স্বর্ণার সাহসিকতায় বাঁচলো তাদের প্রাণ by মরিয়ম চম্পা
সমস্ত
ফ্লোর ছেয়ে গেছে কালো ধোঁয়ায়। অন্ধকার রুমে শুধু আর্তনাদ আর বাঁচার আকুতি।
অপেক্ষা এই কোনো ক্রেন কিংবা লেডার এসে তাদের নিচে নামাবে। প্রাণে
বাঁচাবে। কিন্তু না। বাঁচার কোনো উপায় না দেখে সঙ্গে থাকা ২০ থেকে ২৫ জন
সহকর্মীর কেউ কেউ মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে লাফিয়ে পড়ে জীবন বাঁচাবে ।
ঠিক সেই মুহূর্তে সাহসী স্বর্ণার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত তাদের নিশ্চিত
মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচায়। বনানীর অগ্নিকাণ্ডে বেঁচে ফেরা এবং আহত স্বর্ণার
সঙ্গে মানবজমিনের একান্ত আলাপচারিতায় উঠে আসে সেই ভয়াল দিনের বিস্তারিত
বর্ণনা।
বনানীর এফ আর টাওয়ারে ১২ তলায় ডার্ড গ্রুপে ট্রেনিং এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত ছিলেন সেঁজুতি স্বর্ণা। এই বিল্ডিং এ ডার্ড গ্রুপের ১২, ১৩, ১৬ ও ১৯ তলায় মোট ৪টি অফিস রয়েছে। স্বর্ণা বলেন, দুপুর ১টার আগ পর্যন্ত আমরা একদমই বুঝতে পারিনি যে এতো ধোঁয়া এবং আগুন আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। এর কিছুক্ষণ পরেই এডমিনের এক আপু বললেন আমাদের বিল্ডিং এ আগুন লেগেছে। তোমরা যে যেভাবে পারো নিজেদের মতো বের হয়ে ছাদের দিকে যাও। এ সময় আমরা ২৫ জনের মতো ছিলাম। আমরা ঠিক ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। অনেক চেষ্টা করে প্রধান দরজা পর্যন্ত কোনোভাবেই যেতে পারছিলাম না এতোটা উত্তাপ। সিঁড়িতে তো প্রশ্নই ওঠে না। প্রচণ্ড ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে সিঁড়ির এক দুই ধাপ গিয়ে আবার ফিরে আসি। এরমধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেছে। প্রচণ্ড ধোঁয়ায় আমাদের দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। আমাদের ইমিডিয়েট বসকে বললাম স্যার আমরা রুমাল ও টাওয়াল ভিজিয়ে নাকে মুখে ধরলে নিঃশ্বাস নিতে সুবিধা হবে। পুরো বিল্ডিংটি গ্লাস প্রোটেক্টটেড। ফ্লোরের ধোঁয়া বের করতে আমরা তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেই সমস্ত গ্লাসগুলো ভেঙ্গে ফেলবো। হাতের কাছে চেয়ার টেবিল যে যা পেয়েছি তাই দিয়ে গ্লাস ভাঙ্গার চেষ্টা করেছি। তবে গ্লাস ভাঙ্গতে আমাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে।
এ সময় সিনিয়র অনেকেই প্রাণে বাঁচতে লাফ দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাদের বোঝালাম, যদি মরতে হয় এখানেই মরবো। কারণ এতো উঁচু থেকে লাফ দিয়ে বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই। কি করবো তখন ওই মুহূর্তে আমাদের মাথায় কিছু কাজ করছিল না। তখন কাগজে লিখে ভারি কিছুর সঙ্গে মুড়িয়ে নিচে ছুড়ে মারি। যেখানে লেখা ছিল, আমাদের জন্য অন্তত একটি সিঁড়ি পাঠান। অথবা কোনো একটা ব্যবস্থা করেন যাতে আমরা অন্তত নিচে নামতে পারি। তখন লেখা