স্পট: নিউমার্কেট- আগের রূপে চাঁদাবাজি by সুদীপ অধিকারী
সরজমিন রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নিউ সুপার মার্কেট, চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট, ধানমণ্ডি হকার্স মার্কেটের সামনের দুই পাশ, গ্লোব মার্কেট, নুরজাহান মার্কেট, গাউসিয়া মার্কেট, ঢাকা কলেজের সামনে, বলাকা, নীলক্ষেত, সাইন্সল্যাব, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, মিরপুর রোডসহ পুরো এলাকার ফুটপাথে শত শত জামা-কাপড়, জুতা-স্যান্ডেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের হকারির দোকান। ব্যবসায়ীরা বলেন, এই এলাকায় প্রতিটি মার্কেটের সামনের অংশকে একেকটি লাইন হিসেবে ধরা হয়। ছোট মার্কেট কিংবা ভবনের সামনের স্থানকেও লাইন বলা হয়। যেমন সাইন্সল্যাবের বায়তুল মামুর মসজিদ মার্কেটের সামনে থেকে প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারের ফুটপাথ পর্যন্ত একটি লাইন। প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টার থেকে কাদের আর্কেড শেরওয়ানি মার্কেট হয়ে ওরিয়েন্টাল লাটিমী শপিংমল পর্যন্ত একটি লাইন। লাটিমী মল থেকে জাহান ম্যানশন শপিংমল, গোল্ডেন গেন শপিং সেন্টার, মাহমুদ ম্যানশন ও পেট্রোল পাম্প পর্যন্ত একটি লাইন। গ্লোব শপিং সেন্টার থেকে বদরুদ্দোজা সুপার মার্কেট, নেহার ভবন শপিং সেন্টার, নূরজাহান সুপার মার্কেট পর্যন্ত একটি লাইন। নূরজাহান থেকে ধানমণ্ডি হকার্স মার্কেটের ফুটপাথ পর্যন্ত একটি লাইন। ধানমণ্ডি হকার্সের দক্ষিণ পাশের শুরু থেকে নূরানী মার্কেট, মিনি মার্কেট, এয়াকুব সুপার মার্কেট, কাজী ম্যানশন, শাহানুর ম্যানশন, রিজেন্সি প্লাজা হয়ে ইস্টার্ন মল্লিকা পর্যন্ত একটি লাইন। ইস্টার্ন মল্লিকার উল্টো পাশ থেকে নিউমার্কেটের দিকে আসতে গ্রিন স্মরণিকা, সুবাস্তু অ্যারোমা সেন্টার শপিংমল, ইসমাইল ম্যানশন, গাউছিয়া মার্কেট, নূর ম্যানশন, চাঁদনি চক মার্কেট পর্যন্ত একটি লাইন। চাঁদনি চক থেকে বলাকা সিনেমা হল পর্যন্ত একটি, বলাকা থেকে নীলক্ষেত হয়ে নিউমার্কেট থানার আগ পর্যন্ত একটি লাইন রয়েছে। রাস্তার অপর পাশের নীলক্ষেত মোড় থেকে চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট পর্যন্ত একটি, চন্দ্রিমা থেকে ঢাকা কলেজ, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ হয়ে সাইন্সল্যাব পর্যন্ত একটি এবং চন্দ্রিমা থেকে বিশ্বাস বিল্ডার্স হয়ে শাহনেওয়াজ হল পর্যন্ত আরও একটি লাইন রয়েছে। পুরো নিউমার্কেট এলাকায় মোট ১২টি লাইন রয়েছে। এসব একেকটি লাইনে অন্তত ১শ’ থেকে দেড়শ’টি করে দোকান রয়েছে।
এমনই এক লাইনের দোকানি মো. সুমন। নিউ এলিফ্যান্ট রোডের এই দোকানি বলেন, গত ১৫-২০ বছর ধরে তিনি এলাকাটিতে ব্যবসা করে আসছেন। গত সেপ্টেম্বরে তার তিনটি দোকানের দু’টিই দখল হয়ে গেছে। বাকি দোকানটিও ছেড়ে দেয়ার জন্য হুমকি দেয়া হচ্ছে। সুমন বলেন, নিউমার্কেট থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক কে. এম. চঞ্চলের লোকজন সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ন্যাশনাল ব্যাংকের সামনে তার দু’টি দোকান দখল করে নিয়েছে। যুবদলকর্মী ফরহাদ, হাসানসহ ৮ থেকে ১০ জন এই দখলদারিত্বে জড়িত। তার দু’টি দোকান বর্তমানে বিএনপিকর্মী দুলালের নিয়ন্ত্রণে। যুবদলকর্মী হাসান তাকে বার বার ফোন করে বাকি দোকানটিও ছেড়ে দেয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছেন। আর দোকান না ছাড়লে প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হবে সুমনের। ইরফান নামে আরেক দোকানি বলেন, শেখ হাসিনা পালানোর আগে আমাদের এই নিউমার্কেট এবং আশপাশ এলাকার ফুটপাথে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ করতেন নিউমার্কেট থানা যুবলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ইসমাইল হোসেন, ১৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি বিপ্লব