মাতৃভূমির মতোই মা ও ভাষা by মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ
ভাষা
হচ্ছে ভাবের বাহন, স্বপ্ন-প্রত্যাশা, আত্মপ্রকাশ ও উজ্জীবনের সেতু।
মানুষের অস্তিত্বের প্রধান তিনটি অবলম্বনই হচ্ছে মা, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমি।
মানুষের জীবন হচ্ছে তার মাতৃভাষা, দেশের ভাষা, জাতির ভাষা। ভাষা সমাজ গড়ে,
আবার সমাজও ভাষা গড়ে। তাই কোনো জাতির ভাষা তার সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিচয়
মেলে। সুতরাং মানব সমাজে ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আর এ
কারণেই রাব্বুল আলামিন মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টির সঙ্গে
সঙ্গে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন ভাষার মাধ্যমে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তিনিই সৃষ্টি
করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিক্ষা দিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে।’ (সূরা আর রহমান
: ৩-৪)। পৃথিবীতে মানব বংশের বিচিত্রতা এবং মানুষের বৈচিত্র্যময় রং, রূপ,
দেহ-সৌষ্ঠবের পার্থক্য যেমন মেনে নিতে হয়, তেমনি তাদের ভাষার পার্থক্যও
মেনে নিতে হয়। ভাষাকে আল্লাহতায়ালার মহান সত্তাকে চেনা, জানা ও তার বিশাল
কুদরতকে বোঝার নিদর্শন বলা হয়েছে। কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘এবং তার
নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও
বর্ণের বৈচিত্র্য। অবশ্যই এতে রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন।’ (সূরা রুম :
২২)। মাতৃভাষা যে আল্লাহ প্রদত্ত জন্মগত অধিকার এ আয়াতটি তার প্রমাণ বহন
করে। এ জন্য কোনো বিশেষ এলাকার মানুষদের ভাষা-বর্ণের বিচিত্রতার কারণে
তাদের অনিষ্ট করার পরিকল্পনাকারীদের ইসলাম প্রত্যাখ্যান করে। ইসলাম
নির্দিষ্ট কোনো এলাকার ভাষাভাষী মানুষদের ধর্ম নয়; বরং গোত্র-বর্ণ
নির্বিশেষে সব ভাষাভাষী মানুষের ধর্ম। হজরত আদম (আ.)-এর ভাষা কী ছিল এ
বিষয়ে মতদ্বৈধতা ও অস্পষ্টতা থাকলেও তার ভাষা ছিল এক, কিন্তু স্থান-কাল
পাত্রভেদে পরবর্তীতে বিভিন্ন ভাষার উৎপত্তি ঘটেছে। যেমন পরস্পর দুটি জাতি
বসবাস করলে তাদের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান ও চেনাজানা হয়। আর সাধারণত নিম্ন
জাতি প্রভাবশালী জাতির ভাষা কৃষ্টি, কালচারে প্রভাবিত হয়। পরাভূত জাতি যেমন
বিজয়ী-জাতির ভাষা গ্রহণ করে, তেমনি বিজয়ী-জাতিও বিজিতের ভাষা গ্রহণ করে।
এতে ভাষার সংমিশ্রণ ঘটে এবং নতুন ভাষার সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষায়ও বিভিন্ন
জাতির ভাষার শব্দের সংমিশ্রণ ঘটেছে। আর এভাবেই যুগে যুগে বিভিন্ন
জনপদে-ভূখণ্ডে অজস ভাষার উদ্ভব ঘটেছে। মায়ের সঙ্গে যেমন সন্তানের সম্পর্ক
গভীর, মাতৃভাষার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কও তেমনি গভীর। মাতৃভাষার সঙ্গে
মানুষের স্বভাবগত এবং তা একটি জন্মগত চাহিদা বটে। ইসলাম মানুষের এ স্বভাবগত
ও জন্মগত চাহিদার যথেষ্ট মূল্যায়ন করেছে। প্রত্যেক জাতির জন্য
আল্লাহতায়ালা পয়গাম বান্দাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য নবী ও রাসূলের এক
ধারাবাহিকতা সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর নানা দেশে নানা ভাষাভাষী মানুষের কাছে
এক বা দুই লাখ চব্বিশ হাজার নবী-রাসূলের এক মহাসমারোহ ঘটেছে। আর প্রত্যেক
নবী ও রাসূলের ওপর ওহি প্রেরিত হয়েছে তার স্বগোত্রীয় ভাষার মাধ্যমে। যুগে
যুগে বিভিন্ন জাতির কাছে প্রেরিত সব নবী-রাসূল নিজ নিজ উম্মতকে যে ওহির
বাণী শুনিয়েছেন তা ছিল তাদের মাতৃভাষা। কোনো একজন নবীও ভিন্ন কোনো ভাষায়
মানুষকে ধর্মের প্রতি আহ্বান জানাননি।
এ কারণেই প্রত্যেক নবী-রাসূলের ভাষা
ছিল তাদের কওমের তাদের অঞ্চলের মাতৃভাষা। মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘আমি
প্রত্যেক রাসূলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যেন তারা তাদের
সম্প্রদায়ের কাছে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে।’ (সূরা ইবরাহিম : ০৪)।
নবী ও রাসূলরা যদি সুকৌশলে মানুষকে আল্লাহর পথে নিজ মাতৃভাষায় আহ্বান না
করতেন তা হলে জনসাধারণ তা পূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করতে পারত না। কেননা
আহ্বানকারী যদি এক ভাষার হন, আর তার জাতি হয় ভিন্ন ভাষাভাষী, তবে তার ডাকে
কেউই সাড়া দেবে না। আমাদের আদর্শ ও মানবজাতির পথ নির্দেশক মহানবী (সা.)
