জিনজিরার ক্ষুদ্র শিল্পে বিদেশি থাবা by এম এম মাসুদ
বাংলার
চীন, বাংলার জাপান বা মেইড ইন জিনজিরা ইত্যাদি নামে পরিচিত কেরানীগঞ্জ
উপজেলার জিনজিরা। একে মিনি মোটর ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন হিসেবেও অভিহিত করা হয়।
কিন্তু এখন সেখানে পড়েছে বিদেশি থাবা। দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ
অবদান রাখা এই এলাকা বিশেষ করে ধোলাইখালের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের
আওতাভুক্ত লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং বা হালকা প্রকৌশল শিল্প বর্তমানে শুল্ক বৈষম্য
ও বিদেশি নিম্ন মানের যন্ত্রাংশের সহজ লভ্যতার কারণে ব্যবসায় চরম মন্দা
যাচ্ছে। সূত্র জানায়, হালকা প্রকৌশল শিল্পের কাঁচা-মাল আমদানি করতে শুল্ক
দিতে হয় ৪০ শতাংশ। আর খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি করতে শুল্ক দিতে হয় ১ শতাংশ।
ফলে ধোলাইখালের তৈরি যন্ত্রাংশ কেনার চেয়ে বিদেশি নিম্ন মানের পার্টস
কিনছেন ক্রেতারা। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছে ধোলাইখালের ব্যবসায়ীরা।
উদ্যোক্তারা জানান, স্বাধীনতার পর পরই ধোলাইখালে পুরনো যন্ত্রাংশের ব্যবসা শুরু হয়। এখানে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় মিলে ৫ শতাধিক কারখানা। এখানকার ওয়ার্কশপ, লেদ ইন্ডাস্ট্রি এবং পুরনো যন্ত্রাংশ কেনাবেচা ও পুরনো গাড়ি কাটার কাজে নিয়োজিত প্রায় ৬ লক্ষাধিক শ্রমিক। এখানে মোটরপার্টস ও হালকা প্রকৌশল শিল্পের প্রায় ৪ হাজারের মতো যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে ১৩৭টি আইটেম বিশ্বের ১৭টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। এ শিল্পের বছরে লেনদেন প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার অধিক। সরকারকে এ খাতের ব্যবসায়ীরা বছরে দেড়শ’ কোটি টাকার অধিক রাজস্ব দিচ্ছেন। দেশের মোট চাহিদার ২০ শতাংশ পূরণ হয় ধোলাইখাল থেকে। অথচ এই শিল্প এখন উদ্যোক্তাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতি উচ্চহারে আমদানি শুল্ক, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, কাস্টমস কর্মকর্তাদের হয়রানিসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে ব্যবসায়ীরা লোকসানের মুখোমুখি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশের অপার সম্ভাবনাময় এই ধোলাইখালের মেশিনারি পার্টস শিল্প বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
হালকা প্রকৌশল শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিইআইওএ) সূত্রে জানা গেছে, এই খাতে প্রায় ১৭টি শিল্পের বিভিন্ন কারখানার মেশিনারিজের ৪ হাজার খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে। সারা দেশে সাড়ে ৮ হাজার কারখানা আছে। এর মাঝে ঢাকায় আছে ৫ হাজার। বগুড়ায় ১৫০০, যশোরে ১০০০, টঙ্গীতে ১০০০, পাবনায় ৫০০, নারায়ণগঞ্জে ১০০০, চট্টগ্রামে ২০০০, খুলনায় ১০০০ কারখানা আছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, চীন, জাপান, মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান ও সিঙ্গাপুর থেকে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ও খুচরা যন্ত্রাংশগুলো আমদানি করে ব্যবসায়ীরা। এছাড়া পুরনো গাড়ি ভেঙেও পার্টস সংগ্রহ করেন তারা। এখানে প্রায় সব মডেলের গাড়ি বিশেষ করে টয়োটা, নিশান, হোন্ডা, মিৎসুবিশি, সুজুকি, মারুতির যন্ত্রাংশ বেশি পাওয়া যায়। বাস এবং ট্রাকের মধ্যে বেড ফোর্ড, ইসুজু, নিশান, হিনো, ভলভো, টাটা, অশোক লেল্যান্ড, টারসেল, আইয়ার, ক্যান্টার প্রভৃতি গাড়ির যন্ত্রাংশ পাওয়া যায়।
