রাকিবের মৃত্যু এবং একটি অনুসন্ধান
সংবাদমাধ্যমটির খবরে বলা হয়েছে, মোহাম্মদপুরে গত ১৯শে জুলাই সন্ধ্যায় বারো বছর বয়সী রাকিব হাসানের উজ্জ্বল তরুণ জীবনের আকস্মিক এবং করুণ পরিণতি ঘটে। আধা কিলোমিটার অনতিদূরের এক ছাদ থেকে এই দৃশ্যটি ভিডিও করেছিলেন এক প্রত্যক্ষদর্শী। সে সময় তাদের মাথার উপর দিয়ে একটি হেলিকপ্টার ক্রমাগত উড়াউড়ি করছিল। তা থেকে বর্ষিত হতে থাকে সাউন্ড গ্রেনেড। নেত্র নিউজ বলছে- হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া সাউন্ড গ্রেনেডের আঘাতেই মৃত্যু হয়েছে রাকিবের। হেলিকপ্টারটি পরিচালনা করছিল বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যরা। ১৯শে জুলাই মোহাম্মদপুরে বিক্ষোভ দমনে সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ার বিষয়টি স্বীকার করলেও এতে হতাহতের খবর অস্বীকার করেছে র্যাব। তবে রাকিবের মৃত্যু এ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, বিক্ষোভ দমনে ছাত্র-জনতার ওপর ছোড়া সাউন্ড গ্রেনেড কম ভয়াবহ নয়। বিক্ষোভ দমনে সাউন্ড গ্রেনেডের কোনো প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছে শান্তিতে নোবেল পাওয়া ফিজিশিয়ান ফর হিউম্যান রাইটসের বিজ্ঞানীরা। তারা জানিয়েছেন, হেলিকপ্টার বা ড্রোন থেকে জনসমাগমে গুলি চালানো বিপজ্জনক।
রাকিবের মৃত্যুতে র্যাবের সংশ্লিষ্টতা তদন্ত করতে ভিডিও, মেডিকেল ও ফরেনসিক রিপোর্ট, পুলিশের নথি বিশ্লেষণ করেছে নেত্র নিউজ। তারা এ বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, প্রতক্ষদর্শী এবং রাকিবের পরিবারের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করেছে।
সংবাদমাধ্যমটির তদন্তে আরও জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে রাকিবের পরিবার যেন এই হত্যাকাণ্ডের বিচার না চান সে চেষ্টা করেছিল স্থানীয় পুলিশ। তবে দেশে অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর তারা এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিলে পুলিশ তাদের কৌশল পরিবর্তন করে। তারা পতিত সরকারের দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ওপর দোষ চাপায়। কিন্তু র্যাবের ওই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আওয়ামী লীগের অনেক ব্যক্তিই জড়িত ছিলেন না।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে এসব প্রাণঘাতী সাউন্ড গ্রেনেডের ব্যাপক ব্যবহার করেছে বাংলাদেশের পুলিশ ও র্যাবের সদস্যরা। বিভিন্ন সরকারি নথিতে দেখা যায়, ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ২২ হাজার সাউন্ড গ্রেনেড কেনার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
রাকিবের মৃত্যুর শেষ দৃশ্যপট: রাকিবের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো একত্রিত করেছে নেত্র নিউজ। তার পরিবারের দেয়া এক ভিডিওতে দেখা যায় ঘটনার দিন সন্ধ্যা ৬টা ৩৮ মিনিটে রাকিবের নিথর মৃতদেহটি রাস্তায় পড়ে আছে। ভিডিওতে যে স্থানটি দেখা যায় তা রাকিবের বাসা থেকে মাত্র এক মিনিট দূরে অবস্থিত বলে চিহ্নিত করেছে নেত্র নিউজ। ভিডিওর দ্বিতীয় মিনিটে দেখা যাচ্ছে লোকজন দ্রুততার সঙ্গে রাকিবের নিথর দেহটি প্রধান সড়কের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যাচাইকৃত আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায় চিকিৎসার জন্য রাকিবকে রিকশায় তোলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। প্রায় ১১ মিনিট পর ৬টা ৫২ মিনিটে প্রত্যক্ষদর্শী সালমান নাঈমের ধারণ করা একটি ভিডিওতে আকাশে উড়তে থাকা হেলিকপ্টার থেকে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে দেখা যায়। রাকিব সাউন্ড গ্রেনেডের আঘাতে যে স্থানে লুটিয়ে পড়ে সেখান থেকে নাঈমের বাসা মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে। নাঈম নেত্র নিউজকে জানিয়েছেন, ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় হেলিকপ্টার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া শুরু করে র্যাব। প্রায় আধা ঘণ্টা যাবৎ ক্রমাগত সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে। নাঈম বলেন, রাকিব আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ার সময়ও হেলিকপ্টার থেকে ক্রমাগত সাউন্ড গ্রেনেডের বর্ষণ করেছে র্যাব।