সরকার, সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম লিটন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম হোসেন ইবু, ১৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জিএস রানা, নিউমার্কেট হকার্স লীগের সভাপতি মনির, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ছৈইয়াসহ আওয়ামীপন্থিরা। বর্তমানে তাদের সেই সিস্টেমেই চাঁদা নিচ্ছেন বিরোধী মতের লোকেরা। এই ব্যবসায়ী বলেন, আগে চাঁদা নেয়ার বিষয়টি খুল্লাম খুল্লাম থাকলেও এখন চাঁদা আদায় করা হচ্ছে গোপনে। দোকানের মহাজন বা সরাসরি দোকান মালিকের কাছ থেকে চাঁদার টাকা কালেকশন করা হচ্ছে। আর দোকান মালিক আমাদের কাছ থেকে সেই টাকা দোকান ভাড়ার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে নিচ্ছেন। নিউ এলিফ্যান্ট রোডের ন্যাশনাল ব্যাংকের সামনে আরেক দোকানি আবু সাইদ বলেন, আমরা নতুন ব্যবসায়ী। আগে এখানে আমাদের দোকান ছিল না। গত মাসে স্থানীয় বিএনপি নেতা দুলালের মাধ্যমে দোকানটা নিয়েছি। সাইফুল নামে আরেক দোকানি বলেন, আমার এক আত্মীয় আমাকে বলেছিল কিছু টাকা দিলে একটা দোকান পাওয়া যাবে। আমি তাকে বিশ হাজার টাকা দিই। তিনি স্থানীয় এক নেতার মাধ্যমে আমার এই দোকানটা পাইয়ে দিয়েছেন। তবে সেই বিএনপি নেতার নাম আমি বলতে পারবো না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিউমার্কেট এলাকার বেশকিছু ব্যবসায়ী জানান, গত ৫ই আগস্টের পর থেকে নিউমার্কেটের সামনের ফুটপাথ ১৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি আবদুস সাত্তার ও সাধারণ সম্পাদক আমির হোসেনের নিয়ন্ত্রণে। হকার্স মার্কেট থেকে সাইন্সল্যাব পর্যন্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিউমার্কেট থানা যুবদল সভাপতি নিজাম ব্যাপারীর হাতে। তার নিজেরও ফুটপাথে আটটি দোকান রয়েছে। নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে দোকানিরাও। দীর্ঘদিন ধরে থাকা দোকানিদের সরিয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে বসানো হচ্ছে নিত্যনতুন দোকান।
তবে নিউমার্কেট থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক কে. এম. চঞ্চল বলেন, দোকান দখলের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। কেউ যদি আমার নাম করে অপকর্ম করে বেড়ায় তার দায় তো আমি নিতে পারি না। তিনি বলেন, আমাদের এই নিউমার্কেট এলাকায় বর্তমানে তিনটি যুবদলের গ্রুপ রয়েছে। আমার প্রতিপক্ষরাই হয়তো আমাকে ফাঁসাতে আমার নাম করে এসব অপকর্ম করছে।
নিউমার্কেট থানা যুবদল সভাপতি নিজাম ব্যাপারী বলেন, উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমার বিরুদ্ধে এই সব কথা ছড়ানো হচ্ছে। চাঁদা তো নেয়ার প্রশ্নই আসে না। আমরা আরও থানা পুলিশের সঙ্গে দোকানে দোকানে গিয়ে সকলকে বলে এসেছি যেনো কাউকে চাঁদা না দেয়। আর কেউ চাঁদা চাইতে আসলে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিতে। আমাদের জানাতে।
এদিকে ফুটপাথ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে ১৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি আবদুস সাত্তার বলেন, আমি কোনো দোকান নিয়ন্ত্রণে নিইনি। উপরন্তু নিউমার্কেট এলাকায় যেনো চাঁদাবাজি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখছি। ফুটপাথের দোকানিরা গরিব মানুষ। তাদের সকলকে আমি নিষেধ করে দিয়েছি যেন কাউকে চাঁদা না দেয়।
এ বিষয়ে নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহ্সীন উদ্দিন বলেন, চাঁদাবাজির বিষয়ে আমরা জিরো টলারেন্স। কেউ যদি এ বিষয়ে সুর্নিদিষ্ট অভিযোগ দেয় আমরা যাচাই-বাছাই করে যথাযথ আইগত ব্যবস্থা নেবো। ইতিমধ্যে আমরা এমন তিনটি চাঁদাবাজির অভিযোগ পেয়েছি। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদেরকে আমরা আইনের আয়তায় নিয়ে এসেছি। যত ক্ষমতাশালীই হোক না কেনো চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের কোনো ছাড় নেই।
No comments