অপশক্তি রুখে দেয়ার শপথ
হাতে ফুল, চোখে জল। আছে ক্ষোভের আগুন, প্রতিবাদের ভাষা। তবুও নিশ্চুপ সবাই। ধীর পায়ে এগোচ্ছেন বেদির দিকে। কারও কারও চোখ-মুখ বলে দিচ্ছে- কাঁদতে আসিনি, এসেছি ফাঁসির দাবি নিয়ে। পাঠক, বলছি শোকগাথা গুলশান হলি আর্টিজানের কথা। শনিবার সকালটা এভাবেই শুরু হয়েছিল। এক বছর আগের ভয়াল রাতের কথা স্মরণ করতে সকাল ১০টার আগে থেকে রাজধানীর সব পথ যেন একাকার হয়ে মিশেছিল গুলশান ৭৯নং সড়কের সামনে। পুরো জাতি বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছিল জঙ্গি সন্ত্রাসীদের হামলায় নির্মম মৃত্যুর শিকার নিরপরাধ মানুষগুলোর। হাজির হয়েছিলেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার হাজার হাজার মানুষ। এসেছিলেন নিহত বিদেশিদের স্বজন, শুভাকাক্সক্ষী বন্ধুরাও। ক্ষোভ আর অশ্রুভেজা চার ঘণ্টার শ্রদ্ধা নিবেদনে সবার মুখে ও মনে উচ্চারিত হচ্ছিল- এই শোক হবে অপ্রতিরোধ্য শক্তি, রুখে দেব সব অপশক্তি। দেখে যাও সন্ত্রাসী কাপুরুষরা, ভীত নই আমরা। আমরা আজ আরও ঐক্যবদ্ধ; সব ধর্মান্ধ, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। সেই রাতের ভয়াবহতায় যেন থমকে গিয়েছিল পুরো বাংলাদেশ। আচমকা এক দুঃস্বপ্ন এসে আঘাত করেছিল। ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিল এক কালরাত্রি। জঙ্গিবাদের অশুভ থাবায় তখন ক্ষতবিক্ষত হলি আর্টিজান বেকারি। বাংলাদেশের জন্য সেটি ছিল বড় বিষাদের রাত। গুলশান-২ এ অবস্থিত এ রেস্তোরাঁয় জঙ্গিদের আক্রমণ হতবাক করেছিল পুরো জাতিকে। রাত ৮টার একটু পরে কয়েক জঙ্গি অস্ত্র হাতে সজ্জিত হয়ে হলি আর্টিজানে অতর্কিত হামলা চালায়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই বলেছেন, আক্রমণের প্রায় ঘণ্টাখানিকের মধ্যেই তারা তিন বাংলাদেশি, এক ভারতীয়, নয় ইতালিয়ান, সাত জাপানি নাগরিককে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের আক্রমণে প্রাণ হারান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দু’জন চৌকস সদস্যও।
যদিও এ হত্যাকাণ্ডের তথ্যগুলো পাওয়া গিয়েছিল ঘটনার একদিন পর। সেদিন রাত ২টা পর্যন্ত জঙ্গিদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর এক অভিযানে পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। কিন্তু তার অনেক আগেই ঝরে যায় অনেক নিরীহ প্রাণ। নির্মম মর্মস্পর্শী এ ঘটনার এক বছর পূর্তিতে শনিবার দেশের শোকার্ত সাধারণ মানুষ, বিশিষ্ট নাগরিক, সুধী সমাজ, রাজনীতিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা সবার ঢল নামে হলি আর্টিজানে। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় তারা স্মরণ করেন বর্বর এ হত্যাযজ্ঞে নিহতদের। শপথ নেন শোককে শক্তিতে পরিণত করে বাংলাদেশ থেকে সব ধরনের জঙ্গিবাদের আস্ফালনকে চিরতরে রুখে দেয়ার। তবে আগতদের সবার মনের মধ্যেই ছিল অনেক প্রশ্ন। জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশের সফলতা আছে, এটি মেনে নিয়েই তারা জানতে ও বুঝতে চেয়েছিলেন- বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ আর সিরিয়া বা ইরাকের জঙ্গিবাদ তো এক ধরনের নয়। এদের কথিত আইএসের দোসর বলা হলেও ওইসব দেশের জঙ্গি হামলার সঙ্গে এখানকার জঙ্গিদের হামলার মধ্যে কোনো মিল নেই। তারপরও বছরজুড়ে জঙ্গি সংবাদ পিছু ছাড়ছে না কেন? বিশেষ করে সবার মধ্যে একটা প্রশ্ন বেশি ঘুরপাক খাচ্ছিল। তারা গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, হলি আর্টিজান হামলার মূল পরিকল্পনাকারী কারা? কী তাদের