আইনের সার্বভৌমত্ব বনাম রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব by এবনে গোলাম সামাদ
একটা
দেশে আইন আদালতের প্রয়োজন অবশ্যই আছে। কিন্তু আইন আদালত রাজনৈতিক সমস্যার
সমাধান করে দিতে পারে না। রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হতে হয় রাজনৈতিকভাবে।
যারা রাজনৈতিক বিষয়ে বই লিখে খ্যাতিমান হয়ে আছেন, তাদের মধ্যে একজন হলেন
বিলাতের A V Dicey। তিনি তার বিখ্যাত The Law of the Constitution (1915)
নামক বইতে বলেন, বিলাতে গণতন্ত্র স্থায়িত্ব পেতে পেরেছে, তার কারণ বিলাতের
গণতন্ত্র হলো জনমতভিত্তিক। কেবলই আইনভিত্তিক নয়। তার নিজের কথায়,Behind the
sovereign which the lawyer recognizes, there is another sovereign to
whom the legal sovereign must bow. আইন বিশারদরা আইনের সার্বভৌমত্বকে বড়
করে দেখেন। কিন্তু আইনের শেষ ভিত্তি হলো জনসম্মতি। জনগণের ইচ্ছার প্রতিকূলে
আইনের সার্বভৌমত্ব তাই টিকতে পারে না। যেহেতু বিলাতে জনমতের স্বীকৃতি আছে,
তাই হয় না গণঅভ্যুত্থান। খালেদা জিয়াকে আদালত কারাগারে পাঠাল। আমরা
আদালতের বিচারের সমালোচনা করতে চাই না। কিন্তু আমরা মনে করি, বিষয়টির সাথে
রাজনীতি এমনভাবেই জড়িয়ে পড়েছে যে, জনমতের সাথে আদালতের রায় খাপ না খেতেও
পারে। বিজ্ঞ বিচারকেরা বলছেন, খালেদা জিয়া যা করেছেন তা হলো আর্থিক অপরাধ।
কিন্তু আর্থিক অপরাধ কিভাবে করা হয়েছে তা নিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে সংশয়।
কেননা এতিমখানার নামে পাঠানো টাকাটা দিয়েছে একটি বিদেশী রাষ্ট্র। টাকাটা
এসেছে খালেদা জিয়ার নামে। ঠিক প্রধানমন্ত্রীর নামে নয়। টাকাটা নয়ছয় হয়ে
থাকলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কিন্তু মামলাটা হতে পারল
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। রাষ্ট্র যদি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে থাকে, তবে রাষ্ট্র
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মামলা দায়ের করতে পারল কিভাবে? রাষ্ট্রের টাকা
বাংলাদেশে অনেকভাবেই নয়ছয় হচ্ছে। যেমন মন্ত্রীরা সরকারি টাকায় নানা দেশের
জায়গায় সফর করছেন। কিন্তু সফরে গিয়ে আবার দিয়ে ফেলছেন দলের নির্বাচনী
বক্তৃতা। সরকারি টাকায় যেটা তারা করতে পারেন না। এটাও সরকারি অর্থের অপচয়
বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে সেটা হচ্ছে না। রাষ্ট্র ও সরকার
সমার্থক নয়। কিন্তু বাংলাদেশে বাস্তব ক্ষেত্রে তাকে তোলা হচ্ছে সমার্থক
করে। যিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তিনিই আবার বক্তৃতা করছেন একই সভায় একই
সময়ে আওয়ামী লীগের নেত্রী হিসেবে। আমার মনে পড়ে ভারতে তখনকার
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একবার সরকারি হেলিকপ্টারে করে গিয়ে কোনো
জায়গায় দিয়ে ফেলেছিলেন নির্বাচনী বক্তৃতা। এক ব্যক্তি এ জন্য এলাহাবাদ
হাইকোর্টে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। অভিযোগ তোলেন নির্বাচনে সরকারি অর্থ
ব্যয়ের অপরাধের। এহালাবাদ হাইকোর্ট রায় দেন যে, ইন্দিরা গান্ধী পাঁচ বছর
কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী এহালাবাদ
হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেন। ভারতের
সর্বোচ্চ আদালত একটি দ্ব্যর্থক রায়সহ এলাহাবাদের সিদ্ধান্ত মুলতবি রাখেন।
বাংলাদেশ একটা পৃথক দেশ। কিন্তু নির্বাচনী আইন প্রায় ভারতেরই মতো। এ দেশেও
তাই আদালতে মামলা হতে পারত বিষয়টিকে নিয়ে। কিন্তু দুদক এ বিষয়ে দেখাচ্ছে না
কোনো তৎপরতা। কোনো ব্যক্তিও করছেন না এ বিষয়ে কোনো মামলা। কেবল খালেদা
জিয়ার বিরুদ্ধেই হতে পারল আর্থিক অপরাধজনিত কারণে মামলা এবং তাকে পেতে হলো
সাজা। নিম্ন আদালতের রায় অবশ্য উচ্চ আদালতে বাতিল হয়ে যেতেও পারে। আমরা এ
বিষয়ে কোনো কিছু আন্দাজ করতে চাই না। তবে আমাদের ধারণা, খালেদা জিয়া আর
বিএনপি দল হিসেবে সমার্থক নয়। দল হিসেবে বিএনপির আছে বিরাট সমর্থন। খালেদা
জিয়ার ভাবমর্যাদা কোনো কারণে বিবর্ণ হওয়ার অর্থ দাঁড়াবে না বিএনপির
জনপ্রিয়তা উবে যাওয়া। অথবা ভোটের বাক্সে বিএনপির ভোট কম পড়া। বিএনপি এবং
আওয়ামী লীগ দু’টি আলাদা দল। কিন্তু এই দলীয় পার্থক্যের মূলে কাজ করছে না
কেবল ব্যক্তিত্বের সঙ্ঘাত। খালেদা জিয়ার সাথে শেখ হাসিনার ব্যক্তিত্বের
সঙ্ঘাত আছে। সেটা কেউ অস্বীকার করবে না। কিন্তু দু’টি দলের পার্থক্য ঘটেছে
নীতিগত কারণেও। আওয়ামী লীগ একপর্যায়ে চেয়েছে দেশে একদলের রাজত্ব স্থাপন
করতে। বলেছে, আগে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র। কিন্তু বিএনপি আগাগোড়াই
চেয়েছে বহুদলীয় উদার গণতন্ত্র। সে কখনোই মনে করেনি একমাত্র রাষ্ট্রই দেশের
অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে পারে। সে আস্থা রেখেছে ব্যক্তি উদ্যোগে। সে দেশে
সমাজতন্ত্র গড়ার নামে ব্যক্তি উদ্যোগকে কখনো বন্ধ করে দিতে চায়নি।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার সময় আরম্ভ হয় শ্রমশক্তি রফতানি, তৈরী পোশাক রফতানি,
চিংড়ি মাছ রফতানি, যা দেশের অর্থনীতিতে সৃষ্টি করে বিশেষ গতি। এই গতি আনে
দেশে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। ঘোচে বাংলাদেশের তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ। আওয়ামী লীগ
ঝুঁকে পড়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি। গ্রহণ করতে চেয়েছিল সোভিয়েত
অর্থনীতির আদর্শকে অনুসরণ করতে। আর এক কথায় রাষ্ট্রিক পঞ্চবার্ষিক
পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন সাধন করতে। কিন্তু এখন সোভিয়েত
ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে। তার পদ্ধতি আর বিশ্বের কোনো দেশেই আদ্রিত নয়। বরং হচ্ছে
বহুলভাবেই নিন্দিত। কিন্তু আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীরা এখনো যেন চাচ্ছেন এই
নিন্দিত আদর্শকেই শ্রেষ্ঠ ভাবতে। বাংলাদেশে মানুষ চাচ্ছে উদার গণতন্ত্র।
কারণ, এই ব্যবস্থাতেই মানুষ পেতে পারে সর্বাধিক ব্যক্তিস্বাধীনতা। গণতন্ত্র
কেবল একটি রাজনৈতিক দর্শন নয়। বাস্তবে তা হলো একটি উন্নত জীবনবিধান। একটি
বড় রকমের অর্জন। আওয়ামী লীগের মতো দল একটি দেশে ক্ষমতায় থাকা মানে হলো,
দেশে রাষ্ট্র-দাসত্ব (State-slavery) প্রতিষ্ঠিত হওয়া। বাংলাদেশের মানুষ
চায় প্রকৃত স্বাধীনতা। তারা চায় না রাষ্ট্র-দাসত্ব।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল
