বিদ্যালয়ে যাওয়া মানেই শেখা নয় by খায়েম সাভেদ্রা
ড.
খায়েম সাভেদ্রা পেরুর সাবেক শিক্ষামন্ত্রী। পেরুর ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক। পরে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে
পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১০ বছর বিশ্বব্যাংকে কাজ করেছেন। বর্তমানে
সংস্থাটির এডুকেশন গ্লোবাল প্র্যাকটিসের সঙ্গে যুক্ত। তিনি সম্প্রতি
বাংলাদেশ সফরে এলে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রথম আলোর
সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আয়েশা কবির
প্রথম আলো: বাংলাদেশ সফর থেকে আপনি কী অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন?
খায়েম সাভেদ্রা: এটা সংক্ষিপ্ত, তবে অর্থবহ সফর। মৌলিক শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে অনেক কথা বলার আছে। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ার সুযোগ বেড়েছে। কয়েক বছর ধরে উৎপাদনশীল খাতের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংশ্লিষ্টতা বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অংশীদারত্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিদ্যমান নানা প্রতিবন্ধকতা দূর করার লক্ষ্যে আমাদের ২০০টি প্রকল্প আছে। এটি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি। বাংলাদেশ গত বছর অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল আইন অনুমোদন করে। এটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এখানে অনেকগুলো ভালো ও খারাপ মানের বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার খারাপ মানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে চলতে পারে না। একজন তরুণ যদি মানসম্পন্ন শিক্ষা না পায়, সে তার জীবনে ওই বছরগুলো আর কখনো ফিরে পাবে না। কোনগুলো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তা জানার জন্য অ্যাক্রেডিটেশন ব্যবস্থা যথাযথভাবে প্রয়োগ করা উচিত। নিম্নমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত। আরেকটা বিষয় হলো কারিগরি শিক্ষা। কয়েক বছর আগেও কারিগরি শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর ১ শতাংশের মতো পড়ত। এখন এটা বেড়ে ১৪ শতাংশ হয়েছে। আমি ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। মুগ্ধ হওয়ার মতো। কারিগরি শিক্ষায় বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে। যারা কারিগরি শিক্ষা নিতে চায়, তাদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা খুবই ভালো উদ্যোগ। সব মেয়ের জন্য এই বৃত্তির ব্যবস্থা। কারিগরি বিষয়ে পড়ার আর্থিক সামর্থ্য নেই, এমন ছেলেরা এই বৃত্তি পেতে পারে। কারিগরি শিক্ষায় নারী-পুরুষের অনুপাত ২৫ শতাংশ। এটা ৫০ শতাংশ হওয়া উচিত। তবে বর্তমানের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। মৌলিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ভর্তিতে গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি হয়েছে। বিদ্যালয়ে ভর্তির হার এখন ৯৮ শতাংশ। তবে বিশ্বব্যাংকের বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদনের অন্যতম মূল বার্তা ছিল বিদ্যালয়ে যাওয়া মানেই শেখা নয়। অনেক শিশু বিদ্যালয়ে যায়, তবে সবাই শিখতে পারে না। বাংলাদেশে আমরা জাতীয় পর্যায়ের মূল্যায়ন থেকে জানতে পেরেছি, শেখার ব্যাপারে এখনো সমস্যা আছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়েছে। তাই আমরা গুণগত মান নিশ্চিত করার সমস্যার বিষয়টি বুঝতে পেরেছি।
প্রথম আলো: বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদনে শিক্ষার সংকটের কথা আছে। বাংলাদেশ কীভাবে এ থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে?
