অর্ধশতাধিক এমপি মনোনয়ন আতঙ্কে
আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন হারানোর ভয়ে আছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অর্ধশতাধিক সংসদ সদস্য। যাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে। নানাভাবে চেষ্টা করেও অনেক সংসদ সদস্যকে সংশোধন করা যায়নি। বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর অনেকেই এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। মূলত এ ধরনের জনবিচ্ছিন্ন নেতারাই সবচেয়ে আতঙ্কে আছেন। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সবার আমলনামা রয়েছে- এমন ঘোষণার পরপরই এসব এমপি মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। এ তালিকায় বিতর্কিত সংসদ সদস্যের পাশাপাশি একাধিক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর নামও আছে বলে জানা গেছে। এলাকায় গিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের নিয়ে জনগণের জন্য কাজ করার নির্দেশ দিলেও গুটিকয়েক এমপি ও দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ছাড়া অন্য কেউ এসব আমলে নেননি। এদের সম্পর্কে সাংগঠনিকভাবে জরিপ চালানো হয়। পাশাপাশি এদের সম্পর্কে বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টও হাইকমান্ডের হাতে পৌঁছেছে। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন- আগামী নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হবে এবং তার হাতে দলীয় এমপিদের আমলনামা রয়েছে। এমন ঘোষণার পর নড়েচড়ে বসেন তারা। গত রমজানে প্রায় সব এমপি এলাকায় গেছেন। ইফতার পার্টিতে অংশ নিয়েছেন। দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ শুরু করেছেন। পবিত্র ঈদুল ফিতরেও সংসদ সদস্যরা স্ব স্ব নির্বাচনী এলাকায় নামাজ আদায় করেছেন। জনবিচ্ছিন্ন এমপি ও মন্ত্রীরা সাড়ম্বরে এলাকায় জনসংযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন। নিজের বলয়ের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি দলের সব নেতাকর্মীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। এদিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলছেন, যাদের জনসম্পৃক্ততা নেই, নিজ আসনের নেতাকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা নেই এবং নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যারা সুনাম হারিয়েছেন এমন এমপিরা এবার মনোনয়ন পাবেন না। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, আমরা চাই আগামী নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হোক। সে জন্য এখন থেকেই মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মাঠে কাজ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু যাদের গ্রহণযোগ্যতা নেই বা যারা জনপ্রিয় নন তাদের মনোনয়ন দেয়া হবে না। কেননা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আবারও ক্ষমতায় ফেরার লক্ষ্যেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেবে। আর সে জন্যই যারা ভোটে জিতে আসতে পারবেন এমন ব্যক্তিদেরই মনোনয়ন দেয়া হবে। গত ৭ মে জাতীয় সংসদে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে দলের এমপিদের আমলনামা তার হাতে থাকার তথ্য জানান দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এবার নির্বাচন হবে প্রতিযোগিতামূলক। তাই যাদের নির্বাচনে জেতার সামর্থ্য রয়েছে শুধু তারাই দলের মনোনয়ন পাবেন। প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পরপরই পাল্টে যেতে থাকে পরিস্থিতি। দলের শীর্ষ মহল কী ভাবছে, জরিপে কার সম্পর্কে কী তথ্য আসছে জানার জন্য এমপিরা তৎপর হয়ে ওঠেন। আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, সাংগঠনিক এবং জরিপ দু’ভাবেই এমপিদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছে দলের হাইকমান্ড। এসব প্রতিবেদনে বেশকিছু এমপির দুর্নীতি, তাদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড, টাকার বিনিময়ে চাকরি দেয়া, এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, দখলবাজি, তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব, বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত নানা তথ্য উঠে এসেছে। এ ছাড়া এমপিদের কেউ কেউ হত্যা, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির দায়ে জেলে গেছেন, অথবা তাদের স্বজনরা গেছেন। আবার কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত শুরু করেছে। এমপিদের এলাকায় না যাওয়া এবং