ধানের দাম নেই, চালে ছাড় নেই
বিভিন্ন
হিসাব-নিকেশ আর পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগে থেকেই ধারণা ছিল এবার দেশে বোরো
ধানের বাম্পার ফলন হবে। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩
লাখ টন বেশি ধান উৎপাদন হলেও কৃষক তার ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। তবে কৃষক
ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ভোক্তার গলা কেটে চালের দাম নিচ্ছেন বিক্রেতারা।
ধান নিয়ে এখন বেশ বিপাকে কৃষক। কৃষকের ঘরে ধান আছে। কিন্তু আনন্দ নেই। কারণ ধানের উৎপাদন পর্যায়ের দাম আর চালের গ্রাহক পর্যায়ের মূল্য ব্যবধান বিশাল। প্রান্তিক কৃষক নিজেদের উৎপাদিত ধানের উপযুক্ত মূল্য না পেলেও বাজারে চালের দাম বেশ চড়া। কৃষকপর্যায়ে বর্তমানে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা। অথচ এক কেজি চাল কেনার জন্য ভোক্তাকে গুনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা।
বিশ্লেষকদের মতে, সরকার যদি আগেই অনুমান করতে পারতো, তাহলে এখন ধানের দাম নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা এড়ানো যেত। কিন্তু তা হয়নি। ধানের দাম নিয়ে কৃষক পর্যায়ে হতাশা যখন চরমে, তখন সরকার বেশ তড়িঘড়ি করে বিদেশ থেকে চাল কেনা নিরুৎসাহিত করার জন্য আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়েছে। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির উন্নত হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় আছে।
এক হিসাব করে দেখা গেছে, বর্তমানে ৬০০ টাকা মণ হিসাবে এক কেজি ধানের দাম দাঁড়ায় ১৫ টাকা। খুচরা বাজারে ৪০ টাকার নিচে কোনো চাল নেই। এক মণ ধানে চাল হয় ২৫ থেকে ২৮ কেজি। সে হিসেবে কেজিপ্রতি চালের দাম হয় ১৭ থেকে ১৮ টাকা। কৃষক ১৮ থেকে ২০ টাকা পাচ্ছেন। অথচ বাজারে চাল অর্থাৎ গ্রাহকপর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৩৪ থেকে ৪০ টাকা। তবে এ পার্থক্য গড়ে ২০ থেকে ২২ টাকা। উৎপাদনকারী কৃষক যেখানে চালের দাম পাচ্ছেন ১৮ থেকে ২০ টাকা, সেখানে ভোক্তাকে সর্বনিম্ন কিনতে হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকায়। ক্ষেত্রবিশেষে দামের এ পার্থক্য আরো বেশি। এ ব্যবধানের বেশিরভাগ অর্থ চলে যাচ্ছে ফড়িয়াদের পকেটে। উৎপাদক আর গ্রাহকপর্যায়ে ধান-চালের দামে এমন পার্থক্যকে অস্বাভাবিক বলছেন বিশ্লেষকরা।
অর্থনীতি সমিতির সভাপতি আবুল বারকাত মনে করেন, উৎপাদন খরচের সঙ্গে শ্রমের মূল্য যোগ করে এবার ধানের দাম প্রতিমণ ১২০০ টাকা হওয়া উচিত। এ মুহূর্তে প্রতিমণ বোরো ধান উৎপাদনে ৬০০ টাকার বেশি খরচের যে হিসাবটি দেওয়া হচ্ছে, তা কৃষকের পারিশ্রমিক বাদ দিয়ে করা।
ধানের দাম এতোটাই কমে গেছে যে তীব্র ক্ষোভে ফসলের মাঠে আগুন ধরিয়ে দিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছেন টাঙ্গাইলের এক কৃষক। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় কৃষক নানা উপায়ে প্রতিবাদ করেছেন।
সাধারণ মানুষের কাছে বিআর ২৮ চালের চাহিদা বেশি। রাজধানীর কয়েকটি চালের বাজার ঘুরে ও সরকারি সংস্থার হিসাবে দেখা যায়, খুচরা বাজারে এ চালের কেজিপ্রতি সর্বনিম্ন দাম ৩৪ থেকে ৩৮ টাকা। পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩২ টাকা। খুচরা বাজারের সঙ্গে পাইকারি বাজারের মূল্যপার্থক্য দাঁড়াচ্ছে ৫ থেকে ৬ টাকা।