খায়েম সাভেদ্রা: শিক্ষাদানের মান বাড়ানোই বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষকতা পেশার ওপর নজর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছু অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে আরও বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। শিক্ষকদের ভালো বেতন, সামাজিক স্বীকৃতি ও তাঁদের দেখে যেন ভালো ছাত্ররা এ পেশায় আসে, তা নিশ্চিত করতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রধান শিক্ষক। অন্য শিক্ষকদের উদ্দীপ্ত করা ও তাঁদের কাজগুলোকে সংগঠিত করার সক্ষমতা প্রধান শিক্ষকদের থাকতে হবে। অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি তাঁদের বিদ্যালয় কমিউনিটির অংশ করার উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে মেধার ভিত্তিতে প্রধান শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যবস্থাপনা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি মন্ত্রণালয়কে কত কাজ সামলাতে হয়। ৯০ হাজার বিদ্যালয়, ৫০ লাখ শিক্ষক ও লাখ লাখ শিক্ষার্থী সামলাতে হতে পারে। তাই আমলাতন্ত্রকে দক্ষ হতে হবে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশে জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হয়। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় এটা বেশ বেশি। আদর্শ পরিমাণটা কী হওয়া উচিত?
খায়েম সাভেদ্রা: এই হার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে অনেক কম। আরও অনেক দেশের তুলনায়ও বেশ কম। এটা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ সত্তরের দশকে জিডিপির ৪ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। এখন সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা উচিত। তবে এটা আদর্শ হিসাবকে বোঝায় না। প্রতিবছর শিক্ষার্থীপ্রতি কত টাকা ব্যয় করা হয়, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বছরে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় প্রায় ১৬ হাজার টাকা। এটা খুবই কম এবং এটা বাড়ানো উচিত। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখানে আরও বেশি বিনিয়োগ করবে-বিষয়টা এমন নয়। বড় বিনিয়োগটা দেশের ভেতর থেকেই করতে হবে। শিক্ষায় আরও বেশি বিনিয়োগ করা এবং ভালোভাবে করা বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষকেরা ভালোভাবে তাঁদের কাজ করছেন, অর্থ ভালোভাবে ব্যয় হচ্ছে-এটা নিশ্চিত করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শুধু কম্পিউটার-ল্যাপটপে বিনিয়োগ করলেই হবে না, শিক্ষকেরা যেন এসব যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারেন, সে জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে। নইলে টাকাটা নষ্ট হবে।
প্রথম আলো: বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে ১৭ লাখ ডলার দিচ্ছে। আপনারা কীভাবে জবাবদিহি নিশ্চিত করেন?
খায়েম সাভেদ্রা: এটা বাংলাদেশ সরকারের ও আমাদের-উভয়ের জন্যই চ্যালেঞ্জ। ব্যাংক থেকে আপনি ঋণ নিতে পারেন, কিন্তু এটা জনগণের
টাকা। আমরা দুর্নীতির কথা বলছি না, টাকাটা যথাযথভাবে ব্যয় করার কথা বলছি। নিশ্চিত করতে হবে যে যতটুকু অর্থই ব্যয় করা হোক না কেন, সেটা যেন শিক্ষার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিনিয়োগটা কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে কি না, দেশের সেই পর্যবেক্ষণব্যবস্থা থাকতে হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আলো: বাস্তবে কিন্তু দুর্নীতির সমস্যাও আছে।
খায়েম সাভেদ্রা: আমি যেহেতু মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছি, আমি জানি এটা সব সময় চ্যালেঞ্জের। আপনাদের হয়তো সঠিক নীতিমালা আছে, কিন্তু দেখতে হবে সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কি না। সব সময়ই দুর্নীতির আশঙ্কা থাকে। তাই বিরামহীনভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হবে।
প্রথম আলো: বিশ্বব্যাপী দক্ষ শ্রমশক্তির চাহিদা পূরণের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে কী বলবেন?
