রিকশার জঞ্জাল রাজধানী by নাজমুল হুদা

হঠাৎ করে রিকশার নগরীতে পরিণত হয়েছে ঢাকা। লাখ লাখ রিকশা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শহর জুড়ে। লাইসেন্সবিহীন প্যাডেল ছাড়াও চলছে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা। এসব রিকশার দৌরাত্ম্যে সড়কে তৈরি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা। এত সংখ্যক রিকশা নিয়ন্ত্রণ করতেও হিমশিম খাচ্ছে ঢাকার ট্রাফিক বিভাগ। সংশ্লিষ্টদের মতে, ঢাকায় এখন ব্যাঙের ছাতার মতো তৈরি হচ্ছে রিকশা। যার কোনো পরিসংখ্যান সরকারি- বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের হাতে নেই। এসব রিকশা নিয়ন্ত্রণেও নেয়া হচ্ছে না কোনো কার্যকরী উদ্যোগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশি আয়ের আশায় এখন অল্প টাকায় রিকশা বানিয়ে অনেকেই সড়কে নেমে পড়ছেন। প্রতিদিন শত শত রিকশা তৈরি হচ্ছে শহরের বিভিন্ন ছোট-বড় গ্যারেজে।

সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ঢাকায় অন্তত ১২ লাখ প্যাডেলচালিত রিকশা রয়েছে। অবৈধ অটোরিকশা রয়েছে ৬-৭ লাখের মতো। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, রাজধানীতে বর্তমানে প্যাডেলচালিত রিকশার লাইসেন্স রয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজারেরও কম। এর মধ্যে ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে লাইসেন্স দেয়া বৈধ রিকশার সংখ্যা ১ লাখ ৪৫ হাজারের মতো। অন্যদিকে উত্তর সিটি করপোরেশনে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে ৩০ হাজারের মতো। তবে নতুন করে ঢাকায় এখন রিকশার লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে না। দক্ষিণ সিটির এক কর্মকর্তা জানান, ২০২২-২৩ অর্থবছরের পর থেকে নতুন করে কোনো রিকশার লাইসেন্স দেয়া হয়নি। এ ছাড়া উত্তর সিটিতে ২০১৯ সালের পর আর কোনো রিকশার লাইসেন্স দেয়া হয়নি। বর্তমানে উত্তরের সব রিকশাই লাইসেন্সবিহীন চলছে। দুই সিটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, ঢাকায় মোট কতোটি রিকশা রয়েছে তার হিসাব নেই সিটি করপোরেশনের কাছে।

বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, আগস্টের পর থেকে সড়কের এনফোর্সমেন্ট ঢিলেঢালা। এই সুযোগে বেশি আয়ের আশায় যেসব রিকশা পাড়া-মহল্লায় চলতো তা মূল সড়কে চলছে। তাই সড়কে বিশৃঙ্খলা বেড়েছে। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী জেলার অসংখ্য রিকশা ঢাকায় চলে এসেছে। তবে এসব রিকশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

অর্থনৈতিক সংকটের কারণে অনেকে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহের দিকে ঝুঁকছেন বলে মনে করেন এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অনেকেই ৬০-৭০ হাজার টাকা জোগাড় করে আয়ের জন্য রিকশা নিয়ে সড়কে নামছেন। এজন্য স্থানীয় গ্যারেজে প্রতিদিন অসংখ্য রিকশা তৈরি হচ্ছে। এগুলো না থামানো গেলে এর সংখ্যা আরও বাড়বে। এই রিকশাগুলো কোন সড়কে চলবে? কী পরিমাণ চলবে? তার বিজ্ঞানভিত্তিক হিসাব করে বৈধতা দিতে হবে। তবে ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো এখন যেভাবে চলছে সেভাবে বৈধতা দেয়ার সুযোগ নেই।