কাগজগুলো হয়তো কারো কাছে পৌঁছায়নি। আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে যে আমরা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবো। তখন মনে হলো মোবাইল ফোনে যেহেতু ইন্টারনেট আছে তাই লাইভ অথবা ভিডিও কিছু একটা করে ফেসবুকে দেই। অন্তত ফেসবুকের বন্ধুরা যে কেউ দেখে যেন ফায়ার সার্ভিসকে দেখায়। ভিডিওতে বলি ফায়ার সার্ভিসের লোকদের এই ভিডিওটা আপনারা একটু দেখান। না হলে আমরা কেউ সার্ভাইভ করতে পারবো না। ভাই আমাদের জন্য একটি সিঁড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। ওই ভিডিও পাঠানোর অনেক পরে ৮ অথবা ১০ তলা পর্যন্ত ক্রেনে উঠে দুজন লোক আসে। তখন আমরা রিকোয়েস্ট করে বললাম প্লিজ আমাদের এখান থেকে বাঁচান।
তারা বলল দেখেন আগে আমাদের আগুন নিভাতে হবে। আপনারা একটু অপেক্ষা করেন। ফেসবুকে ভিডিওটা পাঠানোর পরে আমরা মোটামুটি কারো সঙ্গে আর ফোনে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। ওই মুহূর্তে আমরা এতোটাই ট্রমাতে ছিলাম কীভাবে কি করেছি সেটা আমরা কেউ ব্যাখ্যা করতে পারবো না। শুধু এতোটুকুই মনে আছে ভেতরে প্রচণ্ড ধোঁয়া। আমার ১ হাত সামনেও কোনো কিছু দেখতে পাইনি। মোবাইলের লাইট দিয়েও দেখা যাচ্ছিল না এতো অন্ধকার। সামান্য একটি প্লাস্টিক পোড়ালে সেই ধোঁয়াটা নেয়া যায় না। তার ওপরে অফিসে তো এসি ও সোফার সিনথেটিক পোড়া ধোঁয়া। ফ্লোরের সবগুলো গ্লাস ভেঙ্গে ফেলার কারণে সমস্ত কালো ধোঁয়া রুমের ভেতরে ঢুকে পড়ে।
এতো ধোঁয়া ছিল যে আমরা ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলাম না। এমনকি চোখও খুলতে পারছিলাম না। ইতিমধ্যে আমাদের গলা, চোখ, মুখ, স্কিনসহ সর্বত্রই জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে গেছে। রুমের মধ্যে প্রচণ্ড হিট। ১০ তলা পর্যন্ত উঠে আসা ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা বললো, দেখেন আমাদের ক্রেন ১২ তলা পর্যন্ত যাবে না। তখন আমরা মোটামুটি আশা ছেড়ে দিয়েছি যে আমরা হয়তো এ যাত্রায় আর বেঁচে ফিরবো না। এ সময় ফ্লোরে অনেক সিনিয়র ভাইয়েরা ছিল যারা লাফ দেয়ার জন্য রেডি। তখন অনেক অনুরোধ করে বললাম ‘দেখেন যা হোক এখান থেকে হোক, আপনারা প্লিজ লাফ দিয়েন না’। যদি মরতে হয় এখানে থেকেও মরতে হবে। লাফ দিয়ে পড়েও মরতে হবে। কারণ লাফ দিলেও বাঁচার কোনো গ্যারান্টি নেই। পরে সিনিয়র ভাইয়েরা আর লাফ দিতে উদ্যত হয় নি। আমি জানি না এটা হঠাৎ আল্লাহর রহমত কি না। এর কিছুক্ষণ পরেই ল্যাডার নিয়ে দুজন ফায়ার সার্ভিসের লোক ১২ তলায় আসলো। আমরা অনুরোধ করে বললাম দেখেন ভাই মেয়েদের অন্তত আগে নামানোর ব্যবস্থা করেন। তখন এমন একটি পরিস্থিতি মেয়ে আর ছেলে কি সবাই বাঁচার জন্য আকুতি করছিল। ক্রেন বা ল্যাডারে ওঠার জন্য আমাদের যেখান থেকে লাফ দিতে হয়েছে সেটা কিন্তু যথেষ্ট নিচে ছিল। মেয়েদের পক্ষে এই উচ্চতাটা ম্যানেজ করে লাফ দেয়াটা অনেক কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।
