নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারে ঈদ আনন্দ নেই
রহস্যজনকভাবে
নিখোঁজ হওয়া বা তুলে নেয়ার পর সন্ধান মিলছে না তাদের। কারও এক বছর, কারও
দুই বা তিন বছর ধরে খোঁজ নেই। স্বজনেরা প্রিয়জনের ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন
গুনছেন। কিন্তু তাদের সেই অপেক্ষা আর শেষ হয় না। এক দুঃসহ সময় কাটাচ্ছেন
তারা। ঈদের আনন্দ নেই এসব পরিবারে। নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের
খোঁজখবর নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন মানবজমিনের স্টাফ রিপোর্টার আল-আমিন ও মরিয়ম চম্পা-
২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর রাজধানীর শাহিনবাগের ৫৫৩ নম্বর বাড়ি থেকে সাজেদুল ইসলাম সুমন (৩৭)কে র্যাবের পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাদের স্বজনেরা র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট শাখায় যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো পক্ষই তাকে আটকের খবর নিশ্চিত করেনি। এরপর থেকে এই পরিবারের দিন কাটছে দুঃসহ যন্ত্রণায়। রাজধানীর শাহিনবাগের ৫৫৩ নম্বর বাসায় সাজেদুল ইসলাম সুমনের পরিবারের বসবাস। সুমনের দুই মেয়ে হাফসা ও আরোরা। বাবার অপেক্ষায় প্রহর কাটছে দুই মেয়ের। সুমনের স্ত্রী মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছেন যে, প্রয়োজন ছাড়া কারও সঙ্গে কথাই বলেন না। সুমনের বৃদ্ধা মা হাজেরা খাতুন ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে শয্যাশায়ী। এবার ঈদের আনন্দ নেই সুমনের পরিবারে। সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম তুলি কান্নাজড়িত কণ্ঠে মানবজমিনকে জানান, তার ভাই শেয়ার ব্যবসা করতেন। ২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর বাসা থেকে র্যাবের পোশাকধারী লোকজন তাকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ মিলছে না।
তিনি বলেন, আমার ভাই ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। এটাই কি তার অপরাধ? এটা যদি তার অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে তার ভাইয়ের বিচার করা হোক। কিন্তু, হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না। তিনি জানান, তারা নিয়মিতভাবে প্রেস ক্লাবসহ বিভিন্নস্থানে তাদের ভাইসহ গুম হওয়া সদস্যদের উদ্ধারের জন্য এখনো ঢাকাসহ বিভিন্নস্থানে সমাবেশ করছেন। তিনি তার ভাইকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।
রাজধানীর পূর্ব নাখালপাড়ার ৩২২/ডি নম্বর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মো. মাসুমের (২৮) পরিবারের কান্না থামছে না। ঈদ উপলক্ষে তাদের মধ্যে কোনো আনন্দ নেই। তার বোন ফাওজিয়া ইসলাম জানান, তার ভাইকে ২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর উত্তরার একটি প্রাইভেট কোচিং সেন্টার থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। মাসুম তীতুমীর কলেজের ফিন্যান্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন। ফাওজিয়া আরো জানান, তার ভাই পড়াশোনার পাশাপাশি প্রাইভেট পড়াতো। কোচিংয়ে ক্লাস নিতো। সেই টাকা দিয়ে সংসারের সহযোগিতা করতো। কর্মক্ষম একজন মানুষ পরিবার থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কারণে পরিবারে অভাব অনটন নেমে এসেছে। তিনি বলেন, আমার ভাই যদি কোনো অপরাধ করে থাকে তাহলে প্রচলিত আইনের মাধ্যমে বিচার হোক। এভাবে একজন মানুষ গুম হয়ে থাকবে এটা মেনে নেয়া যায় না। ফাওজিয়া আরো জানান, তার ভাই নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই বাবা ও মা অসুস্থ হয়ে গেছে। তারা প্রেস ক্লাবসহ বিভিন্নস্থানে মানববন্ধনে তার ভাইকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