মুজিবনগরের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের থাকবে
মানব সমতা ও তারা ভোগ করবে সামাজিক ন্যায়বিচার। পরে বাংলাদেশের সংবিধানের
প্রস্তাবনায় যোগ করা হয়, বাংলাদেশ হবে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু
মুজিবনগরের ঘোষণাপত্রে সমাজতন্ত্র কথাটা ছিল না। যদিও বাংলাদেশের সংবিধানে
সমাজতন্ত্র কথাটা সংযুক্ত হয়। তথাপি বলা হয়েছে যে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত
করতে হবে গণতান্ত্রিক উপায়ে। গণতন্ত্রকে বাতিল করে বলা হয়নি, একদলের
রাজত্বকে প্রতিষ্ঠা করবার কথা। আওয়ামী লীগের আদর্শ বাংলাদেশের সংবিধানের
পরিপন্থী। শেখ হাসিনা বলছেন, আমাদের মধ্যে নাকি ফিরে আসছে পাকিস্তানের
প্রেতাত্মা (বাংলাদেশে প্রতিদিন, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮)। কিন্তু ২০১২ সালে
শেখ মুজিবুর রহমানের যে অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে, তাতে তিনি
বলেছেন, দ্বিজাতিতত্ত্ব ছিল সঠিক। পাকিস্তান আন্দোলন ছিল ন্যায্য। কেবল তাই
নয়, বাংলাদেশের বাংলাভাষী মুসলমানেরা কেবল বাঙালি নয়, তাদের মধ্যে কাজ করে
চলেছে একটা মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবোধ (পৃষ্ঠা ৪৭ দ্রষ্টব্য)। এর পরে কি বলা
যায়, আমাদের অনেকের মধ্যে পাকিস্তানের প্রভুদের প্রভাব বিরাজ করছে? শেখ
মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে
প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে চিন্তা-ভাবনার। এখন আর বলা যাচ্ছে
না, হাজার বছরের বাঙালি কথাটা। আওয়ামী লীগের জাতিসত্তার ধারণাটাও মনে
হচ্ছে হওয়া উচিত হাল নাগাদ। অনেক কিছুই ঘটছে, কিছু দিন আগেও যার কথা ভাবা
যায়নি। যেমন, আমরা সাবেক পাকিস্তানের মধ্যে আন্দোলন করেছিলাম বাংলাকে
উর্দুর সাথে রাষ্ট্রভাষা করতে। আমরা সেই ইতিহাস নিয়ে এখনো করছি নানাভাবেই
কান্নাকাটি। যদিও রাষ্ট্রভাষা বাংলা কোনো অসফল আন্দোলন ছিল না। বাংলা
অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে লাভ করতে পেরেছিল স্বীকৃতি। কিন্তু বর্তমানে
দেখছি এখনকার পাকিস্তানে উর্দুর সাথে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে চীনা ভাষাকে
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। কী বিরাট এই পরিবর্তন? চীনে অনেক ভাষা আছে। তার মধ্যে
কুয়ান হয়া হলো চীনের রাষ্ট্রভাষা। এই ভাষাটা বাইরের দুনিয়ায় ম্যান্ডারিন
নামেও পরিচিত। ম্যান্ডারিন নামটা পর্তুগিজদের দেয়া। চীন বিশেষভাবেই ঢুকে
পড়তে পারছে ভারত উপমহাদেশের মধ্যে। এর জন্য তাকে করতে হচ্ছে না কোনো যুদ্ধ।
কিন্তু ভারত এভাবে ঢুকতে পারছে না চীনের মধ্যে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ
বাধলে পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়াবে খুবই জটিল। শেখ হাসিনা হয়তো ভাবছেন, ভারত-চীন
যুদ্ধে ভারত জিতবে। কিন্তু অতটা নিশ্চয়তাবোধ বাস্তবভিত্তিক হচ্ছে বলে মনে
হয় না। অন্তত রণনীতির দিক থেকে। কারণ, চীনা সৈন্যরা ঢুকে পড়ছে এমন এক দেশে,
যেখান থেকে দিল্লি দূরে নয়। পানিপথের মধ্য দিয়ে তারা অনেক সহজে দিল্লি
অভিমুখী হতে পারবে।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
No comments