মুক্ত গণমাধ্যমই সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবে by মাহ্ফুজ আনাম
ডেইলি
স্টার-এর ২৭ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই সন্ধ্যায় সম্মানিত পাঠক, পৃষ্ঠপোষক,
বিজ্ঞাপনদাতা ও অতিথিদের জানাই উষ্ণ শুভেচ্ছা। আন্তরিকতার সঙ্গে বলতে চাই,
একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন সম্পূর্ণ স্বাধীন ও মুক্ত
গণমাধ্যম। সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য আরও প্রয়োজন সর্বোচ্চ মানের সাংবাদিকতা।
সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো
নিবর্তনমূলক আইনের দরকার নেই। সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য দরকার গতিশীল একটি
বেসরকারি খাত। সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য দরকার সর্বোচ্চ মাত্রার একটি
সুশৃঙ্খল ব্যাংকিং খাত। সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য দরকার একটি স্বচ্ছ ও
জবাবদিহিমূলক প্রশাসন। সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য দরকার গণতন্ত্র ও নির্বাচিত
সরকার। সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য দরকার সরকার ও স্বাধীন গণমাধ্যমের গতিময় ও
পারস্পরিক শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্ক। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে উন্নয়নের উজ্জ্বল
দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমাদের বিশ্বাস, বাংলাদেশের সামনে একটি উজ্জ্বল
ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশকে সেই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে
আমরা (গণমাধ্যম) সরকার, আমলা, বেসরকারি খাত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সুশীল
সমাজসহ দেশের সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। যেমন স্মরণ রাখতে
হবে, আমাদের প্রত্যেকেরই পেশাগত ভিন্নধর্মী কাজ আছে। সেই কাজের নীতিমালা
আছে, সেই নীতিমালা অনুসারে কর্মক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থায় নিজ নিজ
ভূমিকা পালন করতে আমরা দেশের কাছে দায়বদ্ধ। সরকারকে যেমন স্বচ্ছতা ও
জবাবদিহির সঙ্গে দেশ চালাতে হয়; সংসদ সদস্যদের যেমন নির্বাচনী এলাকার জন্য
কাজ করতে হয়, ভোটারদের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হয়; পুলিশকে যেমন আইনশৃঙ্খলা
রক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়; ঠিক একইভাবে একটি মুক্ত, স্বাধীন ও
নীতিনিষ্ঠ গণমাধ্যমকেও সমাজের অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতে হয়। আমরা
প্রত্যেকে যদি আমাদের নিজ নিজ ভূমিকা পালন ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা প্রদর্শনে
ব্যর্থ হই; পুলিশ যদি আইনকানুন ঠিকমতো প্রয়োগ করতে না পারে; সংসদ সদস্যরা
যদি জনগণকে সেবা দিতে ব্যর্থ হন; সরকার যদি আইন অনুযায়ী দেশ চালাতে ব্যর্থ
হয়; ঠিক একইভাবে মুক্ত সংবাদমাধ্যম যদি পেশাদার ও নৈতিক জায়গা ধরে রেখে
দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়; তাহলে দিন শেষে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সমাজ
পিছিয়ে পড়ে। আমরা যেহেতু এই দেশটাকে ভালোবাসি, সেহেতু আসুন প্রতিটি
প্রতিষ্ঠান ও পেশাকে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব স্বাধীনভাবে পালন করতে দিই।
আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই-পৃথিবীতে বাংলাদেশসহ সব গণতান্ত্রিক দেশে
শুধু দুটি পেশাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে সংবিধানের সুনির্দিষ্ট ধারার
মাধ্যমে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনকে সংরক্ষিত করেছে। সেখানে প্রকৌশলী,
চিকিৎসক, ব্যবসায়ী কিংবা আইনজীবীর কথা বলা হয়নি।
সেখানে শুধু বিচার বিভাগ ও
গণমাধ্যমের কথা বলা হয়েছে। কেন? কেন প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধানে এ
দুটি পেশার কথা বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে? কারণ, অভিজ্ঞতা আমাদের
দেখিয়েছে; অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে; কারণ, এই সত্যটি প্রতিটি দেশ উপলব্ধি