বাড্ডার একেএম রহমতুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের গলির একটি বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন আল আমিন। আল আমিনের বোন শারমিন খাতুন জানান, তার ভাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। ২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর র্যাব পরিচয় দিয়ে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে তার ভাই নিখোঁজ রয়েছেন। তিনি আরো জানান, সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গেলে তারা আল আমিনকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে বার বার ধরনা দেয়ার পরও তারা কোনো সন্ধান দিতে পারেনি। শারমীন খাতুন বলেন, আমার ভাই কোনো রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় ছিল না। রাজধানীর তেজগাঁও ও বসুন্ধরা এলাকাসহ বিভিন্নস্থানে যে একসঙ্গে ৮ জন গুম হয়েছিল তার মধ্যে আমার ভাইও ছিল।
২০১৪ সালের ২৮শে নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজনৈতিক সহকর্মীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে নিখোঁজ হন ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের ৫ কর্মী। এরমধ্যে সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সম্রাট মোল্লা, ৭৯ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি খালেদ হাসান সোহেল, ৭৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি আনিসুর রহমান খান, একই ওয়ার্ডের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক বিপ্লব ও ৮০ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক দল সম্পাদক মিঠু। ১১ দিন পর মুন্সীগঞ্জে নিয়ে আনিসুর রহমান, বিপ্লব ও মিঠুকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু এখনো খোঁজ মেলেনি সম্রাট ও খালেদের। ২০১৩ সালের ২রা ডিসেম্বর রাজধানীর শিশুপার্ক এলাকা থেকে মাহফুজুর রহমান, সোহেল সরকার, বংশাল থানা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি হাবিবুল বাশার জহির, ৭১নং ওয়ার্ডের সভাপতি পারভেজ হোসাইন ও ছাত্রদল কর্মী হোসাইন চঞ্চলকে সাদা পোশাকে কে বা কারা তুলে নিয়ে যায়। তারা এখনো নিখোঁজ। একই বছর ৪ঠা ডিসেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরা থেকে ছয়জন নিখোঁজ হন। তারা হলেন- ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন, সুমনের খালাতো ভাই জাহিদুল করিম তানভীর, মাজহারুল ইসলাম রাসেল, মো. আল আমিন ও আসাদুজ্জামান রানা, আবদুল কাদের ভুঁইয়া মাসুম। এদের মধ্যে তিনজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, ছাত্রদলের সাবেক নেতা আনিসুর রহমান তালুকদার খোকনসহ কয়েকজনকে খুঁজে পাওয়া গেছে। আবার কয়েকজনের লাশও পাওয়া গেছে। তবে দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা এম ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরুসহ অনেককে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিএনপি ও নিখোঁজ পরিবারের সদস্যরা বরাবরই অভিযোগ করে আসছে, এসব গুমের পেছনে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত। নরসিংদী কলেজ ছাত্রদলের নির্বাচিত জিএস সিদ্দিকুর রহমান নাহিদ গত রমজানের শুরুতে নিখোঁজ হন। এখনো তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
