তিস্তায় হতাশ আ’লীগ আতিথেয়তায় খুশি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরে দেশটির আতিথেয়তায় অত্যন্ত খুশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু তিস্তাচুক্তি না হওয়ায় হতাশ হয়েছেন মতাসীন দলটির নীতিনির্ধারকেরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে ভারত যে সম্মান দেখিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে দেশের জনগণের জন্য গৌরব ও সম্মানের। বিশেষ করে প্রটোকল ভেঙে শেখ হাসিনাকে বিমানবন্দরে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অভ্যর্থনা সবাইকে অবাক করেছে। এ ছাড়া ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে রাত যাপনসহ প্রধানমন্ত্রীর সফর ঘিরে সব আয়োজনই ছিল বাংলাদেশের জন্য সম্মানের। তবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিস্তাচুক্তির বিষয়ে বড় কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় কিছুটা হতাশা তো রয়েছেই। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, কৌশলগত কারণে এ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে দেয়া আতিথেয়তাকেই বড় করে দেখছে আওয়ামী লীগ। সে জন্য তিস্তাচুক্তির বিষয়টি এড়িয়ে নেতাদের মুখে মুখে প্রধানমন্ত্রীকে বরণ, লালগালিচা সংবর্ধনা, নৈশভোজ ও বাংলাদেশকে দেয়া ঋণের বিষয়টি উঠে আসছে। কারণ দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিস্তাচুক্তির ব্যাপারে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো হতাশা প্রকাশ করা হলে আগামী নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে এবং নির্বাচন সামনে থাকা অবস্থায় নেতাকর্মীরা হাতোদ্যম হয়ে পড়তে পারেন। সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে নেতাদের সাথে কথা বললে তারা ঘুরে ফিরে শেখ হাসিনাকে ভারতের দেয়া আতিথেয়তার বিষয়টিকেই আলোচনায় আনেন।
এ দিকে ভারতীয় পত্রিকা টাইমস অব ইন্ডিয়ার বাংলা সংস্করণের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভারত মনে করছেÑ তিস্তা নিয়ে একেবারে খালি হাতেই ঢাকায় ফিরতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। নয়াদিল্লির এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আপে করে বলেছেন, ‘মোদিজি আমাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু দিদিমণি কী করবেন, তা আমি জানি না। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় তো অন্য অবস্থানই নিলেন।’ প্রধানমন্ত্রী স্বভাবসুলভ হাসির ছলে হিন্দিতে কথাগুলো বলেছেন বটে, কিন্তু স্পষ্ট যে, প্রধানমন্ত্রী মোদির কথায় আশ্বস্ত হওয়ার পর মমতার আপত্তিতে হতাশ তিনি। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্য এই ধাক্কা এলো এমন একটা সময়ে, ঠিক যার পরের বছর বাংলাদেশে ভোট।’ প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, তিস্তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব খারিজ করার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই মোদির সাথে বৈঠক করেন মমতা। তিনি জানিয়েছেন, ওই বৈঠক ছিল নেহায়েতই রাজ্যের আর্থিক বিষয় সংক্রান্ত। কিন্তু বিজেপি সূত্রে জানা যায়, তিস্তা প্রসঙ্গও সেখানে উঠেছিল এবং আগের অবস্থান থেকে একটুও সরে আসেননি মমতা! মমতা সাফ জানিয়ে দেন, ‘যা প্রস্তাব দেয়ার, তা তো দিয়েই দিয়েছি। এবার কেন্দ্রীয় সরকার সমীক্ষা করে দেখুক।’ বিজেপি নেতৃত্বের দাবি, এই অবস্থায় তো কেন্দ্রীয় সরকারের সামনে একটা রাস্তাই খোলা রয়েছে। তা হলো, রাজ্যের আপত্তি উপো করে চুক্তি সম্পাদনের পথে এগিয়ে যাওয়া। তিস্তা হলো আন্তর্জাতিক চুক্তি। সেই েেত্র এই চুক্তি করার অধিকার কেন্দ্রের রয়েছে। কিন্তু তা করতে গেলে সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা। ফলে প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করার পরেও তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিচলিত হওয়া স্বাভাবিক। এ ছাড়া মতায় আসার পর থেকে মোদি নিজেকে বাংলাদেশবান্ধব দেখানোর চেষ্টা করেছেন এবং অনেকাংশে সফলও তিনি। কিন্তু তিস্তাচুক্তি না হলে তার এই ভাবমর্যাদা ুণœ হবে। অন্য দিকে বাংলাদেশে সরকারবিরোধীদের অভিযোগ শেখ হাসিনা আসলে নয়াদিল্লির হাতের পুতুল। তার সফরে তিস্তাচুক্তি না হওয়ায় বিরোধীরা ইতোমধ্যেই অভিযোগ তুলতে শুরু করেছেন, পুতুল হয়েও তো লাভের লাভ কিছুই হলো না। বিজেপি নেতারা মনে করেন, তিস্তাচুক্তি না হলে শেখ হাসিনা বিপাকে পড়বেন। আগামী বছর ভোটে তিনি হেরেও যেতে পারেন। সে েেত্র পশ্চিমবঙ্গে আবার শরণার্থীদের ঢল নামতে পারে। বাংলাদেশে মৌলবাদী রমরমাও হতে পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতা আলাপকালে বলেন, বিষয়টি পুরোপুরি না হলেও কিছুটা সত্য।
কারণ দেশের জনগণের সবচেয়ে বড় চাওয়া ছিল তিস্তাচুক্তি। কিন্তু তা না হওয়া বা এ ক্ষেত্রে বড় কোনো অগ্রগতি না হওয়াটা আমাদের জন্য খানিকটা বিব্রত কর। আগামী নির্বাচনের আগে বিষয়টির সমাধান না হলে আমাদের ভোটে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কোনো কোনো নেতা বলেন, এবারের সফরে তিস্তাচুক্তি যে হবে না, তা আগে থেকেই জানা গিয়েছিল। তারপরও কবে নাগাদ চুক্তি হতে পারে, তা জানার আগ্রহ বাংলাদেশের ছিল। কিন্তু সে ব্যাপারেও সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ না হওয়া সরকারের জন্য খানিকটা অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ মমতার বিকল্প প্রস্তাবকে আমলে নিচ্ছে না। কারণ চুক্তি হবে ভারতের সাথে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে। পশ্চিমবঙ্গ বা মমতার সাথে নয়। মোদি তার মেয়াদেই এ চুক্তি করার যে আশ্বাস দিয়েছেন আমরা তাতে আশাবাদী হতে চাই। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে ইতঃপূর্বে কোনো প্রধানমন্ত্রী রাত যাপন করেননি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাই প্রথম সেখানে রাত যাপন করেছেন। এটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য অবশ্যই গৌরবের। আর তিস্তা চুক্তি সম্পর্কে ভারতের সরকার প্রধানের আশ্বাস পাওয়া গেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কী বলল তা মূল বিষয় নয়। দলের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ভারত সরকার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে যে সম্মান দেখিয়েছে, তা দেশের মানুষের জন্য সম্মান ও গৌরবের। আমার বিশ্বাস, এতে বাংলাদেশের মানুষ মুগ্ধ হয়েছেন। আর তিস্তাচুক্তির বিষয়টি অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। এক অর্থে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছেন, তিস্তাচুক্তি হবে।
No comments