উদ্দেশ্য? এটি যতদিন সত্যিকারার্থে খুঁজে বের করা সম্ভব হবে না, ততদিন জঙ্গিবিরোধী কোনো অভিযান ওই অর্থে সফল হবে না। তাই আগে খুঁজে বের করতে হবে, কারা কী উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র বানাতে চায়। এছাড়া সবাই বলছিলেন, আজকের এই দিনের সবচেয়ে বড় শপথ হতে হবে- প্রত্যেকে নিজ নিজ পরিবার থেকে জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু করতে হবে। আমাদের সন্তান ও ভাইবোনরা কীভাবে বেড়ে উঠছে, তারা কোথায় যায়, কাদের সঙ্গে চলাফেরা করে, মোবাইল ফোন ও ফেসবুকে তারা কী ধরনের অ্যাপস ব্যবহার করে, কাদের সঙ্গে কী ধরনের যোগাযোগ করে ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিনিয়ত খবর রাখতেই হবে। তা না হলে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে বিপথগামী এই জঙ্গিবাদ দমন করা কোনোদিন সম্ভব হবে না। কারণ এটি আজ শুধু বাংলাদেশের একার সমস্যা নয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে বিশ্বের প্রতিটি দেশেই নানাভাবে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। হলি আর্টিজানে শ্রদ্ধা জানাতে আসা সুশীল সমাজের কয়েকজন যুগান্তরকে বলেন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। গবেষণা হতে হবে- এতদিন এ ধরনের জঙ্গিবাদ মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিতদের মধ্যে কেন ছড়িয়ে পড়ছে। একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, বিষয়টি নিয়ে কেউ কোনো কিছু স্পষ্ট করে বলছে না। যা বলা হচ্ছে তা ভাসা ভাসা। কেন তারা জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে সে কারণ আগে অনুসন্ধান করে বের করতে হবে।
তারপর সে অনুযায়ী প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে শুধু অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানোর মতো অবস্থা হবে। এছাড়া জঙ্গি দমনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সহনশীলতা বড় প্রয়োজন। কিন্তু এ বিষয়টি আমাদের এখানে খুবই বিপরীত অবস্থায় রয়েছে। মনে রাখতে হবে- মানুষকে তার ক্ষোভ, হতাশা প্রকাশ করার জন্য ‘স্পেস’ দিতে হবে। কিন্তু সেটি দেয়া না হলে তা অনেক সময় জঙ্গিবাদসহ নানা অশুভ শক্তির জন্ম দিতে পারে। হলি আর্টিজান বেকারির ভেতরে বাড়িটির একটি দেয়ালের পাশে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বেদি তৈরি করা হয়। সাধারণ মানুষের জন্য সকাল ১০টা থেকে হলি আর্টিজানের দরজা খুলে দেয়া হয়। কিন্তু তার আগ থেকেই অনেকে সেখানে ফুল হাতে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। তখন কারও কারও চোখ ছলছল করছে। ১০টার পর শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শুরু হলে কেউ কেউ অশ্রু সংবরণ করেই বেদির সামনে এগিয়ে যান। কেউ আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। সকাল সাড়ে ১০টায় গুলশান ১০৪ নম্বর সড়ক এলাকা থেকে দুই সন্তান নিয়ে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসেন আবিদা সুলতানা। শ্রদ্ধা শেষে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে তিনি কাঁদছিলেন। বললেন, মানুষ কী করে মানুষকে হত্যা করে? গত বছর ঘটনার দিন রাতভর আতঙ্কে ছিলেন তিনি। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নির্ঘুম রাত কেটেছে ভয়ে ভয়ে। সকালে ছুটে এসেছিলেন হত্যাযজ্ঞ এলাকায়। সেই স্মৃতি এখনও তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। বেলা পৌনে ১১টার দিকে হলি আর্টিজান বেকারির বারান্দায় স্বামীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন টঙ্গী থেকে আসা গৃহবধূ শারমীন হোসেন। শারমীন যুগান্তরকে জানান, স্বামী নূর হোসেন রাজিক ও সন্তান আজমাইনকে নিয়ে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন। নূর হোসেন বললেন, ‘টিভিতে দেখেছি ভয়াবহতা। এখনও বুক থরথর করে কাঁপছে। বাংলাদেশে এমন হবে কোনোদিন ভাবতে পারিনি। জঙ্গি তো ধরা পড়ছে, কিন্তু এর শেষ কোথায়? মূল হোতারা তো ধরা পড়ছে না। তাহলে দেশের মানুষ নিরাপদ কোথায়?’ সকাল ১০টায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরসহ সংগঠনের ১০-১২ জন নেতা নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। শাহরিয়ার কবির বলেন, জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ সফল। কিন্তু জঙ্গি নির্মূলে আদর্শিক লড়াই চালাতে হবে। শক্তি দিয়ে জঙ্গিবাদ নির্মূল সম্ভব নয়। মানুষকে ধর্মের বিষয়ে ভুল বার্তা প্রদানকারী জামায়াত-শিবির, মওদুদীবাদী, ওয়াহাবিবাদ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।
জামায়াত-শিবিরসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো যতদিন না পর্যন্ত নিষিদ্ধ হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ নিরাপদ নয়। দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃস্থাপন করতে হবে।’ বেকারিটি ঘেঁষা লেকভিউ ক্লিনিকের ফার্মাসিস্ট বিজয় ইসলামের সঙ্গে যুগান্তর প্রতিবেদকের কথা হয় দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে। হামলার রাতে তিনি ক্লিনিকে ছিলেন। বললেন, ‘যখন হামলাকারীরা একের পর এক গুলি করে মানুষ হত্যা করছিল, তখন শব্দ শুনছিলাম। দেখার জন্য যখন ক্লিনিকের দ্বিতীয় তলার বারান্দায় যাই, তখন বেকারিটির ভেতরে গুলির সঙ্গে আগুনের মতো ঝিলিক চোখে এসে লাগে। ভয়-আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছিলাম। ক্লিনিকের স্টাফরা প্রাণভয়ে দিগি¦দিক ছোটাছুটি করছিল। ৯টি কেবিনে রোগীরা ভর্তি ছিল। সবাই কেবিনের ভেতর থেকে রুম লক করে রেখেছিল। ওই রাত এবং পরের দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপারেশন জীবনে কোনো দিন ভুলব না। ভাই, আর কথা বলতে পারছি না। দেখেন, ভয়ে শরীর কাঁপছে।’ ‘ইশরাতের জন্য কাঁদতে এসেছি। ক্ষমা চাইতে এসেছি ইশরাতসহ নিহতদের কাছে। বুক ভেঙে যাচ্ছে। এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, তারা নেই। ইশরাত ছিল আমার প্রিয়বন্ধু। ১৪ বছরের ঘনিষ্ঠতা। গত রোজার শুরুতে তার বাসায় দাওয়াত খেয়ে অনেক মজা করেছিলাম। আজ বন্ধু নেই, বন্ধুর স্মৃতিগুলো শুধুই কাঁদায়। যেসব হায়েনারা তাদের হত্যা করল, তাদের বিচার কি হবে না? একই সঙ্গে মূল পরিকল্পনাকারীদের গ্রেফতার করে প্রকাশ্যে আনা হোক। তবেই নিহতদের আত্মা শান্তি পাবে।’ শনিবার দুপুরে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারির অস্থায়ী বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে এভাবে কথাগুলো বলছিলেন সেই রাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার ইশরাতের বান্ধবী আয়শা। বৃষ্টিতে ভিজে বান্ধবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আয়শা যখন বের হচ্ছিলেন, তখনও কাঁদছিলেন। শনিবার সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত নিহতদের প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের মানুষ। দুপুর ১টা ১০ মিনিটে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী। শ্রদ্ধা শেষে বৃষ্টিতে ভিজেই