আসামে নাগরিকত্ব নিয়ে আতঙ্ক
নতুন
বছরের প্রথম দিনেই অনিশ্চয়তার কবলে পড়েছেন ভারতের আসাম রাজ্যের ১ কোটি ৩৯
লাখ লোক। নাগরিকত্বের জাতীয় নিবন্ধনের (এনআরসি) খসড়া তালিকায় তাদের কারও
নাম নেই। ইতিমধ্যেই তালিকায় নাম না থাকায় এক মণিপুরি মুসলিম আত্মহত্যা
করেছেন। তালিকায় ১ কোটি ৯০ লাখ লোকের নাম ঠাঁই পেলেও বাদ পড়েছেন রাজ্যের
চার বিধায়কসহ সাবেক মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট নাগরিকেরা। বাদ পড়া
বিশিষ্টজনদের মধ্যে রয়েছেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য তপোধীর
ভট্টাচার্য, আসাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ-এর মালিক-সম্পাদক
তৈমুর রাজা চৌধুরী প্রমুখ। ভারতীয় সময় গত রোববার মধ্যরাতে তালিকা প্রকাশের
পর রাজ্যজুড়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে নাগরিকদের
নিবন্ধন না হলেও শুধু আসামেই তা করা হলো। বিজেপি শাসিত আসাম রাজ্য সরকারসহ
সেখানকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভিযোগ, আসামে প্রচুর বাংলাদেশির অনুপ্রবেশ
ঘটেছে। আর বিজেপি গত বছরের মে মাসে রাজ্য সরকার গঠনের পর থেকে
অনুপ্রবেশকারীরা স্থানীয় হিন্দুদের কর্মসংস্থান নষ্ট করছে দাবি করে ‘অবৈধ’
মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেয়। তাই বিদেশিদের শনাক্ত করতেই
সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণে শুরু হয় এনআরসি তালিকা প্রস্তুতি। তালিকা
প্রকাশকে ঘিরে তাই আতঙ্কে ছিল মুসলমান-অধ্যুষিত বরপেটা, দুবরি, করিমগঞ্জ,
কাছাড়সহ বিভিন্ন জেলার বাসিন্দারা। রাজ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে
পড়ার আশঙ্কাও তৈরি হয় তালিকা প্রকাশকে ঘিরে। ভারতের রেজিস্ট্রার জেনারেল
শৈলেশ সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে তালিকা প্রকাশের সময় বলেন, চলতি বছরেই
পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশিত হবে। রাজ্যের ৩ কোটি ২৯ লাখ মানুষ নাগরিকত্বের
জন্য আবেদন করে। এর মধ্যে মাত্র ১ কোটি ৯০ লাখের নাম প্রথম তালিকায় রয়েছে।
অন্যদের নাম যাচাইয়ের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে। এনআরসির রাজ্য সমন্বয়ক প্রতীক
হাজেলার বরাত দিয়ে পিটিআই জানায়, প্রথম দফায় যাদের নাম বাদ পড়েছে, তাদের
উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। নাম যাচাইয়ের ক্ষেত্রে জটিলতা থাকায় এক পরিবারের
কোনো কোনো সদস্যদের নাম প্রথম তালিকা থেকে বাদ গেছে। যাচাইয়ের প্রক্রিয়া
যেহেতু এখনো শেষ হয়নি, তাই তালিকা থেকে যারা বাদ পড়েছে, তাদের উদ্বিগ্ন
হওয়ার কোনো কারণ নেই। আসামের লোকজনের নাগরিকত্ব নিবন্ধনের প্রক্রিয়াটি শুরু
হয় ২০১৫ সালের মে মাসে। বছরের প্রথম দিনই কাছাড় জেলার কাশীপুরে মণিপুরি
মুসলিম হানিফ খান (৪৫) আত্মহত্যা করেন। পুলিশ মুখে কুলুপ আঁটলেও স্থানীয়
ব্যক্তিদের অভিযোগ, এনআরসিতে নাম থাকায় হতাশা থেকে আত্মহত্যা করেছেন হানিফ।
হানিফের মতো আত্মহত্যার রাস্তা বেছে না নিলেও বহু মানুষ রাজ্য ছাড়তে শুরু
করেছেন।
অবশ্য আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল গুয়াহাটিতে
সাংবাদিকদের বলেন, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। দ্বিতীয় তালিকায় বৈধ নাগরিকদের
নাম থাকবে। তবে বিজেপির রাজ্য সভাপতি রঞ্জিত কুমার দাস গতকাল সাংবাদিকদের
বলেন, ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত আসামে আসা হিন্দুরা নিশ্চিন্ত। তবে ‘বিদেশি’
মুসলিমদের রাজ্য ছাড়তে হবে। প্রয়োজনে ভারতের অন্য রাজ্যে ‘বাংলাদেশি
মুসলিমদের’ আশ্রয় নিতে হবে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। বিজেপিরই জোট শরিক
আসাম গণপরিষদের রাজ্য সভাপতি অতুল বরার দাবি, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর
যাঁরাই আসামে অনুপ্রবেশ করেছে, জাতি-ধর্মনির্বিশেষে তাঁদের রাজ্য ছাড়তে
হবে। কংগ্রেস অবশ্য মনে করে, আসামে বিদেশি শনাক্তকরণের নামে সংখ্যালঘুদের
নির্যাতন করছে বিজেপি। রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা তরুণ গগৈ
সাংবাদিকদের কাছে আগেই দাবি করেছেন, আসামে একজনও বাংলাদেশি নেই। আসামে
এনআরসি নিয়ে চলমান উত্তেজনার মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো, অল আসাম
স্টুডেন্টস ইউনিয়নের (এএএসইউ) নেতা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্যের পরিবারের কয়েকজন
সদস্যের নাম বাদ পড়া। এনআরসির প্রথম খসড়া প্রকাশকে অবৈধ অভিবাসীদের ঠেকাতে
আসামের জন্য ঐতিহাসিক মুহূর্ত আখ্যা দিয়ে তিনি তালিকাকে স্বাগত জানান।
আসামের নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক সাধন পুরকায়স্থ শিলচর থেকে মুঠোফোনে
প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবাই খ্রিষ্টীয় নববর্ষ পালন করলেও আসামের বাঙালিদের
কোনো আনন্দ নেই। নতুন বছর আমাদের কাছে অশুভ বার্তা বয়ে এনেছে। ৭০ শতাংশ
বাঙালির নাম বাদ পড়েছে।’
No comments