এক সাগর মেঘের দেশে
পাহাড়, মেঘের বাড়ি! মন তো ছুটে যাবেই। গিয়েছিলাম রাঙামাটির সাজেক ভ্যালিতে। কোথাও গেলে দল বেঁধেই যাই। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু এবার যাওয়াটা ছিল একটু ভিন্ন। দলের সবার সঙ্গে আগে সামনাসামনি কখনো দেখা হয়নি। ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় পরিচয়। লোকে বলে, ভার্চ্যুয়াল জগতের মানুষ আর আসল মানুষ নাকি ভিন্ন দুই সত্তা। কেবল ফেসবুকের গ্রুপে সামান্য পরিচয় ভরসা করে পাহাড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত! অনেকে বলেছিল বোকামি। সঙ্গী মনমতো না হলে ভ্রমণের আনন্দটাই তো মাটি। সাজেক ঘুরে এসে শেষ কথাটা সবার আগে বলতে ইচ্ছে করছে, এ রকম ‘বোকামি’ বারবার করতে চাই। পরিকল্পনাটা করেছিলাম বাধ্য হয়েই। কাছের বন্ধুদের সঙ্গেই যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এর ছুটি মেলে তো ওর মেলে না। শেষমেশ বিকল্প হিসেবেই ফেসবুকের ভ্রমণ গ্রুপগুলোতে খোঁজ নেওয়া। একটা গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ হলো। যাদের আয়োজনে ১৩ জনের একটা দল সাজেকে যাচ্ছে। ভিড়ে গেলাম সেই দলে। তবে টিকিট কাটা, কটেজ ভাড়া করা, খাবারদাবার—সব নিয়ে বেশ টেনশনই হচ্ছিল। সঙ্গী হিসেবে আমার স্ত্রী আয়েশাও যাচ্ছে, ফলে চিন্তাটা একটু বেশিই। জিজ্ঞেস করতেই ওই গ্রুপের অ্যাডমিন বললেন, আপনাকে কোনো চিন্তা করতে হবে না। শুধু টাকা দেবেন। আমরাই সব করে দেব। টিকিট থেকে শুরু করে থাকা-খাওয়া সবই। এরপর এসে গেল সেই দিন। রাতে বাস ছাড়ল ঢাকার ফকিরাপুল থেকে।
ভোরে খাগড়াছড়ি পৌঁছালাম যখন, চোখেমুখে রাজ্যের ক্লান্তি। ঘুম ভেঙে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে হকচকিয়ে গেলাম। আমরা কয়েক শ ফুট ওপরে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। মিনিট কয়েক পরপর প্রায় ৯০ ডিগ্রি বাঁক। গা কাঁটা দিয়ে উঠছিল। উত্তেজনাও বোধ হচ্ছিল। যখন খাগড়াছড়ি শহরে পৌঁছালাম, তখন সকাল নয়টা। দলনেতা বললেন, আমরা রওনা দেব ঠিক ১০টায়। চাঁদের গাড়িতে। বলে রাখা ভালো প্রশাসনিক মানচিত্রে সাজেকের অবস্থান রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় হলেও খাগড়াছড়ি শহর থেকে যেতে হয়। তখন মাথায় শুধুই ঘুরছিল পাহাড় আর মেঘ। আমার স্ত্রী আর আমার জায়গা হলো চাঁদের গাড়ির সামনের আসনে। শহরের ইট-দালানের ঘোর কাটিয়ে শুরু হলো পাহাড়ি বনাঞ্চল। ৩০ মিনিট পর আমরা প্রবেশ করলাম এক অন্য পৃথিবীতে। ধুলো নেই, নেই শহুরে কোলাহল। সবুজের দেশ, কুয়াশার দেশ; যেন এক টুকরো স্বর্গোদ্যান। সর্পিল গতিতে কখনো ডানে তো কখনো বাঁয়ে চলছে গাড়ি। কখনো ১০০ ফুট উঁচুতে তো কখনো ১০০ ফুট নিচে নামছে। যেন গাড়ি না, কোনো রোলারকোস্টারে যেন চড়ে বসেছি আমরা। আগে কখনো পাহাড়ে যাইনি বলে পুরো যাত্রাপথটাই আমার কাছে ছিল রোমাঞ্চের। সেই ঘোর নিয়েই দুপুরে পৌঁছালাম মেঘের দেশ সাজেক ভ্যালিতে। দুপুরে খেলাম মুরগি-ভাত। লুসাইদের প্রচলিত পাহাড়ি বাঁশের তরকারি। সঙ্গে ঘন ডাল। তবে যাঁরা মরিচ কম খান তাঁরা একটু সাবধান। পাহাড়ি মরিচে ঝাল বেশি! একটু জিরিয়ে নিয়ে বেলা তিনটার দিকে রওনা হলাম কংলাকপাড়া দেখতে। দুই হাজার ফুটেরও বেশি উচ্চতার কংলাক পাহাড়চূড়া থেকে সূর্যাস্ত দেখাটাই উদ্দেশ্য। এবার আর গাড়ি নয়; নিজের পাজোড়াই ভরসা। ১৫ মিনিট ট্র্যাকিং করে পৌঁছালাম পাহাড়চূড়ায়। পাহাড়ি মিষ্টি পেঁপের অভ্যর্থনা পেলাম। বিক্রি করছেন স্থানীয় লোকজন। দামও বেশি নয়। পেঁপে খেয়ে কিছুক্ষণ ছবি তুললাম। সবাই মিলে সূর্যাস্ত উপভোগ করলাম। সে রাত ছিল পূর্ণিমার। এবার গন্তব্য সাজেক ভ্যালির হেলিপ্যাড। হেলিপ্যাডে বসেই পূর্ণিমার চাঁদ উপভোগ করা। ফিরতে ফিরতেই চাঁদ আলো দিতে শুরু করেছিল। সেখানে সবাই মিলে গোল হয়ে বসলাম। এতক্ষণে এসে সবার সঙ্গে সবার পরিচয় হওয়ার সুযোগ মিলল। এর আগে সবাই একসঙ্গে গান গেয়েছি। কবিতা আবৃত্তি করেছি। কিন্তু ঘটা করে পরিচিত হওয়াটাই হয়নি। পরিচিতি পর্বে জানা গেল কেউ প্রকৌশলী, কেউ বেসরকারি চাকরিজীবী, কেউ চালাচ্ছেন নিজের প্রতিষ্ঠান। কেউবা ব্যাংকার।
সবাই শুধু ভিন্ন ভিন্ন পেশারই না, ভিন্ন ভিন্ন জেলারও অধিবাসী। পেয়ে গেলাম একজন বিদেশিও। শুভায়্যু বিশ্বাস এসেছিলেন কলকাতা থেকে! আমাদের দলে ছিল আরও চার দম্পতি। সবাই উপভোগই করলাম পূর্ণিমাস্নাত রাতে ফানুস ওড়ানো। রাতে খেলাম বাঁশে রান্না করা মুরগি। বিশেষভাবে রান্না করা ডাল ও আলুভাজা। খেয়ে সবাই বেশ ক্লান্ত ছিলেন। অনেকেই ঘুমোতে চললেন। আয়েশাকে বললাম, ঘুমোলেই রাত কেটে যাবে। এই চাঁদমাখা সাজেক মিস করব? সঙ্গে পেলাম শাহিন ভাই ও তাঁর স্ত্রী মৌরীকে। কটেজ থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের হেলিপ্যাডের উদ্দেশে রওনা হলাম। সেখানে প্রায় আরও দুই ঘণ্টা আড্ডা দিয়ে কটেজে ফিরে ঘুম। অ্যালার্ম আর মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙতেই