কাশ্মীর: মাত্র ১০০ মিটার দূরেই শত্রু, দশকের পর দশক কেমন সেই অভিজ্ঞতা by সোয়ামিনাথন নটরাজন
১৯ অগাস্ট ২০১৯: বিতর্কিত কাশ্মীরের দুই অংশে ভারত ও
পাকিস্তান প্রায় ১০ লাখ সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছে। একটি এলাকায় এত বেশি
সৈন্য সম্ভবত বিশ্বের আর কোথাও নেই।
কাশ্মীরের সীমান্ত রেখার কোথাও
কোথাও ভারী অস্ত্রে সজ্জিত দুই দেশের সৈন্যদের অবস্থান খুব কাছাকাছি। কোথাও
এই ব্যবধান এমনকি ১০০ মিটার।
বিপজ্জনক এক সীমান্তে চিরশত্রুর চোখে
চোখ রেখে জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা কেমন - বিবিসিকে তা বলেছেন বৈরি এই দুই
দেশের দুজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা।
"সংঘাতের শুরু হয় হাল্কা
মেশিনগানের গুলি দিয়ে। তারপর এক সময় ভারি মেশিনগান। তারপর শুরু হয়
মর্টারের গোলা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই পক্ষের মধ্যে বেশ ভারি অস্ত্র
ব্যবহার হচ্ছে। পরিস্থিতি খুব খারাপ হলে, অবস্থা সামাল দিতে আমাদের
সিনিয়র কম্যান্ডাররা সীমান্তের ওপারে পাকিস্তানের কম্যান্ডারদের সাথে
যোগাযোগ করেন।"
কাশ্মীরে ভারত ও পাকিস্তানের কিছু সেনা চৌকির মধ্যে ব্যবধান ৫০ মিটারেরও কম |
কাশ্মীর নিয়ন্ত্রণ রেখায় কী হয় - এভাবেই বিবিসির কাছে তা বর্ণনা করেন ভারতের একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা
পারমানবিক
শক্তিধর ভারত ও পাকিস্তানের প্রায় দশ লাখ সৈন্য বর্তমানে কাশ্মীরে
মুখোমুখি অবস্থান করছে। কোথাও কোথাও তাদের মধ্যে দূরত্ব খুবই কম।
শত্রুর নজর এবং অস্ত্রের আওতার মধ্যে কাজ, খাওয়া দাওয়া, ঘুমানোর অভিজ্ঞতা কেমন ?
লড়াই
শুরুতেই
পাকিস্তানী অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল কিছুটা দার্শনিকের সুরে বলেন, "সবাই
শান্তি ভালোবাসে, কিন্তু শান্তি আসলে একটি অলীক ধারণা। কখনো কখনো শান্তির
জন্যই আপনাকে লড়াই করতে হয়।"
কর্নেল মুরুগানানথাম নয় বছর কাশ্মীরে ছিলেন |
ভারতীয় কর্মকর্তা বললেন, "আপনাকে হয় মারতে হবে, নয় মরতে হবে। ভাবার কোনো সময় নেই।"
"সীমান্তে
পরিস্থিতি কখনই একরকম থাকে না। সবসময়ই বিপজ্জনক এবং ক্রমাগত বদলায়। আমরা
তাদের সীমান্ত চৌকির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করি, তারাও আমাদের চৌকি
দখলের চেষ্টা করে, " বললেন কর্নেল মুরুগানানথাম, অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার।
"এই ইঁদুর-বেড়াল খেলার শেষ নেই। তবে যারাই সীমান্তে উঁচু জায়গার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে, তারাই প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে।"
সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসাবে তরুণ বয়সেই মুরুগানানাথামকে কাশ্মীর নিয়ন্ত্রণ রেখা পাহারার দায়িত্বে পাঠানো হয়েছিল।
"১৯৯৩
সাল - সে সময় পাকিস্তান ভারতের ভেতর জঙ্গি ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল।
