অন্তর্বর্তী সরকারকে অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কে জড়িয়ে দুর্বল করা হচ্ছে by শহীদুল্লাহ ফরায়জী
জুলাই-আগস্টে রাজনৈতিক লড়াইয়ের তীব্রতায়, গণমানুষের সম্পৃক্ততায় যখন আন্দোলনের স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়িয়ে উৎকর্ষ, বৈশিষ্ট্য, বৈচিত্র্য এবং অজস্রতায় অত্যুচ্চ রূপ লাভ করেছিল, সেই অনন্য সাধারণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে গণঅভ্যুত্থানকে অনিবার্য করে তোলে। দেশের সকল মানুষের অসাধারণ লড়াইয়ের প্রেরণায় অসাধ্য সাধনে আমরা জয়লাভ করি। এখনো আমরা জুলাই গণহত্যার ভয়াবহতা প্রকাশ করতে পারিনি। সাঁজোয়া যান থেকে আহত ছাত্রকে ছুড়ে ফেলে দেয়া, আহত এবং জীবন্ত অবস্থায় লাশ পুড়ে ফেলাসহ- নির্বিচার হত্যাকারীদের অনেককেই যেমন শনাক্ত করতে পারিনি তেমনি কে বা কারা আন্দোলনে আহতদের হাসপাতালে চিকিৎসা প্রদান না করতে বর্বরোচিত নির্দেশ দিয়েছিল, এবং কারা কারা সেই নির্দেশ অনুসরণ করেছিল তাদেরকেও আমরা আজ পর্যন্ত চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে পারিনি। কতোজন আহত আর কতোজন বাকি জীবন সূর্যের আলো দেখবে না- তাও আমরা সুস্পষ্ট করতে পারিনি। আহতদের বিশেষ করে দৃষ্টিহীনদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকার কী ভাবছে তাও এখনো জানা যায়নি। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর কতো লক্ষ গুলি বর্ষিত হয়েছে তাও প্রকাশ করা দরকার।
আমাদের সন্তানরা জীবন উৎসর্গ করে আমাদেরকে বেঁচে থাকার পরিসর অবারিত করে দিয়ে গেছে, আর আমরা তাদেরকে ভুলে গিয়ে, ক্ষমতার প্রতিযোগী হয়ে গেলে নিজেরাই অভিযুক্ত হয়ে পড়বো। এর মাঝে কতো অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ককে আমরা হাজির করছি। প্রশ্ন উঠেছে- গণঅভ্যুত্থানে সৃষ্ট সরকারের বৈধতা নিয়ে। যখন জনগণের সম্মতিতে প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের সমস্ত সম্ভাবনা বিলুপ্ত করে দেয়া হয়েছিল, তখন ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়ে, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার গঠন করেছে। হাজার হাজার ছাত্র-জনতার আত্মবলিদান এবং প্রজাতন্ত্রের সকল জনগোষ্ঠীর নৈতিক সমর্থন- অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বৈধতা দিয়েছে। সংবিধানবিরোধী অবৈধ সরকারকে উৎখাত করাই হচ্ছে বৈধ এবং আইনসম্মত।
মালিকানার সূত্রে জনগণের ক্ষমতা প্রতিনিধিদের নিকট হস্তান্তর- অবশ্যই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। অর্থাৎ রক্ত বা ব্যালট দিয়ে যে সরকারই নির্ধারণ করা হোক- তা কোনোক্রমেই সীমাহীন নয়। জনগণের ক্ষমতা কাউকেই অনির্দিষ্ট করে দেয়া যায় না। কারণ যে ক্ষমতা সময়ে-সময়ে জনগণের কাছে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ বিনষ্ট করে তা জনগণের মালিকানাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। ফলে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সময়সীমা নির্দিষ্ট করা থাকে। যেহেতু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রচণ্ড সংঘাত, সংঘর্ষ ও রক্তপাত অতিক্রম করে আবির্ভূত হয়েছে সেহেতু সরকারকে ক্রমাগতভাবে তার অবস্থান সুনির্দিষ্ট করতে হবে। রাষ্ট্রের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা অনুযায়ী সংস্কার এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। অন্তর্ভুক্ত জনগণের ইচ্ছা এবং আকাঙ্ক্ষাকে বিবেচনায় নিতে হবে। জনগণের আবেগ এবং অনুভূতিকে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। সামাজিক ইচ্ছার প্রতিফলন থাকতে হবে সরকারের প্রতিটি কর্মে। জনপ্রিয়তা বা গণসমর্থন কোনোটাই চিরস্থায়ী নয়, বরং সতত পরিবর্তনশীল। যেহেতু রাষ্ট্র এবং সরকার জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত থাকে, সেহেতু সকল ক্ষেত্রে সরকারের বিশ্বস্ততা এবং নিষ্ঠা যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তাহলে সরকারকে জনগণ ভালোবাসা ও নৈতিক সমর্থন দিয়ে সংরক্ষণ করবে না। সম্মতি মানে নিঃশর্ত নয়। বাংলাদেশ যেহেতু রাজতান্ত্রিক বা অভিজাত তান্ত্রিক নয়, সেহেতু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের অভিপ্রায় এবং আনুগত্যকে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের মনন, চিন্তার স্তর, জটিল প্রকৃতি, বিভেদ, অনৈক্য, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পথ চলতে হবে। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু চাপিয়ে দিলে বা অতীতের মহান অর্জন যা জনগণের গভীর মনস্তত্ত্বে গ্রথিত হয়ে আছে তা সরিয়ে দিলে জনগণ তীব্র প্রতিবাদ করবে, রক্ত দিয়ে পুনরায় প্রতিহত করবে।
বিদ্যমান বাস্তবতা কোনো কোনো অতিবিপ্লবীর বিবেচনায় থাকছে না। ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কে জড়িয়ে দুর্বল করা হচ্ছে, জনসমর্থনে ফাটল ধরানো হচ্ছে, যা অপশক্তির ষড়যন্ত্রের পথকে প্রশস্ত করছে।
এবার একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করতে চাই। দেশের একজন প্রথিতযশা চিন্তাবিদ বলেছেন- এই যে সরকার, সেটা সেনা-সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার। এই সরকার এখনো পর্যন্ত টিকে আছে, যেহেতু আমাদের সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান একজন ভালো মানুষ এবং তিনি সাপোর্ট করে যাচ্ছেন বলে। তিনি যদি সমর্থন না করেন এই সরকার পড়ে যাবে। তার শুভবুদ্ধির উপর ভিত্তি করে সরকার দাঁড়িয়ে আছে। ফলে সেনা-সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার চাই না। আমাদের সৈনিকেরাও চায় না। তিনি আরও বলেছেন- ‘অবিলম্বে এই সংবিধান বাতিল করে, সেনাবাহিনী সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকারের ধারণা থেকে বের হয়ে এসে- পরিপূর্ণ স্বাধীন সরকার হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে।’
উল্লেখ থাকে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সৃষ্টি হয়েছে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এবং এই গণঅভ্যুত্থানের সমর্থনে সেনাবাহিনীর ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অথচ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সেনা সমর্থন দেয়া অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য এবং অযৌক্তিক বক্তব্য। কারণ গণতান্ত্রিক স্বদেশ বা প্রজাতন্ত্রের জন্য আমাদের সেনাবাহিনী ’৭১ সালে লড়াই করেছিল বীরত্ব ও দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত হয়ে। তাদের সমর্থন থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বেরিয়ে আসার নৈরাজ্যকর এক পরিস্থিতি জন্ম দেবে, যা কারও কাম্য নয়। ‘রাষ্ট্রকাঠামো’ বা ‘পরিবর্তন’ একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। তা মানতেই হবে।
উক্ত চিন্তাবিদ নিজেই বলেছেন- ‘সেনা-সমর্থন প্রত্যাহার করলে সরকার পড়ে যাবে।’ আবার তিনিই দাবি করছেন, ‘সেনা-সমর্থিত সরকারের ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে’। সেনাবাহিনী প্রজাতন্ত্রের তথা রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী এবং সমগ্র জনগোষ্ঠীর অংশীজন। জনগণের সরকারকে সমর্থন না দিয়ে সেনাবাহিনী নির্বিকার হয়ে বাইরে অবস্থান করলে আজকের দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় বিশ্বব্যবস্থায় রাষ্ট্র টিকে থাকবে কিনা তা ভেবে দেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়! বিরাজিত বাস্তবতায় সেনা-সমর্থন ছাড়া রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ঝুঁকিতে পড়বে কি না- এসবের কোনো কিছুই বিবেচনায় না নেয়া রাষ্ট্রের জন্য কতো বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, তা কল্পনাও করা যায় না।
