ফুরসৎ নেই লোকজ শিল্প কারিগরদের by সাদেকুল ইসলাম
পুরনো জীর্ণতা আর গ্লানি ধুয়ে-মুছে বৈশাখ
বাঙালির জীবনে নিয়ে আসছে নতুন দিনের নতুন বছরের এক অনন্য আনন্দ উৎসব। আর
এই বৈশাখকে বরণ করার জন্য চলছে নানান প্রস্তুতি। এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।
রাত পোহালেই পহেলা বৈশাখ। তাই পহেলা বৈশাখ এবং মাসজুড়ে বৈশাখী বিভিন্ন
মেলাকে সামনে রেখে মাটি দিয়ে তৈরি বর-কনে, পশু-পাখি, ব্যাংকসহ বিভিন্ন
খেলনা, নানান রঙের ও প্রকারের বাহারি কাগজ, কাপড় ও শোলা দিয়ে গোলাপ, স্টার,
সূর্যমুখী, কিরনমালা, মানিক চাঁদ, জবা, বিস্কুট, গাঁদাসহ বিভিন্ন নামের
কৃত্রিম ফুল ও বাঁশি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন নওগাঁর কারিগররা।
নাওয়া-খাওয়া ভুলে পরিবার-পরিজন নিয়ে ব্যস্ত সুলতানপুর, দেবীপুর, শৌলগাছি ও
আত্রাই উপজেলার জামগ্রামের কারিগররা। সারা বছরই তারা এসব তৈরির সঙ্গে জড়িত।
আর এটিকে তারা পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তবে কাঁচামাল, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি
সেই সঙ্গে আধুনিক প্লাস্টিক খেলনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকতে না পারায়
মাটির খেলনা তৈরি ও বিক্রি অলাভজনক হয়ে পড়ায় বিশেষ দিবস ঈদ, পূজা, পার্বণ ও
মেলা ছাড়া আর কুমারপাড়ায় খেলনা তৈরি করছেন না জেলার কারিগররা।
জেলার নওগাঁর সদর উপজেলার সুলতানপুর, রাণীনগর উপজেলার আতাইকুলা, মহাদেবপুর উপজেলার শিবপুর সুলতানপুর গ্রামের কুমারপাড়াগুলো মাটির খেলনা তৈরির জন্য বিখ্যাত। কিন্তু এসব গ্রামে ও এখন আর বিশেষ দিবস ও মেলা ছাড়া খেলনা তৈরি করেন না কারিগররা। তবে হাঁড়ি পাতিল ও রান্নার বাসনপত্র তৈরি করে কোনরকমে টিকিয়ে রেখেছেন তারা বাপ-দাদার এই পেশাকে।
কারিগর সমনাথ মহন্ত ও অরুণ কুমার পাল বলছেন, মাটির খেলনা তৈরির উপকরণ (কাঁচামাল) জ্বালানি কাঠ, মাটি, রং ইত্যাদির দাম ও পরিবহন খরচ ২/৩ গুণ বাড়লেও খেলনার দাম সেভাবে বাড়েনি আর কেনা-বেচাও খুবই কম। বিভিন্ন ধরনের ১ হাজার খেলনা মেলায় বিক্রি করে সব খরচ বাদে টেকে মাত্র ১ থেকে দেড় হাজার টাকা, যা দিয়ে সংসার চালানোই কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাই অধিকাংশ কারিগর এখন জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে চলে যাচ্ছেন ভিন্ন পেশায়। মৃৎ শিল্প তথা ঐতিহ্যবাহী মাটির খেলনা শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে এ সব লোকজ শিল্পের কারিগরদের আর্থিকভাবে সহায়তা করা প্রয়োজন বলে জানান মৃৎ শিল্পের কারিগররা। নওগাঁর সদর উপজেলার দেবীপুর গ্রাম বাঁশি গ্রাম হিসেবে পরিচিত। বৈশাখের মেলাকে সামনে রেখে বাঁশি তৈরিতে নল কাটা, সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য জরি প্যাঁচানো ও বিভিন্ন রঙের বেলুন লাগানোর কাজে ব্যস্ত কারিগররা। এ গ্রামের প্রায় তিনশ’ পরিবারের মধ্যে আড়াইশ’ পরিবারই বাঁশি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। সারা বছরই বাঁশি তৈরি করা হয়। বাড়ির পুরুষরা বাঁশি নিয়ে বিভিন্ন জেলার মেলাতে ৭-১৫ দিনের জন্য বেরিয়ে যান। বিক্রি শেষে যা লাভ থাকে তাই চলে তাদের সংসার। আর মেয়েরা সাংসারিক কাজের পাশাপাশি বাঁশি তৈরি করেন। এতে পুরুষরাও সহযোগিতা করে থাকেন। এছাড়া পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবারকে সহযোগতিা করে থাকে।
আজিম উদ্দিন ও হেলাল হোসেন জানান, বৈশাখীর বিভিন্ন মেলা, ঈদ ও পূজা-পার্বণে বাঁশির চাহিদা থাকে বেশি। স্থানীয়দের কাছ পাইকারি ও খুরচা বাঁশি বিক্রি করে দেড় থেকে দুইশ’ টাকা লাভ হয়। এছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, সিলেট, ময়মনসিংহ, বগুড়া, পাবনা, দিনাজপুর, খুলনা ও চাঁপাই নবাবগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় পাইকারি বিক্রি করা হয়। এই গ্রাম থেকে বছরের প্রায় ৫০ লাখের মতো বাঁশি দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়ে থাকে। এমনকি বিদেশেও