বুলডোজারে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে রোহিঙ্গা গ্রাম
আন্তর্জাতিক
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) অভিযোগ করেছে,
সেনাবাহিনীর দমন অভিযানে জনশূন্য হয়ে পড়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গ্রামগুলো
বুলডোজার দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা নিধনের
আলামতগুলোও ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে দেশটি। নতুন স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে
মানবাধিকার সংস্থাটি এ অভিযোগ করেছে। তারা বলছে, গত বছরের শেষদিক থেকে
রাখাইনের উত্তর অংশের অন্তত ৫৫টি রোহিঙ্গা গ্রামের সব স্থাপনা ও ক্ষেতখামার
ভারি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সমান করে ফেলা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ওই অঞ্চলে
সেনাবাহিনীর চালানো ধ্বংসযজ্ঞের প্রমাণ মুছে ফেলার ব্যবস্থা করেছে
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। এইচআরডব্লিউ বলছে, গত আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত অন্তত
৩৬২টি রোহিঙ্গা গ্রাম সম্পূর্ণ বা আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার চিহ্ন দেখা
গেছে তাদের হাতে আসা স্যাটেলাইট ছবিতে। এর আগে পুড়িয়ে দেয়া বেশ কিছু
গ্রামের সঙ্গে অন্তত দুটি জনশূন্য অক্ষত গ্রাম বুলডোজার দিয়ে মাটির সঙ্গে
মিশিয়ে দেয়ার প্রমাণ পাওয়ার কথাও বলছে মানবাধিকার সংস্থাটি। সংস্থাটির
এশিয়াবিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস এক বিবৃতিতে বলেন, এসব গ্রাম ছিল
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর দমন অভিযানের ভয়াবহতার প্রমাণ। জাতিসংঘের
বিশেষজ্ঞরা যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার আলামত সংগ্রহ করতে পারেন এবং
দোষীদের যাতে যথাযথভাবে শনাক্ত করা যায়, সেজন্যই এসব গ্রাম ওই অবস্থায়
সংরক্ষণ করা প্রয়োজন ছিল। তিনি আরও বলেন, ‘এক সময় সেখানে যে রোহিঙ্গাদের
বসবাস ছিল, তাদের স্মৃতি এবং সেই সঙ্গে তাদের আইনি অধিকারের চিহ্নও
বুলডোজার দিয়ে মুছে ফেলা হচ্ছে।’ এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তর
রাখাইনের মিন হল্ট এলাকার দুটি গ্রামের স্যাটেলাইট ছবি তারা পেয়েছে, যেগুলো
গত বছর পর্যন্ত আগুনে পোড়ানো হয়নি এবং খুব সম্ভবত আবারও বসবাসের উপযোগী
অবস্থায় ছিল। কিন্তু সেই গ্রাম দুটিও ৯ জানুয়ারি থেকে ১৩ ফেব্র“য়ারির মধ্যে
বুলডোজার দিয়ে সমান করে দেয়া হয়েছে। বার্তা সংস্থা এপি ও রয়টার্স দুই
সময়ের চিত্র তুলে ধরে লিখেছে, এমন এক সময়ে এইচআরডব্লিউ এসব ছবি প্রকাশ করল
যখন রাখাইনের ওই অঞ্চলে ত্রাণ তৎপরতা চালানোর বিষয়ে জাতিসংঘ ও জাপানের
সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে মিয়ানমার সরকার। রাখাইনের ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও
একটি সেনাক্যাম্পে সমন্বিত হামলার পর ২৫ আগস্ট থেকে সেনাবাহিনীর এই দমন
অভিযান শুরু হয়, যাকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে
জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে মিয়ানমার সরকার ওই হামলার জন্য রোহিঙ্গা
গেরিলাদের একটি দলকে দায়ী করে আসছে।
সেনাবাহিনীর অভিযানকে তারা বলছে,
‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই’। সেনা অভিযান শুরুর পর থেকে গত ছয় মাসে প্রায় ৭
লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে।
গ্রামে গ্রামে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওযের ভয়াবহ বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে
তাদের ভাষ্যে। পশ্চিমা সরকারগুলোর চাপ এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি
উপেক্ষা করেই নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির সরকার রাখাইনে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট
ফাইন্ডিং মিশন পরিচালনার পথ বন্ধ করে রেখেছে। রয়টার্স জানিয়েছে,
এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনের বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র জ তাইয়ের কোনো
মন্তব্য তারা পায়নি। মিয়ানমারের কর্মকর্তারা এর আগে বলেছিলেন, গত নভেম্বরে
বাংলাদেশের সঙ্গে করা প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে
তারা বিভিন্ন এলাকা প্রস্তুত করছে। আর গত জানুয়ারিতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয়
সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছিল, আটটি এক্সক্যাভেটর ও চারটি বুলডোজার ওই
এলাকায় কাজ করছে। মিয়ানমার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে, বাংলাদেশের সঙ্গে করা
চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের ফেরানোর পর আপাতত দুটি অস্থায়ী ক্যাম্পে রাখা
হবে এবং পরে তাদের নিজেদের ঠিকানায় ফেরার সুযোগ দেয়া হবে। তবে সমাজকল্যাণ,
ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী উইন মিয়াত আই গত সেপ্টেম্বরে বলেছিলেন, রাখাইনে
পুড়ে যাওয়া ভূমি নিয়ম অনুযায়ী সরকারের দখলে চলে যাবে এবং সরকার সেসব ভূমির
পুনঃউন্নয়ন করবে।
No comments