জনসম্পৃক্ততা না থাকার অভিযোগ দলের হাইকমান্ডকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। সূত্র জানায়, সমালোচিত ও বিতর্কিতদের তালিকায় এমপিদের পাশাপাশি কয়েকজন মন্ত্রীর নামও আছে। সব মিলিয়ে এ তালিকা বেশ দীর্ঘ। এতে রাজধানী ঢাকার একাধিক এমপির বিরুদ্ধে নিজ বলয়ের বাইরে অন্য নেতাকর্মীদের উপেক্ষা করা, ঠাকুরগাঁওয়ের এক এমপির বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল করা ও তাদের ওপর হামলার অভিযোগ আছে। দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত এক সংসদ সদস্যের (বর্তমানে মন্ত্রী) নির্বাচনী এলাকায় ন্যূনতম জনপ্রিয়তা নেই। তিনি এলাকার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেন না এমন তথ্যও রয়েছে। ছেলের কর্মকাণ্ডের কারণে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এক জেলার মন্ত্রী দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছেন। ছেলে ও জামাইয়ের অপরাধের অভিযোগে অপর এক জেলার মন্ত্রীসহ জনপ্রিয়তা হারানো মন্ত্রীদের নামও এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া রংপুর থেকে নির্বাচিত ২ এমপি যারা দলের কেন্দ্রীয় নেতা হলেও মূলত ব্যবসায় সময় দেয়ার কারণে দলে ও এলাকায় সময় দেন না বলে জরিপ রিপোর্টগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে। বিতর্কিতদের তালিকায় আছেন ইয়াবা ব্যবসার সম্পৃক্ততার অভিযোগে সমালোচিত কক্সবাজারের এক সংসদ সদস্য, দলীয় নেতা হত্যা মামলায় কারাগারে থাকা টাঙ্গাইলের সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান, বনানীর আলোচিত (দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ধর্ষণস্থল) হোটেল রেইনট্রির মালিক ঝালকাঠির এক এমপি। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ছবির ওপর নিজের মুখের ছবি লাগিয়ে প্রচার করে চট্টগ্রামের এক এমপি বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া এবং কর্মীদের ওপর নির্যাতন করার অভিযোগে অভিযুক্ত বরগুনার এক এমপি, স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের কর্মকাণ্ডের কারণে সমালোচিত পিরোজপুরের এক এমপি, স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক এমপি এরা দলের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি করেছেন। জামায়াত সংশ্লিষ্টতায় অভিযুক্ত রাজশাহীর এক এমপি, কোনোদিন দল না করে হঠাৎ করেই এমপি বনে যাওয়া সিরাজগঞ্জের এক এমপি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংখ্যালঘু হামলা ও গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল পল্লীতে আগুন-কাণ্ডে সমালোচিত এমপিও আছেন এ তালিকায়। নিজ দফতরে সরকারি কর্মকর্তা পেটানো, কর্মকর্তার দরজায় তালা দেয়া এবং এলাকায় দলের কর্মীদের মারধর করেন নেত্রকোনার এক এমপি, নিজ দলের নেতার বাড়িতে দেয়াল দিয়ে বের হওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দেয়া খুলনার এক এমপি, অস্ত্র মামলায় কারাভোগকারী ফেনীর এক এমপি, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনে শাসক দলের প্রার্থীর পরাজয়ের পেছনে দায়ী এক এমপিও বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। এরাই মূলত মনোনয়ন-ঝুঁকিতে আছেন। বরগুনা-৪-এর সরকারদলীয় এমপি শওকত হাছানুর রহমান রিমনের কাছে এ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এলাকাতেই থাকি। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ ছড়ানো হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি দাবি করে বলেন, এলাকার প্রতিটি মানুষের খোঁজখবর আমি রাখি। আসলে কিছু লোক আমাকে মনোনয়নবঞ্চিত করার জন্য মিথ্যা অপবাদ ছড়াচ্ছে। এ সংক্রান্ত এ প্রশ্নের জবাবে নীলফামারী জেলার আওয়ামী লীগদলীয় এক এমপি যুগান্তরকে বলেন, সব সময়ই তিনি এলাকায় যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠকে দলের সভাপতির বক্তব্যের পর থেকে এখন এলাকাতেই থাকছেন। শুধু সংসদ চললে ঢাকায় আসেন। তিনি বলেন, তার আসনে আরও তিনজন দল থেকে মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করছেন। সে কারণে তিনি চেষ্টায় ত্রুটি রাখতে চান না। তিনি বলেন, এবারের ঈদে এলাকার সব পর্যায়ের নেতাকর্মীর খোঁজখবর নিয়েছেন, জনগণকে সাধ্যমতো সহায়তা করেছেন, রমজানে অনেক ইফতার মাহফিলে অংশ নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী ও বিশাল দলে মনোনয়ন পাওয়া কঠিন, পাওয়ার পর সেটা ধরে রাখা আরও কঠিন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
No comments