রাকিব নিহত হওয়ার সাত দিন পর ২৫শে জুলাই মোহাম্মদপুরে হেলিকপ্টার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড এবং কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার বিষয়টি স্বীকার করে র্যাব। তবে মৃত্যুর দায় অস্বীকার করেছে তারা। সংবাদমাধ্যমের জন্য সংরক্ষিত র্যাবের ফোন নাম্বারে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও এর কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। মেডিকেল রিপোর্ট বলছে, ঘটনার দিন সন্ধ্যা ৭টা ৫২ মিনিটে রাকিবকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রিকশায় তোলার প্রায় এক ঘণ্টা পর হাসপাতালে পৌঁছায় রাকিবের নিথর দেহ। রাকিবের রোগী ভর্তির টিকিটে তার মাথায় সাউন্ড গ্রেনেডের আঘাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইলেক্ট্রোকার্ডিগ্রাম পরীক্ষার পর রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাকিবকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। রাকিবের পিতা আবুল খায়ের তার ছেলের লাশ দাফনের জন্য নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তবে রাকিবের মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ের জন্য তার লাশ নিকটস্থ শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
রাকিবের পরিবারের কোনো আপত্তি না থাকলেও নেত্র নিউজকে ময়নাতদন্তের অনুলিপি দিতে অস্বীকৃতি জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তারা বিচার বিভাগীয় বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনুমোদনের কথা জানায়। তবে নেত্র নিউজ ময়নাতদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক চিকিৎসকের হাতে লেখা নোট সংগ্রহ করেছে। রাকিবের মরদেহের ফরেনসিক প্যাথলজিতে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এমন একজন চিকিৎসকের সঙ্গে নেত্র নিউজ যোগাযোগ করলে তিনি নোটগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করেন। তবে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার অনুমোদন না থাকায় নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
ওই নোটে গ্রেনেডের আঘাতেই রাকিবের মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মৃত্যুর আগেই রাকিব আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং তার মৃত্যু একটি হত্যাকাণ্ড (হোমিসাইডাল) বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওই নোটে। মেডিকেল নথিতে আরও উল্লেখ করা হয়, গ্রেনেডের আঘাতে ‘পুরোপুরি ছিন্নভিন্ন’ হয়ে যায় রাকিবের মস্তিষ্ক। ফলে তার মাথায় প্রকাণ্ড ক্ষত ছিল। এ ছাড়া মাথার খুলির হাড়ও ভেঙে যায় রাকিবের। সাউন্ড গ্রেনেডের আঘাতেই রাকিবের মাথায় এমন ক্ষত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ফিজিশিয়ান্স ফর হিউম্যান রাইটসের (পিএইচআর) একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেছেন, আঘাতের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় সাউন্ড গ্রেনেডেই ‘তার মাথা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে।’
নেত্র নিউজের পাওয়া ওই নোট এবং আনুষঙ্গিক নথিপত্র পর্যালোচনা করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন এক নারী ফরেনসিক বিজ্ঞানী। নোটে উল্লিখিত বর্ণনা দেখে তিনিও একই মত দেন। তিনি বলেন, রাকিবের মাথার অবস্থার সঙ্গে উপর থেকে ভোঁতা বস্তুর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
