উসকানি প্রদান নয়, সহাবস্থানে বিশ্বাসী হতে হবে by আবদুল লতিফ মন্ডল
সম্প্রতি
ফেনী মহিপাল সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ক্ষমতাসীন
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের
বলেছেন, বিএনপি জোরালো আন্দোলন করার সক্ষমতা হারিয়েছে। তিনি আরও বলেন,
বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে আদালতের রায়ে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ নেই।
এটি তাদের সময়ের মামলা নয়। এটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের দুর্নীতি দমন
কমিশনের (দুদক) মামলা। ২০ ফেব্রুয়ারি গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা
রুজু এবং মামলার রায় প্রদান প্রসঙ্গে একই কথা বলেন। তিনি বলেন, জিয়া
অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় তিনি দেননি, দিয়েছেন আদালত। আর খালেদা জিয়ার
বিরুদ্ধে মামলাটি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, দুদক। তিনি আরও বলেন, খালেদা
জিয়াকে ছাড়া যদি বিএনপি নির্বাচনে না আসে, তাহলে কিছু করার নেই। নির্বাচন
সংবিধান অনুযায়ী সময়মতোই হবে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, সেনাসমর্থিত
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু’বছরে (২০০৭ ও ২০০৮) বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা
জিয়ার বিরুদ্ধে ৬টি মামলা ছিল, আর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে
ছিল ১৫টি মামলা। কিন্তু ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে
জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার ও আওয়ামী লীগের
নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা ছিল, সেগুলো নির্বাহী আদেশে কোয়াশ করা
হয়। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার ৬টি মামলার সঙ্গে নতুন করে আরও মামলা যুক্ত হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রুজু করা জিয়া অরফানেজ
ট্রাস্ট মামলায় আদালত সম্প্রতি তাকে সাজা দিয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন ও
তিনবার প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা খালেদা জিয়ার সাজা হওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতাদের
মনে হয়তো বিশ্বাস জন্মেছে যে, বিএনপিকে ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে দূরে
রাখতে তারা যেভাবে সক্ষম হয়েছিলেন, তেমনিভাবে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য
দলটির নেতাকর্মীদের সহিংস আন্দোলনে যেতে উসকে দিয়ে নতুন করে তাদের কারাগারে
পাঠাতে পারলে বিএনপিকে আগামী একাদশ নির্বাচন থেকে দূরে রাখা সম্ভব হতেও
পারে। এতে বিএনপি আইনগতভাবে নিবন্ধন হারিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য
হয়ে পড়বে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার সাজার পর তার মুক্তির
জন্য সহিংস আন্দোলনে যাওয়ার উসকানি উপেক্ষা করে বিএনপি শান্তিপূর্ণ
আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছে।
খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপি এ পর্যন্ত
যেসব শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- জাতীয় প্রেস
ক্লাবের সামনে প্রতীকী অনশন, রাজধানীসহ সারা দেশে মানববন্ধন,গণস্বাক্ষর
সংগ্রহ এবং সব জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে স্মারকলিপি প্রদান। বিএনপির এসব
শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সরকারকে অনেকটা হতাশ করেছে বলে অনেকে মনে করেন। তাদের
ধারণা, আওয়ামী লীগের অনেকে চেয়েছিল জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা
জিয়ার সাজা হলে তার মুক্তির জন্য বিএনপি হিংসাত্মক আন্দোলনের পথ বেছে নেবে,
যা দলটিকে আদালতের রায় অবমাননাকারী এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হিসেবে
প্রচারে সরকারকে সুযোগ এনে দেবে। বিএনপি সহিংস আন্দোলনের পথে গিয়ে যান
চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, যানবাহনের ক্ষতিসাধন, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি
বিনষ্ট, অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির মতো অপরাধে লিপ্ত হলে দলটির নেতাকর্মীদের
আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইনের আওতায় এনে দীর্ঘ সাজা
ভোগের ব্যবস্থা নেয়া সরকারের জন্য সহজ হবে। উল্লেখ্য, ১১ ফেব্রুয়ারি জাতীয়
সংসদে ওই আইনটির সংশোধনী পাস হয়। এতে উপর্যুক্ত অপরাধগুলোসহ আইনটির
আওতাভুক্ত অন্যান্য অপরাধের জন্য সাজার মেয়াদ ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ৭ বছর করা
হয়েছে। আসলে দাবি আদায়ে বড় দু’দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শান্তিপূর্ণ
আন্দোলনের নজির নেই বললেই চলে। গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর
রাষ্ট্রপতি এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সরকার পদত্যাগ করলে ১৯৮১
সালে নিহত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন
বিএনপি ১৯৯১ সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের আমলে
অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করলে শেখ হাসিনার
নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ এনে
নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে। এরপর ১৯৯৪ সালে তারা মাগুরার একটি আসনে
উপনির্বাচনে অনিয়ম ও ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এ দাবিতে ১৯৯৪
থেকে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি সময়কালে আওয়ামী লীগ প্রথমে সংসদ বর্জন ও পরে
সংসদ থেকে পদত্যাগ ছাড়াও ১৭৩ দিন হরতাল পালন করে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সহিংস
আন্দোলনে দেশের যাতায়াত ব্যবস্থা কার্যত অচল হয়ে পড়ায় জনগণ চরম বিপদের
