শাহবাগ হারেনি কখনো by সাজেদুল হক ও মরিয়ম চম্পা
ইতিহাস
তৈরির কারখানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আরো একবার ইতিহাসের দরজা খুললো এখান
থেকে। নানা ‘যদি’, ‘কিন্তু’ এখনো আছে। ওরা যা চেয়েছিল হয়তো ঠিক তাই
পায়নি। তবে নয়া মডেলের এক আন্দোলনে অভাবনীয় বিজয়ই দেখেছে তারুণ্য। সময় কত
কিছুই না বদলে দেয়। এই একই শাহবাগ। একই তারুণ্যের বিস্ফোরণ। কিন্তু দৃশ্যপট
কতই না আলাদা। ওই শাহবাগ ছিল রীতিমতো সেলিব্রেটি শো। রাজনীতিবিদদের মধ্যে
প্রতিযোগিতা। মিডিয়ার আকুণ্ঠ সমর্থন। যেন এক উৎসব। সংসদ আপ্লুত হয়েছে সে
শাহবাগ নিয়ে। যদিও শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি এক থাকেনি। ২০১৩ টু ২০১৮। লম্বা
ভ্রমণ। দুই ‘অভ্যুত্থানের’ শুরুই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দিয়ে। বিজয় দেখেছে
দুই শাহবাগই। তবে এবারের আন্দোলন নানা দিক থেকেই একেবারে আলাদা। নতুন
ধাঁচের এক আন্দোলনের সাক্ষী হলো বাংলাদেশ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দিয়ে শুরু হলেও আগের শাহবাগ পরে আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমনির্ভর আন্দোলন ছিল না। সব টিভি দিনের পর দিন ওই আন্দোলন লাইভ সম্প্রচার করেছে। মোটা দাগে সব পত্রিকাও ছিল আন্দোলনের সমর্থক। এবার টিভি চ্যানেলে তেমন কোনো লাইভ সম্প্রচার দেখা যায়নি। এর প্রতিবাদে আন্দোলনকারীদের অনেকে ক্ষুব্ধ হন মিডিয়ার প্রতি। সাংবাদিকরা আক্রমণেরও শিকার হয়েছেন। সংবাদ বয়কটের ঘটনা ঘটেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুরো আন্দোলনটিই ছিল ফেসবুকনির্ভর। আন্দোলকারীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করেছেন ফেসবুকে। ফেসবুকে লাইভ সম্প্রচার হয়েছে। পুরো আন্দোলনের তাৎক্ষণিক আপডেটও তারা পেয়েছেন ফেসবুকের মাধ্যমে। এটা করতে গিয়ে অবশ্য কিছু গুজবও ছড়িয়েছে। যার ফল ভালো হয়নি। তবে মূলধারার গণমাধ্যমকে ছাপিয়ে সামাজিক মাধ্যম যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, এ আন্দোলনে তা আরো একবার পরিষ্কার হয়ে গেল। কোনো কোনো পর্যবেক্ষক মনে করেন, গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলা ন্যক্কারজনক ঘটনা। আবার মিডিয়ার এমন পক্ষপাতও লজ্জাজনক। এ আন্দোলন মিডিয়াকে কাঠগড়ায় তোলার কাজটি ভালোমতোই করেছে।
সাংবাদিক ও গবেষক আফসান চৌধুরী এ প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, এই আন্দোলনে নিঃসন্দেহে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কারণ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মালিক সকলেই। এটা নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি সকলের হাতে থাকে। এর যেমন সুবিধা আছে, তেমনি অসুবিধাও রয়েছে। কারণ ফেসবুকের মাধ্যমে যেমন সত্য খবর ভাইরাল হয়, তেমনি মিথ্যা খবরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের প্রথম দিকে আহত এক ছাত্রের মৃত্যুর মিথ্যা গুজব ছড়ানোর মধ্যদিয়ে আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হলেও তা ছিল সাময়িক। মোটা দাগে বলতে গেলে কোটা সংস্কারের এই আন্দোলনে গণমাধ্যমের তুলনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সবচেয়ে বেশি কার্যকর ও সক্রিয় ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, অন্যান্য আন্দোলনে মূল ধারার গণমাধ্যমগুলো এগিয়ে থাকলেও এই আন্দোলনে সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষত ফেসবুক কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। আমরা লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবো যে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো আন্দোলনটাই ছিল ফেসবুকনির্ভর। যেখানে মূল ধারার গণমাধ্যম পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। সংবাদকর্মীদের ওপর আন্দোলনকারীদের হামলার ঘটনা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। তবে এটাও মানতে হবে