আলাদাভাবে পিএইচআরের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক রোহিনী আরও বলেছেন, সাউন্ড গ্রেনেডগুলো বিভিন্ন ধরনের আঘাতের কারণ হিসেবে পরিচিত। যেমন সরাসরি আঘাতের ফলে পুড়ে যাওয়া অথবা বিস্ফোরণে আহত বা আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া।
মাথা ব্যতীত রাকিবের শরীরে আর কোনো আঘাত ছিল না বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্যাথলজিস্টের নোটে। হাসপাতাল থেকে রাকিবের মৃতদেহ পাঠানোর পর শেরেবাংলা নগর থানার তৈরি তদন্ত প্রতিবেদনের অনুলিপিও হাতে পেয়েছে নেত্র নিউজ। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কপালসহ বাহ্যিক অঙ্গগুলো স্বাভাবিক ছিল। যা চিকিৎসকের দেয়া বর্ণনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যদিও প্রতিবেদনে মাথার আঘাতের বর্ণনা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। শুধু বলা হয়েছে, মাথাটি একটি সাদা ব্যান্ডেজে সম্পূর্ণভাবে ঢাকা ছিল।
অধরা ন্যায়বিচার
রাকিবের পিতা আবুল খায়ের নেত্র নিউজকে বলেছেন, তার ছেলের লাশ তাদের হাতে হস্তান্তরের সময় একটি বিবৃতিতে জোরপূর্বক স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছে পুলিশ। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে আইনি লড়াইয়ের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। আবুল খায়েরের স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমি এই শর্তে লাশ সংগ্রহ করছি যে, ভবিষ্যতে এই লাশের বিষয়ে কোনো আইনি আশ্রয় নেবো না। বিবৃতিতে শফিক নামে পুলিশের একজন উপ-পরিদর্শকের (এসআই) কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। আবুল খায়ের জানান, এই শফিকই তাকে ওই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছিল। স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশে ব্যাপক রদবদল করে। ফলে শফিককে খুঁজে বের করতে পারেনি বা তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি নেত্র নিউজ।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার রাকিবের মতো হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচারের অঙ্গীকার করেছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাকিবের এক চাচা তার মৃত্যুর বিষয়ে থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন। নেত্র নিউজ সেই অভিযোগের একটি অনুলিপি হাতে পেয়েছে। তবে সেখানে র্যাবের সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহারের কথা উল্লেখ নেই। এর পরিবর্তে, ওই অভিযোগটিতে রাকিবের মৃত্যুর দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার মতো শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে দলটির ওয়ার্ড পর্যায়ের কর্মী-সমর্থকদের। সেখানে কোনো প্রমাণ ছাড়াই গুলিতে রাকিবের প্রাণহানি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
একজন বিশ্লেষক বলেছেন, সাধারণত পক্ষপাতদুষ্ট আইনজীবীদের মাধ্যমে এই ধরনের অভিযোগগুলো তৈরি হয়, যারা ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যদের বিনামূল্যে আইনি পরিষেবা দিয়ে থাকেন। তিনি আরও বলেন, প্রকৃত জবাবদিহিতা চাওয়ার পরিবর্তে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য এমন মর্মান্তিক ঘটনার মামলাকে কাজে লাগানোর প্রবণতা থাকে এসব আইনজীবীর। এই ধরনের দাবির বৈধতার ব্যাপারে পুলিশের তদন্ত করার কথা এবং প্রকৃত অপরাধীকেই অভিযুক্ত করার কথা। যদিও গত ১৭ই অক্টোবর এই মামলায় সংশ্লিষ্ট হিসেবে ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা আতিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যদিও সেদিন র্যাবের কর্মকাণ্ডের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না এবং সংস্থাটির ওপর সরকারি কর্তৃত্বেরও অভাব ছিল বলে উল্লেখ করেছে নেত্র নিউজ।
No comments