ছিলেন স্বীয় মাতৃভাষায় অতুলনীয়। তিনি বলেছেন, ‘আমাকে দান করা হয়েছে
সর্বমর্মী বচন।’ (মুসলিম : ৫২৩)। কাব্যানুরাগী আরব সমাজে আবির্ভূত রাসূল
(সা.) ছিলেন আরবদের সবচেয়ে বিশুদ্ধভাষী। তিনি মাতৃভাষা শুদ্ধ এবং
সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতেন। তাই মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে বলা আমাদের নবীর
সুন্নত। সুতরাং যে কোনো জাতির মাতৃভাষা অশুদ্ধভাবে উচ্চারণ করা সুন্নতের
পরিপন্থী। হয়তো কেউ কেউ বলবেন রাসূল (সা.) যেহেতু আরবি ভাষী এবং কোরআনের
ভাষা আরবি, তাই ভাষা অশুদ্ধ বলা সুন্নতের বরখেলাফ, অন্য ভাষাগুলো অশুদ্ধ
বলা সুন্নতের পরিপন্থী নয়, এটা একদম সঠিক নয়। কেননা, প্রিয়নবী (সা.) ডান
হাত দিয়ে আরবের ফল খেজুর খেয়েছেন। এখন কেউ যদি বলে বাম হাত দিয়ে খেজুর
খাওয়া সুন্নতের পরিপন্থী, কিন্তু আম, জাম, লিচু কাঁঠাল ইত্যাদি বাম হাত
দিয়ে খেলে সুন্নতের বরখেলাপ নয়, তবে তা ভুল হবে। মহানবী (সা.) হলেন আরবি।
মাতৃভাষাকে তিনি এত বেশি ভালোবাসতেন যে, তিনি নিজেই বলেছেন, আমি তিনটি
কারণে আরবিকে ভালোবাসি। এর একটি হল, মাতৃভাষার কারণে। রাসূল (সা.)-এর
মাতৃভাষা আরবি বলেই রাব্বুল আলামিন কোরআনের ভাষা হিসেবে মনোনীত করেছেন
আরবিকে। যেন আরব সমাজের প্রতিটি মানুষ কোরআনের বাণী অতি গ্রহণ করতে পারে।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী! কোরআনকে আমি তোমার নিজের ভাষায় সহজ করে
অবতীর্ণ করেছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে। (আদ দোখান : ৫৮)। প্রখ্যাত
সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুন বলেন, ‘প্রত্যেকেরই শিক্ষার মাধ্যম তার মাতৃভাষা
হওয়া উচিত। অপর ভাষায় শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষাদান অসম্পূর্ণ শিক্ষারই
নামান্তর।’ সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) বলেন, ‘কোনো দেশে দ্বীনি খেদমত
করতে অগ্রহী ব্যক্তিকে সে দেশের মানুষের ভাষা ও সাংস্কৃতিক বোধ পূর্ণ
মাত্রায় আয়ত্ত করতে হবে।’ হজরত আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.) তার এক ছাত্রকে
উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, ‘যদি হিন্দুস্তানে দ্বীনি খেদমত করতে চাও, তবে উর্দু
ভাষায় যোগ্যতা অর্জন কর।’ এমনি আরও অসংখ্য উক্তি পাওয়া যায় মাতৃভাষার
সপক্ষে। সুতরাং মাতৃভাষার প্রতি আমাদের প্রেম ও ভালোবাসা থাকতে হবে একান্ত
করে।
লেখক : শিক্ষক, বাইতুন নূর মাদ্রাসা ঢাকা
ahmadabdullah7860@gmail.com
লেখক : শিক্ষক, বাইতুন নূর মাদ্রাসা ঢাকা
ahmadabdullah7860@gmail.com
No comments