খায়েম সাভেদ্রা: বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে এটা চ্যালেঞ্জ। এখানে শিক্ষকদের কাজ আগের তুলনায় অনেক বেশি জটিল। আগের চ্যালেঞ্জ ছিল জ্ঞানের বিষয়ে। কিন্তু সৃজনশীল চিন্তার যোগ্যতা, সমস্যার সমাধান, দলগত কাজ ও সামাজিক-আবেগীয় দক্ষতা অর্জন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলা, অধ্যবসায় ও ভালো যোগাযোগদক্ষতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ায় সহায়তা করে। বৈশ্বিক অর্থনীতির এই অনিশ্চিত যুগে ভবিষ্যৎ শ্রমবাজারের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক চাকরি আর থাকবে না। নতুন ধরনের পেশা আসবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সেইভাবে উপযোগী করে তৈরি করতে হবে। পরিবর্তনই একমাত্র সত্য। ১০ বছর আগে কম্পিউটারের অ্যাপ ডেভেলপারদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এখন এটা লাভজনক পেশা। এটা হয়তো ১০ বছর পর না-ও থাকতে পারে এবং এই পেশার জায়গায় নতুন কিছু আসতে পারে। সেটার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের শিক্ষা খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী? সেগুলো মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার উপায় কী?
খায়েম সাভেদ্রা: শিক্ষা খাতে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা কঠিন। এই দেশে অনেক ভালো ভালো উদ্ভাবন আছে। এর একটা হলো কারিগরি শিক্ষায় নারীদের বৃত্তি দেওয়া। আমি একটা শিক্ষাকেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়েছিলাম, যেখানে যারা কখনো বিদ্যালয়ে যায়নি, দ্বিতীয় শ্রেণির পর বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে কিংবা আবার পড়াশোনা করতে চায়, তাদের দ্বিতীয়বারের মতো একটা সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। ঝরে পড়ার সংখ্যা হয়তো কম, কিন্তু শূন্য নয়। মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার সংখ্যাটা বেশ বড়, বিশেষ করে ছাত্রীদের। আরও বেশিসংখ্যক শিশুর উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করা উচিত। প্রাথমিক পর্যায়ে ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীদের সমতা একটি ভালো বিষয়। কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার অনেক বেশি। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কারিগরি ও বিশ্ববিদ্যালয়-উভয় পর্যায়ে ছেলে ও মেয়ের পড়াশোনা শেষ করার সমান সুযোগ থাকতে হবে। সমতাই মূল চ্যালেঞ্জ। শিক্ষকদের ক্যারিয়ার ও বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে কাজ করে যেতে হবে। এগুলো শিক্ষাকে দেশের উন্নয়নের শক্তিতে পরিণত করবে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
খায়েম সাভেদ্রা: ধন্যবাদ।
প্রথম আলো: বাংলাদেশ সফর থেকে আপনি কী অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন?
খায়েম সাভেদ্রা: এটা সংক্ষিপ্ত, তবে অর্থবহ সফর। মৌলিক শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে অনেক কথা বলার আছে। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ার সুযোগ বেড়েছে। কয়েক বছর ধরে উৎপাদনশীল খাতের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংশ্লিষ্টতা বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অংশীদারত্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিদ্যমান নানা প্রতিবন্ধকতা দূর করার লক্ষ্যে আমাদের ২০০টি প্রকল্প আছে। এটি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি। বাংলাদেশ গত বছর অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল আইন অনুমোদন করে। এটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এখানে অনেকগুলো ভালো ও খারাপ মানের বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার খারাপ মানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে চলতে পারে না। একজন তরুণ যদি মানসম্পন্ন শিক্ষা না পায়, সে তার জীবনে ওই বছরগুলো আর কখনো ফিরে পাবে না। কোনগুলো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তা জানার জন্য অ্যাক্রেডিটেশন ব্যবস্থা যথাযথভাবে প্রয়োগ করা উচিত। নিম্নমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত। আরেকটা বিষয় হলো কারিগরি শিক্ষা। কয়েক বছর আগেও কারিগরি শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর ১ শতাংশের মতো পড়ত। এখন এটা বেড়ে ১৪ শতাংশ হয়েছে। আমি ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। মুগ্ধ হওয়ার মতো। কারিগরি শিক্ষায় বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে। যারা কারিগরি শিক্ষা নিতে চায়, তাদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা খুবই ভালো উদ্যোগ। সব মেয়ের জন্য এই বৃত্তির ব্যবস্থা। কারিগরি বিষয়ে পড়ার আর্থিক সামর্থ্য নেই, এমন ছেলেরা এই বৃত্তি পেতে পারে। কারিগরি শিক্ষায় নারী-পুরুষের অনুপাত ২৫ শতাংশ। এটা ৫০ শতাংশ হওয়া উচিত। তবে বর্তমানের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। মৌলিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ভর্তিতে গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি হয়েছে। বিদ্যালয়ে ভর্তির হার এখন ৯৮ শতাংশ। তবে বিশ্বব্যাংকের বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদনের অন্যতম মূল বার্তা ছিল বিদ্যালয়ে যাওয়া মানেই শেখা নয়। অনেক শিশু বিদ্যালয়ে যায়, তবে সবাই শিখতে পারে না। বাংলাদেশে আমরা জাতীয় পর্যায়ের মূল্যায়ন থেকে জানতে পেরেছি, শেখার ব্যাপারে এখনো সমস্যা আছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়েছে। তাই আমরা গুণগত মান নিশ্চিত করার সমস্যার বিষয়টি বুঝতে পেরেছি।
প্রথম আলো: বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদনে শিক্ষার সংকটের কথা আছে। বাংলাদেশ কীভাবে এ থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে?
খায়েম সাভেদ্রা: শিক্ষাদানের মান বাড়ানোই বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষকতা পেশার ওপর নজর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছু অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে আরও বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। শিক্ষকদের ভালো বেতন, সামাজিক স্বীকৃতি ও তাঁদের দেখে যেন ভালো ছাত্ররা এ পেশায় আসে, তা নিশ্চিত করতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রধান শিক্ষক। অন্য শিক্ষকদের উদ্দীপ্ত করা ও তাঁদের কাজগুলোকে সংগঠিত করার সক্ষমতা প্রধান শিক্ষকদের থাকতে হবে। অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি তাঁদের বিদ্যালয় কমিউনিটির অংশ করার উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে মেধার ভিত্তিতে প্রধান শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যবস্থাপনা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি মন্ত্রণালয়কে কত কাজ সামলাতে হয়। ৯০ হাজার বিদ্যালয়, ৫০ লাখ শিক্ষক ও লাখ লাখ শিক্ষার্থী সামলাতে হতে পারে। তাই আমলাতন্ত্রকে দক্ষ হতে হবে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশে জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হয়। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় এটা বেশ বেশি। আদর্শ পরিমাণটা কী হওয়া উচিত?
খায়েম সাভেদ্রা: এই হার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে অনেক কম। আরও অনেক দেশের তুলনায়ও বেশ কম। এটা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ সত্তরের দশকে জিডিপির ৪ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। এখন সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা উচিত। তবে এটা আদর্শ হিসাবকে বোঝায় না। প্রতিবছর শিক্ষার্থীপ্রতি কত টাকা ব্যয় করা হয়, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বছরে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় প্রায় ১৬ হাজার টাকা। এটা খুবই কম এবং এটা বাড়ানো উচিত। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখানে আরও বেশি বিনিয়োগ করবে-বিষয়টা এমন নয়। বড় বিনিয়োগটা দেশের ভেতর থেকেই করতে হবে। শিক্ষায় আরও বেশি বিনিয়োগ করা এবং ভালোভাবে করা বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষকেরা ভালোভাবে তাঁদের কাজ করছেন, অর্থ ভালোভাবে ব্যয় হচ্ছে-এটা নিশ্চিত করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শুধু কম্পিউটার-ল্যাপটপে বিনিয়োগ করলেই হবে না, শিক্ষকেরা যেন এসব যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারেন, সে জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে। নইলে টাকাটা নষ্ট হবে।
প্রথম আলো: বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে ১৭ লাখ ডলার দিচ্ছে। আপনারা কীভাবে জবাবদিহি নিশ্চিত করেন?