যে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর রাগ করে নিউজ কাভারেজ থেকে বিরত থেকে গণমাধ্যমকর্মীরাও তাদের অপেশাদার সুলভ আচরণের পরিচয় দিয়েছেন। একজন সংবাদকর্মীকে নানান প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে হয়। সব বাধাকে উপেক্ষা করে সংবাদ সংগ্রহ করাই তাদের প্রধান কাজ। তার মানে এই নয় যে, কতিপয় মূলধারার গণমাধ্যম নিউজ কাভারেজ না দেয়ায় ছাত্রদের আন্দোলন থেমে থেকেছে। আন্দোলন বরং সফল ও ভালোভাবেই এগিয়ে গেছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পুরো আন্দোলনই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। আপাত পরস্পর বিচ্ছিন্ন তরুণরা একই উদ্দেশ্যে নিয়ে জড়ো হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন থেকেই আন্দোলন চলছে। নানা কর্মসূচি। তবে গত রোববার দুপুর থেকেই বিক্ষোভ নতুন দিকে মোড় নিতে থাকে। যখন শাহবাগে অবস্থান নেয়ার পর আন্দোলনকারীরা দাবি জানাতে থাকেন, কোটা সংস্কারের ব্যাপারে সংসদ থেকে ঘোষণা না আসা পর্যন্ত তারা জায়গা ছাড়বেন না। পুলিশ বাধা দিতে এলে তারা ফুল নিয়ে এগিয়ে যায়। ফুল অবশ্য ফিরিয়ে দেয় পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাত ৮টার দিকেই অ্যাকশনে যায়। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের শাহবাগ থেকে হটিয়ে দিতেও সক্ষম হয় তারা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শক্ত অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। সারা রাত ধরেই চলে খণ্ড খণ্ড লড়াই। একপর্যায়ে এক ছাত্রের মৃত্যুর গুজবও ছড়িয়ে পড়ে। আক্রমণের শিকার হয় ভিসির বাসভবন। বর্বরোচিত হামলা হয় সেখানে। আন্দোলনকারীরা অবশ্য এর দায় অস্বীকার করেন। তারা মনে করেন, বহিরাগতরা এ হামলা চালিয়েছে।
রাতভর তৎপর ছিল ছাত্রলীগ। দফায় দফায় তারা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। তবে রাতে একপর্যায়ে বিভিন্ন হল থেকে কয়েকশ’ ছাত্রী বের হয়ে এলে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। সোমবার দিনভর আন্দোলন চলে সারা দেশে। বিকালে ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন একটি গ্রুপের সঙ্গে বৈঠকে বসেন আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধিদলের নেতা আন্দোলন স্থগিতের কথা জানান। কিন্তু বেঁকে বসেন রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থানরত আন্দোলনকারীরা। পরিষ্কার ঘোষণা দাবি করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা। কিছু সময়ের জন্য তাদের মুখপাত্রের ভূমিকা নেন বিপাশা। মঙ্গলবারের সকালের আন্দোলনে ছিল বিভক্তি। যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও এদিন যোগ দেন আন্দোলনে। মতিয়া চৌধুরী ও আবুল মাল আবদুল মুহিতের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বিকাল নাগাদ স্থগিত ঘোষণা করা অংশও আন্দোলনে যোগ দেয়। রাতে সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রলীগ নেত্রীর হাতে এক শিক্ষার্থীর রক্তাক্ত হওয়ার ঘটনা পুরো আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢালে। বুধবারের পরিস্থিতি ছিল একেবারে আলাদা। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কোনো আন্দোলনে এত শিক্ষার্থী আর কোনো দিন যোগ দেননি। দিনের শেষভাগে আসে কোটা বাতিলের ঘোষণা।
ভিসির বাসায় হামলার ন্যক্কারজনক অধ্যায় বাদ দিলে পুরো আন্দোলন ছিল অহিংস চরিত্রের। কোথাও জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনা ঘটেনি। তবে পুলিশের আক্রমণের জবাব প্রথম রাতে তারা খুব শক্তভাবেই দিয়েছিল। আন্দোলনে কমিটি থাকলেও সে অর্থে কোনো নেতা ছিলেন না। আন্দোলনে যোগ দেয়া লাখ লাখ শিক্ষার্থী জানতেন না তাদের নেতা কে? অনেক পর্যবেক্ষক অবশ্য মনে করেন, এ আন্দোলন শুধু কোটা সংস্কারের নয়। চাকরি বঞ্চিত লাখ লাখ মধ্যবিত্ত তরুণ এর মাধ্যমে নিজেদের ক্ষোভেরই প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল বিপুল। বাংলাদেশে অতীতে কোন