পিএসআই শফিউল আজমের ভিন্ন রকম ‘দারোগাগিরি’
রাত গভীর হলে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীতে তার বিচরণ শুরু হয়। এ সময় তার কোমরে থাকে পিস্তল। হাতে ওয়াকিটকি। মাঝেমধ্যে ২-৩ জনের ফোর্সও সঙ্গে থাকে। তাদের কারও হাতে লাল সিগন্যাল লাইট। কারও হাতে হ্যান্ডকাফ। সিভিল পোশাকে রাতভর পুরোদস্তুর ডিউটি করে পুলিশের এই সিভিল টিম। ডিউটি শেষে দিনের আলো ফোটার আগেই গা ঢাকা দেন তারা। শফিউল আজম নামে এক শিক্ষানবিস (পিএসআই) এসআইয়ের (উপপরিদর্শক) নেতৃত্বে চলে তাদের এমন নিশুতি ডিউটি। কিন্তু এ বিশেষ ডিউটির কথা ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কিছুই জানেন না। রাজধানীতে অপরাধ দমনের এমন দায়িত্ব পালন করা পিএসআই শফিউল আজম বর্তমানে টাঙ্গাইল পুলিশ ট্রেনিং কলেজের প্রশিক্ষণার্থী।
সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতরের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা ইউনিটের নিজস্ব অনুসন্ধানে এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনা বেরিয়ে আসে। কেচো খুঁড়তে সাপ বেরোনোর মতোই পিএসআই সফিউল আজমের কর্মস্থলে লাগাতার অনুপস্থিতির তথ্য জানা যায়। সূত্র বলছে, বিষয়টি নিয়ে গোয়েন্দা ইউনিটের তদন্ত শেষ পর্যায়ে। শিগগির পুরো বিষয়টি লিখিত আকারে পুলিশ সদর দফতরকে অবহিত করা হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দফতরের গোয়েন্দা ইউনিটের এক সদস্য (এজেন্ট) যুগান্তরকে বলেন, পিএসআই শফিউল আজম অনেকটা ছিনতাইকারীর মতো গভীর রাতে ঢাকার গুলশান-বনানী এলাকায় হাজির হন। এরপর রাতের ঢাকায় ডিউটিরত থাকার অভিনয় শুরু করেন। সঙ্গে থাকে ৪-৫ জনের একটি গ্রুপ। ভাবখানা পুলিশ হলেও বাস্তবে এরা কেউ পুলিশ নন। কেউ কেউ আছেন সোর্স। যারা পুলিশের তালিকাভুক্ত অপরাধী। সূত্র জানায়, সফিউল আজমের নেতৃত্বে ওই দলটি রীতিমতো পেশাদার ছিনতাইকারীর মতো শিকারের অপেক্ষায় ওতপেতে থাকে। নিরীহ পথচারী পেলে তার কাছে যা কিছু পাওয়া যায় তার সবই ছিনিয়ে নেয়। এমনকি ফিটিং কেস (মিথ্যা ঘটনা) সাজিয়ে অনেককে গ্রেফতারও করা হয়। এরপর সারা রাত আটকে রেখে আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের চাঁদা। শুধু রাস্তায় নয়, বিভিন্ন মাদকের স্পট, অসামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন আবাসিক হোটেল ও ফ্ল্যাট, মাদক ব্যবসায়ী, বিদেশি মদ-বিয়ার বহনকারী যানবাহনের বিষয়ে তারা আগাম গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করেন। এরপর অভিযান বা গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে শুরু হয় মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি। টাকা পেলে সব অবৈধ কর্মকাণ্ড নির্বিঘেœ চলতে দেয়ার গ্যারান্টিও দেয়া হয়। বিনিময়ে নির্ধারণ করে দেয়া হয় মোটা অঙ্কের মাসোহারা। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, গত শনিবার গভীর রাত পর্যন্ত তার অবস্থান ছিল রাজধানীর গুলশান-২ নম্বর এলাকায়। এদিন রাতে তিনি এক ব্যবসায়ীকে আটকে ৪ লাখ টাকা আদায় করেন। টাকা না দিলে ওই ব্যবসায়ীর নগ্ন ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করার ভয় দেখানো হয়। এছাড়া গত মাসে পাকিস্তান দূতাবাসের উল্টোদিকে হঠাৎ যানবাহন তল্লাশি শুরু করে সফিউলের কথিত রেইডিং পার্টি। এ সময় একজন সরকারি কর্মকর্তার গাড়িতে চারটি বিয়ার পাওয়া যায়।