সংবিধান বাতিল করে সেনা-সমর্থন প্রত্যাহার করলেই সরকার স্বাধীন হয়ে যাবে, এটা রাষ্ট্রের কাঠামোগত দর্শনের সঙ্গে একেবারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ইতিহাসের আলোকে রাষ্ট্রের অপরিবর্তনীয় কিছু কাঠামো নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ নয়, বৈধ সরকারের প্রতি তার আনুগত্য নিশ্চিত করার মধ্যদিয়েই সরকার স্বাধীন হবে। কোনো ধরনের শূন্যতায় গণবিরোধীদের বড় ধরনের উস্কানির পথ প্রশস্ত করে কিনা, অপশক্তির উত্থানকে ত্বরান্বিত করে কিনা, তা আমাদেরকে প্রতি মুহূর্তে বিবেচনায় নিতে হবে।
আমরা দখলদার অবৈধ সরকারকে উৎখাত করেছি। পূর্ববর্তী ফ্যাসিবাদী সরকার সংবিধান এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে অবৈধভাবে ও অনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে। এজন্য খুনি সরকার পরিবর্তন করে, জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দখলকৃত প্রতিষ্ঠানকে জনগণ রক্ত দিয়ে রাহুমুক্ত করেছে। সুতরাং এই বঙ্গভবন, গণভবন- জনগণের এবং রাষ্ট্রের। বঙ্গভবনে শপথ নিলেই সরকার বিপ্লবী হয় না, কিংবা শহীদ মিনারে শপথ নিলেই কেউ বিপ্লবী হয়ে যাবে- এমন ধারণা কোনোক্রমেই প্রাসঙ্গিক নয়। বিশ্বব্যবস্থায় সরকার গঠনের প্রয়োজনীয় কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। যে শর্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পূরণ করেছে। একদিনে এককভাবে কোনো রাষ্ট্র- রাষ্ট্রের বিধি, নিয়ম-শৃঙ্খল ছুড়ে ফেলতে পারবে না, এর মাঝেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র নির্মাণে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পাদন করতে হবে। এই বিদ্যমান বাস্তবতা থেকেই ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার হস্তান্তর নয়, রূপান্তর করতে হবে। জনগণকে অবশ্যই আদর্শিক এবং নৈতিক মূল্যবোধে জাগ্রত রাখতে হবে। ক্রমাগতভাবে নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। ঘোষণা দিলেই রাষ্ট্রের মৌলিক-রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে যায় না, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের বিলোপ ঘটে না, তার জন্য দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রয়োজন।
আজকের বিশ্বব্যবস্থায় সকল রাষ্ট্রের সংবিধান বা কনস্টিটিউশন রয়েছে। ১৯৭১ সালে আমাদের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়েছিল- এ ভূখণ্ডের মানুষের অভিপ্রায় অনুযায়ী সংবিধান রচনার জন্য। সুতরাং সারা বিশ্বব্যাপী, এমনকি মুক্তিকামী মানুষের কাছেও কনস্টিটিউশন বা সংবিধান কাম্য। সংবিধানকে গঠনতন্ত্র বলার ব্যক্তিগত মনোভাব যেকারও থাকতেই পারে কিন্তু সর্বজন স্বীকৃত ‘সংবিধান’কে গঠনতন্ত্র বলে চিহ্নিত করা প্রয়োজনীয় আলোচনা নয়।
বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতির অংশ, বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায় সহায়ক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য জনগণের সকল অংশের সঙ্গে সেনাবাহিনীরও নিরঙ্কুশ সমর্থন অপরিহার্য। মনে রাখতে হবে, অবাস্তব বা নৈরাজ্যকর এমন কোনো চিন্তাধারাকে প্রশ্রয় বা উস্কে দেয়া যাবে না, যা রাষ্ট্র বা সরকারকে বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।
রক্তস্নাত গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি প্রজাতন্ত্রের সকলকে সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক সমর্থন দিতে হবে।
লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
faraizees@gmail.com
No comments