সারাদেশের গড় হিসাবে কৃষকপর্যায়ে বর্তমানে প্রতিমণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকায়। অথচ এক কেজি ভালো মানের চাল কেনার জন্য ভোক্তাকে গুনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। আর মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৮ থেকে ৪০ টাকায়। অভিযোগ উঠেছে, চালকল মালিকদের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণে কৃষক উৎপাদন খরচের অর্ধেক মূল্যে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। চালের দামও নিয়ন্ত্রণ করছেন তারাই। এদিকে উত্তরবঙ্গের অনেক জেলায় প্রতিমণ ধান ৩২০-৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক জানান, কৃষকের স্বার্থরক্ষায় বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতি বিঘায় সেচে ১ হাজার ৫০০, সার ও কীটনাশকে ৩ হাজার, বীজ ৫০০, নিড়ানি ৫০০, কাটায় ৩ হাজার টাকাসহ সব মিলিয়ে ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকা খরচ হয়। বিঘায় ২০ মণ ধান হলে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা লোকসান হবে বলে জানা গেছে।
এদিকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার খুচরা বাজারে প্রতিকেজি ভালো মানের চাল বিক্রি হয় ৫২ থেকে ৫৬ টাকায়।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতি কেজি মোটা চাল পাইকারিতে ৩১ থেকে ৩৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর এ বছর প্রতি কেজি চালের উৎপাদন খরচই পড়েছে ৩৬ টাকা। এক মাস আগেও চালের দর ছিল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা। সবচেয়ে কম দামি মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। রাজধানী বাজারে পাইকারি বাজারে বর্তমানে ৫০ কেজির প্রতিবস্তা আটাশ চাল বিক্রি হচ্ছে ১,৭০০ টাকা, মিনিকেট নতুন চাল ২,২০০ টাকা এবং পুরনোটা ২,৪০০ টাকায়। স্বর্ণা ৫০ কেজির বস্তা ১,৩৮০ থেকে ১,৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া গুটি চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতিবস্তা ১,৩২০ টাকায়।
এদিকে চালের দাম না কমলেও ধানের দাম কমেই চলেছে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহেও বাজারে নতুন ধান বিক্রি হয়েছে স্থানভেদে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা মণ। আর এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন চিকন চালের ধান মাত্র ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। কোথাও কোথাও ধানের দাম আরো কম।
টিসিবির হিসাবে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৩ টাকা থেকে ৪ টাকা করে কমেছে। সরু চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৪৮ টাকা ৫৬ টাকার মধ্যে যা এক সপ্তাহ আগেও ৫২ টাকা থেকে ৬৪ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। এক বছর আগের তুলনায় সরু চালের দাম কমেছে ১৬ শতাংশ।
দেশের প্রধান ধান উৎপাদনকারী এলাকার মধ্যে রয়েছে রংপুর, দিনাজপুর ও কুষ্টিয়া। এসব এলাকা থেকে প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় প্রতি মণ ধানের দাম ২০০ থেকে ৩৫০ টাকা কম। বর্তমানে মোটা চালের ধান প্রতি মণ ৬৪৫ থেকে ৬৬০ টাকা, মাঝারি ধান ৭০০ থেকে ৭১০ টাকা ও সরু ধান ৯৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে। কিন্তু এই চালের পাইকারি মূল্য ৪০ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৪২ বা ৪৩ টাকা। অথচ কৃষক প্রতি কেজি ধানের মূল্য পাচ্ছে মাত্র ১৪ থেকে ১৫ টাকা।
খুচরা আর পাইকারি বাজারে চালের মূল্য হিসাব করে দেখা গেছে, পাইকারের চেয়ে খুচরা বাজারে প্রতিকেজি চালে অতিরিক্ত নেয়া হচ্ছে ১৬ থেকে ১৭ টাকা। বাজারে যেহেতু মিনিকেট চাল বেশি চলে তাই এই চালের মূল্য নিয়েই সাধারণত কথা বলেন ব্যবসায়ীরা। তবে মানভেদে মোটা চাল প্রতিকেজি ৪০ টাকার কম বেশি বিক্রি হচ্ছে।
চালের দামের বিষয়ে বাবু বাজার চাল ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাওসার আলম খান বলেন, বর্তমানে নতুন মিনিকেট প্রতি কেজি চাল ৪০ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৪১ বা ৪২ টাকা দরে পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে। আর পুরনো মিনিকেট ৪৩ থেকে ৪৪ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
