কূটনীতিক পদে সরাসরি নিয়োগে ক্ষোভ
বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে ঘটছে তুঘলকি কাণ্ড। পররাষ্ট্র ক্যাডার পদে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা ছাড়াই অনেককে কূটনীতিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাচ্ছেন প্রভাবশালীরা। এ ধরনের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা একই পদে ছয় থেকে নয় বছর কাজ করছেন। কূটনীতিক পদে এভাবে সরাসরি নিয়োগ দেয়ায় পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এতে পররাষ্ট্র ক্যাডারে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। যে কোনো সময় এর বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। বিদেশে বাংলাদেশের ৫৬টি কূটনৈতিক মিশন রয়েছে। এসব মিশনে রাষ্ট্রদূত পদে সীমিত মাত্রায় সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পেশাদার কূটনীতিকের বাইরে রাজনৈতিক নিয়োগ দেয়ার রেওয়াজ রয়েছে। তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় রাষ্ট্রদূত নিয়োগের ক্ষেত্রেও তার যোগ্যতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত পদ ছাড়া অন্য কূটনীতিক পদে নিয়োগে সাধারণত বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। তার বাইরে বিসিএস উত্তীর্ণ অন্য ক্যাডার থেকেও সীমিত সংখ্যক নিয়োগ দেয়া হয়। পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তারা বিদেশে একই পদে সাধারণত তিন বছর থাকতে পারেন। কিন্তু বিসিএস ছাড়া চুক্তিতে নিয়োজিতরা বিদেশে বাংলাদেশ মিশনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বছরের পর বছর পার করছেন। কর্মরত অবস্থায় অনেক কর্মকর্তা রীতিবহির্ভূত কাজ করছেন। এসব কারণে দেশের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, প্রভাবশালীদের তদবিরে নিয়োগপ্রাপ্তদের নিয়ে ফরেন সার্ভিসে ক্ষোভের শেষ নেই। কারণ তদবিরে নিয়োগপ্রাপ্তরা বিদেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিশনে নিয়োগ পাচ্ছেন। তারা তেমন কাজ না করেই বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে কাজ না করলেও তাদের দাপটের শেষ নেই।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেলেঙ্কারিও ঘটাচ্ছেন। সর্বশেষ কেলেঙ্কারি ঘটিয়েছেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশের ডেপুটি কনসাল জেনারেল মো. শাহেদুল ইসলাম। গৃহকর্মীকে উপযুক্ত বেতন না দেয়ার অভিযোগে এক মামলায় তিনি গ্রেফতার হন। এতে করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জানা গেছে, মো. শাহেদুল ইসলাম ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন নেতা। তার বাবা এমপি ছিলেন। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। এরপর ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনস্যুলেট জেনারেলের দফতরে গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিকের পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ছয় বছরের বেশি সময় ধরে তিনি সেখানে আছেন। এদিকে অভিযুক্ত কূটনীতিক শাহেদুলকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে অবস্থিত বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের কাউন্সিলর পদে বদলি করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনার পর ভারতীয় কূটনীতিক দেবযামী খুবরাগাড়েকে ভারত ফিরিয়ে দেয়। জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক যুগান্তরকে নিশ্চিত করেন, শাহেদুলকে জাতিসংঘ মিশনে বদলি করা হয়েছে। নিউইয়র্ক মিশনে চৌধুরী সুলতানা পারভিন নামে একজন কূটনীতিক পদে কর্মরত আছেন। তাকে ২০০৯ সালের আগস্টে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনিও বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের সদস্য নন। তিনি সেখানে কনসাল ও হেড অব চ্যান্সারির দায়িত্ব পালন করছেন। আট বছরের বেশি সময় একই মিশনে কোনো পেশাদার কূটনীতিককেও রাখা হয় না। ফ্রান্সে বাংলাদেশ দূতাবাসে আনিসা আমিন নামে একজন ২০০৮ সালের এপ্রিল থেকে প্রথম সচিব (সংস্কৃতি) পদে নিযুক্ত আছেন। তিনিও বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তা নন। ফলে তার নিয়োগ এবং নয় বছরের বেশি সময় একই মিশনে থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে মোছা. নাজমা আক্তার ২০১২ সালের মার্চ থেকে প্রথম সচিব হিসেবে নিযুক্ত আছেন। একই মিশনে শামীমা পারভিন নামে আরও একজন দ্বিতীয় সচিব পদে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নিযুক্ত আছেন। তারা কেউই বিসিএস কর্মকর্তা নন। যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে বাংলাদেশ মিশনে মো. ওহিদুর রহমান বিশ্বাস টিপু ২০১০ সালের অক্টোবর থেকে নিযুক্ত আছেন। কানাডায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে ২০১১ সালের নভেম্বর থেকে প্রথম সচিব পদে নিযুক্ত আছেন অপর্ণা রানী পাল। জার্মানিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে ২০১১ সালের নভেম্বর থেকে প্রথম সচিব পদে নিযুক্ত আছেন কাজী তুহিন রাসেল। লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনে ২০১১ সালের অক্টোবর থেকে মিনিস্টার (কাউন্সিলর) পদে নিযুক্ত আছেন শিরিন আখতার। তারা কেউই ফরেন সার্ভিসের কর্মকর্তা নন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট একজন নাম প্রকাশ না করে বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘জনগণের ট্যাক্সের টাকা দাতব্য কাজে অনির্দিষ্টকালের জন্য ব্যয় করা যায় না। বিসিএস পাস না করা এসব কর্মকর্তা ৬, ৭, ৮, ৯ বছর ধরে বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনে নিযুক্ত। তাদের নিয়োগের বৈধতা প্রশ্নাতীত নয়। কারণ তারা সরকারের গেজেটেড কর্মকর্তা নন। অথচ সরকারি অর্থ নিচ্ছেন। এভাবে পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষা ছাড়া সরাসরি কূটনীতিক নিয়োগ সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক শনিবার যুগান্তরকে বলেন, এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করব না।
No comments