আমাদের কাজ ছিল সেটা ঠেকানো। যখনই সীমান্তের ওপর থেকে গুলি শুরু হতো,
আমরা জানতাম জঙ্গিদের কাভার দেওয়ার জন্য তা করা হচ্ছে। সুতরাং আমাদেরকে
তখন বিশেষভাবে তৎপর হতে হতো।"
কড়া নজর
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল বিবিসির সাথে কথা বলেন তিনি তার নাম প্রকাশ করতে রাজী হননি।
"আমাকে যখন কাশ্মীরে পাঠানো হয়, তখন যুদ্ধবিরতি চলছিল। কিন্তু আমাদের সবসময় খুব সাবধানে থাকতে হতো"
দুই পক্ষই উঁচু জায়গাটি দখলের চেষ্টা করে |
পাকিস্তান সম্প্রতি মাত্র ২৬ জন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাকে
মিডিয়ায় কথা বলার অনুমতি দিয়েছে। বিবিসি তাদের একজনের সাথে কথা বলার
অনুমতি চাইলে, সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়।
কিন্তু
সাবেক এই কর্নেল নাম না প্রকাশ করার শর্তে কাশ্মীরের পুঞ্চ সীমান্তে ২০০৬
থেকে ২০০৮ পর্যন্ত একটি ইউনিটের কমান্ডারের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা বলতে
রাজী হন। ভারতের সাবেক কর্নেলও ঐ এলাকাতেই ছিলেন।
"কোনো কোনো সেনা
চৌকিকে ভীষণ আড়াল করে রাখা হতো। অধিকাংশ সময় সেগুলো নজরে পড়তো না। একটি
জায়গায় ভারত ও পাকিস্তানের চৌকিগুলোর মধ্যে দূরত্ব ছির মাত্র ২৫ মিটারের
মতো," বললেন পাকিস্তানি অফিসার।
শত্রুর মুখোমুখি
শত্রুর এত কাছাকাছি থাকা, নজরের মধ্যে থাকা খুব স্বস্তির বিষয় নয়।
ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এরকম খুব কাছাকাছি চৌকিগুলোতে তরুণ অফিসারদের এক বা দুই মাসের জন্য মোতায়েন করা হয়।
"আমার একটি এলাকায় দুই নিরাপত্তা চৌকির মধ্যে দূরত্ব ছিল মাত্র ১৫০
মিটার। আমি দেখতে পেতাম পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের অস্ত্র পরিষ্কার করছে,"
বললেন কর্নেল মুরুগানানথাম।
ভারি গোলাগুলির সময় গ্রামবাসীদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয় |
"আরেক জায়গায়, আমার চৌকিটি ছিল একটি নিচু জায়গায়। আমি তাদের চোখে না দেখলেও বুঝতে পারতাম তারা আমাদের সবসময় দেখছে।"
"যদিও
ভয় খুবই স্বাভাবিক একটি প্রতিক্রিয়া, তবুও প্রশিক্ষণের কারণে আমি নিজেকে
শান্ত রাখতে শিখেছিলাম। বিশেষ করে আমার জওয়ানদের সামনে আমি কোনোভাবেই
দেখাতে পারিনা যে আমি ভয়ে রয়েছি। আমি তাদেরকে বলতাম, যাই ঘটুক, এই চৌকি
আমরা ছাড়বনা।"
পাকিস্তানের সাবেক কর্নেল বললেন, তিনি একবার একটি
চৌকিতে রাত কাটিয়েছিলেন যেটির খুবই কাছে ছিল ভারতীয় একটি সেনা চৌকি। "তবে
এসব পরিবেশে আপনি একসময় অভ্যস্ত হয়ে যান। সাহসী হয়ে যান।"
তবে
দুই প্রশিক্ষিত এবং সুসজ্জিত সেনাবাহিনী যখন পরস্পরের প্রতি এত ঘৃণা পোষণ
করে, তখন পরিস্থিতি যে কোনো সময় আয়ত্তের বাইরে চলে যেতেই পারে।
কর্নেল মুরুগানানাথাম বললেন, "একদিন আমার একজন জওয়ান পাকিস্তানিদের মেশিনগানের গুলিতে মারা গেল।"
"পুরো
ব্যাটালিয়ন শোকার্ত হয়ে পড়েছিল। বদলা নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল
