রোহিঙ্গাদের 'দিন চলছে বিভিন্ন সংস্থা আর মানুষের সাহায্যে, যেটা আমি কোন দিন কল্পনা করিনি'
মিয়ানমারের
কুমারখালি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন জাফর ইসলাম। নিজের এলাকায়
৩০ বিঘা জমি, বাড়ি ঘর সব মিলিয়ে বেশ নাম ডাক ছিল মি. ইসলামের। কয়েক
গ্রামের মানুষ তাকে এক নামে চিনতো। কিন্তু সেই ব্যক্তি, জীবন বাঁচাতে
একেবারে এক কাপড়ে পালিয়ে এসেছেন পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে। আর এখন পলিথিনের
শেড দেয়া ঘরে দিনের পর দিন পার করছেন তিনি এবং তার পরিবার। বাংলাদেশের
সর্বদক্ষিণের জেলা কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার টেংখালি ক্যাম্পে এখন বাস
জাফর ইসলামের। স্ত্রী হাসিনা বেগম এবং ছয় সন্তান নিয়ে এখানে রয়েছেন তিনি
ছয় মাস ধরে। ওপরে পলিথিন এবং চারপাশে বেড়া দিয়ে ঘেরা ছাপড়ার মত দুটি
ঘর। ঘরের মধ্যে ঢুকে আমি দেখতে পেলাম কোনমতে জীবন ধারণ করার জন্য যে কাপড়
দরকার সেগুলোই আছে। আসবাব বলতে কিছু নেই। মাটিতে বিছানা পেতে শোবার স্থান
করা। আমি যখন সেখানে গেলাম তখন দুপুর একটার কাছাকাছি। তবে দুপুরের
রান্না-বান্নার কোন আয়োজন আমর চোখে পড়লো না। নেই কাজ কর্মের কোন তাড়া।
হাসিনা বেগম মেঝেতে শুয়ে ছিলেন। আমাকে দেখে উঠে বসলেন। ছেলে মেয়েরাও অলস
বসে ছিল। মায়ের পাশে এসে বসলো তারাও। সেখানেই বলছিলেন মিয়ানমারে তাদের
ফেলা আসা সহায়-সম্পত্তি, প্রভাব প্রতিপত্তি আর এখনকার দীনহীন অবস্থার কথা।
এই জাফর ইসলামের বাড়ী ছিল কাঠের তৈরি দোতলা বাড়ী। যেটা মিয়ানমারের
গ্রাম-অঞ্চলে শুধুমাত্র বিত্তবানদের থাকে। ঐতিহ্যবাহী এসব বাড়ী অনেক
পুরনো, এবং বংশের ঐতিহ্য ধারণ করে।
সেই বাড়ী ছেড়ে পলিথিনের ছাপড়ায় দিন
কাটছে তাদের এখন। হাসিনা বেগম এবং জাফর ইসলামের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের
হয়ে এলো। হাসিনা বেগম বলছিলেন "এক কাপড়ে রাতের অন্ধকারে নৌকায় করে
পালিয়ে এসেছি। ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা সব বন্ধ। কবে আবার পড়াশোনা শুরু
করতে পারবে তার কোন ঠিক নেই।" মি. ইসলাম পুরো সময়টা মাথা নীচু করে কথা
বলছিলেন। বলছিলেন, এভাবে জীবন যাপন করা তার জন্য অসম্মানের। "শুধু সন্তান
আর পরিবারের কথা চিন্তা করে পালিয়ে এসেছি," বলছিলেন তিনি। "যখন আসি তখন এক
মাস চলার মত অর্থ আমার হাতে ছিল। কিন্তু আট জনের খরচ চালাতে কিছু দিনের
মধ্যেই সেই অর্থ শেষ হয়ে যায়। এখন দিন চলছে বিভিন্ন সংস্থা আর মানুষের
সাহায্যে, যেটা আমি কোন দিন কল্পনা করিনি।" হাসিনা বেগম বলছিলেন তাদের
জমি-জমাতে অনেক কৃষক কাজ করতো। প্রতিদিন অনেক মানুষের খাবার ব্যবস্থা তারা
করতেন কিন্তু এখন তাদেরকে অন্যের ওপর ভরসা করে চলতে হচ্ছে। এই পরিবারটির
কাছে জানতে চাইলাম এখনকার জীবন নিয়ে তাদের কী ভাবনা? স্বামী-স্ত্রী
দুইজনেই একই উত্তর দিলেন। তারা বললেন, সেখানে অনেক সমস্যা কিন্তু জীবনের
নিশ্চয়তা আছে। কিন্তু মিয়ানমারে তাদের সবকিছু ছিল কিন্তু জীবনের কোন
নিশ্চয়তা ছিল না। জাফর ইসলাম বলছিলেন, তিনি শুনেছেন যে তার জমি
মিয়ানমারের আর্মি দখল করে ফ্যাক্টরি বানানোর কাজ করছে। জানতে চাইলাম
মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা আছে কিনা? অনেক ক্ষণ চুপ থেকে বললেন "ইচ্ছা
আছে। কিন্তু ফিরে যাবো কোন ভরসায়?"
No comments