বিশ্ব অর্থনীতির ঝুঁকিপূর্ণ পুনরুদ্ধার by জোসেফ ই স্টিগলিৎস
এক বছর আগে আমি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম, ২০১৭ সালের সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক
হবে অনিশ্চয়তা। এই অনিশ্চয়তার অন্যান্য কারণের মধ্যে একটা হবে ডোনাল্ড
ট্রাম্পের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া, আর একটা কারণ হবে ইউরোপীয়
ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট। অনিশ্চয়তাকেই একমাত্র
নিশ্চয়তা মনে হয়েছিল, মনে হয়েছিল ভবিষ্যৎটা খুবই গোলমেলে হবে। দেখা
গেল, ২০১৭ সালটা খুব ভালো ছিল না, তবে যতটা খারাপ হবে বলে অনেকে আশঙ্কা
করেছিলেন, ততটা খারাপও গেল না। যেমনটা ধারণা ছিল, ট্রাম্পের বাগাড়ম্বর ও
খামখেয়ালিপনা যথেষ্টই দেখা গেল। যাঁরা তাঁর ক্ষান্তিহীন টুইটার বার্তাগুলোর
দিকে লক্ষ রেখেছেন, তাঁরা ভাবতে পারেন যে যুক্তরাষ্ট্র বুঝি বাণিজ্যযুদ্ধ
আর পরমাণুযুদ্ধের মাঝখানে টলোমলো করছে।
ট্রাম্প একদিন সুইডেনকে তিরস্কার
করলেন তো আরেকদিন অস্ট্রেলিয়াকে, তারপর ইউরোপীয় ইউনিয়নকে। তারপর সমর্থন
জানালেন নিজের ঘরের নয়া নাৎসিবাদীদের প্রতি। আর তাঁর ধনিকগোষ্ঠী-নিয়ন্ত্রিত
মন্ত্রিসভার সদস্যরা নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধি, অদক্ষতা-অযোগ্যতা ও স্রেফ
নোংরামির প্রতিযোগিতায় একে অপরকে টেক্কা দিয়ে চলেছেন। উদ্বেগজনকভাবে
কিছু রেগুলেটরি পশ্চাদপসরণ লক্ষ করা গেছে, বিশেষত পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে।
ঘৃণাতাড়িত কর্মকাণ্ডের কথা না-ই বা বললাম, যেগুলোর পেছনে ট্রাম্পের
গোঁড়ামিপূর্ণ অবস্থানের প্রণোদনা ছিল। তবে এ পর্যন্ত আমেরিকান
প্রতিষ্ঠানসমূহ ও ট্রাম্প প্রশাসনের অদক্ষতা মিলিয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি
হয়েছে, তাতে সৌভাগ্যবশত প্রেসিডেন্টের কদর্য বাগাড়ম্বর ও বাস্তবে যা করা
হয়েছে, তার মধ্যে বিরাট ফারাক দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতির জন্য
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কোনো বাণিজ্যযুদ্ধ বেধে যায়নি। বাণিজ্য
আলোচনাগুলো থেমে যাওয়া সত্ত্বেও নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্টের
(নাফটা) ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা অনেকটাই কমে গেছে; মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্রের
মুদ্রাবিনিময় হারকে মানদণ্ড ধরলে সেটা বোঝা যায়।
কিন্তু ট্রাম্পের
উল্টাপাল্টা কথাবার্তা ও কাণ্ডকীর্তি থামছে না: বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়
ট্রাম্প যে হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়ে দিয়েছেন, সেটা ২০১৮ সালে শেষ পর্যন্ত
ফাটতে পারে। মার্কিন শেয়ারবাজারের রেকর্ড মাত্রার চাঙা অবস্থাকে কেউ
কেউ ট্রাম্পের অর্থনৈতিক মিরাকলের প্রমাণ হিসেবে দেখাতে চাইছেন। আমার মনে
হয়, এ থেকে অংশত এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে মহামন্দা কাটিয়ে ওঠার যে প্রক্রিয়া
এক দশক ধরে চলে আসছে, শেষ পর্যন্ত তা স্থিতিশীল হচ্ছে। প্রতিটি পতনেরই শেষ
আছে, এমনকি গভীরতম পতনেরও শেষ আছে। ট্রাম্প ভাগ্যবান এই অর্থে যে তিনি এই
সময়ে হোয়াইট হাউসে আছেন এবং তাঁর পূর্বসূরিদের কাজের সুফল পাচ্ছেন। কিন্তু
আমি এটাকে বাজারে অংশগ্রহণকারীদের অদূরদর্শিতারও প্রমাণ মনে করি। কর
হ্রাসের সম্ভাবনায় তারা এই ভেবে উল্লসিত যে ২০০৭ সালের আগের অবস্থা ফিরিয়ে
আনা গেলে এই অর্থ আবারও শেয়ারবাজারে যাবে। ২০০৮ সালের পর যা ঘটেছিল—৭৫