২০১৫ সালের ১০ই মার্চ রাতে উত্তরার একটি বাসা থেকে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে বলে পরিবারের দাবি। পরে তাকে ভারতের শিলংয়ে খুঁজে পাওয়া যায়। ২০১৩ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি বিএনপি সমর্থক আইনজীবী সোহেল রানাকে উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টর থেকে ছাই রঙের মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। স্ত্রী আফরোজা সুলতানা জানান, তার স্বামী বিএনপি সমর্থক হলেও সক্রিয় নেতা নন। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুমের অর্ধযুগ পেরিয়ে গেছে। ইলিয়াস আলী ২০১২ সালের ১৭ই এপ্রিল রাতে বনানীর বাসার কাছ থেকে ড্রাইভার আনসার আলীসহ নিখোঁজ হন। তাদের এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২০১০ সালের ২৫শে জুন রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে নিখোঁজ হন বিএনপি নেতা কমিশনার চৌধুরী আলম। তাকেও ফিরে পায়নি পরিবার। ওই বছরের ১৭ই এপ্রিল রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড থেকে অপহৃত হন ঝালকাঠির রাজাপুর থানা যুবদল নেতা মিজানুর রহমান জমাদ্দার এবং তার দুই সহযোগী মুরাদ ও ফোরকান। কয়েক মাস পর ফোরকান বেরিয়ে এসে তাদের নিখোঁজ হওয়ার কাহিনী মিডিয়ার সামনে তুলে ধরেন। এর কয়েকদিন পর আবারও নিখোঁজ হন ফোরকান।
ইলিয়াস আলীর স্ত্রী রুশদীর লুনা বলেন, ইলিয়াসকে ছাড়া ঈদের দিনের কষ্টের কথাতো আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না। এটা কাউকে বোঝানো যায় না। পরিবারের একজন অভিভাবকের অনুপস্থিতিতে যেভাবে আমাদের থাকার কথা আমরা তেমনই আছি। গত ৬ বছর ধরে আমাদের ঈদের কোনো প্রস্তুতি নেই। আমরা ঈদের সময় গ্রামের বাড়ি সিলেটে যাই। ওখানে আমার শাশুড়ি থাকেন। আমরা নিজেরা শপিং বলতে কিছুই করি না। যারা আমাদের হেল্পিং হ্যান্ড অর্থাৎ কর্মচারী বা সাহায্যকারী ও কিছু গরিব মানুষের জন্য ঈদের কেনাকাটা করি। ঈদের সময় দলের নেতাকর্মীরা বাসায় আসে দেখা করতে এই পর্যন্তই। এর বাইরে কোনো উদযাপন নেই আমাদের। আমাদের মতো স্বজনহারাদের কষ্টের কথা আসলে বোঝাতে পারবো না।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনের দুই তিন মাস আগে দলের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বেশি সক্রিয় হন ছাত্রদল নেতা চঞ্চল হোসেন। ২০১৩ সালের ২রা ডিসেম্বর শাহবাগ থেকে দুপুর আড়াইটায় নিখোঁজ হন চঞ্চল হোসেন। আজ পর্যন্ত তার সন্ধান পায়নি তার পরিবার। চঞ্চলের স্ত্রী রেশমা আক্তার বলেন, ঈদ বলে আমাদের কাছে এখন কিছু নেই। কয়েক বছর ধরেই আমরা ঈদ উদযাপন করি না। চঞ্চলকে হারিয়ে ওর বাবা-মা, ভাই-বোন কারোর মনেই কোন শান্তি নেই। আমার ছেলে আহাদ প্রতি ঈদে বাবার অপেক্ষায় থাকে। আমাদের কোনো ঈদ নেই।
বংশাল এলাকার পারভেজ হোসেনসহ মোট ৪ জনকে ২০১৩ সালের ২রা ডিসেম্বর শাহবাগ থেকে অপহরণ করা হয়। ওই দিন দুপুর ২টায় স্ত্রী ফারজানা আক্তারের সঙ্গে পারভেজের সর্বশেষ কথা হয়। কান্নাভেজা কণ্ঠে ফারজানা বলেন, আমাদের তো আর ঈদ নাই। ও যে দিন গেছে সেদিন থেকে আমাদের ঈদও চলে গেছে। ঈদের দিন বাসায় দরজা বন্ধ করে নীরবে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। আমাদের দুই ছেলে মেয়ে আদিবা ইসলাম ঋতু ও আরাফ হোসেন। বাবার ছবি নিয়ে প্রায়ই তারা আমার কাছে জানতে চায় বাবা কবে আসবে? ছেলের কথার কোনো জবাব দিতে পারি না। এ বছর ঈদে কোনো কেনা কাটা করিনি। প্রতি বছর বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া টাকা দিতেন। ওটা দিয়ে বাচ্চাদের জন্য ঈদের কেনাকাটা করতাম। এবছর তিনি জেলে আছেন। আত্মীয়স্বজনরা বাচ্চাদের টুকিটাকি জামা কাপড় কিনে দিয়েছে। এবার ওগুলো দিয়েই ঈদ পালন করবে বাচ্চারা।