কাওরান বাজারে দেখা গেছে, একই বাজারে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি মিনিকেট চালের দামে ১০ থেকে ১২ টাকার ব্যবধান।
এই বাজারের পাইকারি দোকান জনপ্রিয় রাইস এজেন্সির বিক্রয়কর্মী আমির হোসেন বলেন, আমরা বড় ব্যবসায়ী এবং মিল মালিকদের থেকে চাল এনে বিক্রি করি। যে দামে চাল আনা হয় তার চেয়ে কেজিপ্রতি ২ থেকে ৩ টাকা টাকা ব্যবসা করি। কিন্তু খুচরা দোকান আমাদের থেকে নিয়ে একটু বেশি লাভে বিক্রি করে।
চালের দাম এই বাজারেরই খুচরা ব্যবসায়ী মানিক মিয়া ১০ কেজির প্যাকেটজাত এসিআই পিউর চাল বিক্রি করেন ৫৮০ টাকায়। সেই হিসেবে প্রতিকেজি চালর দাম পড়ে ৫৮ টাকা। দাম বেশি রাখার কারণ হিসেবে তিনি জানান, তার কেনা পড়ছে বেশি তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে খোলা মিনিকেট চালের কেজি ৫৪ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি করেন তিনি। এই চালের পাইকারি মূল্য ৪০ থেকে ৪৪ টাকার মধ্যে হলে ৫৪ থেকে ৫৫ টাকা রাখেন।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ২৮শে মার্চ খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে চলতি বোরো মৌসুমে ২৫শে এপ্রিল থেকে ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত ১২ লাখ ৫০ হাজার টন ধান-চাল সংগ্রহ করার কথা।
এদিকে বাজারে ধানের দাম না পাওয়া নিয়ে কৃষকদের ব্যাপক অভিযোগের মধ্যে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ চালের আমদানি শুল্ক দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। চাল আমদানিতে এখন ৫৫ শতাংশ কর দিতে হবে। ফলে আমদানি করা চালের দাম বাড়বে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা। কিন্তু বাজারে চালের দাম কেজিতে গড়ে ২ থেকে ৩ টাকা কমেছে। মোটা চালের দাম এখন ৩০ টাকা। যা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
চালের দামের বিষয়ে বাবু বাজার চাল ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাওসার আলম খান বলেন, রমজানে চাল কম চলে। তাই দাম একটু কম। রমজানের পরে বিক্রয় বেশি হবে। বর্তমানে নতুন মিনিকেট প্রতি কেজি চাল ৪০ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৪১ বা ৪২ টাকা দরে পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে। আর পুরনো মিনিকেট ৪৩ থেকে ৪৪ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
কাওরান বাজারের চালের আড়তের পাইকারী ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বলেন, এবার উৎপাদন বেশি হওয়ায় বাজারে চালের সরবরাহ বেশি হচ্ছে। মৌসুমে এই সময়ে কম দামে ধান কেনাবেচা হওয়ায় মিলমালিকরা কম দামে চাল সরবরাহ শুরু করেছেন। নতুন চালের দাম কেজিতে প্রায় ৫ টাকা কম দামে বিক্রি হচ্ছে। তবে এতে ক্রেতারা লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু এবার কৃষক ধানের দাম থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
আড়তদার ব্যবসায়ীরা আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির বিষয়ে বলেন, চালের আমদানি শুল্ক অনেক দেরিতে বাড়ানো হয়েছে। মৌসুমের ধান ওঠার আগে বাড়ানো হলে কৃষকরা ধানের ভালো দাম পেত।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান মনে করেন, চালের শুল্ক বাড়ানো যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এটি আরো আগে বৃদ্ধি করলে কৃষকরা বেশি লাভবান হতেন। চাল আমদানি কমলে দেশে ধানের ভালো দাম পবে কৃষকরা।