আন্দোলনে এতো নারী শিক্ষার্থী অংশ নেয়ার নজির নেই। চারুকলার শিক্ষার্থী জ্যোতি বলেন, এটা কোনো নারী-পুরুষের একক আন্দোলন নয়। এটা আমাদের সব ছাত্র সমাজের আন্দোলন। নারীদের জন্য আলাদা কোটার ব্যবস্থা করে যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে সেটাকে ভাঙতেই আমরা মূলত এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছি। আমরা মেয়েরা কোটার বাইরেও চাকরি পাওয়ার পর পুরুষদের কাছ থেকে বৈষম্যমূলক কথা শুনতে হয়। বলা হয়ে থাকে, আরে আপনাদের জন্য তো আলাদা নারী কোটার ব্যবস্থা আছে। যুগ এগিয়েছে, সময় এগিয়েছে। তাই আমরা কোনো কোটার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে কর্মক্ষেত্রে সমান তালে এগিয়ে যেতে চাই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্দোলনের শুরু থেকেই সরকারের ভেতরে টেনশন কাজ করেছে। বিশেষ করে এতে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের কোনো ষড়যন্ত্র কাজ করছে কি-না তা নিয়ে সরকারের নানা মহলে সংশয় ছিল। এ আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরের জন্য কেউ কাজ করছে কি-না তা নিয়েও অনুসন্ধান চলে। এ কারণেই শক্তি প্রয়োগ ছাড়াও আলাপ-আলোচনার পথও খোলা রাখা হয়। দলীয় সাধারণ সম্পাদককেই বিষয়টি ফয়সালার দায়িত্ব দেয়া হয়। তার পরও সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে কোটা পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা দেয়া হয়। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আন্দোলন স্থগিত হওয়া সরকারের জন্য স্বস্তিদায়ক। তবে সরকার বিষয়টি যে ভাষায় মীমাংসা করেছে তা আন্দোলনকারী তরুণদের মধ্যে কোনো স্বস্তি দিতে পারেনি। দুপক্ষেই এ অস্বস্তি হয়তো দীর্ঘদিন থেকে যাবে।
অনেককেই এ তরুণরা ভুল প্রমাণ করেছে। বিশেষ করে আমরা যারা মনে করতাম, ‘এখনকার তরুণরা শুধু ফেসবুক আর স্মার্টফোনেই ব্যস্ত থাকে। তাদের প্রতিবাদের কোনো শক্তি নেই। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে তারা কোনো আন্দোলন করতে পারে না’ ইত্যাদি। বহু পুরনো কথা- ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো লোকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না। কোনো রাষ্ট্রের তরুণ প্রজন্ম যদি লক্ষ্যে অবিচল থেকে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করে তা কখনো ব্যর্থ হয় না। আপাত দৃষ্টিতে দ্বিতীয় শাহবাগ অভ্যুত্থানের এটাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দিয়ে শুরু হলেও আগের শাহবাগ পরে আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমনির্ভর আন্দোলন ছিল না। সব টিভি দিনের পর দিন ওই আন্দোলন লাইভ সম্প্রচার করেছে। মোটা দাগে সব পত্রিকাও ছিল আন্দোলনের সমর্থক। এবার টিভি চ্যানেলে তেমন কোনো লাইভ সম্প্রচার দেখা যায়নি। এর প্রতিবাদে আন্দোলনকারীদের অনেকে ক্ষুব্ধ হন মিডিয়ার প্রতি। সাংবাদিকরা আক্রমণেরও শিকার হয়েছেন। সংবাদ বয়কটের ঘটনা ঘটেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুরো আন্দোলনটিই ছিল ফেসবুকনির্ভর। আন্দোলকারীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করেছেন ফেসবুকে। ফেসবুকে লাইভ সম্প্রচার হয়েছে। পুরো আন্দোলনের তাৎক্ষণিক আপডেটও তারা পেয়েছেন ফেসবুকের মাধ্যমে। এটা করতে গিয়ে অবশ্য কিছু গুজবও ছড়িয়েছে। যার ফল ভালো হয়নি। তবে মূলধারার গণমাধ্যমকে ছাপিয়ে সামাজিক মাধ্যম যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, এ আন্দোলনে তা আরো একবার পরিষ্কার হয়ে গেল। কোনো কোনো পর্যবেক্ষক মনে করেন, গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলা ন্যক্কারজনক ঘটনা। আবার মিডিয়ার এমন পক্ষপাতও লজ্জাজনক। এ আন্দোলন মিডিয়াকে কাঠগড়ায় তোলার কাজটি ভালোমতোই করেছে।