করতে পেরেছে যে যখন আপনার বিচার বিভাগ স্বাধীন হবে, তখনই পক্ষপাতহীন বিচার
পাবেন। যখন গণমাধ্যম স্বাধীন থাকবে, তখন সরকার ও জনগণ সঠিকভাবে উপকৃত হবে।
এটা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতার ফল। একটা উদাহরণ
দিই। ধরুন, সরকার নীতি প্রণয়ন করল, গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহী পদক্ষেপ নিল এবং
বিশাল ব্যয়বহুল প্রকল্প বাস্তবায়ন করল। এরপর সরকার কেমন করে জানবে সেই
প্রকল্প ঠিকঠাক বাস্তবায়ন করা হয়েছে কি না? সরকার জনগণের সেবা করার জন্য যে
নীতিগুলো গ্রহণ করল, তা আসলেই জনগণের কাজে আসছে কি না-এই প্রশ্নের উত্তর
সরকার কোন পন্থায় জানবে? এই সরকারের নীতি এবং গোটা সরকার সম্বন্ধে জনগণের
অভিমত কী, তা সরকার জানবে কোন মাধ্যমে? আমলারা কি মাঠপর্যায়ের আসল চিত্র
সরকারকে দেবেন? কর্মকর্তারা কি প্রকৃত সত্য সরকারকে বলবেন? মাঠপর্যায়ের
বাস্তবতা জানার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আমাদের দেশসহ
বহু দেশের বহু সরকারের পতন হয়েছে। একমাত্র মুক্ত গণমাধ্যমই সরকারকে সত্য
ঘটনা জানাতে পারে। ফলে নিজের ভালোর জন্য, নিজের সাফল্যের জন্য প্রতিটি
গণতান্ত্রিক সরকারের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় মাধ্যম হচ্ছে মুক্ত ও স্বাধীন
গণমাধ্যম, যার মাধ্যমে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে। অনেক ক্ষেত্রে ভুল-বোঝাবুঝি
সত্ত্বেও এই কথাগুলোই ২৭ বছর ধরে আমরা ডেইলি স্টার-এর মাধ্যমে বলার চেষ্টা
করেছি। আপনাদের অনেকের মনে আছে, অনেকে হয়তো ভুলে গেছেন, বিগত দিনে ডাকা
প্রতিটি হরতালের বিরুদ্ধে ডেইলি স্টার অবস্থান নিয়েছে। যখনই যে বিরোধী দল
সংসদ বর্জন করেছে, ডেইলি স্টার তার প্রতিবাদ করেছে। যখনই যে সরকারই পুলিশ
বা নিরাপত্তাকর্মীদের দিয়ে বিরোধীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, ডেইলি স্টার
তার প্রতিবাদ করেছে। কেন? কারণ, আমরা বিশ্বাস করি, এগুলো গণতন্ত্রের জন্য
ক্ষতিকর; এগুলো দেশ ও জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী। আমাদের বিশ্বাস, একমাত্র
গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারলেই আমরা টেকসই সমৃদ্ধি অর্জন করতে
পারব। আমাদের মধ্যে, এমনকি বিদেশেও কারও কারও ধারণা, উন্নয়ন ও গণতন্ত্র
একসঙ্গে চলতে পারে না। আমি খুব জোর দিয়ে বলতে চাই, এই ধারণা মৌলিকভাবে
ত্রুটিপূর্ণ, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দেউলিয়া এবং ঐতিহাসিকভাবে মিথ্যা। দুনিয়ার
কোথাও এই ধারণা সঠিক প্রমাণিত হয়নি। যদিও এই থিওরি সর্বাংশে ভুল, তথাপি এ
কথাই ঘুরেফিরে আসছে। আমাদের দেশ ও অন্য বহু দেশে বলা হচ্ছে, গণতন্ত্রের
জন্য অপেক্ষা করা যেতে পারে, কিন্তু উন্নয়নকে আগে আসতে দিতেই হবে। আমাদের
কানে বারবার বলা হচ্ছে, ‘খিদে পেটে স্বাধীনতার কোনো মানে নেই।’ যাঁদের বয়স
বেশি, তাঁরা হয়তো মনে করতে পারবেন, জেনারেল আইয়ুব খানের আমলে আমরা এই
কথাগুলো শুনেছি। এই থিওরি কখনো কাজে আসেনি।
কারণ, গণতন্ত্র ও উন্নয়ন একে
অন্যের সম্পূরক এবং হাত ধরাধরি করে চলে। এ ক্ষেত্রে কোনো ‘প্রথম’ বা
‘দ্বিতীয়’ নেই। যখন তারা হাত ধরাধরি করে এগোয়, একমাত্র তখনই উন্নয়ন জনগণের
অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ করতে পারে। আমরা দেখেছি শুধু ধনী, অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত
এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জন্যও উন্নয়ন ঘটতে পারে। কিন্তু উন্নয়নের লক্ষ্য
যদি জনগণ হয়, তাহলে উন্নয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের ভাবনা কী, সে বিষয়ে
অবশ্যই তাদের মধ্য থেকে বক্তব্য আসতে হবে। সেটা নিশ্চিত করতে পারে একমাত্র
গণতন্ত্র। আর একমাত্র গণতন্ত্রই নিশ্চিত করতে পারে মুক্ত গণমাধ্যম, যা
জনগণের ‘কণ্ঠ’ হয়ে ভূমিকা পালন করে। আজ আমাদের বয়স ২৭ বছর। প্রতিষ্ঠাতা
সম্পাদক এস এম আলীর বর্ণাঢ্য নেতৃত্বের পাশাপাশি আমাদের প্রতিষ্ঠাতা
চেয়ারম্যান আজিমুর রহমান, প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস মাহমুদ এবং
প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা সম্পাদক তৌফিক আজিজ খানের ব্যতিক্রমী ও