২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর রাজধানীর শাহিনবাগের ৫৫৩ নম্বর বাড়ি থেকে সাজেদুল ইসলাম সুমন (৩৭)কে র্যাবের পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাদের স্বজনেরা র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট শাখায় যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো পক্ষই তাকে আটকের খবর নিশ্চিত করেনি। এরপর থেকে এই পরিবারের দিন কাটছে দুঃসহ যন্ত্রণায়। রাজধানীর শাহিনবাগের ৫৫৩ নম্বর বাসায় সাজেদুল ইসলাম সুমনের পরিবারের বসবাস। সুমনের দুই মেয়ে হাফসা ও আরোরা। বাবার অপেক্ষায় প্রহর কাটছে দুই মেয়ের। সুমনের স্ত্রী মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছেন যে, প্রয়োজন ছাড়া কারও সঙ্গে কথাই বলেন না। সুমনের বৃদ্ধা মা হাজেরা খাতুন ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে শয্যাশায়ী। এবার ঈদের আনন্দ নেই সুমনের পরিবারে। সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম তুলি কান্নাজড়িত কণ্ঠে মানবজমিনকে জানান, তার ভাই শেয়ার ব্যবসা করতেন। ২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর বাসা থেকে র্যাবের পোশাকধারী লোকজন তাকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ মিলছে না।
তিনি বলেন, আমার ভাই ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। এটাই কি তার অপরাধ? এটা যদি তার অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে তার ভাইয়ের বিচার করা হোক। কিন্তু, হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না। তিনি জানান, তারা নিয়মিতভাবে প্রেস ক্লাবসহ বিভিন্নস্থানে তাদের ভাইসহ গুম হওয়া সদস্যদের উদ্ধারের জন্য এখনো ঢাকাসহ বিভিন্নস্থানে সমাবেশ করছেন। তিনি তার ভাইকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।
রাজধানীর পূর্ব নাখালপাড়ার ৩২২/ডি নম্বর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মো. মাসুমের (২৮) পরিবারের কান্না থামছে না। ঈদ উপলক্ষে তাদের মধ্যে কোনো আনন্দ নেই। তার বোন ফাওজিয়া ইসলাম জানান, তার ভাইকে ২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর উত্তরার একটি প্রাইভেট কোচিং সেন্টার থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। মাসুম তীতুমীর কলেজের ফিন্যান্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন। ফাওজিয়া আরো জানান, তার ভাই পড়াশোনার পাশাপাশি প্রাইভেট পড়াতো। কোচিংয়ে ক্লাস নিতো। সেই টাকা দিয়ে সংসারের সহযোগিতা করতো। কর্মক্ষম একজন মানুষ পরিবার থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কারণে পরিবারে অভাব অনটন নেমে এসেছে। তিনি বলেন, আমার ভাই যদি কোনো অপরাধ করে থাকে তাহলে প্রচলিত আইনের মাধ্যমে বিচার হোক। এভাবে একজন মানুষ গুম হয়ে থাকবে এটা মেনে নেয়া যায় না। ফাওজিয়া আরো জানান, তার ভাই নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই বাবা ও মা অসুস্থ হয়ে গেছে। তারা প্রেস ক্লাবসহ বিভিন্নস্থানে মানববন্ধনে তার ভাইকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
