নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য কমছেই না by শাহেদ শফিক
মজুরির ক্ষেত্রে এখনও নারীর শ্রমকে সমমর্যাদা দেওয়া হয় না, ছবি- পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার থেকে তোলা |
আসমা বেগম কাজ করেন ঢাকা ওয়াসার একটি ঠিকাদারি
প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক হিসেবে। সংস্থাটির ড্রেন সংস্কার ও উন্নয়নসহ বিভিন্ন
কাজে ইট-পাথর আর মাটি কাটার কাজের শ্রমিক তিনি। সহকর্মী পুরুষদের সমান কাজ
করেন তিনি। থাকেন রাজধানীর নন্দীপাড়ার একটি বস্তিতে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে
ভিজে এবং লোকজনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি উপেক্ষা করে উন্নয়নকাজের অংশীজন
হিসেবে ভূমিকা রাখছেন আসমা বেগম। কিন্তু তিনি মজুরি পান পুরুষের অর্ধেক।
কোনও কোনও ক্ষেত্রে আসমাকে পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় বেশি শ্রম দিতে হয়। কেবল
তিনিই নন, হরহামেশাই নারীরা মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
আসমা বেগম জানান, তার সঙ্গে অন্য যেসব নারী শ্রমিক
কাজ করেন, তাদের অবস্থাও একই। প্রতিদিন সকালে পুরষ সদস্যদের অন্তত একঘণ্টা
আগে কাজে যোগ দেন তারা। দিন শেষে আধাঘণ্টা থেকে একঘণ্টা পরে কর্মস্থল ত্যাগ
করতে হয়। এর পরেও তাদের সবাইকে মজুরি বৈষম্যের শিকার হতে হয়। এমনকি অনেক
ঠিকাদার নারী বলে তাদের কাজেও নিতে চান না। কাজের ধরন ও সময় অনুসারে মুজরি
নির্ধারণ করা হলেও নারীরা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষ শ্রমিকের অর্ধেক,
কিংবা তার চেয়েও কম মজুরি পান। একজন পুরুষ শ্রমিক দৈনিক দুই বেলায় ৫০০ টাকা
মজুরি পেলেও একজন নারী শ্রমিক পান ৩০০ টাকা।
এই নারী জানান, সন্তানের ক্ষুধা মেটাতে বৈষম্য
উপেক্ষা করে কাজ করতে হয় তাকে। অসুস্থ হলে কিংবা কাজে একটু ত্রুটি ধরা
পড়লে, বেতন কাটা থেকে শুরু করে কাজ হারাতে হয়। অনেক সময় কটূক্তির শিকার
হলেও মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। কাজে যোগ দিতে একঘণ্টা দেরি হলে দেড়ঘণ্টা শ্রম
দিতে হয়। অনেক সময় বাচ্চাদের কোলে নিয়েও তাদেরকে কাজ করতে হয়। এজন্য
‘কাজের ক্ষতি হচ্ছে’ অভিযোগে তাদের থেকে অতিরিক্ত আরও এক থেকে দেড়ঘণ্টা কাজ
আদায় করে নেওয়া হয়।
নারী
নেত্রীদের অভিযোগ, দেশের শ্রমবাজারে এখনও নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর হয়নি।
বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন খাতে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। কিন্তু পুরুষ
শ্রমিকের সমান কাজ করে, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে বেশি শ্রম দিয়েও একজন নারী
শ্রমিক পুরুষ শ্রমিকের সমান মজুরি পান না। অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে কম
বা তাদের চেয়ে অর্ধেক মজুরি পাচ্ছেন।
কেবল ব্যক্তি মালিকানাধীন বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেই
নয়, সরকারি প্রতিষ্ঠানেও এমন ঘটনা দেখা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার
দুই সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সবাই মাস্টার রোলে কর্মরত।
বিভিন্ন সময় কাজের প্রয়োজনে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে এসব শ্রমিককে নিয়োগ
দেওয়া হয়। পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি নারী শ্রমিকদেরও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
এক্ষেত্রে দুটি ক্যাটাগরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। দক্ষ শ্রমিক ও অদক্ষ শ্রমিকের