ক্রেনটি আসার পরে প্রথমেই লাফ দিয়ে দুই থেকে ৩টি ভাইয়া ও একজন আপু উঠে পড়লো। তখন আমি বললাম দেখেন আমি প্রেগনেন্ট। ধোঁয়ায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। যেকোনো মূল্যে আপনারা আমাকে এবং আমার অনাগত বাচ্চাটাকে বাঁচান। এটা আমার প্রথম বাচ্চা। তখন আমাকে তারা বললো প্লিজ আমাদের ১০ মিনিট সময় দেন। আমি বললাম ততোক্ষণ হয়তো আমার শ্বাস-প্রশ্বাস থাকবে না। অথবা আমি সার্ভাইভ করতে পারবো না। ক্রেনের লোকদের নিচে নামিয়ে সর্বোচ্চ ৫ মিনিটের মধ্যে তারা আমাদের ফ্লোরে পৌঁছে যায়। এরপর বাকিদের নামানো হয়। আমরা সবাই আল্লাহর কৃপায় বেঁচে আছি। তবে ফ্লোরে আটকে পড়ে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা আমরা কীভাবে পার করেছি সেটা হয়তো কেউ মনে করতে পারবো না। সবচেয়ে খারাপ লেগেছে আমাদের অফিসের দারোয়ান ও পিয়ন এরা কখন বেরিয়ে গেছে কেউ টের পেলাম না। তাছাড়া আগুন লাগার পরে আমাদের ফ্লোরে কোনো এলার্মও বাজেনি। অফিসে অগ্নি নির্বাপক কোনো যন্ত্র ছিল না। ইমার্জেন্সি যে সিঁড়ি আছে সে সম্পর্কে আমাদের খুব একটা ধারণা নেই।
ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি স্বর্ণা বলেন, দু একদিন অবজারভেশনে রেখে ডাক্তার বলছে ছেড়ে দেবে। ধোঁয়ার কারণে এ্যাজমার সমস্যা দেখা দিয়েছে। কফ ও থুথুর সঙ্গে পোড়া ও কালো কার্বনগুলো বের হচ্ছে। প্রথমে আইসিইউতে রাখা হয়। পরদিন কেবিনে আনা হয়। স্বর্ণার গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলায়। ঢাকায় স্বামীর সঙ্গে পূর্ব রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় থাকেন। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করেছেন। বাবা মৃত শাহাজাদা। মা ওয়াসিমা আক্তার গৃহিণী। দুই ভাইবোনের মধ্যে স্বর্ণা বড়। স্বামী রাকিব কামাল ব্র্যাক ব্যাংকে কর্মরত।
বনানীর এফ আর টাওয়ারে ১২ তলায় ডার্ড গ্রুপে ট্রেনিং এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত ছিলেন সেঁজুতি স্বর্ণা। এই বিল্ডিং এ ডার্ড গ্রুপের ১২, ১৩, ১৬ ও ১৯ তলায় মোট ৪টি অফিস রয়েছে। স্বর্ণা বলেন, দুপুর ১টার আগ পর্যন্ত আমরা একদমই বুঝতে পারিনি যে এতো ধোঁয়া এবং আগুন আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। এর কিছুক্ষণ পরেই এডমিনের এক আপু বললেন আমাদের বিল্ডিং এ আগুন লেগেছে। তোমরা যে যেভাবে পারো নিজেদের মতো বের হয়ে ছাদের দিকে যাও। এ সময় আমরা ২৫ জনের মতো ছিলাম। আমরা ঠিক ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। অনেক চেষ্টা করে প্রধান দরজা পর্যন্ত কোনোভাবেই যেতে পারছিলাম না এতোটা উত্তাপ। সিঁড়িতে তো প্রশ্নই ওঠে না। প্রচণ্ড ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে সিঁড়ির এক দুই ধাপ গিয়ে আবার ফিরে আসি। এরমধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেছে। প্রচণ্ড ধোঁয়ায় আমাদের দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। আমাদের