খায়েম সাভেদ্রা: এটা বাংলাদেশ সরকারের ও আমাদের-উভয়ের জন্যই চ্যালেঞ্জ। ব্যাংক থেকে আপনি ঋণ নিতে পারেন, কিন্তু এটা জনগণের
টাকা। আমরা দুর্নীতির কথা বলছি না, টাকাটা যথাযথভাবে ব্যয় করার কথা বলছি। নিশ্চিত করতে হবে যে যতটুকু অর্থই ব্যয় করা হোক না কেন, সেটা যেন শিক্ষার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিনিয়োগটা কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে কি না, দেশের সেই পর্যবেক্ষণব্যবস্থা থাকতে হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আলো: বাস্তবে কিন্তু দুর্নীতির সমস্যাও আছে।
খায়েম সাভেদ্রা: আমি যেহেতু মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছি, আমি জানি এটা সব সময় চ্যালেঞ্জের। আপনাদের হয়তো সঠিক নীতিমালা আছে, কিন্তু দেখতে হবে সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কি না। সব সময়ই দুর্নীতির আশঙ্কা থাকে। তাই বিরামহীনভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হবে।
প্রথম আলো: বিশ্বব্যাপী দক্ষ শ্রমশক্তির চাহিদা পূরণের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে কী বলবেন?
খায়েম সাভেদ্রা: বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে এটা চ্যালেঞ্জ। এখানে শিক্ষকদের কাজ আগের তুলনায় অনেক বেশি জটিল। আগের চ্যালেঞ্জ ছিল জ্ঞানের বিষয়ে। কিন্তু সৃজনশীল চিন্তার যোগ্যতা, সমস্যার সমাধান, দলগত কাজ ও সামাজিক-আবেগীয় দক্ষতা অর্জন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলা, অধ্যবসায় ও ভালো যোগাযোগদক্ষতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ায় সহায়তা করে। বৈশ্বিক অর্থনীতির এই অনিশ্চিত যুগে ভবিষ্যৎ শ্রমবাজারের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক চাকরি আর থাকবে না। নতুন ধরনের পেশা আসবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সেইভাবে উপযোগী করে তৈরি করতে হবে। পরিবর্তনই একমাত্র সত্য। ১০ বছর আগে কম্পিউটারের অ্যাপ ডেভেলপারদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এখন এটা লাভজনক পেশা। এটা হয়তো ১০ বছর পর না-ও থাকতে পারে এবং এই পেশার জায়গায় নতুন কিছু আসতে পারে। সেটার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের শিক্ষা খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী? সেগুলো মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার উপায় কী?
খায়েম সাভেদ্রা: শিক্ষা খাতে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা কঠিন। এই দেশে অনেক ভালো ভালো উদ্ভাবন আছে। এর একটা হলো কারিগরি শিক্ষায় নারীদের বৃত্তি দেওয়া। আমি একটা শিক্ষাকেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়েছিলাম, যেখানে যারা কখনো বিদ্যালয়ে যায়নি, দ্বিতীয় শ্রেণির পর বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে কিংবা আবার পড়াশোনা করতে চায়, তাদের দ্বিতীয়বারের মতো একটা সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। ঝরে পড়ার সংখ্যা হয়তো কম, কিন্তু শূন্য নয়। মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার সংখ্যাটা বেশ বড়, বিশেষ করে ছাত্রীদের। আরও বেশিসংখ্যক শিশুর উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করা উচিত। প্রাথমিক পর্যায়ে ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীদের সমতা একটি ভালো বিষয়। কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার অনেক বেশি। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কারিগরি ও বিশ্ববিদ্যালয়-উভয় পর্যায়ে ছেলে ও মেয়ের পড়াশোনা শেষ করার সমান সুযোগ থাকতে হবে। সমতাই মূল চ্যালেঞ্জ। শিক্ষকদের ক্যারিয়ার ও বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে কাজ করে যেতে হবে। এগুলো শিক্ষাকে দেশের উন্নয়নের শক্তিতে পরিণত করবে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
খায়েম সাভেদ্রা: ধন্যবাদ।
No comments