সরজমিন দেখা গেছে, ধোলাইখালে মোটর পার্টস ও ইলেকট্রনিক সামগ্রীর এক বিশাল সম্ভাবনাময় ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে। গ্যাসকিট, পিস্টন, বিয়ারিং থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি মোটর পার্টস গাড়ির ব্রেকডাম, ইঞ্জিন, কার্টিজ, সকেট, জগ, জাম্পার, স্প্রিং, হ্যামার, ম্যাকেল জয়েন্ট, বল জয়েন্টসহ নানা মেশিনারিজ ও পার্টস তৈরি হচ্ছে এখানে। সুলভমূল্যে পার্টস কিনতে গাড়ির মালিকরা বাধ্য হয়েই এখানে আসেন।
প্রস্তুত হচ্ছে ওষুধ শিল্পের জন্য বিলিস্টার মেশিন। এই মেশিন আগে বিদেশ থেকে ৫০ লাখ টাকা দিয়ে আমদানি করা হতো। এখন ধোলাইখাল থেকে এই মেশিন তৈরি করে নিতে খরচ হয় মাত্র ৮-১০ লাখ টাকা। এছাড়া গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী যেকোনো মেশিনই ধোলাইখালের ব্যবসায়ীরা কম খরচে প্রস্তুত করে দিতে সক্ষম।
আরিফ নামের এক শ্রমিক বলেন, ধোলাইখালের কারিগর ও উদ্যোক্তারা যেসব যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি করেন তা শিল্প, গৃহস্থালী, কৃষি, বৈদ্যুতিক, যানবাহন, খেলনা ও চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেকোনো যন্ত্র একবার দেখে তা হুবহু তৈরি করতে পারেন। ফলে আমদানি বিকল্প যন্ত্রাংশের শেষ ভরসা এই ধোলাইখাল।
বিইআইওএ সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, সরকার একটু সহযোগিতা করলেই আমরা উঠে দাঁড়াতে পারি। আমাদের পণ্য ব্র্যান্ড করার সুযোগ দিলে ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের দেশীয় ব্র্যান্ড তৈরি হতো। তখন ক্রেতারা ব্র্যান্ড দেখে পণ্য কিনতে পারতেন। এখন ক্রেতারা বিদেশি ব্র্যান্ড দেখে পণ্য কেনেন। এ শিল্পের বড় অবদান হচ্ছে, পুরো খাতটি আমদানির বিকল্প হিসেবে কাজ করছে।
সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হোসেন খান বলনে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ধোলাইখাল ব্যান্ড দিন দিন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। শক্তিশালী স্থানীয় শিল্প গড়ে তোলার জন্য অবকাঠামো ও নীতিগত সহযোগিতা প্রয়োজন। এখন এ খাত বড় অসহায় হয়ে পড়েছে। উন্নত প্রযুক্তির সংযোজনও প্রয়োজন। কিন্তু সরকারের কোনো পলিসি না থাকায় নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারছি না। এছাড়া শুল্ক বৈষম্যের কারণে আমরা আরো পিছিয়ে পড়ছি। আশা করছি সরকার এদিকে নজর দিবে।
বিইআইওএ সূত্রে জানা গেছে, এ খাতে বিভিন্নভাবে প্রায় ৬ লাখ মানুষ জড়িত। উদ্যোক্তা রয়েছে প্রায় ৪০ হাজার। তাদের বিনিয়োগ রয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। দেশে এই শিল্পের বাজার বছরে প্রায় ৫৫ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এর মধ্যে স্থানীয়ভাবে জোগান দেয়া হয় ১৫ হাজার কোটি টাকার যন্ত্রাংশ। এসব যন্ত্রাংশ আমদানি করলে প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতো। জিডিপিতে এ শিল্পের অবদান প্রায় ৩ শতাংশ।
বিইআইওএ পরিসংখানে দেখা গেছে, ধোলাইখালের যন্ত্রাংশের রপ্তানি আয় প্রতি বছর বাড়ছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল ২১ কোটি ৯ লাখ ডলার। ২০১৯-১৭ অর্থবছরে আয় দাঁড়িয়েছে ৬৮ কোটি ৮ লাখ ডলার। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে আয় হয়েছে ১৮ কোটি ৯ লাখ ডলার। ২০০৯-১০ অর্থবছরে হয়েছে ৩১ কোটি ১ লাখ ডলার। ২০১০-১১ অর্থবছরে হয়েছে ২২ কোটি ১ লাখ ডলার। ২০১১-১২ অর্থবছরে হয়েছে ৩৭ কোটি ৬ লাখ ডলার। ২০১২-১৩ অর্থবছরে আয় হয়েছে ৩৬ কোটি ৭ লাখ ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আয় হয়েছে ৩৬ কোটি ৬ লাখ ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে হয়েছে ৪৪ কোটি ৭ লাখ ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আয় হয়েছে ৫১ কোটি ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আয় হয়েছে ৩৫ কোটি ৬ লাখ ডলার।