সাংবাদিকদের জানালেন, দেশের মানুষকে মনে রাখতে হবে জাতির বিবেককে ধাক্কা দিয়ে গেছে হলি আর্টিজানের জঙ্গি হামলা। এক বছর ধরে তদন্ত হচ্ছে, কিন্তু চূড়ান্তভাবে কিছুই যেন হচ্ছে না। এমন ভয়াবহ হামলার নেপথ্যে কারা- তাদের পরিচয়ও পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেই তো ভূত। মাঝেমধ্যে অনাকাক্সিক্ষতভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন করা হচ্ছে। কিন্তু এর দ্বারা অসাম্প্রদায়িকতা ও নৈতিকতার শিক্ষা এবং ধর্মান্ধবিরোধী শিক্ষা পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। প্রাইমারি ও মাধ্যমিকে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির শিক্ষা এখনও রয়েছে জানিয়ে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, জঙ্গিবাদ ও ধর্মান্ধতাকে উসকে দিতে পারে এমন পাঠ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বাতিল করতে হবে। ইতালিয়ান নাগরিক তাভেল্লা সিজার হত্যার বিচার সঠিক প্রক্রিয়ায় হলে হলি আর্টিজান হামলার ঘটনা হয়তো ঘটত না। রাজনৈতিক বিবেচনায় জড়িত কেউ যেন ছাড় না পায় কিংবা নিরপরাধ কেউ যেন হয়রানি না হয়, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান এই শিক্ষাবিদ।
রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী ও গবেষক ড. চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘দেশে জঙ্গি হামলার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু জঙ্গি হামলা প্রতিরোধ কিংবা জঙ্গিদের হত্যা করা হলেও কি জঙ্গি হামলা থেকে আমরা সাধারণ মানুষ মুক্ত হতে পারছি? এমন ভয়াবহতা নির্মূল করতে অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায়। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষার দিকে তাকিয়ে আমি আমার জন্মভূমি বাংলাদেশকে চিনতে পারি না।’ বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বলেন, একটি দেশে কী করে স্বাধীনতাবিরোধীরা থাকে। কী করে রাজনীতি করে। জামায়াত-শিবিরসহ ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠনগুলো নিষিদ্ধের দাবি জানান তিনি। তিনি বলেন, এমন ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যে কোনো মূল্যে তাদের গ্রেফতার করতে হবে। ফ্লাক্স ওয়ানের সহকারী পরিচালক রুবাবা দৌলা মতিন সাংবাদিকদের বলেন, হলি আর্টিজানে হামলাকারীরা এ দেশের ইতিহাসে কলঙ্ক লেপন করেছে। হামলার নেপথ্যের কারিগররা দেশি নাকি বিদেশি, তা আমরা জানতে চাই। দেশের মানুষ এমন ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মূল হোতাদের গ্রেফতার দেখতে চায়। জঙ্গি নির্মূলে সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে বলেও তিনি মনে করেন। সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বলেন, জঙ্গিবাদ মোকাবেলার জন্য দরকার রাজনৈতিক সমঝোতা। সরকারের একার পক্ষে জঙ্গিবাদ মোকাবেলা সম্ভব নয়। এজন্য সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ দলমত-নির্বিশেষে সবার সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। তিনি বলেন, জঙ্গির সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন গোষ্ঠীসহ প্রত্যেককে কঠোর হাতে নির্মূল করতে হবে। শ্রদ্ধা নিবেদনের বেদির পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন নিহত ফারাজের এক আত্মীয় মনিকা চৌধুরী। তিনি বলেন, গুলশানে হামলা করে যারা বোঝাতে চেয়েছে বাংলাদেশ জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র, তাদের