সাংবাদিক ও গবেষক আফসান চৌধুরী এ প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, এই আন্দোলনে নিঃসন্দেহে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কারণ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মালিক সকলেই। এটা নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি সকলের হাতে থাকে। এর যেমন সুবিধা আছে, তেমনি অসুবিধাও রয়েছে। কারণ ফেসবুকের মাধ্যমে যেমন সত্য খবর ভাইরাল হয়, তেমনি মিথ্যা খবরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের প্রথম দিকে আহত এক ছাত্রের মৃত্যুর মিথ্যা গুজব ছড়ানোর মধ্যদিয়ে আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হলেও তা ছিল সাময়িক। মোটা দাগে বলতে গেলে কোটা সংস্কারের এই আন্দোলনে গণমাধ্যমের তুলনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সবচেয়ে বেশি কার্যকর ও সক্রিয় ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, অন্যান্য আন্দোলনে মূল ধারার গণমাধ্যমগুলো এগিয়ে থাকলেও এই আন্দোলনে সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষত ফেসবুক কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। আমরা লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবো যে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো আন্দোলনটাই ছিল ফেসবুকনির্ভর। যেখানে মূল ধারার গণমাধ্যম পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। সংবাদকর্মীদের ওপর আন্দোলনকারীদের হামলার ঘটনা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। তবে এটাও মানতে হবে যে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর রাগ করে নিউজ কাভারেজ থেকে বিরত থেকে গণমাধ্যমকর্মীরাও তাদের অপেশাদার সুলভ আচরণের পরিচয় দিয়েছেন। একজন সংবাদকর্মীকে নানান প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে হয়। সব বাধাকে উপেক্ষা করে সংবাদ সংগ্রহ করাই তাদের প্রধান কাজ। তার মানে এই নয় যে, কতিপয় মূলধারার গণমাধ্যম নিউজ কাভারেজ না দেয়ায় ছাত্রদের আন্দোলন থেমে থেকেছে। আন্দোলন বরং সফল ও ভালোভাবেই এগিয়ে গেছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পুরো আন্দোলনই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। আপাত পরস্পর বিচ্ছিন্ন তরুণরা একই উদ্দেশ্যে নিয়ে জড়ো হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন থেকেই আন্দোলন চলছে। নানা কর্মসূচি। তবে গত রোববার দুপুর থেকেই বিক্ষোভ নতুন দিকে মোড় নিতে থাকে। যখন শাহবাগে অবস্থান নেয়ার পর আন্দোলনকারীরা দাবি জানাতে থাকেন, কোটা সংস্কারের ব্যাপারে সংসদ থেকে ঘোষণা না আসা পর্যন্ত তারা জায়গা ছাড়বেন না। পুলিশ বাধা দিতে এলে তারা ফুল নিয়ে এগিয়ে যায়। ফুল অবশ্য ফিরিয়ে দেয় পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাত ৮টার দিকেই অ্যাকশনে যায়। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের শাহবাগ থেকে হটিয়ে দিতেও সক্ষম হয় তারা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শক্ত অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। সারা রাত ধরেই চলে খণ্ড খণ্ড লড়াই। একপর্যায়ে এক ছাত্রের মৃত্যুর গুজবও ছড়িয়ে পড়ে। আক্রমণের শিকার হয় ভিসির বাসভবন। বর্বরোচিত হামলা হয় সেখানে। আন্দোলনকারীরা অবশ্য এর দায় অস্বীকার করেন। তারা মনে করেন, বহিরাগতরা এ হামলা চালিয়েছে।
রাতভর তৎপর ছিল ছাত্রলীগ। দফায় দফায় তারা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। তবে রাতে একপর্যায়ে বিভিন্ন হল থেকে কয়েকশ’ ছাত্রী বের হয়ে এলে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। সোমবার দিনভর আন্দোলন চলে সারা দেশে। বিকালে ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন একটি গ্রুপের সঙ্গে বৈঠকে বসেন আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধিদলের নেতা আন্দোলন স্থগিতের কথা জানান। কিন্তু বেঁকে বসেন রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থানরত আন্দোলনকারীরা। পরিষ্কার ঘোষণা দাবি করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা। কিছু সময়ের জন্য