বাড্ডার একেএম রহমতুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের গলির একটি বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন আল আমিন। আল আমিনের বোন শারমিন খাতুন জানান, তার ভাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। ২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর র্যাব পরিচয় দিয়ে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে তার ভাই নিখোঁজ রয়েছেন। তিনি আরো জানান, সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গেলে তারা আল আমিনকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে বার বার ধরনা দেয়ার পরও তারা কোনো সন্ধান দিতে পারেনি। শারমীন খাতুন বলেন, আমার ভাই কোনো রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় ছিল না। রাজধানীর তেজগাঁও ও বসুন্ধরা এলাকাসহ বিভিন্নস্থানে যে একসঙ্গে ৮ জন গুম হয়েছিল তার মধ্যে আমার ভাইও ছিল।
২০১৪ সালের ২৮শে নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজনৈতিক সহকর্মীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে নিখোঁজ হন ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের ৫ কর্মী। এরমধ্যে সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সম্রাট মোল্লা, ৭৯ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি খালেদ হাসান সোহেল, ৭৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি আনিসুর রহমান খান, একই ওয়ার্ডের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক বিপ্লব ও ৮০ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক দল সম্পাদক মিঠু। ১১ দিন পর মুন্সীগঞ্জে নিয়ে আনিসুর রহমান, বিপ্লব ও মিঠুকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু এখনো খোঁজ মেলেনি সম্রাট ও খালেদের। ২০১৩ সালের ২রা ডিসেম্বর রাজধানীর শিশুপার্ক এলাকা থেকে মাহফুজুর রহমান, সোহেল সরকার, বংশাল থানা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি হাবিবুল বাশার জহির, ৭১নং ওয়ার্ডের সভাপতি পারভেজ হোসাইন ও ছাত্রদল কর্মী হোসাইন চঞ্চলকে সাদা পোশাকে কে বা কারা তুলে নিয়ে যায়। তারা এখনো নিখোঁজ। একই বছর ৪ঠা ডিসেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরা থেকে ছয়জন নিখোঁজ হন। তারা হলেন- ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন, সুমনের খালাতো ভাই জাহিদুল করিম তানভীর, মাজহারুল ইসলাম রাসেল, মো. আল আমিন ও আসাদুজ্জামান রানা, আবদুল কাদের ভুঁইয়া মাসুম। এদের মধ্যে তিনজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, ছাত্রদলের সাবেক নেতা আনিসুর রহমান তালুকদার খোকনসহ কয়েকজনকে খুঁজে পাওয়া গেছে। আবার কয়েকজনের লাশও পাওয়া গেছে। তবে দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা এম ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরুসহ অনেককে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিএনপি ও নিখোঁজ পরিবারের সদস্যরা বরাবরই অভিযোগ করে আসছে, এসব গুমের পেছনে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত। নরসিংদী কলেজ ছাত্রদলের নির্বাচিত জিএস সিদ্দিকুর রহমান নাহিদ গত রমজানের শুরুতে নিখোঁজ হন। এখনো তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