ধারণা ভুল। বাংলাদেশ কখনও জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র নয়, ছিল না, হবেও না। কিন্তু দেশের মানুষকে সজাগ থাকতে হবে। কারণ জঙ্গিদের মূল হোতারা এখনও ধরা পড়েনি। মনে রাখতে হবে, ফারাজদের মতো নিরপরাধ তরুণদের যারা হত্যা করতে পারে, তাদের চেতনা আমরা বুঝে গেছি। এমন ধ্বংসাত্মক ও মানবতাবিরোধী চেতনাধারীদের যে কোনো মূল্যে মোকাবেলা করতে হবে। সকালে হলি আর্টিজানে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, জঙ্গিরা দুর্বল হলেও নির্মূল হয়নি। জঙ্গিবাদ দমনে সবাইকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আর যারা জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক তাদের সেই প্লাটফর্মে আহ্বান জানানো হবে না। এ সময় সেখানে আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে ছিলেন মাহবুবউল হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, এনামুল হক শামীম, আহমদ হোসেন, সুজিত রায় নন্দী, আমিনুল, বিপ্লব বড়–য়া প্রমুখ। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বাংলাদেশ পুলিশের প্রশংসা করে বলেন, সরকার ও পুলিশ যৌথভাবে জঙ্গি দমনে সফলতা পেয়েছে। প্যারিসের পুলিশ যেটা পারেনি, বাংলাদেশ পুলিশ সেটা করে দেখিয়েছে। এদিকে শনিবার সকালে হলি আর্টিজান বেকারিতে নিহতদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে দেশে জঙ্গিবাদ নির্মূল হবে না। হলি আর্টিজান হামলার পর ‘আমরা আশা করেছিলাম এ ব্যাপারে একটি সামগ্রিক সমন্বিত পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে দেশের মধ্যে বিভিন্নভাবে যে উগ্রবাদী নেটওয়ার্ক চেপে বসেছে, সেটিকে উৎখাত করা হবে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের দিক থেকে এ ধরনের কোনো সমন্বিত উদ্যোগ আমরা দেখিনি।’ এই দিনটি দেশ ও জাতির জন্য কালো অধ্যায় আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, দেশ-বিদেশের এতগুলো মানুষ জঙ্গিদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়া নিঃসন্দেহে আমাদের আবহমান বাংলার যে সংস্কৃতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং দেশের যে এগিয়ে চলা, আমরা যে সম্প্রীতির পক্ষে, প্রগতির পক্ষে, অগ্রগতির পক্ষে সেখানে কলঙ্ক তিলক তারা এঁকে দিয়েছে। রুহুল কবির রিজভী বলেন, হলি আর্টিজান হামলার এক বছর পরও পুলিশ তদন্ত শেষ করতে পারেনি। এখনও অভিযোগপত্র দেয়া হয়নি, প্রশাসন কী ধরনের কাজ করছে আমরা বলতে পারছি না। কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে তাও জানি না। সকালে রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বে বিএনপির ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল হলি আর্টিজান বেকারির সেই বাড়ি প্রাঙ্গণে নিহতদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। প্রতিনিধি দলের অন্যদের মধ্যে ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় নেতা হাবিবুল ইসলাম হাবিব, আবদুস সালাম আজাদ, জাসাসের রফিকুল ইসলাম তালুকদার, শায়রুল কবির খান ও সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলা চেয়ারম্যান মেজর (অব.) আবদুল্লাহ আল মামুন। এদিকে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অসাম্প্রদায়িক চেতনার। সেই জায়গাটিতে হলি আর্টিজানের ঘটনা বড় আঘাত। আমরা কখনও ভাবিনি এ রকম একটি ঘটনা ঘটতে পারে। জাতি এ জন্য প্রস্তুত ছিল না। জঙ্গি নির্মূলে সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, দেশ থেকে যে