ভিত্তিতে। এক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের বেশির ভাগকেই অদক্ষ শ্রমিক বলে নিয়োগ
দেওয়া হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নারী পরিচ্ছন্নতা
কর্মী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা নারীরা কাজে কোনও ফাঁকি দেই না। যথা
সময়েই কাজে হাজির হই। কিন্তু পুরুষ সদস্যদের অনেকেই ঘুম থেকে ওঠেন দেরিতে।
কেউ কেউ কাজেও আসেন না। কিন্তু এর পরেও তাদের দক্ষ বলে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
আর দক্ষ ও অদক্ষ ক্যাটাগরির মাধ্যমে মাসে দুই থেকে চার হাজার টাকা বেতন
বৈষম্য করা হয়।
পুরনো ঢাকার একটি জুতা তৈরির কারখানায় কাজ করেন লায়লা
বেগম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের কারখানায় পুরুষ সদস্যের চেয়েও
আমি কাজ বেশি করি। আমার অভিজ্ঞতাও আছে। এটা আমাদের মালিকও জানেন। আমি যে
পদে কাজ করি, সেই একই পদে একজন পুরুষ সহকর্মী রয়েছেন। তিনি আমার চেয়ে বেশি
বেতন পান। তার কাজে অনেক ত্রুটি ধরা পড়ে। আমি নারী বলেই আমার বেতন কম। এসব
মেনেই কাজ করতে হয়। কারণ, আমার পরিবারে উপার্জন করার মতো আর কেউ নেই। সংসার
আমাকেই চালাতে হয়। কাজ ছেড়ে দিয়ে কোথায় যাবো? যেখানে যাবো, সেখানেও একই
অবস্থা।
কর্মজীবী
নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জীবিকার তাগিদে কর্মক্ষেত্রে মজুরি
বৈষম্য মেনে নিয়েই পুরুষের সঙ্গে লড়তে হচ্ছে নারী শ্রমিকদের। ঘরের কাজ সেরে
বাইরের কাজে শরিক হচ্ছেন তারা। এভাবে পুরুষের পাশাপাশি সংসারে আর্থিক
সহায়তা দিতে অবদান রাখছেন তারা। এজন্য তাদের তেমন কোনও অভিযোগ নেই। তবে এই
নারীদের ভাষ্য, কারণে-অকারণে কর্মচ্যুতির শিকার হন তারা। অনেক সময়
নির্যাতনের শিকার হতেও হচ্ছে।
দেশের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা
গেছে, তৈরি পোশাক শিল্প, কৃষিকাজ, ইটভাটা, গৃহস্থলী, নির্মাণ কাজ ও বিভিন্ন
কলকারখানার কাজসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক কোনও কাজেই নারীরা পুরুষের সমান মজুরি
পান না। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এ বৈষম্য আরও বেশি।
এজন্য দেশের নারী শ্রমিক সংগঠনগুলো আন্দোলনও করে যাচ্ছে।
ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জলি
তালুকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মালিকদের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে— সস্তা
শ্রমে কাজটা আদায় করা। নারীদের কাছ থেকে সস্তা মূল্যে শ্রম আদায় করা যায়,
সেজন্যই তারা এমন বৈষম্য করে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ন্যূনতম মজুরি কাঠামো
না থাকায় নারীদের কম মজুরি দিয়ে বঞ্চিত করছেন মালিকরা। বিষয়টি
রাষ্ট্রীয়ভাবে তদারকির প্রয়োজন। তা না হলে নারী ও পুরুষ শ্রমিকের বৈষম্য
কমবে না।’
তিনি বলেন, ‘দেশের পোশাক কারখানাগুলোর শ্রমিকদের ৮০
শতাংশই নারী। বাকি ২০ শতাংশ পুরুষ। তার মানে হচ্ছে নারী শ্রমিকরাই দক্ষ।
দক্ষ না হলেতো এই শিল্পটা আজ বিশ্বের দরবারে এই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারতো না।
নারীরা দক্ষতা ও শৃঙ্খলভাবে কাজ করেন। সে হিসেবে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে।
কিন্তু এর পরেও পুরুষের চেয়ে তাদের মজুরি কম দেওয়া হয়। তাদেরকে ঠকানো যায়।
এটা আমাদের দেশে নারীদের প্রতি চরম বৈষম্য। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কারণেই
এটাই হচ্ছে। তবে এখন প্রতিবাদ হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তনও হয়েছে।’
No comments