বাবু বাজার সায়েম রাইস এজেন্সির কর্ণধার জাকির হোসাইন রনি বলেন, পাইকারি বাজারে চালের দাম কমেছে। কিন্তু খুচরা বাজারে তেমন কমেনি। কর্তৃপক্ষ বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না বলেই খুচরা বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা পর্যন্ত দাম নিয়ে ভোক্তাদের ঠকাচ্ছে।
ধান নিয়ে এখন বেশ বিপাকে কৃষক। কৃষকের ঘরে ধান আছে। কিন্তু আনন্দ নেই। কারণ ধানের উৎপাদন পর্যায়ের দাম আর চালের গ্রাহক পর্যায়ের মূল্য ব্যবধান বিশাল। প্রান্তিক কৃষক নিজেদের উৎপাদিত ধানের উপযুক্ত মূল্য না পেলেও বাজারে চালের দাম বেশ চড়া। কৃষকপর্যায়ে বর্তমানে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা। অথচ এক কেজি চাল কেনার জন্য ভোক্তাকে গুনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা।
বিশ্লেষকদের মতে, সরকার যদি আগেই অনুমান করতে পারতো, তাহলে এখন ধানের দাম নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা এড়ানো যেত। কিন্তু তা হয়নি। ধানের দাম নিয়ে কৃষক পর্যায়ে হতাশা যখন চরমে, তখন সরকার বেশ তড়িঘড়ি করে বিদেশ থেকে চাল কেনা নিরুৎসাহিত করার জন্য আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়েছে। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির উন্নত হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় আছে।
এক হিসাব করে দেখা গেছে, বর্তমানে ৬০০ টাকা মণ হিসাবে এক কেজি ধানের দাম দাঁড়ায় ১৫ টাকা। খুচরা বাজারে ৪০ টাকার নিচে কোনো চাল নেই। এক মণ ধানে চাল হয় ২৫ থেকে ২৮ কেজি। সে হিসেবে কেজিপ্রতি চালের দাম হয় ১৭ থেকে ১৮ টাকা। কৃষক ১৮ থেকে ২০ টাকা পাচ্ছেন। অথচ বাজারে চাল অর্থাৎ গ্রাহকপর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৩৪ থেকে ৪০ টাকা। তবে এ পার্থক্য গড়ে ২০ থেকে ২২ টাকা। উৎপাদনকারী কৃষক যেখানে চালের দাম পাচ্ছেন ১৮ থেকে ২০ টাকা, সেখানে ভোক্তাকে সর্বনিম্ন কিনতে হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকায়। ক্ষেত্রবিশেষে দামের এ পার্থক্য আরো বেশি। এ ব্যবধানের বেশিরভাগ অর্থ চলে যাচ্ছে ফড়িয়াদের পকেটে। উৎপাদক আর গ্রাহকপর্যায়ে ধান-চালের দামে এমন পার্থক্যকে অস্বাভাবিক বলছেন বিশ্লেষকরা।
অর্থনীতি সমিতির সভাপতি আবুল বারকাত মনে করেন, উৎপাদন খরচের সঙ্গে শ্রমের মূল্য যোগ করে এবার ধানের দাম প্রতিমণ ১২০০ টাকা হওয়া উচিত। এ মুহূর্তে প্রতিমণ বোরো ধান উৎপাদনে ৬০০ টাকার বেশি খরচের যে হিসাবটি দেওয়া হচ্ছে, তা কৃষকের পারিশ্রমিক বাদ দিয়ে করা।
ধানের দাম এতোটাই কমে গেছে যে তীব্র ক্ষোভে ফসলের মাঠে আগুন ধরিয়ে দিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছেন টাঙ্গাইলের এক কৃষক। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় কৃষক নানা উপায়ে প্রতিবাদ করেছেন।
সাধারণ মানুষের কাছে বিআর ২৮ চালের চাহিদা বেশি। রাজধানীর কয়েকটি চালের বাজার ঘুরে ও সরকারি সংস্থার হিসাবে দেখা যায়, খুচরা বাজারে এ চালের কেজিপ্রতি সর্বনিম্ন দাম ৩৪ থেকে ৩৮ টাকা। পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩২ টাকা। খুচরা বাজারের সঙ্গে পাইকারি বাজারের মূল্যপার্থক্য দাঁড়াচ্ছে ৫ থেকে ৬ টাকা।
সারাদেশের গড় হিসাবে কৃষকপর্যায়ে বর্তমানে প্রতিমণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকায়। অথচ এক কেজি ভালো মানের চাল কেনার জন্য ভোক্তাকে গুনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। আর মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৮ থেকে ৪০ টাকায়। অভিযোগ উঠেছে, চালকল মালিকদের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণে কৃষক উৎপাদন খরচের অর্ধেক মূল্যে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। চালের দামও নিয়ন্ত্রণ করছেন তারাই। এদিকে উত্তরবঙ্গের অনেক জেলায় প্রতিমণ ধান ৩২০-৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক জানান, কৃষকের স্বার্থরক্ষায় বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতি বিঘায় সেচে ১ হাজার ৫০০, সার ও কীটনাশকে ৩ হাজার, বীজ ৫০০, নিড়ানি ৫০০, কাটায় ৩ হাজার টাকাসহ সব মিলিয়ে ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকা খরচ হয়। বিঘায় ২০ মণ ধান হলে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা লোকসান হবে বলে জানা গেছে।
এদিকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার খুচরা বাজারে প্রতিকেজি ভালো মানের চাল বিক্রি হয় ৫২ থেকে ৫৬ টাকায়।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতি কেজি মোটা চাল পাইকারিতে ৩১ থেকে ৩৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর এ বছর প্রতি কেজি চালের উৎপাদন খরচই পড়েছে ৩৬ টাকা। এক মাস আগেও চালের দর ছিল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা। সবচেয়ে কম দামি মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। রাজধানী বাজারে পাইকারি বাজারে বর্তমানে ৫০ কেজির প্রতিবস্তা আটাশ চাল বিক্রি হচ্ছে ১,৭০০ টাকা, মিনিকেট নতুন চাল ২,২০০ টাকা এবং পুরনোটা ২,৪০০ টাকায়। স্বর্ণা ৫০ কেজির বস্তা ১,৩৮০ থেকে ১,৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া গুটি চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতিবস্তা ১,৩২০ টাকায়।
এদিকে চালের দাম না কমলেও ধানের দাম কমেই চলেছে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহেও বাজারে নতুন ধান বিক্রি হয়েছে স্থানভেদে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা মণ। আর এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন চিকন চালের ধান মাত্র ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। কোথাও কোথাও ধানের দাম আরো কম।
টিসিবির হিসাবে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৩ টাকা থেকে ৪ টাকা করে কমেছে। সরু চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৪৮ টাকা ৫৬ টাকার মধ্যে যা এক সপ্তাহ আগেও ৫২ টাকা থেকে ৬৪ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। এক বছর আগের তুলনায় সরু চালের দাম কমেছে ১৬ শতাংশ।
দেশের প্রধান ধান উৎপাদনকারী এলাকার মধ্যে রয়েছে রংপুর, দিনাজপুর ও কুষ্টিয়া। এসব এলাকা থেকে প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় প্রতি মণ ধানের দাম ২০০ থেকে ৩৫০ টাকা কম। বর্তমানে মোটা চালের ধান প্রতি মণ ৬৪৫ থেকে ৬৬০ টাকা, মাঝারি ধান ৭০০ থেকে ৭১০ টাকা ও সরু ধান ৯৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে। কিন্তু এই চালের পাইকারি মূল্য ৪০ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৪২ বা ৪৩ টাকা। অথচ কৃষক প্রতি কেজি ধানের মূল্য পাচ্ছে মাত্র ১৪ থেকে ১৫ টাকা।
খুচরা আর পাইকারি বাজারে চালের মূল্য হিসাব করে দেখা গেছে, পাইকারের চেয়ে খুচরা বাজারে প্রতিকেজি চালে অতিরিক্ত নেয়া হচ্ছে ১৬ থেকে ১৭ টাকা। বাজারে যেহেতু মিনিকেট চাল বেশি চলে তাই এই চালের মূল্য নিয়েই সাধারণত কথা বলেন ব্যবসায়ীরা। তবে মানভেদে মোটা চাল প্রতিকেজি ৪০ টাকার কম বেশি বিক্রি হচ্ছে।
চালের দামের বিষয়ে বাবু বাজার চাল ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাওসার আলম খান বলেন, বর্তমানে নতুন মিনিকেট প্রতি কেজি চাল ৪০ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৪১ বা ৪২ টাকা দরে পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে। আর পুরনো মিনিকেট ৪৩ থেকে ৪৪ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