কোনো অপশক্তি দূর করতে হলে সাংস্কৃতিক আন্দোলনও জরুরি। এ সময় অন্যদের মধ্যে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন. শহীদ আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী, কন্যা নূজহাত চৌধুরী, মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনীর, শহীদ বুদ্ধিজীবী শহিদুল্লা কায়সারের মেয়ে শমী কায়সার, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসহ আরও কয়েকটি সংগঠন। অতিরিক্ত আইজি মোখলেসুর রহমানের নেতৃত্বে¡ পুলিশের একটি প্রতিনিধি দল সকালে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য হলি আর্টিজান চত্বরে আসে। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেসুর সাংবাদিকদের বলেন, হলি আর্টিজানের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছি। বাংলাদেশ যেন ভবিষ্যতে সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের পরিচিতি না পায় তার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ও পুলিশের পেশাদারিত্ব মিলিয়ে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। পুলিশ জীবন বাজি রেখে বাংলাদেশকে একটি নিরাপদ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের কোনো ঠাঁই নেই। জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ পুলিশের সফলতা পৃথিবীর সব নিরাপত্তা বাহিনী ও সংস্থা একবাক্যে স্বীকার করেছে। এদিকে সকাল ৭টা ২০ মিনিটে পুলিশ পাহারায় বেকারিটিতে প্রবেশ করেন ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত মাসাতো ওয়াতানাবির নেতৃত্বে জাপানি একটি প্রতিনিধি দল। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ৭টা ২৯ মিনিটে তারা বেরিয়ে যান। এ সময় তাদের সঙ্গে সাংবাদিকরা কথা বলতে চাইলেও তারা কথা বলতে রাজি হননি। এরপর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসেন ইতালির নিহতদের স্বজন ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা। গুলশান কূটনৈতিক বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. জসিম উদ্দিন জানান, নিহতদের আত্মীয়স্বজন, দেশি-বিদেশি বন্ধু-বান্ধবসহ জাপানি রাষ্ট্রদূত, জাইকা প্রতিনিধি দল শ্রদ্ধা জানিয়েছে। আগত বিদেশি এবং সাধারণ লোকজনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শুক্রবার থেকেই হলি আর্টিজান বেকারি এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়। এদিকে দুপুর ২টায় পুলিশ প্রশাসন বেকারিটির প্রধান গেট বন্ধ করে দেয়। এ সময় রাস্তায় সাধারণ মানুষকে অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়। তখনও বৃষ্টি পড়ছিল। সাধারণ মানুষ বৃষ্টিতে ভিজেই তখনও নিহতদের স্মরণ করছিলেন। প্রসঙ্গত, গত বছর ১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজানে কথিত আইএস নামধারী জঙ্গিরা নৃশংতা চালিয়ে দেশ-বিদেশের ২২ জনকে হত্যা করে। এই নির্মম হত্যাযজ্ঞে নিহত হন বাংলাদেশের ইশরাত আখন্দ, ফারাজ আইয়াজ হোসেন, অবিন্তা কবির, ভারতের নাগরিক তারিশি জৈন, ইটালির নাগরিক নাদিয়া বেনেডেট্টি, ক্লদিও ক্যাপেলি, ভিনসেনজা ডি অ্যালেস্ট্রো, ক্লদিয়া মারিয়া ডি অ্যান্টোনা, সিমোনা মন্টি, অ্যাডেলে পুগলিসি, ক্রিস্টিয়ান রসি, মারিয়া রিবোলি, মার্কো টোনডাট, জাপানি নাগরিক মাকাতো ওবামুরা, হিরোশি তানাকা, কোয়া ওগাসাওয়ারা, হিদেকি হাশিমোতো, নোবুহিরো কুরোসাকি, ইয়োকু সাকাই, রুই শিমোদাইরা এবং বাংলাদেশের দুই পুলিশ কর্মকর্তা ওসি সালাউদ্দিন আহমেদ খান ও এসি রবিউল করিম।
No comments