বাকি জওয়ানরা। আমরা কর্মকর্তারা তাদেরকে শান্ত করেছিলাম, তাদেরকে বলেছিলাম
আমরা সময়মতো এর জবাব দেব।"
"আমি কাছে আরেকটি চৌকি থেকে পাল্টা হামলার পরিকল্পনা করেছিলাম, পাকিস্তানিরা হতাহত হয়েছিল।"
এভাবেই কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা মাঝেমধ্যেই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
গোলাগুলির পরিণতি ভোগ করতে হয় সীমান্তের গ্রামবাসীদেরও |
পাকিস্তানি
কর্নেল বলেন, তিনি যখন সীমান্ত চৌকিতে ছিলেন তখন কোনো লড়াই হয়নি, তবে
তার সৈন্যরা মাঝে মধ্যেই আবেগ-তাড়িত হয়ে পড়তো, উত্তেজিত হয়ে পড়তো।
"আমরা
যখনই ভারত শাসিত কাশ্মীরের ভেতর থেকে নির্যাতনের খবর পেতাম, সৈন্যরা
অস্থির হয়ে পড়তো। তাদের আবেগ ঠাণ্ডা করতে কয়েকদিন লেগে যেত।"
বৈরি আবহাওয়া
বিপদ যে সবসময় শত্রু সৈন্যদের কাছ থেকে আসে, তা নয়। বরফে আচ্ছাদিত সুন্দর হিমালয়ও সৈন্যদের জন্য চরম বিপদ বয়ে আনে।
"নিউমোনিয়া এবং ঠাণ্ডা থেকে বুকের নানা অসুখ বড় চ্যালেঞ্জ। জীবন বাঁচানো অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে, " বললেন পাকিস্তানি অফিসার।
প্রচণ্ড ঠাণ্ডা সৈন্যদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। |
"একজন অসুস্থ সৈন্যকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য বাকি চারজন জওয়ানের জীবন হুমকিতে পড়ে। "
একমত হলেন ভারতীয় কর্মকর্তা।
"উঁচু পাহাড়ে একধরণের অস্বাভাবিক অনুভূতি হয়। অত উঁচুতে গিয়ে থাকার জন্য জন্য ছয়দিন ধরে প্রশিক্ষণ নেওয়া লাগে।"
"যত সৈন্য খোয়া যায়, তার অর্ধেকের জন্যই দায়ী আবহাওয়া - ঠাণ্ডা, ফ্রস্টবাইট।"
বজ্রপাত
পাহাড়ে, প্রকৃতি অনেক সময় অসম্ভব বে-খেয়ালি আচরণ করে।
১৯৯৭ সালে কর্নেল মুরুগানানথামের পোস্টিং ছিল শামসাবাড়ি রেঞ্জে। ওপারে পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের লিপা উপত্যকা।
"আমার
মনে আছে দিওয়ালির দিনে হঠাৎ শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড় এবং সেই সাথে বজ্রপাত।
আমাদের চৌকিটি ছিল ৩৬০০ মিটার ওপর। অত উচ্চতায় মেঘ ডাকার শব্দ খুবই
ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতা।"
উঁচু দুর্গম চৌকিতে সরঞ্জাম পৌঁছানো দুরূহ কাজ |
"বজ্রপাতে পাহাড়ের চূড়ায় আগুন ধরে
গিয়েছিল। আমরা সাথে সাথে সমস্ত জেনারেটর বন্ধ করে দিই। রেডিও যোগাযোগের
যন্ত্র বন্ধ করে দিয়ে বাঙ্কারে গিয়ে আশ্রয় নিই। আমরা দেখলাম
পাকিস্তানিরাও তাই করছে।"
সাহায্য
দুর্গম
পাহাড়ি এলাকায় অনেক নিরাপত্তা চৌকির সাথে যোগাযোগের জন্য কোনো রাস্তা
নেই। হয় হেলিকপ্টার না হয় গাধার পিঠে মালপত্র নেওয়া হয়।
"কাশ্মীরের পথঘাট খুবই সরু এবং বিপজ্জনক। গাড়ি খাদে পড়ে অনেক সৈন্য মারা যায়," বললেন পাকিস্তানী অফিসার।
"অমি যখন ছিলাম, গাড়ি দুর্ঘটনায় আমার দুজন সৈন্য মারা গিয়েছিল।"
সীমান্তে দু-পক্ষ এক অন্যের ওপর সর্বক্ষণ নজর রাখে |
সীমান্তে