এরপর ওই কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে ৩০ হাজার টাকা আদায় করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সরকারি কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে তার গাড়িটি থামানো হয়। এরপর তল্লাশির সময় তারা গাড়িতে চারটি বিয়ারের ক্যান পেয়ে যান। বিয়ার পেয়েই উল্লসিত হয়ে একজন বলেন, ‘শফি স্যার, মাল পাইছি, ওরে গ্রেফতার করেন।’ সফিউল আজমের এমন ঘুষ বাণিজ্য প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের অসৎ পুলিশের কারণে গোটা পুলিশ বাহিনীর বদনাম হচ্ছে। অবিলম্বে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে বেশি বেগ পেতে হবে না। কারণ তার মোবাইল ফোনের কল লিস্ট দেখলেই প্রায় রাতে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থানের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। সূত্র জানায়, পিএসআই শফিউল কয়েক বছর আগে ঢাকা মহানগর পুলিশের বনানী থানায় কর্মরত ছিলেন। বনানী থানায় থাকার সুবাদে গুলশান ও বনানী এলাকার বিভিন্ন মাদক স্পট তার নখদর্পণে। তাই এসব মাদক স্পট থেকে তিনি নিয়মিত মাসোয়ারা আদায় অব্যাহত রেখেছেন। জানা গেছে, শফিউল আজম বর্তমানে ডিসি কোর্স (চাকরি স্থায়ীকরণ) করতে টাঙ্গাইলে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে সংযুক্ত। টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা আসা-যাওয়ায় একটু সমস্যা হচ্ছে তার। এ কারণে তিনি এখন গুলশান-বনানী এলাকায় শুক্র, শনিসহ সপ্তাহে ৩-৪ দিন করে আসেন। স্থানীয় কতিপয় অপরাধীকে তিনি নিজস্ব সোর্স হিসেবে ব্যবহার করেন। যাদের নিয়ে গভীর রাতে ‘রেইডিং পার্টি’ গঠন করা হয়। জানা গেছে, টাঙ্গাইলে কোর্স করতে যাওয়ার আগে প্রবেশনারি সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে মাত্র দুই মাসের জন্য কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় সংযুক্ত ছিলেন সফিউল আজম। কিন্তু এ দুই মাসেই কেরানীগঞ্জে তিনি ঘুষখোর পুলিশ কর্মকর্তার উপাধি পেয়ে যান। যুগান্তরের কেরানীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, নবীন এ পুলিশ কর্মকর্তা প্রতারক ও ধান্ধাবাজদের মতো আচরণ করতেন। চাহিদামাফিক বাড়তি আয়-রোজগার করতে নানা কৌশলে হয়রানি-নাজেহাল করতেন সাধারণ মানুষকে।
আর এসব কাজে কম সময়ের মধ্যেই তার বিশেষ সহযোগী হয়ে যান থানার তৎকালীন সেকেন্ড অফিসার এসআই শরীফুল ইসলাম ও শাহাদাৎ হোসেন। সূত্র জানায়, গত বছর ডিসেম্বরে কেরানীগঞ্জের ইমামবাড়ি সড়ক থেকে হাফেজ ও আলী নামে দুই ব্যক্তিকে আটক করেন সফিউল আজম। তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ চোরাচালানের অভিযোগ ছিল। কিন্তু আইগত ব্যবস্থা না নিয়ে সারা রাত থানাহাজতে আটকে রাখা হয়। পরদিন সকালে ৪০ হাজার টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। কেরানিগঞ্জে থাকাকালে মোটরসাইকেল আটক করে টাকা আদায় ছিল শফিউলের অবৈধ আয়ের আরেকটি বড় উৎস। এছাড়া স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের কাছেও তার বিশেষ কদর ছিল। এভাবে তার বিরুদ্ধে ঘুষ দুর্নীতি ও জনহয়রানির অভিযোগ চাউর হয়ে গেলে তাকে ঢাকার আদালত পাড়ায় বদলি করা হয়। কিন্তু ঘুষের নেশা তার পিছু ছাড়ে না। সপ্তাহ পার না হতেই এখানে তিনি ঘুষ কেলেংকারিতে জড়িয়ে পড়েন। এরপর গত ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি ডিসি কোর্স করতে টাঙ্গাইলে চলে যান। সূত্র জানায়, কনস্টেবল হিসেবে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন শফিউল। চাকরির শুরু থেকেই তিনি নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ায় একাধিকবার সাময়িক বরখাস্ত হন। তার বিরুদ্ধে একাধিকবার বিভাগীয় মামলাও দায়ের করা হয়। এসআই শফিউল আজমের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টাঙ্গাইল পুলিশ ট্রেনিং কলেজের কমান্ড্যান্ট হাসানুল হায়দার যুগান্তরকে বলেন, অভিযোগের বিষয়টি অবশ্যই তদন্ত করে দেখা হবে। ঘটনার সত্যতা পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ছাড় দেয়া হবে না। শিক্ষানবিশ এসআই শফিউল আজম যুগান্তরকে বলেন, আমি টাঙ্গাইলে আছি। এখান থেকে কীভাবে ঢাকায় যাব? বিভাগীয় মামলা ও বরখাস্তের বিষয়ে তিনি বলেন, এসব মোটেও সত্য কথা নয়। এগুলো যারা বলেছে, তারা মিথ্যা বলেছে।
No comments