ব্যবসায়ী রফিক জানান, কোনো পার্টস যদি কোনো দোকানে না পাওয়া যায়, তবে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। এখানে ছোট বড় অনেক ওয়ার্কশপ আছে, যেখানে লেদ মেশিনের সাহায্যে অবিকল পার্টস তৈরি করে দেয়া হয়। উৎপাদিত গাড়ির যন্ত্রাংশগুলো সাধারণভাবে প্যাকেটজাত করে স্থানীয় বাজারে ছাড়া হয়। কিন্তু বিদেশ থেকে আমদানি করা একই যন্ত্রাংশ উন্নত প্যাকেটে বাজারজাত করা হয়। ফলে বাজার হারাচ্ছি আমরা।
বেশিরভাগ ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, কেউ ভালো নেই। সবার এক কথা, বড় কষ্টে আছি। বেচা কেনা একদমই নেই। সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। একজন ব্যবসায়ী জানালেন, বাবা এই ব্যবসা করছে। এখন আমি করছি। লেখাপড়া করিনি। অন্য কোনো কাজও করতে পারি না। এটা যে বাদ দেবো সেটাও পারছি না। সংসার নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। বিক্রির পরিমাণ অসম্ভব রকম কমে গেছে। কোনো কোনো দোকানদার দিনে একটাও ক্রেতা পান না। ফলে দোকানভাড়ার টাকা জোগানই অনেকের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। আর এখানে যেসব উদ্যোক্তা আছেন তাদের ব্র্যান্ডিং করার সক্ষমতা নেই।
ধোলাইখালের ব্যবসায়ীরা এর হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে চায়। ফিরিয়ে আনতে চায় রমরমা অবস্থা। এজন্য সরকারের কাছে বেশকিছু দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবস্থা করা। প্রশিক্ষিত লোকবল তৈরি করা। স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা। এই সেক্টরের উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগের দরকার। মৌলিক কাঁচামালের ওপর উচ্চ আমদানি শুল্ক উল্লেখযোগ্য হারে কমানো, অন্যদিকে আমদানিকৃত তৈরি ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক বাড়ানো। মান নিয়ন্ত্রণের জন্য টেস্টিং সেন্টার স্থাপন। উন্নতমানের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট চালু করা। লাইট ইঞ্জিনিয়ারের জন্য আলাদা শিল্প পার্ক তৈরি করা। দেশি-বিদেশি বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে যোগাযোগ বাড়ানো।
অর্থনীতিবিদ জায়েদ বকত বলেন, হালকা প্রকৌশল শিল্পের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। এ খাতে এখন দরকার নতুন প্রযুক্তির সম্ভাবনা। তাহলেই এ খাত ঘুরে দাঁড়াবে।
উদ্যোক্তারা জানান, স্বাধীনতার পর পরই ধোলাইখালে পুরনো যন্ত্রাংশের ব্যবসা শুরু হয়। এখানে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় মিলে ৫ শতাধিক কারখানা। এখানকার ওয়ার্কশপ, লেদ ইন্ডাস্ট্রি এবং পুরনো যন্ত্রাংশ কেনাবেচা ও পুরনো গাড়ি কাটার কাজে নিয়োজিত প্রায় ৬ লক্ষাধিক শ্রমিক। এখানে মোটরপার্টস ও হালকা প্রকৌশল শিল্পের প্রায় ৪ হাজারের মতো যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে ১৩৭টি আইটেম বিশ্বের ১৭টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। এ শিল্পের বছরে লেনদেন প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার অধিক। সরকারকে এ খাতের ব্যবসায়ীরা বছরে দেড়শ’ কোটি টাকার অধিক রাজস্ব দিচ্ছেন। দেশের মোট চাহিদার ২০ শতাংশ পূরণ হয় ধোলাইখাল থেকে। অথচ এই শিল্প এখন উদ্যোক্তাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতি উচ্চহারে আমদানি শুল্ক, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, কাস্টমস কর্মকর্তাদের হয়রানিসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে ব্যবসায়ীরা লোকসানের মুখোমুখি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশের অপার সম্ভাবনাময় এই ধোলাইখালের মেশিনারি পার্টস শিল্প বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