সম্মুখীন হয়, শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় লাখ লাখ
শিক্ষার্থী, ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যবসা-বাণিজ্য। সে সময় এমনকি অনেক অফিসগামী
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অপদস্ত পর্যন্ত হতে হয়। দীর্ঘ সহিংস আন্দোলনে
দেশের অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়। তাছাড়া আওয়ামী লীগের জাতীয় সংসদ বর্জনের
মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি শুরু হয়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে (২০০১-০৬) বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সংসদ অধিবেশনে ঘন
ঘন অনুপস্থিত থাকে, অবরোধ কর্মসূচি পালনসহ ১৩০ দিন হরতাল করে। ২০০৬ সালের
শেষদিকে ইয়াজউদ্দীন আহম্মদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী
লীগ পরবর্তী বছরে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়ার পর
সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ সময় রাজপথে ঝরে পড়ে একাধিক তাজা প্রাণ।
সহিংস আন্দোলনে বিএনপিও পিছিয়ে থাকেনি। ১৯৯৬ সালের ২ জুন নির্দলীয়
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ৭ম সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ
হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২৩ জুন সরকার গঠন করে। বিএনপি নির্বাচনে
কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে এবং আওয়ামী লীগ সৃষ্ট
সংসদ বর্জনের ‘সংস্কৃতি’ অনুসরণ করে। তাছাড়া আওয়ামী লীগ শাসনের এ মেয়াদে
(১৯৯৬-২০০১) বিরোধী দল বিএনপি জাতীয়ভাবে ৪৫ দিন হরতাল পালন করে।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম
সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের জন্য তারা বিএনপির শাসনামলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল এবং সংসদ
থেকে পদত্যাগ করেছিল, ক্ষমতায় এসে তারাই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে
সংসদ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। প্রধান বিরোধী
দল বিএনপি ও তাদের সহযোগী ১৯টি দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা
পুনর্বহালের দাবিতে সরকারকে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি
অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অনেকটা
একতরফাভাবে সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আবারও ক্ষমতায় আসে। নবম সংসদ
নির্বাচনের পর বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন
এবং নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানাতে থাকলেও তারা জোরদার আন্দোলনে
যায়নি। তবে সরকারের কাছ থেকে এসব দাবি পূরণে কোনো সাড়া না পেয়ে বিএনপি
২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি লাগাতার হরতাল ও অবরোধের ডাক দেয়। তিন মাসব্যাপী এ
সহিংস আন্দোলনে কয়েক ডজন তাজা প্রাণ ঝরে পড়ে, সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে
ক্ষতিগ্রস্ত হয় বহুসংখ্যক যানবাহন, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে
পড়ে, রাজধানীর সঙ্গে দূরপাল্লার বাস, ট্রাক-ভ্যানের চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে
যায়, সময়মতো কৃষিপণ্যের চালান মোকামে, গুদামে পাঠাতে বা বাজারজাত করতে না
পারায় কৃষককে কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতিতে পড়তে হয়। রেল চলাচল
বাধাগ্রস্ত হয়, সমুদ্রবন্দরে মালামাল ওঠানো ও নামানো বাধাগ্রস্ত হওয়ায়
ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমদানি-রফতানি। দেশের শহরাঞ্চলে বেসরকারি খাতে সেবামূলক
সার্ভিসগুলোর চাহিদা ভীষণভাবে কমে যাওয়ায় এসবের সঙ্গে জড়িত ছোট ও মাঝারি
ব্যবসায়ীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এককথায়, দেশে অর্থনীতির অপূরণীয়
ক্ষতি হয়। বিএনপি এসব হিংসাত্মক কজের দায়ভার অস্বীকার করলেও তা জনগণের
বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হয়নি। ২০১৫ সালের সহিংস আন্দোলনের ব্যর্থতা
থেকে শিক্ষা নিয়ে বিএনপি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় নিম্ন
আদালতে সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য সহিংস আন্দোলনের পথে পা
বাড়ায়নি। দলটির নেতারাও কেউ কোথাও কোনো হঠকারী বক্তব্য দেননি। খালেদা জিয়ার
অনুপস্থিতিতে তার মুক্তির জন্য দলটির নেতৃত্ব সম্মিলিতভাবে শান্তিপূর্ণ
আন্দোলন ও আইনি পথে হাঁটছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় নিম্ন
আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার পক্ষে তার আইনজীবীরা ২০ ফেব্রুয়ারি
হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চে আপিল দায়ের করেছেন। আজ আপিলের শুনানি হওয়ার
কথা এবং খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবীরা।
সবশেষে যা বলতে চাই তা হল, অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় নিম্ন আদালতে
সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে সর্বাত্মক
আন্দোলনে যাওয়ার মতো শক্তি বিএনপির নেই- শাসক দল আওয়ামী লীগের কোনো কোনো
নেতার এরূপ ধারণা ঠিক নয়। তাছাড়া এরূপ বক্তব্য দিয়ে তারা বিএনপিকে কঠোর
আন্দোলনে যাওয়ার জন্য উসকানি দিচ্ছে, যা কোনোক্রমে কাম্য নয়। আদালতের রায়ের
প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই বিএনপি আইনি লড়াইয়ের পথ বেছে নিয়েছে। খালেদা জিয়াকে
মুক্ত করতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ও আইনি লড়াইয়ের পথ বেছে নেয়ায় বিএনপি দেশে
ও বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছে। আর যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হল, দেশের দুটি
বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সহাবস্থানে বিশ্বাসী হতে হবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com
No comments