ইমিডিয়েট বসকে বললাম স্যার আমরা রুমাল ও টাওয়াল ভিজিয়ে নাকে মুখে ধরলে নিঃশ্বাস নিতে সুবিধা হবে। পুরো বিল্ডিংটি গ্লাস প্রোটেক্টটেড। ফ্লোরের ধোঁয়া বের করতে আমরা তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেই সমস্ত গ্লাসগুলো ভেঙ্গে ফেলবো। হাতের কাছে চেয়ার টেবিল যে যা পেয়েছি তাই দিয়ে গ্লাস ভাঙ্গার চেষ্টা করেছি। তবে গ্লাস ভাঙ্গতে আমাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে।
এ সময় সিনিয়র অনেকেই প্রাণে বাঁচতে লাফ দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাদের বোঝালাম, যদি মরতে হয় এখানেই মরবো। কারণ এতো উঁচু থেকে লাফ দিয়ে বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই। কি করবো তখন ওই মুহূর্তে আমাদের মাথায় কিছু কাজ করছিল না। তখন কাগজে লিখে ভারি কিছুর সঙ্গে মুড়িয়ে নিচে ছুড়ে মারি। যেখানে লেখা ছিল, আমাদের জন্য অন্তত একটি সিঁড়ি পাঠান। অথবা কোনো একটা ব্যবস্থা করেন যাতে আমরা অন্তত নিচে নামতে পারি। তখন লেখা কাগজগুলো হয়তো কারো কাছে পৌঁছায়নি। আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে যে আমরা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবো। তখন মনে হলো মোবাইল ফোনে যেহেতু ইন্টারনেট আছে তাই লাইভ অথবা ভিডিও কিছু একটা করে ফেসবুকে দেই। অন্তত ফেসবুকের বন্ধুরা যে কেউ দেখে যেন ফায়ার সার্ভিসকে দেখায়। ভিডিওতে বলি ফায়ার সার্ভিসের লোকদের এই ভিডিওটা আপনারা একটু দেখান। না হলে আমরা কেউ সার্ভাইভ করতে পারবো না। ভাই আমাদের জন্য একটি সিঁড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। ওই ভিডিও পাঠানোর অনেক পরে ৮ অথবা ১০ তলা পর্যন্ত ক্রেনে উঠে দুজন লোক আসে। তখন আমরা রিকোয়েস্ট করে বললাম প্লিজ আমাদের এখান থেকে বাঁচান।
তারা বলল দেখেন আগে আমাদের আগুন নিভাতে হবে। আপনারা একটু অপেক্ষা করেন। ফেসবুকে ভিডিওটা পাঠানোর পরে আমরা মোটামুটি কারো সঙ্গে আর ফোনে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। ওই মুহূর্তে আমরা এতোটাই ট্রমাতে ছিলাম কীভাবে কি করেছি সেটা আমরা কেউ ব্যাখ্যা করতে পারবো না। শুধু এতোটুকুই মনে আছে ভেতরে প্রচণ্ড ধোঁয়া। আমার ১ হাত সামনেও কোনো কিছু দেখতে পাইনি। মোবাইলের লাইট দিয়েও দেখা যাচ্ছিল না এতো অন্ধকার। সামান্য একটি প্লাস্টিক পোড়ালে সেই ধোঁয়াটা নেয়া যায় না। তার ওপরে অফিসে তো এসি ও সোফার সিনথেটিক পোড়া ধোঁয়া। ফ্লোরের সবগুলো গ্লাস ভেঙ্গে ফেলার কারণে সমস্ত কালো ধোঁয়া রুমের ভেতরে ঢুকে পড়ে।