তাদের মুখপাত্রের ভূমিকা নেন বিপাশা। মঙ্গলবারের সকালের আন্দোলনে ছিল বিভক্তি। যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও এদিন যোগ দেন আন্দোলনে। মতিয়া চৌধুরী ও আবুল মাল আবদুল মুহিতের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বিকাল নাগাদ স্থগিত ঘোষণা করা অংশও আন্দোলনে যোগ দেয়। রাতে সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রলীগ নেত্রীর হাতে এক শিক্ষার্থীর রক্তাক্ত হওয়ার ঘটনা পুরো আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢালে। বুধবারের পরিস্থিতি ছিল একেবারে আলাদা। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কোনো আন্দোলনে এত শিক্ষার্থী আর কোনো দিন যোগ দেননি। দিনের শেষভাগে আসে কোটা বাতিলের ঘোষণা।
ভিসির বাসায় হামলার ন্যক্কারজনক অধ্যায় বাদ দিলে পুরো আন্দোলন ছিল অহিংস চরিত্রের। কোথাও জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনা ঘটেনি। তবে পুলিশের আক্রমণের জবাব প্রথম রাতে তারা খুব শক্তভাবেই দিয়েছিল। আন্দোলনে কমিটি থাকলেও সে অর্থে কোনো নেতা ছিলেন না। আন্দোলনে যোগ দেয়া লাখ লাখ শিক্ষার্থী জানতেন না তাদের নেতা কে? অনেক পর্যবেক্ষক অবশ্য মনে করেন, এ আন্দোলন শুধু কোটা সংস্কারের নয়। চাকরি বঞ্চিত লাখ লাখ মধ্যবিত্ত তরুণ এর মাধ্যমে নিজেদের ক্ষোভেরই প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল বিপুল। বাংলাদেশে অতীতে কোন আন্দোলনে এতো নারী শিক্ষার্থী অংশ নেয়ার নজির নেই। চারুকলার শিক্ষার্থী জ্যোতি বলেন, এটা কোনো নারী-পুরুষের একক আন্দোলন নয়। এটা আমাদের সব ছাত্র সমাজের আন্দোলন। নারীদের জন্য আলাদা কোটার ব্যবস্থা করে যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে সেটাকে ভাঙতেই আমরা মূলত এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছি। আমরা মেয়েরা কোটার বাইরেও চাকরি পাওয়ার পর পুরুষদের কাছ থেকে বৈষম্যমূলক কথা শুনতে হয়। বলা হয়ে থাকে, আরে আপনাদের জন্য তো আলাদা নারী কোটার ব্যবস্থা আছে। যুগ এগিয়েছে, সময় এগিয়েছে। তাই আমরা কোনো কোটার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে কর্মক্ষেত্রে সমান তালে এগিয়ে যেতে চাই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্দোলনের শুরু থেকেই সরকারের ভেতরে টেনশন কাজ করেছে। বিশেষ করে এতে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের কোনো ষড়যন্ত্র কাজ করছে কি-না তা নিয়ে সরকারের নানা মহলে সংশয় ছিল। এ আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরের জন্য কেউ কাজ করছে কি-না তা নিয়েও অনুসন্ধান চলে। এ কারণেই শক্তি প্রয়োগ ছাড়াও আলাপ-আলোচনার পথও খোলা রাখা হয়। দলীয় সাধারণ সম্পাদককেই বিষয়টি ফয়সালার দায়িত্ব দেয়া হয়। তার পরও সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে কোটা পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা দেয়া হয়। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আন্দোলন স্থগিত হওয়া সরকারের জন্য স্বস্তিদায়ক। তবে সরকার বিষয়টি যে ভাষায় মীমাংসা করেছে তা আন্দোলনকারী তরুণদের মধ্যে কোনো স্বস্তি দিতে পারেনি। দুপক্ষেই এ অস্বস্তি হয়তো দীর্ঘদিন থেকে যাবে।
অনেককেই এ তরুণরা ভুল প্রমাণ করেছে। বিশেষ করে আমরা যারা মনে করতাম, ‘এখনকার তরুণরা শুধু ফেসবুক আর স্মার্টফোনেই ব্যস্ত থাকে। তাদের প্রতিবাদের কোনো শক্তি নেই। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে তারা কোনো আন্দোলন করতে পারে না’ ইত্যাদি। বহু পুরনো কথা- ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো লোকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না। কোনো রাষ্ট্রের তরুণ প্রজন্ম যদি লক্ষ্যে অবিচল থেকে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করে তা কখনো ব্যর্থ হয় না। আপাত দৃষ্টিতে দ্বিতীয় শাহবাগ অভ্যুত্থানের এটাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
No comments