বছরজুড়েই আদালতে খালেদা জিয়ার হাজিরা
বিএনপি
চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ২০১৭ সালে
বিপুলসংখ্যক মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে। কখনো গ্রেফতারি পরোয়ানা
এড়াতে, কখনো জামিন নিতে, আবার কখনো হাজিরা দিতে তাকে আদালতের দ্বারস্থ হতে
হয়েছে। আইনজীবীদের অভিযোগ, খালেদা জিয়াকে মামলা দিয়ে ধাওয়া করা হচ্ছে। তিনি
নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাচ্ছেন না। তারপরও মাথা ঠাণ্ডা রেখে তিনি এই মামলা
লড়ছেন। বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা রয়েছে। এসব মামলার
মধ্যে রয়েছে জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা,
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা, মিরপুর, গুলশান, বাড্ডা, দারুস সালাম, যাত্রাবাড়ী
থানায় পুলিশের দায়ের করা মামলা এবং বড়পুকুরিয়া, নাইকো ও গ্যাটকো মামলা। এসব
মামলায় বছরজুড়ে বিভিন্ন আদালতে খালেদা জিয়াকে হাজিরা দিতে হয়েছে। ডিসেম্বর
মাসের শেষ দুই সপ্তাহে তিন দিন করে খালেদা জিয়াকে জিয়া অরফানেজ ও জিয়া
চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় হাজিরা দিতে হয়েছে। গত ১৯, ২০, ২১ ও ২৬, ২৭ ও ২৮
ডিসেম্বর সপ্তাহে তিন দিন করে আদালতে হাজিরা দেন খালেদা জিয়া। এ ছাড়া এই
তারিখগুলোতে তাকে সকাল থেকে বেলা ৩টা বা ৪টা পর্যন্ত আদালতে অবস্থান করতে
হয়। এই দুই মামলায় সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে দুই বার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি
করা হয়। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার পর তিনি আদালতে হাজির হয়ে জামিন নেন।
এ
ছাড়াও এ মামলায় শুধু ধার্য তারিখ পর্যন্ত তাকে জামিন দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে
এই দুই মামলায় বিচারকার্যক্রম শেষপর্যায়ে রয়েছে। চূড়ান্তপর্যায়ে খালেদা
জিয়ার পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন চলছে। ৩ ও ৪ জানুয়ারি এই জিয়া অরফানেজ
মামলায় খালেদা জিয়ার পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন ধার্য করা হয়েছে। এ
দুই মামলায় বছরে ২৩ দিন আদালতে হাজিরা দিয়েছেন খালেদা জিয়া। বছরের শেষ
হাজিরা তিনি দিয়েছেন ২৮ ডিসেম্বরে। বছরের শুরুতে ৫ জানুয়ারি এ দুই মামলায়
বছরের প্রথম হাজিরা দেন বেগম খালেদা জিয়া। গত ৫ ডিসেম্বর জিয়া অরফানেজ
ট্রাস্ট মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে খালেদা জিয়ার বক্তব্য শেষ হয়। ওই দিন
খালেদা জিয়া বলেন, আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার
১৩৫ নম্বর আয়াতের বাংলা তরজমা দিয়ে। তরজমা : ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের
ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্য দান করো, তাতে
তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্মীয়স্বজনের যদি ক্ষতি হয়
তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাক্সক্ষী
তোমাদের চেয়ে বেশি। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরণ
করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলো কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে
আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজকর্ম সম্পর্কেই অবগত।’ আত্মপক্ষ সমর্থন করে তিনি
আদালতে বলেছিলেন, আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং এ মামলায় বেকসুর খালাস পাওয়ার
যোগ্য। আমি এই মিথ্যা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছি এবং আপনার আদালতে
ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করছি। শেষপর্যায়ে থাকা এ মামলার যুক্তি উপস্থাপনে
খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলেন, জিয়া অরফানেজের টাকা তসরুপ বা আত্মসাৎ হওয়ার
কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। ঘষামাজা করা ও স্বাক্ষরবিহীন কাগজ দিয়ে মামলা তৈরি
করা হয়েছে। সব সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা যায়, এই মামলায় এক পয়সাও তসরুপ হয়নি।
খালেদা জিয়া কোনো অ্যাকাউন্ট খোলেননি। তাহলে সাজা দিতে হবে কেন? তারা বলেন,
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আনা কোনো অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ
কেস প্রমাণ করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। রেজাক খান মামলা থেকে তাকে
খালাস দিতে আদালতের কাছে আবেদন জানান। গত ১৯ ডিসেম্বর থেকে জিয়া অরফানেজ
ট্রাস্ট মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়েছে। খালেদা জিয়ার পক্ষে মামলার
যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করছেন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, আবদুর রেজাক খান
এবং এ জে মোহাম্মদ আলী। এরপর ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার এ মামলায়
যুক্তি উপস্থাপন করবেন। অন্য দিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় আগামী ৩১ জানুয়ারি আদেশের দিন ধার্য রয়েছে। গত ২১
ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর হাকিম আবদুল্লাহ আল মাসুদ আদেশ না দিয়ে ৩১ জানুয়ারি
আদেশের দিন ধার্য করেন। গত ১ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা
মশিউর মালেক ঢাকা মহানগর হাকিম আবদুল্লাহ আল মাসুদের আদালতে খালেদা জিয়ার
বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেন। আইনজীবীরা জানান, গত ১২
অক্টোবর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগে করা মামলায় গ্রেফতারি
পরোয়ানা জারি করেন ঢাকা মহানগর হাকিম নূর নবী। একই দিন জিয়া অরফানেজ
ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রস্ট মামলায় আদালতে হাজির না হওয়ায় তার
বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন পুরান ঢাকার বকশিবাজারে কারা
অধিদফতরের প্যারেড মাঠে স্থাপিত ঢাকার পাঁচ নম্বর বিশেষ জজ ড. মো:
আকতারুজ্জামানের আদালত। এর আগে গত ৯ অক্টোবর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার
বাসে পেট্রল বোমা হামলায় আটজনকে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলায়
খালেদা জিয়াসহ পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন
আদালত। পুলিশের দেয়া অভিযোগপত্র গ্রহণ করে কুমিল্লার জেলা ও দায়রা জজ
জেসমিনা বেগম এ আদেশ দেন। এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী খন্দকার
মাহবুব হোসেন বলেন, বেগম খালেদা জিয়া দেশের রাজনৈতিক গগনে ধ্রুব তারা। তার
বিরুদ্ধে এসব মামলা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হবে। মামলা দিয়ে তাকে ধাওয়া
করা হচ্ছে। তিনি নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাচ্ছেন না। তারপরও মাথা ঠাণ্ডা রেখে
তিনি এই মামলা লড়ছেন। তিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। দেশের মানুষের কাছে
সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী। সেই নেত্রীকে এভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে। এর বিচার
জনগণ করবে। খালেদা জিয়ার অপর আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, নাশকতার
অভিযোগে যেসব মামলায় পুলিশ বাদি হয়েছে ওইসব মামলার সময় পুলিশের দ্বারাই
অবরুদ্ধে ছিলেন খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক দফতরে। এর থেকে বোঝা যায়, এসব
মামলা কাল্পনিকভাবে তৈরি। বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে অনীত দুর্নীতি, রাষ্ট্রদ্রোহ
ও নাশকতার মামলা অন্য কারো ইঙ্গিতে সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব মামলার
বিষয়বস্তু যেমন অসত্য, তেমনই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
No comments