কাওরান বাজারে দেখা গেছে, একই বাজারে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি মিনিকেট চালের দামে ১০ থেকে ১২ টাকার ব্যবধান।
এই বাজারের পাইকারি দোকান জনপ্রিয় রাইস এজেন্সির বিক্রয়কর্মী আমির হোসেন বলেন, আমরা বড় ব্যবসায়ী এবং মিল মালিকদের থেকে চাল এনে বিক্রি করি। যে দামে চাল আনা হয় তার চেয়ে কেজিপ্রতি ২ থেকে ৩ টাকা টাকা ব্যবসা করি। কিন্তু খুচরা দোকান আমাদের থেকে নিয়ে একটু বেশি লাভে বিক্রি করে।
চালের দাম এই বাজারেরই খুচরা ব্যবসায়ী মানিক মিয়া ১০ কেজির প্যাকেটজাত এসিআই পিউর চাল বিক্রি করেন ৫৮০ টাকায়। সেই হিসেবে প্রতিকেজি চালর দাম পড়ে ৫৮ টাকা। দাম বেশি রাখার কারণ হিসেবে তিনি জানান, তার কেনা পড়ছে বেশি তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে খোলা মিনিকেট চালের কেজি ৫৪ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি করেন তিনি। এই চালের পাইকারি মূল্য ৪০ থেকে ৪৪ টাকার মধ্যে হলে ৫৪ থেকে ৫৫ টাকা রাখেন।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ২৮শে মার্চ খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে চলতি বোরো মৌসুমে ২৫শে এপ্রিল থেকে ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত ১২ লাখ ৫০ হাজার টন ধান-চাল সংগ্রহ করার কথা।
এদিকে বাজারে ধানের দাম না পাওয়া নিয়ে কৃষকদের ব্যাপক অভিযোগের মধ্যে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ চালের আমদানি শুল্ক দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। চাল আমদানিতে এখন ৫৫ শতাংশ কর দিতে হবে। ফলে আমদানি করা চালের দাম বাড়বে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা। কিন্তু বাজারে চালের দাম কেজিতে গড়ে ২ থেকে ৩ টাকা কমেছে। মোটা চালের দাম এখন ৩০ টাকা। যা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
চালের দামের বিষয়ে বাবু বাজার চাল ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাওসার আলম খান বলেন, রমজানে চাল কম চলে। তাই দাম একটু কম। রমজানের পরে বিক্রয় বেশি হবে। বর্তমানে নতুন মিনিকেট প্রতি কেজি চাল ৪০ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৪১ বা ৪২ টাকা দরে পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে। আর পুরনো মিনিকেট ৪৩ থেকে ৪৪ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
কাওরান বাজারের চালের আড়তের পাইকারী ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বলেন, এবার উৎপাদন বেশি হওয়ায় বাজারে চালের সরবরাহ বেশি হচ্ছে। মৌসুমে এই সময়ে কম দামে ধান কেনাবেচা হওয়ায় মিলমালিকরা কম দামে চাল সরবরাহ শুরু করেছেন। নতুন চালের দাম কেজিতে প্রায় ৫ টাকা কম দামে বিক্রি হচ্ছে। তবে এতে ক্রেতারা লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু এবার কৃষক ধানের দাম থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
আড়তদার ব্যবসায়ীরা আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির বিষয়ে বলেন, চালের আমদানি শুল্ক অনেক দেরিতে বাড়ানো হয়েছে। মৌসুমের ধান ওঠার আগে বাড়ানো হলে কৃষকরা ধানের ভালো দাম পেত।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান মনে করেন, চালের শুল্ক বাড়ানো যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এটি আরো আগে বৃদ্ধি করলে কৃষকরা বেশি লাভবান হতেন। চাল আমদানি কমলে দেশে ধানের ভালো দাম পবে কৃষকরা।
বাবু বাজার সায়েম রাইস এজেন্সির কর্ণধার জাকির হোসাইন রনি বলেন, পাইকারি বাজারে চালের দাম কমেছে। কিন্তু খুচরা বাজারে তেমন কমেনি। কর্তৃপক্ষ বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না বলেই খুচরা বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা পর্যন্ত দাম নিয়ে ভোক্তাদের ঠকাচ্ছে।
No comments