বছরের মধ্যে সবচেয়ে গভীর মন্দা, বাজেট ঘাটতি এবং অতি ধনীদের কর হ্রাসের ফলে
ক্রমবর্ধমান অসমতা—এগুলো তারা আমলে নিচ্ছে না। ট্রাম্পের সুরক্ষানীতির ফলে
যে ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে, তা তারা আমলে নিচ্ছে না। এবং তারা দেখছে না যে
ট্রাম্প প্রশাসনের ঋণ করে কর হ্রাস যখন কার্যকর হবে, তখন আমেরিকার
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে দেবে, যার ফলে অর্থবাজারে পরিবর্তন শুরু
হয়ে যাবে। অন্যকথায়, আবার দেখা যাচ্ছে যে বাজার স্বল্প মেয়াদে
চিন্তা করতে ভালোবাসে এবং বিশুদ্ধ লোভ দ্বারা তাড়িত হয়। আমেরিকার
দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক কর্মসম্পাদনের পক্ষে এসবের কোনোটাই ভালো ইঙ্গিত দেয়
না। এবং মনে হয়, যদিও ২০১৮ সাল ২০১৭ সালের চেয়ে ভালো যাবে, তবু সামনে আরও
বড় ধরনের ঝুঁকি রয়ে গেছে। ইউরোপের চিত্রও একই রকমের। ইউরোপীয় ইউনিয়ন
থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার ফলে অর্থনীতিতে সে রকম প্রভাব পড়েনি, যে
রকম এর বেরিয়ে যাওয়ার বিরোধিতাকারীরা আশঙ্কা করেছিলেন। তার কারণ ব্রিটিশ
পাউন্ডের অবমূল্যায়ন। কিন্তু এটা ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে উঠছে যে যুক্তরাজ্যের
বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি কীভাবে মোকাবিলা করা হবে বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে
ব্রেক্সিট-পরবর্তী যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক কী হবে, সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী
থেরেসা মের সরকারের পরিষ্কার কোনো দৃষ্টি নেই। ইউরোপের
জন্য দু-দুটো ঝামেলার সম্ভাবনা আছে। একটা ঝুঁকি হলো, সুদের হার যখন
নিশ্চিতভাবেই স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসবে, তখন ইতালির মতো ব্যাপকভাবে
ঋণগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য সংকট এড়ানো কঠিন হবে। আসলে ভবিষ্যতে কিছু সময়ের
জন্য ইউরোজোনের পক্ষে রেকর্ড মাত্রায় নিম্ন সুদের হার অর্জন করা সম্ভব,
এমনকি যদি যুক্তরাষ্ট্রে তা বাড়েও।
হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড ইউরোপের জন্য আরও বড় অস্তিত্ববাদী সংকট হিসেবে দেখা দিতে পারে। ইউরোপীয়
ইউনিয়ন একটা সুবিধাজনক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছাড়া কিছু নয়। এতে কতগুলো দেশের
ঐক্যের প্রতিনিধিত্ব আছে, মৌলিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোর প্রতি যাদের
অঙ্গীকার আছে। কিন্তু হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড এখন সেই মূল্যবোধগুলোকে দাম
দিচ্ছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরীক্ষা চলছে এবং বেশ ভালো আশঙ্কা আছে যে এই
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঘাটতি বের হবে। এ বছরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এসব
রাজনৈতিক পরীক্ষার প্রভাব খুব বড় হবে না বটে, তবে এর দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকিগুলো
পরিষ্কার ও গুরুতর। পৃথিবীর অন্য পাশে, চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন
পিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের ফলে ইউরেশিয়ার অর্থনৈতিক ভূগোল বদলে
যাচ্ছে। চীন চলে যাচ্ছে একদম কেন্দ্রে এবং অঞ্চলভিত্তিক প্রবৃদ্ধির জন্য
গুরুত্বপূর্ণ প্রণোদনা সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু চীনের সামনেও অবশ্যই অনেক