মোতায়েন করা হয় যাদেরয়, সেসব সৈন্যদের জীবন খুবই কঠিন। মাসের পর মাস
তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়, পরিবারের অনেক অনুষ্ঠানে তাদের
অংশগ্রহণ সম্ভব হয়না।
কর্নেল মুরুগানানাথাম বললেন, শত্রুর কাছ থেকে
গুলি খাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, এমন সীমান্ত চৌকিতে কাউকেই একমাসের বেশি রাখা
হয়না। এছাড়া, ৩৫০০ মিটারের উঁচুতে যেসব সীমান্ত চৌকি, সেখানে মোতায়েনের
মেয়াদ বড়জোর তিন মাস।
বাঙ্কার
সীমান্তের
একদম সম্মুখভাগের কিছু কিছু চৌকি অনেক শক্ত করে তৈরি করা হয়। কংক্রিট
এবং ইস্পাত ব্যবহার করা হয়। হাল্কা গুলি ঠেকানোর ক্ষমতা থাকে এসব পোস্টের।
কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রহিত করার পর ভারত সেখানে অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করেছে। |
স্থায়ী সীমান্ত চৌকিগুলোতে অধিকাংশগুলোতেই বাঙ্কার থাকে।
তবে
অস্থায়ী চৌকিগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তার জন্য পাথর এবং বালির বস্তা ব্যবহার
করা হয়। এসব বাঙ্কারে বড় জোর দুই বা তিনজন মেশিনগান নিয়ে বসতে পারে।
যখন দুই বাহিনীর অবস্থান খুব কাছাকাছি হয়, ছোটোখাটো ঘটনাতেই বড় ধরণের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
পাকিস্তানি অফিসার বলছিলেন, "আমাদের সৈন্যরা একবার দেখলো ভারতীয় চৌকির
ওপর একটি চাকতি বসানো বসানো। আমরা ভাবলাম আমাদের ওপর নজরদারির জন্য হয়তো
রেডার বসানো হয়েছে।"
"আমরা একটি বৈঠক ডেকে ভারতীয়দের জিজ্ঞেস করলাম
ওটা কী। তারা বললো ওটা একটা স্যাটেলাইট ডিশ। আমি বুঝতে পারছিলাম না আমরা
কী করা উচিৎ। তারপর আরো বড় আকারের একটি স্যাটেলাইট ডিশ আনিয়ে বসালাম।"
ওয়ার্ল্ড
অ্যাটলাস বা বিশ্বে মানচিত্রে দেখা যায়, ভারত কাশ্মীরের ৪৫.১ শতাংশ এলাকা
নিয়ন্ত্রণ করে, পাকিস্তান করে ৩৮.২। বাকি এলাকা চীনের নিয়ন্ত্রণে।
অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নিয়ন্ত্রণ রেখার বিভিন্ন অংশে কাঁটাতারের বেড়া বসিয়েছে ভারত |
বিতর্কিত লাদাখ সীমান্তে ভারত-চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপক সৈন্য
সমাবেশ করেছে। তবে ১৯৬২ সালের পর এই সীমান্তে কোনো সংঘাত হয়নি।
কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা খুবই বিপজ্জনক। গত ৩০ বছরে নিয়ন্ত্রণ রেখায় দুপক্ষেরই শত শত সৈন্য মারা গেছে।
"সীমান্তে
যে কোনো সময় মৃত্যু হতে পারে। দেশপ্রেম, রেজিমেন্ট নিয়ে গর্ব, কাশ্মীরের
প্রতি আবেগ-অনুগত্য আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। বাহিনীর অন্যদের প্রতি
আনুগত্য, দায়িত্ববোধ আমাদের সাহসী করে," বললেন পাকিস্তানি অফিসার।
ভারতীয় কর্নেলেরও কথা ছিল প্রায় একইরকম, "এক এবং অভিন্ন ভারতের ধারনা আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়।"
গত ৩০ বছরে কাশ্মীর সীমান্তে দু পক্ষেরই শত শত সৈন্য নিহত হয়েছে |
No comments