানাতেও মামলা নেই। গ্রামে পোলট্রি খামার ছিল আবদুল্লাহর।
ছেলেকে তুলে নেওয়ার পরদিন কক্সবাজার থানায় গিয়ে খোঁজ নিয়েছিলেন জানিয়ে সামশু মিয়া বলেন, থানা থেকে বলা হয় আবদুল্লাহকে তাঁরা আটক করেননি। অন্য কোথাও গিয়ে খোঁজ নিতে বলা হয়। এরপর দেশের নানা জায়গায় গিয়ে আবদুল্লাহর খোঁজ নেওয়া হয়েছে, যদিও সন্ধান মেলেনি।
সামশু মিয়া বলেন, ‘গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে টেকনাফে ক্রসফায়ারে অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। গুমের শিকারও অনেকে হয়েছেন। গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আশা করছি, কমিশনের তদন্তের তিন তরুণের খোঁজ মিলবে।’
আবদুল্লাহর বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে জাহেদ হোসেনের বাড়ি। ওই বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। ঘরের বাইরে একটি দোকানের সামনে পাওয়া যায় জাহেদের বড় ভাই নজির আহমদকে। তিনি দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় ছিলেন। দুই বছর আগে দেশে ফেরেন।
নজির আহমদ (৪৬) বলেন, বাবার অবর্তমানে সংসারের হাল ধরেন তাঁদের মা সখিনা খাতুন। জাহেদ নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে মা শুধু কান্নাকাটি করতেন। খাওয়াদাওয়াও ঠিকমতো করতেন না। জাহেদের জন্য কান্নাকাটি করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েন তাঁদের মা। ২০২০ সালের জুলাই মাসে মায়ের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগমুহূর্তেও জাহেদকে একনজর দেখার জন্য ছটফট করেছেন মা।
জাহেদ বিবাহিত, সংসারে দুই মেয়ে। স্বামীর অনুপস্থিতিতে দুই শিশুকন্যাকে নিয়ে সারাক্ষণ উৎকণ্ঠায় থাকেন তাঁর স্ত্রী হাসিনা বেগম। হাসিনা জানান, স্বামী ফিরে আসবেন, এমন আশায় দিন গুনছেন তিনি।
নিখোঁজ জয়নালের বাড়ি সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পাশাপাশি পল্লিচিকিৎসকের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন কক্সবাজার শহরে।
জয়নালের বাড়িতে গিয়ে ফিরোজা খাতুনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, দ্বীপে মানুষ চিকিৎসা নিয়ে অনেক ভোগান্তিতে রয়েছেন। তাই মানুষের সেবায় পল্লিচিকিৎসক হিসেবে প্রশিক্ষণ নিতে কক্সবাজারে গিয়েছিলেন জয়নাল।
ফিরোজা বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো অপরাধ করলে দেশের প্রচলিত আইনে বিচার হতে পারত, কিন্তু গুম করা হলো কেন?’
জানতে চাইলে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, ঘটনাটি পুরোনো হলেও এ পর্যন্ত অভিযোগ নিয়ে কেউ থানায় আসেনি। বাদীপক্ষ আদালত মামলা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ তাদের সহযোগিতা করবে।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারস ফোরামের কক্সবাজারের সভাপতি আইনজীবী আব্দুস শুক্কুর প্রথম আলোকে বলেন, এ পর্যন্ত তাঁরা কক্সবাজারে চারজন গুমের খবর পেয়েছেন। এর মধ্যে টেকনাফের তিন তরুণের নাম রয়েছে। সরকারের গুম অনুসন্ধান কমিটির কাছে এই চারজনের তালিকা পাঠানো হয়েছে।
![]() |
নিখোঁজ মো. আবদুল্লাহর ছবি হাতে মা রহিমা খাতুন। সম্প্রতি কক্সবাজারের টেকনাফ সদরের জাহালিয়াপাড়ায়। ছবি: প্রথম আলো |
![]() |
নিখোঁজ মো. জয়নালের ছবি হাতে মা ফিরোজা খাতুন ছবি: প্রথম আলো |
No comments