এতো ধোঁয়া ছিল যে আমরা ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলাম না। এমনকি চোখও খুলতে পারছিলাম না। ইতিমধ্যে আমাদের গলা, চোখ, মুখ, স্কিনসহ সর্বত্রই জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে গেছে। রুমের মধ্যে প্রচণ্ড হিট। ১০ তলা পর্যন্ত উঠে আসা ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা বললো, দেখেন আমাদের ক্রেন ১২ তলা পর্যন্ত যাবে না। তখন আমরা মোটামুটি আশা ছেড়ে দিয়েছি যে আমরা হয়তো এ যাত্রায় আর বেঁচে ফিরবো না। এ সময় ফ্লোরে অনেক সিনিয়র ভাইয়েরা ছিল যারা লাফ দেয়ার জন্য রেডি। তখন অনেক অনুরোধ করে বললাম ‘দেখেন যা হোক এখান থেকে হোক, আপনারা প্লিজ লাফ দিয়েন না’। যদি মরতে হয় এখানে থেকেও মরতে হবে। লাফ দিয়ে পড়েও মরতে হবে। কারণ লাফ দিলেও বাঁচার কোনো গ্যারান্টি নেই। পরে সিনিয়র ভাইয়েরা আর লাফ দিতে উদ্যত হয় নি। আমি জানি না এটা হঠাৎ আল্লাহর রহমত কি না। এর কিছুক্ষণ পরেই ল্যাডার নিয়ে দুজন ফায়ার সার্ভিসের লোক ১২ তলায় আসলো। আমরা অনুরোধ করে বললাম দেখেন ভাই মেয়েদের অন্তত আগে নামানোর ব্যবস্থা করেন। তখন এমন একটি পরিস্থিতি মেয়ে আর ছেলে কি সবাই বাঁচার জন্য আকুতি করছিল। ক্রেন বা ল্যাডারে ওঠার জন্য আমাদের যেখান থেকে লাফ দিতে হয়েছে সেটা কিন্তু যথেষ্ট নিচে ছিল। মেয়েদের পক্ষে এই উচ্চতাটা ম্যানেজ করে লাফ দেয়াটা অনেক কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।
ক্রেনটি আসার পরে প্রথমেই লাফ দিয়ে দুই থেকে ৩টি ভাইয়া ও একজন আপু উঠে পড়লো। তখন আমি বললাম দেখেন আমি প্রেগনেন্ট। ধোঁয়ায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। যেকোনো মূল্যে আপনারা আমাকে এবং আমার অনাগত বাচ্চাটাকে বাঁচান। এটা আমার প্রথম বাচ্চা। তখন আমাকে তারা বললো প্লিজ আমাদের ১০ মিনিট সময় দেন। আমি বললাম ততোক্ষণ হয়তো আমার শ্বাস-প্রশ্বাস থাকবে না। অথবা আমি সার্ভাইভ করতে পারবো না। ক্রেনের লোকদের নিচে নামিয়ে সর্বোচ্চ ৫ মিনিটের মধ্যে তারা আমাদের ফ্লোরে পৌঁছে যায়। এরপর বাকিদের নামানো হয়। আমরা সবাই আল্লাহর কৃপায় বেঁচে আছি। তবে ফ্লোরে আটকে পড়ে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা আমরা কীভাবে পার করেছি সেটা হয়তো কেউ মনে করতে পারবো না। সবচেয়ে খারাপ লেগেছে আমাদের অফিসের দারোয়ান ও পিয়ন এরা কখন বেরিয়ে গেছে কেউ টের পেলাম না। তাছাড়া আগুন লাগার পরে আমাদের ফ্লোরে কোনো এলার্মও বাজেনি। অফিসে অগ্নি নির্বাপক কোনো যন্ত্র ছিল না। ইমার্জেন্সি যে সিঁড়ি আছে সে সম্পর্কে আমাদের খুব একটা ধারণা নেই।
ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি স্বর্ণা বলেন, দু একদিন অবজারভেশনে রেখে ডাক্তার বলছে ছেড়ে দেবে। ধোঁয়ার কারণে এ্যাজমার সমস্যা দেখা দিয়েছে। কফ ও থুথুর সঙ্গে পোড়া ও কালো কার্বনগুলো বের হচ্ছে। প্রথমে আইসিইউতে রাখা হয়। পরদিন কেবিনে আনা হয়। স্বর্ণার গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলায়। ঢাকায় স্বামীর সঙ্গে পূর্ব রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় থাকেন। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করেছেন। বাবা মৃত শাহাজাদা। মা ওয়াসিমা আক্তার গৃহিণী। দুই ভাইবোনের মধ্যে স্বর্ণা বড়। স্বামী রাকিব কামাল ব্র্যাক ব্যাংকে কর্মরত।
No comments