দেখি আমাদের ঘর ধোঁয়াচ্ছন্ন। বারান্দায় গিয়ে দেখি ঠিক সামনেই মেঘের ভেলা। সত্যিকারের মেঘ! পাতলা মেঘের চাদরেই আমরা ঘুমিয়েছি। মনে হচ্ছিল স্বপ্নের দেশে আমরা। ভোর পাঁচটা বাজতেই বেরিয়ে পড়লাম। অপেক্ষায় রইলাম সকালের সূর্য দেখার। মিজোরাম পাহাড়ের মাথার ওপর দিয়ে উঠল লাল সূর্য। কী আশ্চর্য, কয়েক সেকেন্ডেই বেরিয়ে এল ডগমগে সূর্য। যত বেলা বাড়তে থাকল, কুয়াশার মতো মেঘদল ঘন হতে লাগল। মিজোরামের পাহাড়ের রেঞ্জ আর সাজেকের মাঝে যেন এক সাগর মেঘ! পায়ের নিচে ভেসে যাওয়া এই মেঘের ভেলা দেখে সবাই খুব উল্লসিত। সাজেককে বিদায় জানানোর পালা এল। নাশতা সেরে ১০টায় রওনা হলাম খাগড়াছড়ির উদ্দেশে। এই ভ্রমণে আরও ছিল খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা আলুটিলা গুহা, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কয়েক হাজার ফুট ওপরে। আছে তেরাং চূড়া। যেখানে দাঁড়িয়ে দেখা যায় পুরো খাগড়াছড়ি শহর। দেখা যায় শহরের বুক চিরে এঁকেবেঁকে চলা চেঙ্গী নদী।
যা যা জানা প্রয়োজন
* খাগড়াছড়ি শহর থেকে সাজেক যাওয়ার পথ বেশ দুর্গম ও পাহাড়ি। সবচেয়ে ভালো চাঁদের গাড়ি। সাধারণত পার্বত্য জেলার অধিবাসীরাই গাড়ির চালক হয়ে থাকেন। পাহাড়ি পথঘাট তাঁদের নখদর্পণে। তাঁরা বেশ দক্ষও। তাই ভয়ের তেমন কোনো কারণ নেই।
* পাহাড়ে প্রচুর মশা ও পোকামাকড় রয়েছে। তাই মশানিরোধক মলম সঙ্গে নেওয়া ভালো।
* হাঁটাহাঁটি করা বা পাহাডে ভ্রমণ উপযুক্ত জুতা নিয়ে যান।
* সঙ্গে পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে নিন। সৌরবিদ্যুৎ আর জেনারেটরের ব্যবস্থা থাকলেও সে সুবিধা সীমিত সময়ের জন্য
* সংকট রয়েছে পানির। সঙ্গে পানি নেওয়া উচিত।
যা যা জানা প্রয়োজন
* খাগড়াছড়ি শহর থেকে সাজেক যাওয়ার পথ বেশ দুর্গম ও পাহাড়ি। সবচেয়ে ভালো চাঁদের গাড়ি। সাধারণত পার্বত্য জেলার অধিবাসীরাই গাড়ির চালক হয়ে থাকেন। পাহাড়ি পথঘাট তাঁদের নখদর্পণে। তাঁরা বেশ দক্ষও। তাই ভয়ের তেমন কোনো কারণ নেই।
* পাহাড়ে প্রচুর মশা ও পোকামাকড় রয়েছে। তাই মশানিরোধক মলম সঙ্গে নেওয়া ভালো।
* হাঁটাহাঁটি করা বা পাহাডে ভ্রমণ উপযুক্ত জুতা নিয়ে যান।
* সঙ্গে পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে নিন। সৌরবিদ্যুৎ আর জেনারেটরের ব্যবস্থা থাকলেও সে সুবিধা সীমিত সময়ের জন্য
* সংকট রয়েছে পানির। সঙ্গে পানি নেওয়া উচিত।
No comments