২০১৫ সালের ১০ই মার্চ রাতে উত্তরার একটি বাসা থেকে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে বলে পরিবারের দাবি। পরে তাকে ভারতের শিলংয়ে খুঁজে পাওয়া যায়। ২০১৩ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি বিএনপি সমর্থক আইনজীবী সোহেল রানাকে উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টর থেকে ছাই রঙের মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। স্ত্রী আফরোজা সুলতানা জানান, তার স্বামী বিএনপি সমর্থক হলেও সক্রিয় নেতা নন। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুমের অর্ধযুগ পেরিয়ে গেছে। ইলিয়াস আলী ২০১২ সালের ১৭ই এপ্রিল রাতে বনানীর বাসার কাছ থেকে ড্রাইভার আনসার আলীসহ নিখোঁজ হন। তাদের এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২০১০ সালের ২৫শে জুন রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে নিখোঁজ হন বিএনপি নেতা কমিশনার চৌধুরী আলম। তাকেও ফিরে পায়নি পরিবার। ওই বছরের ১৭ই এপ্রিল রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড থেকে অপহৃত হন ঝালকাঠির রাজাপুর থানা যুবদল নেতা মিজানুর রহমান জমাদ্দার এবং তার দুই সহযোগী মুরাদ ও ফোরকান। কয়েক মাস পর ফোরকান বেরিয়ে এসে তাদের নিখোঁজ হওয়ার কাহিনী মিডিয়ার সামনে তুলে ধরেন। এর কয়েকদিন পর আবারও নিখোঁজ হন ফোরকান।
ইলিয়াস আলীর স্ত্রী রুশদীর লুনা বলেন, ইলিয়াসকে ছাড়া ঈদের দিনের কষ্টের কথাতো আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না। এটা কাউকে বোঝানো যায় না। পরিবারের একজন অভিভাবকের অনুপস্থিতিতে যেভাবে আমাদের থাকার কথা আমরা তেমনই আছি। গত ৬ বছর ধরে আমাদের ঈদের কোনো প্রস্তুতি নেই। আমরা ঈদের সময় গ্রামের বাড়ি সিলেটে যাই। ওখানে আমার শাশুড়ি থাকেন। আমরা নিজেরা শপিং বলতে কিছুই করি না। যারা আমাদের হেল্পিং হ্যান্ড অর্থাৎ কর্মচারী বা সাহায্যকারী ও কিছু গরিব মানুষের জন্য ঈদের কেনাকাটা করি। ঈদের সময় দলের নেতাকর্মীরা বাসায় আসে দেখা করতে এই পর্যন্তই। এর বাইরে কোনো উদযাপন নেই আমাদের। আমাদের মতো স্বজনহারাদের কষ্টের কথা আসলে বোঝাতে পারবো না।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনের দুই তিন মাস আগে দলের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বেশি সক্রিয় হন ছাত্রদল নেতা চঞ্চল হোসেন। ২০১৩ সালের ২রা ডিসেম্বর শাহবাগ থেকে দুপুর আড়াইটায় নিখোঁজ হন চঞ্চল হোসেন। আজ পর্যন্ত তার সন্ধান পায়নি তার পরিবার। চঞ্চলের স্ত্রী রেশমা আক্তার বলেন, ঈদ বলে আমাদের কাছে এখন কিছু নেই। কয়েক বছর ধরেই আমরা ঈদ উদযাপন করি না। চঞ্চলকে হারিয়ে ওর বাবা-মা, ভাই-বোন কারোর মনেই কোন শান্তি নেই। আমার ছেলে আহাদ প্রতি ঈদে বাবার অপেক্ষায় থাকে। আমাদের কোনো ঈদ নেই।
বংশাল এলাকার পারভেজ হোসেনসহ মোট ৪ জনকে ২০১৩ সালের ২রা ডিসেম্বর শাহবাগ থেকে অপহরণ করা হয়। ওই দিন দুপুর ২টায় স্ত্রী ফারজানা আক্তারের সঙ্গে পারভেজের সর্বশেষ কথা হয়। কান্নাভেজা কণ্ঠে ফারজানা বলেন, আমাদের তো আর ঈদ নাই। ও যে দিন গেছে সেদিন থেকে আমাদের ঈদও চলে গেছে। ঈদের দিন বাসায় দরজা বন্ধ করে নীরবে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। আমাদের দুই ছেলে মেয়ে আদিবা ইসলাম ঋতু ও আরাফ হোসেন। বাবার ছবি নিয়ে প্রায়ই তারা আমার কাছে জানতে চায় বাবা কবে আসবে? ছেলের কথার কোনো জবাব দিতে পারি না। এ বছর ঈদে কোনো কেনা কাটা করিনি। প্রতি বছর বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া টাকা দিতেন। ওটা দিয়ে বাচ্চাদের জন্য ঈদের কেনাকাটা করতাম। এবছর তিনি জেলে আছেন। আত্মীয়স্বজনরা বাচ্চাদের টুকিটাকি জামা কাপড় কিনে দিয়েছে। এবার ওগুলো দিয়েই ঈদ পালন করবে বাচ্চারা।
No comments