পাঠানো হয়। সঠিক পৃষ্ঠপোশকতা পেলে এসব কারিগর এ শিল্পের আরো উন্নয়ন ঘটাতে পারবেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার ভোঁপাড়া ইউনিয়নের একেবারেই অবহেলিত একটি গ্রাম জামগ্রাম। নেই কোনো ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা। বাংলাদেশের মধ্যে এটিই একমাত্র গ্রাম যেখানে কাগজ, কাপড় ও শোলার রঙ্গিন বাহারি বিভিন্ন রকমের কৃত্রিম ফুল তৈরি করা হয়। এখানকার তৈরি ফুলই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন উৎসব, ঈদ ও মেলাতে পুরুষরা নিয়ে গিয়ে ফেরি করে বিক্রয় করেন। লাভও হয় দ্বিগুণ। কিন্তু যোগ্য পৃৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এখনো এই হস্তশিল্প আধুনকিতার দোড়গোড়ায় পৌঁছেনি। গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়বে গাছের ছায়াঢাকা বিভিন্ন স্থানে কয়েকজন মিলে বসে তৈরি করছেন এই ফুলগুলো। বাংলাদেশের মধ্যে নানান রঙের মন মাতানো এসব বাহারি রঙিন ফুল তৈরিতে এই জামগ্রামই একমাত্র গ্রাম। শুধু এই গ্রামেই তৈরি করা হয় এসব ফুল। তৈরির পর পরিবারের পুরুষরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ফেরি করে বিক্রয় করেন। তবে দুই ঈদে, বিভিন্ন পূজা, মেলা ও পহেলা বৈশাখে এই সব ফুলের চাহিদা অনেক বেশি। প্রায় ৫০-৬০ বছর পূর্বে গ্রামে এই ফুল তৈরি করা শুরু হয় কিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের হাত ধরে। এখন তা পুরো গ্রামের মানুষের বেঁচে থাকা ও আয়ের একমাত্র উৎসে পরিণত হয়েছে। এই ফুলে লাভ অনেক বেশি। একটি ফুল প্রায় দ্বিগুণ মূল্যে বিক্রয় হয়। বর্তমানে এই গ্রামের প্রায় ৭শ’ পরিবার এই বাহারি ফুল তৈরি করার কাজে নিয়োজিত। সংসার দেখভাল করার পাশাপাশি এই গ্রামের মহিলা, পুরুষ ও ছোট-বড় সবাই এই ফুল তৈরি করার কাজ করে।
রফিকুল ইসলাম জানান, এক সময় এই গ্রাম খুবই অবহেলিত ছিল। রাস্তা-ঘাট কোনটিই ছিল না। কিন্তু বর্তমানে একটু হলেও উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। এই গ্রামে এখনো পর্যন্ত বিদ্যুৎ আসেনি। তাই এসব কারিগর শত ইচ্ছে থাকলেও রাতে এই ফুল তৈরির কাজ করতে পারে না। তাই আমাদের এই শিল্পটিকে আরো গতিশীল করার জন্য প্রয়োজন আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ।
মোছা. নিশাত আনজুমান জানান, আমরা আমাদের সংসারের সব কাজ সম্পন্ন করে পরিবারের পুরুষদের এই ফুল তৈরিতে সাহায্য করি। এই ফুলগুলোতে লাভ অনেক বেশি। আগে পুরুষরা বাইরে গেলে দুর্বৃত্তরা মাঝে মাঝে সবকিছু ছিনতাই করে নিতো কিন্তু এখন আর তা হয় না। এখন শুধু আমাদের এই গ্রামটিকে আধুনিক মানসম্মত গ্রামে পরিণত করা প্রয়োজন।
জনি সোনার জানান, ফুল তৈরিতে পরিবারের গৃহিণীদের অবদান সবচেয়ে বেশি। এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ বিভিন্ন বেসরকারি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে এই ব্যবসা করে আসছেন। তাই মাস শেষে লাভের বেশি ভাগই দিতে হয় এসব এনজিওকে। সরকার যদি এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিনা সুদে ঋণ দিত তাহলে এই হস্তশিল্পটি আগামীতে আরো বেশি সমপ্রসারিত হতো। তাই এই গ্রামবাসীর সরাসরি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা অত্যন্ত প্রয়োজন।
এ বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম জানান, এটি একটি ঐতিহ্যপূর্ণ শিল্প। যার কদর সারা দেশে। শৌখিন মানুষ ও শিশুদের কাছে এই বাহারি কৃত্রিম ফুলের চাহিদা অনেক বেশি। এই শিল্পকে আরো সম্প্রসারিত করার জন্য সরকারের কাজ করা উচিত। এই গ্রামের মানুষদের আর্থিকভাবে সহায়তা করতে পারলে তারা এই শিল্পটিকে আরো অনেক দূর নিয়ে যেতে পারবেন। এতে সরকার এই শিল্প থেকে অনেক অর্থ রাজস্ব আয় করতে পারবেন। এই কারিগরদের জন্য যদি হস্তশিল্পটির উপর উন্নতমানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেত তাহলে শিল্পটি আরো আধুনিক মানসম্মত হতো। আমি চেষ্টা করবো এই গ্রামের মানুষদের আরো বেশি সহযোগিতা করার জন্য।
No comments