ঢাকায় চলাচল করা রিকশার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অলিগলি ছাপিয়ে মূল সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তিন চাকার এই বাহন। ভিআইপি সড়ক, ফ্লাইওভার কিংবা সড়কের উল্টোপথেও দিন-রাত চলছে রিকশা। ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও তাদের সামনে দিয়ে মহাসড়কে উঠছে কম গতির বাহনটি। এতে সড়কের গতিরোধ, বিশৃঙ্খলা ও যানজট তৈরি হচ্ছে। একইসঙ্গে বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। ঢাকায় রিকশা নিয়ন্ত্রণে একাধিকবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সর্বশেষ গত মে মাসে হাসিনা সরকারের আমলে ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধের কথা জানান তৎকালীন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তবে রিকশাচালকদের আন্দোলনের মুখে সেই সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসা হয়। এরপর থেকেই ঢাকার রাস্তায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলতে থাকে ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো। গত ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর তা আরও বেশি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে।

চাঁদাবাজির কারণে সড়কের রিকশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না উল্লেখ করে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, রিকশা নিয়ন্ত্রণ করার কথা সিটি করপোরেশন আর পুলিশের। কিন্তু এখানে অনেক চাঁদাবাজি হয়। প্রত্যেকটা ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে প্রতিদিন বা সপ্তাহভিত্তিক চাঁদা তোলা হয়। এসবের ভাগও যায় সব জায়গায়। তাই তারা এসব নিয়ন্ত্রণ করে না।

একটি প্যাডেলচালিত রিকশা বানাতে ২৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। আর ব্যাটারিচালিত রিকশা বানাতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। নিম্নআয়ের মানুষ এই অর্থ ধারদেনা করে জোগাড় করে রিকশা বানিয়ে সড়কে নেমে পড়েন বলেও জানান বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া ব্যাটারি রিকশা নিয়ে সড়কে উঠতে পারার সুযোগে এর চাহিদাও বেড়েছে অনেক। এসব রিকশা চার্জ করার জন্য ঢাকায় কয়েক হাজার চার্জিং স্টেশন গড়ে উঠেছে। এরমধ্যে গত ২০২১ সালে ট্রাফিক পুলিশের একটি তালিকায় ৭৫২টি চার্জিং স্টেশনের হিসাব রয়েছে। ট্রাফিকের ওয়ারি, তেজগাঁও, মতিঝিল, লালবাগ, গুলশান ও উত্তরা বিভাগে সবচেয়ে বেশি চার্জিং স্টেশন রয়েছে। সরকারিভাবে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও চার্জিং স্টেশনের অনুমোদন না থাকলেও স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবে ও চাঁদা দিয়ে চালাতে হয় এসব রিকশা।

সংশ্লিষ্টদের ধারণা, আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতার সুযোগে রিকশায় সয়লাব হয়েছে ঢাকা। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে সিটি করপোরেশন, বিআরটিএ ও পুলিশসহ সবার যৌথ অভিযান দরকার বলেও মনে করেন তারা। এ ছাড়া চাঁদাবাজির কারণেও ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলেও মনে করছেন তারা। শুধু পুলিশের পক্ষে রিকশা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন উল্লেখ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নজমুল হাসান মানবজমিনকে বলেন, আমাদের চেষ্টার কোনো কমতি নেই। রিকশা বন্ধের জন্য আমাদের কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত কাজ করছে। প্রতিদিন আমরা অভিযান চালাচ্ছি। কিন্তু ফলাফল কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছায়নি।

পুলিশের সঙ্গে এই রিকশা বন্ধ করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের উল্লেখ করে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন দায়িত্ব নিচ্ছে না। এই রিকশার যে উপকরণ এগুলো কীভাবে আসে। এগুলোর বৈধতা কীভাবে পায়। দিনশেষে এটার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা লাগবে। শুধু পুলিশ দিয়ে রিকশা বন্ধ করা সহজ নয়। এত সংখ্যক রিকশা ডাম্পিং করার পর্যাপ্ত জায়াগায়ও নেই।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মীর খায়রুল আলম মানবজমিনকে বলেন, সিটি করপোরেশন নতুন করে কোনো রিকশাকে লাইসেন্স দেয় নাই। লাইসেন্সবিহীন রিকশা সরানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই ব্যবস্থা নেবে। এখন পুলিশ সেভাবে গুছিয়ে উঠতে পারেনি। আমরা মোবাইল কোর্ট করার ক্ষেত্রে পুলিশ পাচ্ছি না। রিকশা তো অনেক। এত রিকশা উচ্ছেদ করতে গেলে অনেক ধরনের মানবাধিকারের বিষয়ও চলে আসে। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.