হালকা প্রকৌশল শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিইআইওএ) সূত্রে জানা গেছে, এই খাতে প্রায় ১৭টি শিল্পের বিভিন্ন কারখানার মেশিনারিজের ৪ হাজার খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে। সারা দেশে সাড়ে ৮ হাজার কারখানা আছে। এর মাঝে ঢাকায় আছে ৫ হাজার। বগুড়ায় ১৫০০, যশোরে ১০০০, টঙ্গীতে ১০০০, পাবনায় ৫০০, নারায়ণগঞ্জে ১০০০, চট্টগ্রামে ২০০০, খুলনায় ১০০০ কারখানা আছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, চীন, জাপান, মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান ও সিঙ্গাপুর থেকে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ও খুচরা যন্ত্রাংশগুলো আমদানি করে ব্যবসায়ীরা। এছাড়া পুরনো গাড়ি ভেঙেও পার্টস সংগ্রহ করেন তারা। এখানে প্রায় সব মডেলের গাড়ি বিশেষ করে টয়োটা, নিশান, হোন্ডা, মিৎসুবিশি, সুজুকি, মারুতির যন্ত্রাংশ বেশি পাওয়া যায়। বাস এবং ট্রাকের মধ্যে বেড ফোর্ড, ইসুজু, নিশান, হিনো, ভলভো, টাটা, অশোক লেল্যান্ড, টারসেল, আইয়ার, ক্যান্টার প্রভৃতি গাড়ির যন্ত্রাংশ পাওয়া যায়।
সরজমিন দেখা গেছে, ধোলাইখালে মোটর পার্টস ও ইলেকট্রনিক সামগ্রীর এক বিশাল সম্ভাবনাময় ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে। গ্যাসকিট, পিস্টন, বিয়ারিং থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি মোটর পার্টস গাড়ির ব্রেকডাম, ইঞ্জিন, কার্টিজ, সকেট, জগ, জাম্পার, স্প্রিং, হ্যামার, ম্যাকেল জয়েন্ট, বল জয়েন্টসহ নানা মেশিনারিজ ও পার্টস তৈরি হচ্ছে এখানে। সুলভমূল্যে পার্টস কিনতে গাড়ির মালিকরা বাধ্য হয়েই এখানে আসেন।
প্রস্তুত হচ্ছে ওষুধ শিল্পের জন্য বিলিস্টার মেশিন। এই মেশিন আগে বিদেশ থেকে ৫০ লাখ টাকা দিয়ে আমদানি করা হতো। এখন ধোলাইখাল থেকে এই মেশিন তৈরি করে নিতে খরচ হয় মাত্র ৮-১০ লাখ টাকা। এছাড়া গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী যেকোনো মেশিনই ধোলাইখালের ব্যবসায়ীরা কম খরচে প্রস্তুত করে দিতে সক্ষম।
আরিফ নামের এক শ্রমিক বলেন, ধোলাইখালের কারিগর ও উদ্যোক্তারা যেসব যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি করেন তা শিল্প, গৃহস্থালী, কৃষি, বৈদ্যুতিক, যানবাহন, খেলনা ও চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেকোনো যন্ত্র একবার দেখে তা হুবহু তৈরি করতে পারেন। ফলে আমদানি বিকল্প যন্ত্রাংশের শেষ ভরসা এই ধোলাইখাল।
বিইআইওএ সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, সরকার একটু সহযোগিতা করলেই আমরা উঠে দাঁড়াতে পারি। আমাদের পণ্য ব্র্যান্ড করার সুযোগ দিলে ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের দেশীয় ব্র্যান্ড তৈরি হতো। তখন ক্রেতারা ব্র্যান্ড দেখে পণ্য কিনতে পারতেন। এখন ক্রেতারা বিদেশি ব্র্যান্ড দেখে পণ্য কেনেন। এ শিল্পের বড় অবদান হচ্ছে, পুরো খাতটি আমদানির বিকল্প হিসেবে কাজ করছে।
সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হোসেন খান বলনে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ধোলাইখাল ব্যান্ড দিন দিন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। শক্তিশালী স্থানীয় শিল্প গড়ে তোলার জন্য অবকাঠামো ও নীতিগত সহযোগিতা প্রয়োজন। এখন এ খাত বড় অসহায় হয়ে পড়েছে। উন্নত প্রযুক্তির সংযোজনও প্রয়োজন। কিন্তু সরকারের কোনো পলিসি না থাকায় নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারছি না। এছাড়া শুল্ক বৈষম্যের কারণে আমরা আরো পিছিয়ে পড়ছি। আশা করছি সরকার এদিকে নজর দিবে।