চ্যালেঞ্জ আছে। কারণ, সে রপ্তানিভিত্তিক প্রবৃদ্ধি থেকে অভ্যন্তরীণ
চাহিদাভিত্তিক প্রবৃদ্ধির দিকে, ম্যানুফ্যাকচারিং অর্থনীতি থেকে
সেবাভিত্তিক অর্থনীতির দিকে এবং গ্রামীণ থেকে শহুরে সমাজে রূপান্তরের এক
জটিল প্রক্রিয়া শুরু করেছে। চীনে মানুষের বয়স বাড়ছে দ্রুত; অর্থনৈতিক
প্রবৃদ্ধি লক্ষণীয়ভাবে ধীরগতি লাভ করেছে। কিছু হিসাবে চীনে অসমতা
যুক্তরাষ্ট্রে অসমতার প্রায় সমান মাত্রায় প্রকট। আর প্রাকৃতিক পরিবেশের
অবক্ষয়ের ফলে মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনমানের ঝুঁকির মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। গত
চার দশকে চীনে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সাফল্যের আংশিক ভিত্তি এমন একটা
ব্যবস্থা, যেখানে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনা রাষ্ট্রের মধ্যে ব্যাপক
আলোচনার মাধ্যমে কতকগুলো সংস্কার শুরু করা হয়েছিল এবং প্রতিটি সংস্কারের
ক্ষেত্রেই উভয়ের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ছিল। সি চিন পিং যেভাবে নিজের হাতে ক্ষমতা
কেন্দ্রীভূত করেছেন, তা কি আকার ও জটিলতায় এমনভাবে বেড়ে ওঠা অর্থনীতির
জন্য ইতিবাচক হবে? চীনের মতো সুবৃহৎ ও জটিল অর্থবাজারের পক্ষে কেন্দ্রীভূত
নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আবার একই সঙ্গে আমরা জানি, অর্থবাজার
পরিচালনায় ঘাটতি থাকলে সেখানকার অর্থনীতি কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে। অবশ্য
এই সবগুলোই দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি। ২০১৮ সালের জন্য বলা যেতে পারে, চীন তার পথ
সামলেই এগোবে, যদিও প্রবৃদ্ধি আরও একটু কমে যেতে পারে। সংক্ষেপে যা
বলতে চাই, উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর ২০০৮-পরবর্তী মন্দা যখন দূর অতীতে
মিলিয়ে যাচ্ছে, তখন ২০১৮ সালে বৈশ্বিক সম্ভাবনা ২০১৭ সালের চেয়ে ভালো মনে
হচ্ছে। রাজস্ব কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি থেকে অধিকতর প্রণোদনামূলক অবস্থানের দিকে
সরে আসার ফলে অতিমাত্রায় কঠোর মুদ্রানীতির প্রয়োজনীয়তা কমে আসবে, আর এ রকম
মুদ্রানীতি শুধু যে অর্থবাজারেই বিকৃতিমূলক প্রভাব রাখে তা নয়, প্রকৃত
অর্থনীতিরও ক্ষতি করে। কিন্তু চীনে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, ইউরোজোনের
ত্রুটিপূর্ণ কাঠামো সংস্কারে ব্যর্থতা (এ পর্যন্ত) এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
যেটা, আন্তর্জাতিক আইনের শাসনের প্রতি ট্রাম্পের ঘৃণা, যুক্তরাষ্ট্রের
বৈশ্বিক নেতৃত্বের প্রতি তাঁর প্রত্যাখ্যান এবং তিনি গণতন্ত্রের যে ক্ষতি
করছেন—এই সমস্ত কিছুই আরও গভীর সব ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে। ঝুঁকিগুলো শুধু
বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্যই নয়, বিশ্বব্যাপী বৃহত্তর গণতন্ত্রের জন্যও বটে।
আমাদের ক্ষণস্থায়ী সাফল্যে তৃপ্ত হলে চলবে না।
জোসেফ ই স্টিগলিৎস: নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ; যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও রুজভেল্ট ইনস্টিটিউটের প্রধান অর্থনীতিবিদ।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডেকেট
অনুবাদ: মশিউল আলম
জোসেফ ই স্টিগলিৎস: নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ; যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও রুজভেল্ট ইনস্টিটিউটের প্রধান অর্থনীতিবিদ।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডেকেট
অনুবাদ: মশিউল আলম
No comments