যুক্তরাষ্ট্রে মহারণ কাল by মোহাম্মদ আবুল হোসেন

কাল মহারণ। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পদের লড়াই। এ গ্রহে সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ যুদ্ধ এটা। এতে বিজয়ীর হাতে উঠবে হোয়াইট হাউসের চাবি। ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্টের চেয়ার আগামী চার বছর দখলে রাখার লাইসেন্স পেয়ে যাবেন। এ জন্য সারাবিশ্বের কোটি কোটি চোখ তাকিয়ে আছে সেদিকে। সঙ্গে আছে অনাকাঙ্ক্ষিত এক ভয়। কঠিন এক অনিশ্চয়তা। মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রে ভোটযুদ্ধ। প্রায় ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন মহারণ হতে যাচ্ছে। তার একদিকে ডেমোক্রেট কমালা হ্যারিস। বিপরীতে রিপাবলিকান ডনাল্ড ট্রাম্প। দু’জনের মধ্যে যে ভোটযুদ্ধ হচ্ছে তাতে জয়ের সুযোগ দু’জনেরই ফিফটি ফিফটি। সমানে সমান। কার গলায় উঠবে জয়ের মালা। কেউ পূর্বাভাস দিতে পারছেন না। এই নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে বাকি বিশ্ব। বিশ্বের অর্থনীতি, রাজনীতি- সবই ঘুরে যেতে পারে। এ জন্যই বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে সবাই। তারা দেখতে চায়- কার হাতে ওঠে হোয়াইট হাউসের চাবি। এবারের নির্বাচনের মতো এমন অনিশ্চিত অবস্থা, উত্তেজনা সাম্প্রতিক সময়ে আর দেখা যায়নি। কমালা হ্যারিস-ডনাল্ড ট্রাম্প দু’জনের সামনেই ইতিহাস গড়ার হাতছানি। কমালা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনিই হবেন যুক্তরাষ্ট্রের এ যাবৎকালের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট, যার শুরু একজন প্রসিকিউটর থেকে। একই সঙ্গে তিনি হবেন প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন প্রেসিডেন্ট। অন্যদিকে ডনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হলে তিনি হবেন ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার পর নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট। নতুন এক ইতিহাস গড়ার প্রত্যয় নিয়ে দুই প্রার্থীই মাঠ চষেছেন। পাল্টাপাল্টি যুক্তিতর্ক তুলে ধরেছেন। তবে এই লড়াইয়ে প্রস্তুতি নেয়ার জন্য ট্রাম্পের চেয়ে অনেক কম সময় পেয়েছেন কমালা হ্যারিস। তার দল ডেমোক্রেট থেকে প্রথমে নির্বাচন করার অঙ্গীকার করেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। শারীরিক অবস্থা ও বয়সের কথা মাথায় নিয়ে ডেমোক্রেট শীর্ষ নেতারা তাকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। জো বাইডেন অনড় থাকেন অবস্থানে। কিন্তু প্রথম সরাসরি প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে ট্রাম্পের সঙ্গে তিনি লেজেগোবরে করে ফেলেন। ফলে তার সরে দাঁড়ানোর দাবি আরও জোরালো হয়। এক পর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। অনুমোদন দিয়ে যান কমালা হ্যারিসকে। তখন কমালার হাতে সময় মাত্র তিন মাস। এ সময়ে ট্রাম্পের মতো একজন জাঁদরেল নেতার বিরুদ্ধে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়া তার জন্য সত্যিই খুব সামান্য। তবু কমালা হ্যারিস নিজেকে লৌহকঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গড়ে তুলেছেন। শুধু তাই নয়। তিনি সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছেন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। পর্নো তারকা ডানিয়েল স্টর্মিকে অর্থের বিনিময়ে ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে মুখ বন্ধ করিয়ে রাখার অভিযোগে অভিযুক্ত তিনি। ২০২১ সালের ৬ই জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে তার উস্কানিতে দাঙ্গার অভিযোগে অভিযুক্ত তিনি। তাছাড়া তার সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ আছে। পুতিনকে দেখা হয় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে। ২০২০ সালের নির্বাচনের পর কমপক্ষে সাতবার পুতিনের সঙ্গে ট্রাস্প সরাসরি ফোনে কথা বলেছেন বলে ‘ওয়ার’ বইয়ে দাবি করেছেন বিখ্যাত সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড। এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও সুইং স্টেট যেমন গুরুত্ব বহন করছে, একই ভাবে নারী ভোটাররাও গুরুত্ব বহন করছেন। আগাম ভোটে তারা সেই জানান দিয়েছেন। ট্রাম্পের দখলে থাকা মিশিগান রাজ্যে সর্বশেষ জরিপে এগিয়ে আছেন কমালা। গতকাল এটা সংবাদ শিরোনাম হয়েছে পশ্চিমা মিডিয়ায়। এ খবর কমালা শিবিরে স্বস্তির। ট্রাম্প যেভাবে বিভক্তি ঘটিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে, এমনটা খুব কমই দেখা গেছে। তিনি শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, অভিবাসীদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তার গ্রুপ নির্বাচন নিয়ে অপপ্রচারে নেমেছে। ভুয়া পোস্ট দিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করছে। গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মুসলিমদের অনুভূতিকে উস্কানি দিয়ে সুবিধা নিতে চাইছেন। কারণ, বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে ট্রাম্প নির্বাচিত হলে প্রথম দিনেই এই যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর মধ্যদিয়ে তিনি আসলে ভোটের কৌশল অবলম্বন করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম ভোটারদের সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ইতিহাস কি বলে! ডনাল্ড ট্রাম্প মুসলিমবিদ্বেষী বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। প্রথম মেয়াদে তিনি ক্ষমতায় আসার পর পরই সাতটি মুসলিম দেশকে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করেন। যে গাজাবাসীকে এবার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন যুদ্ধ বন্ধের, তাদের প্রাণের দাবি জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী ঘোষণার। কিন্তু তার বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে একতরফাভাবে স্বীকৃতি দেন। নির্বাচনে ভারত, চীন, রাশিয়া বড় ইস্যু। রাশিয়া যেমন তার পক্ষে রয়েছে, তেমনি ভারত কোন পক্ষে তা স্পষ্ট নয়। কারণ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেমন ট্রাম্পের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়েছেন, তেমনি জো বাইডেনের সঙ্গে। ট্রাম্প যদি হেরে যান, তাহলে তিনি ২০২১ সালের ৬ই জানুয়ারির মতো দাঙ্গা লাগিয়ে দিতে পারেন বলে অনুমান করছেন অনেকে। তিনি এরই মধ্যে আভাস দিয়েছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে জয়ী হবেন। তার অর্থ তিনি পরাজিত হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না! আইনি লড়াইয়ে যেতে পারেন। এ জন্য শীর্ষ সব আইনজীবীকে আগে থেকেই ভাড়া করেছে উভয় শিবির। ট্রাম্প আইনি লড়াই শুরু করলে তা আইনসম্মত। কিন্তু যেসব আভাস মিলছে, যেসব ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে তাতে এটা স্পষ্ট তিনি হেরে গেলে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে দিতে পারেন তিনি বা তার সমর্থকরা। এই ভয়ই এখন মার্কিনিদের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন গণতান্ত্রিক। এ নির্বাচনে কোনো হাঙ্গামা, দাঙ্গা স্মরণকালে হয়েছে বলে জানা যায় না। কিন্তু ট্রাম্প এই ধারা শুরু করেছেন ২০২১ সালের ৬ই জানুয়ারি। তাছাড়া তিনি নির্বাচিত হলেও আশঙ্কার ব্যাপার আছে। তার বিরুদ্ধে ডেমোক্রেট সরকার যেভাবে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তিনিও ঠিক একই রকম ব্যবস্থা নিতে পারেন- এমন আশঙ্কা শীর্ষ ডেমোক্রেটদের। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি, বিশেষ করে এবারের নির্বাচনে সহিংসতার ভয় করছেন অনেকে। প্রতিহিংসা নেয়ার আশঙ্কা করছেন। এবার নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে কড়াকড়ি করা হয়েছে। নির্বাচনে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের মতো অর্থের ছড়াছড়ি করেছে রিপাবলিকান শিবির। বিশেষ করে ট্রাম্পের প্রচারণায় থাকা টেসলার মালিক ইলন মাস্ক প্রতিদিন ১০ লাখ ডলার করে অর্থ দিয়েছেন ভোটারদের। তিনি একটি গ্রুপের মাধ্যমে ভোটারদের নিবন্ধিত হওয়ার টোপ দিয়েছেন। তাদের মধ্য থেকে লটারি করে প্রতিদিন একজনকে দেয়া হয়েছে ১০ লাখ ডলার করে। এই পদ্ধতি এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যায়নি। ইলন মাস্কের এই চর্চার কারণে তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে। একে বেআইনি বলে ঘোষণা করেছেন অনেক আইনজীবী। ৫৩৮টি ইলেক্টোরাল ভোটের লড়াইয়ে সমান তালে লড়াই করছেন কমালা-ট্রাম্প। সেখানে মোট প্রাপ্ত ভোটের ওপর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটে। একজন প্রার্থীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে কমপক্ষে ২৭০টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট পেতে হয়। যদি দু’জনের কেউই এই সংখ্যা স্পর্শ করতে না পারেন তাহলে হিসাব অন্যদিকে ঘুরে যাবে। যদি দু’জনেই সমান সংখ্যক ২৬৯-২৬৯টি করে ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট পান তাহলে সিদ্ধান্ত নেবে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস। প্রথমে ৫০টি রাজ্যের প্রতিটি থেকে একজন করে প্রতিনিধি ভোট দেবেন দুই প্রার্থীর ওপরে। তাতে যদি কোনো প্রার্থী কমপক্ষে ২৬ ভোট পান তাকেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। তারপর ভাইস প্রেসিডেন্ট বাছাই করবে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট। এতে যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন তিনি হবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট।  
mzamin

No comments

Powered by Blogger.