বিইআইওএ সূত্রে জানা গেছে, এ খাতে বিভিন্নভাবে প্রায় ৬ লাখ মানুষ জড়িত। উদ্যোক্তা রয়েছে প্রায় ৪০ হাজার। তাদের বিনিয়োগ রয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। দেশে এই শিল্পের বাজার বছরে প্রায় ৫৫ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এর মধ্যে স্থানীয়ভাবে জোগান দেয়া হয় ১৫ হাজার কোটি টাকার যন্ত্রাংশ। এসব যন্ত্রাংশ আমদানি করলে প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতো। জিডিপিতে এ শিল্পের অবদান প্রায় ৩ শতাংশ।
বিইআইওএ পরিসংখানে দেখা গেছে, ধোলাইখালের যন্ত্রাংশের রপ্তানি আয় প্রতি বছর বাড়ছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল ২১ কোটি ৯ লাখ ডলার। ২০১৯-১৭ অর্থবছরে আয় দাঁড়িয়েছে ৬৮ কোটি ৮ লাখ ডলার। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে আয় হয়েছে ১৮ কোটি ৯ লাখ ডলার। ২০০৯-১০ অর্থবছরে হয়েছে ৩১ কোটি ১ লাখ ডলার। ২০১০-১১ অর্থবছরে হয়েছে ২২ কোটি ১ লাখ ডলার। ২০১১-১২ অর্থবছরে হয়েছে ৩৭ কোটি ৬ লাখ ডলার। ২০১২-১৩ অর্থবছরে আয় হয়েছে ৩৬ কোটি ৭ লাখ ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আয় হয়েছে ৩৬ কোটি ৬ লাখ ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে হয়েছে ৪৪ কোটি ৭ লাখ ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আয় হয়েছে ৫১ কোটি ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আয় হয়েছে ৩৫ কোটি ৬ লাখ ডলার।
ব্যবসায়ী রফিক জানান, কোনো পার্টস যদি কোনো দোকানে না পাওয়া যায়, তবে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। এখানে ছোট বড় অনেক ওয়ার্কশপ আছে, যেখানে লেদ মেশিনের সাহায্যে অবিকল পার্টস তৈরি করে দেয়া হয়। উৎপাদিত গাড়ির যন্ত্রাংশগুলো সাধারণভাবে প্যাকেটজাত করে স্থানীয় বাজারে ছাড়া হয়। কিন্তু বিদেশ থেকে আমদানি করা একই যন্ত্রাংশ উন্নত প্যাকেটে বাজারজাত করা হয়। ফলে বাজার হারাচ্ছি আমরা।
বেশিরভাগ ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, কেউ ভালো নেই। সবার এক কথা, বড় কষ্টে আছি। বেচা কেনা একদমই নেই। সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। একজন ব্যবসায়ী জানালেন, বাবা এই ব্যবসা করছে। এখন আমি করছি। লেখাপড়া করিনি। অন্য কোনো কাজও করতে পারি না। এটা যে বাদ দেবো সেটাও পারছি না। সংসার নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। বিক্রির পরিমাণ অসম্ভব রকম কমে গেছে। কোনো কোনো দোকানদার দিনে একটাও ক্রেতা পান না। ফলে দোকানভাড়ার টাকা জোগানই অনেকের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। আর এখানে যেসব উদ্যোক্তা আছেন তাদের ব্র্যান্ডিং করার সক্ষমতা নেই।
ধোলাইখালের ব্যবসায়ীরা এর হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে চায়। ফিরিয়ে আনতে চায় রমরমা অবস্থা। এজন্য সরকারের কাছে বেশকিছু দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবস্থা করা। প্রশিক্ষিত লোকবল তৈরি করা। স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা। এই সেক্টরের উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগের দরকার। মৌলিক কাঁচামালের ওপর উচ্চ আমদানি শুল্ক উল্লেখযোগ্য হারে কমানো, অন্যদিকে আমদানিকৃত তৈরি ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক বাড়ানো। মান নিয়ন্ত্রণের জন্য টেস্টিং সেন্টার স্থাপন। উন্নতমানের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট চালু করা। লাইট ইঞ্জিনিয়ারের জন্য আলাদা শিল্প পার্ক তৈরি করা। দেশি-বিদেশি বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে যোগাযোগ বাড়ানো।
অর্থনীতিবিদ জায়েদ বকত বলেন, হালকা প্রকৌশল শিল্পের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। এ খাতে এখন দরকার নতুন প্রযুক্তির সম্ভাবনা। তাহলেই এ খাত ঘুরে দাঁড়াবে।
No comments