প্রতিশ্রুতিশীল তত্ত্বাবধানে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম। আমি তাঁদের
স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। আমি তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পেরেছি,
এটি আমার জন্য গৌরবের ব্যাপার। এটি আমার জন্য বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার যে
আমি অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিশীল, নীতিনিষ্ঠ ও দেশপ্রেমিক এক ঝাঁক সাংবাদিককে
নেতৃত্ব দিতে পেরেছি। এটি আমি ও আমার সহকর্মীদের জন্য অত্যন্ত পরিতৃপ্তির
বিষয় যে আপনাদের প্রয়োজনের বিষয়গুলো নিয়েই ২৭ বছর ধরে প্রতিদিন সকালে আমরা
আপনাদের দরজায় কড়া নাড়ি। যখন আপনাদের দরজায় আবর্জনা জমা হয়, তখন আমরা তা
নিয়ে রিপোর্ট করি। আপনারা যখন ট্রাফিক জ্যামে কষ্ট পান, আমরা তখন আপনাদের
হয়ে সেই কষ্টের কথা বলি। যখন আমাদের নদীগুলো দূষণের শিকার হয়, তখন আমরা
তোলপাড় বাধিয়ে দিই। যখন আমাদের ব্যাংকগুলো লুট হয়, তখন আমরা সর্বোচ্চ
আওয়াজে চিৎকার করে উঠি। যখন জনগণের কষ্টার্জিত টাকা দুর্নীতি খেয়ে ফেলে,
তখন আমরা আত্মসাৎকারীদের মুখোশ খুলে দিই। প্রতিটি জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে
আমরা সাধ্যমতো আপনাদের পাশে থাকার চেষ্টা করি। একইভাবে যখনই গণতন্ত্র,
মৌলিক অধিকার ও আইনের শাসন হুমকির মুখে পড়ে, তখন আমরা প্রতিবাদ করি। আমরা
আমাদের সাধ্যমতো এই প্রতিবাদ জারি রাখব। আমাদের এই বিরোধিতা কোনো সরকার,
কোনো দল বা কোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়।
এই বিরোধিতার উৎস জনগণের ভালোবাসা
এবং দেশমাতৃকার অতন্দ্র প্রহরী একটি সংবাদপত্রের দায়িত্ববোধ থেকে। এই
প্রতিবাদ আসে দেশপ্রেম থেকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে মূল্যবোধ আমরা ধারণ
করেছিলাম, সেই মূল্যবোধ থেকেই সেই প্রতিবাদ জাগ্রত হয়। আমরা বিশ্বাস করি,
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথ ধরেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে; বাংলাদেশে নিশ্চিতভাবেই
ন্যায়বিচারের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ অবশ্যই
গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বিশ্বসভায় দাঁড়াবে। আমাদের সেই বিশ্বাস থেকেই
আমাদের সাংবাদিকতা এবং এই কাগজটির নীতিনির্ধারণ। আমি আমার পত্রিকার
পরিচালনা পর্ষদকে গভীর শ্রদ্ধা জানাতে চাই। সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস
করা একটি পরিচালনা পর্ষদের সহায়তা ছাড়া, একজন সম্পাদক হয়ে আমার পক্ষে এই
পত্রিকা চালানো সম্ভব নয়। পাশাপাশি আমি আবার ধন্যবাদ দিতে চাই আমাদের পাঠক,
পৃষ্ঠপোষক ও বিজ্ঞাপনদাতাদের, যাঁরা সার্বক্ষণিকভাবে আমাদের পাশে আছেন।
আপনারা সবাই হয়তো জানেন, হয়তো অনেকে জানেন না, প্রায় দুই বছর ধরে আমাদের ৪০
শতাংশের মতো বিজ্ঞাপন কমে গেছে। এর কারণ আমরা পাঠকের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ
হয়েছি কিংবা সাংবাদিকতার ঘাটতির অভাবে এমনটা হয়েছে, তা নয়; তবে আসল কারণ
এখনো আমাদের অজ্ঞাত। ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, সব শেষে আমি বলতে চাই, ডেইলি
স্টার একটি নীতিনিষ্ঠ, পেশাদার ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধভিত্তিক দেশপ্রেমী
সংবাদপত্র। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের বিষয়ে কাগজটি সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আমরা মনে করি মুক্ত, স্বাধীন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক গণমাধ্যম ছাড়া
বাংলাদেশ তার প্রত্যাশিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে না। মুক্ত গণমাধ্যমের
শক্তিতে স্বপ্নের সোনার বাংলা একদিন সত্যিকার সোনার বাংলা হয়ে উঠবে। সেই
সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতার যাত্রায় ডেইলি স্টার-এর সঙ্গে অংশীদার হতে আমি
আপনাদের প্রতি উদাত্ত আমন্ত্রণ জানাই। আপনাদের আবারও অসংখ্য ধন্যবাদ।
মাহ্ফুজ আনাম : ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক
মাহ্ফুজ আনাম : ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক
No comments