চট্টগ্রামে মহিউদ্দিন-নাছির মুখোমুখি
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছিরের বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে। দু’জন দু’জনকে প্রকাশ্যে আক্রমণাত্মক ভাষায় কথা বলছেন। একজন আরেকজনকে ব্যর্থ প্রমাণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে মঙ্গলবার দু’জন পৃথক প্রেস ব্রিফিং করেন। প্রেস ব্রিফিংয়েও ছিল পরস্পরের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা, আক্রমণাত্মক বক্তব্য। দুপুরে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটিতে নিজ কার্যালয়ে প্রেস বিফিংয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী আবারও আ জ ম নাছিরকে খুনি আখ্যায়িত করে তাকে সংশোধন হয়ে যেতে বলেন। তিনি বলেন, সবাই মিলে তাকে মেয়র বানিয়েছি। নির্বাচন কীভাবে হয়েছে তাও সবাই জানে। কিন্তু মেয়র হওয়ার পর তিনি দাম্ভিক হয়ে গেছেন। বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম করছেন। এই অপকর্মের জন্য তিনি এখন আর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যেতে পারেন না। তিনি অশুভ শক্তির মোকাবেলায় প্রয়োজনে লাঠি ব্যবহার করবেন বলে জানান। এর আগে সকালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে প্রেস ব্রিফিংয়ে আ জ ম নাছির বলেন, বয়সের ভারে ন্যুব্জ ও ক্ষমতা হারানোর অন্তর্জ্বালা থেকে মহিউদ্দিন চৌধুরী আবোল-তাবোল বকছেন। পাগলের প্রলাপ বকছেন। বিএনপি-জামায়াত ও নাশকতা মামলার আসামিদের নিয়ে সমাবেশ করে, একজন নির্বাচিত ও সরকারদলীয় নেতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী কার্যত সরকারের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছেন।
মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রেস ব্রিফিংয়ে যা বলেন : নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, আ জ ম নাছির খুনি, ছাত্রলীগের ১২টা ছেলের খুনের নেপথ্যে তিনি ছিলেন। ক্ষমতার দাপটের কারণে অনেকে মামলা করেননি। অনেক মামলা হাতে-পায়ে ধরে প্রত্যাহার করাতে সক্ষম হয়েছেন। আমার প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির একটা ছাত্রকেও হত্যা করা হয়েছে। তিনি যে এসবের নেপথ্যে তার প্রমাণ আমার কাছে আছে। প্রয়োজন হলে দেব। যেখানে দিতে হয় সেখানে দেব। তাকে কেন দেব। শেখ হাসিনার একটি মিটিংয়েও তিনি গুলি করেছিলেন। ওই ঘটনায় মামলা হয়েছিল। মহিউদ্দিন চৌধুরী আরও বলেন, নগরবাসীর ওপর নাছির ট্যাক্সের বোঝা কেন চাপাচ্ছেন। বন্দরের কাছে ৩০০ কোটি টাকার ট্যাক্স পাওনা রয়েছে। এসব ট্যাক্স তিনি আদায় কারতে পারেন না। কারণ তিনি বন্দরে ব্যবসা করেন। রেলের কাছে বিপুল অংকের ট্যাক্স পাওনা আছে সিটি কর্পোরেশনের। তিনি এসব ট্যাক্স আদায় করেন না। মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ট্যাক্স দিতে না পারলে শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। আমি তো ট্যাক্স না বাড়িয়ে ১৭ বছর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছি। মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, এখন তো কর্পোরেশনকে পাগলের ঘর বানানো হয়েছে। কর্পোরেশনে মহিলা কাউন্সিলরদের জন্য একটি কমনরুম করেছিলাম। সেই রুমটি তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি চান সবাই তার চেম্বারে যাক। মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, আউটার স্টেডিয়ামে বিজয় মেলার মাঠ দখল করে সুইমিংপুল কেন বানাবেন তিনি। ওয়াকফ এস্টেটের জায়গা দখল করে কেন দোকান বানাবেন। যেখানে আদালতের রায় অমান্য করা হচ্ছে। নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, তার অপকর্মের বোঝা এতই ভারী হয়েছে যে তিনি এখন আর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যেতে পারেন না। সবাই তার বিরুদ্ধে। নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, সব অপকর্মের বিরুদ্ধে, অশুভ কাজের বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদ আগেও ছিল, এখনও আছে। হেফাজতের তাণ্ডব ও জঙ্গি তৎপরতা রুখতে ৫ হাজার লাঠি বানিয়েছিলাম। সেই লাঠি ব্যবহার তখন করেছি। সামনেও প্রয়োজন হলে নগরবাসী লাঠি নিয়ে প্রতিবাদ করবে।
তিনি এমন একটি লাঠি প্রেস ব্রিফিংয়ে সবাইকে দেখান। আ জ ম নাছির উদ্দীন প্রেস ব্রিফিংয়ে যা বলেন : চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির বলেন, আমি নাকি হাসতে হাসতে গুলি করতে পারি। আমি নাকি ১২টা খুন করেছি। এটা তিনি কোথায় দেখেছেন। তার কাছে কী এমন তথ্য-প্রমাণ আছে। থাকলে তা দিতে হবে। উনার কথার কোনো সত্যতা নেই। এ কথাগুলো কেন বলছেন, কীজন্য বলছেন তা আমার কাছে অবাক লাগে। কেউ কেউ বলছেন, আসলে উনি বয়সের ভারে নু্যুব্জ হয়ে পড়েছেন বা উন্মাদ হয়ে গেছেন। ক্ষমতা হারানোর অন্তর্জ¡ালাও রয়েছে। এ কারণে আবোল-তাবোল বকছেন। তার এসব বক্তব্যকে অনেকেই পাগলের প্রলাপ বলে মনে করছেন। তিনি কথা ও কাজে এক জায়গায় স্থির থাকতে পারেন না। ঢালাও ও ভিত্তিহীন অভিযোগ করছেন। আমি নাকি বন্দর চেয়ারম্যানের রুমে বসে থাকি। আমার এখানে সিসিটিভি আছে। বন্দরেও সিসিটিভি আছে। ফুটেজ নিলে আমি কোথায় কতক্ষণ থাকি তার উত্তরটা পাওয়া যাবে। আ জ ম নাছির আরও বলেন, ১ বছর ৮ মাস ১৬ দিন হল দায়িত্ব নিয়েছি। পাঁচ বছর পর ভোটাররা মূল্যায়ন করবে আমার কাজ। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে কেন হঠাৎ করে মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রকাশ্যে এমন কথা বলা শুরু করলেন। এর নেপথ্য রহস্য কী। টাকা দিয়ে মনোনয়ন কিনেছি এমন অভিযোগও আনছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ মুখে মেয়র পদে আমার মনোনয়ন ঘোষণা করেছেন। এ মনোনয়ন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। টাকা কে খেয়েছে? তাহলে টাকাটা কে নিয়েছেন, কে দিয়েছেন, কীভাবে দিয়েছেন তা উনি পরিষ্কার করুক। ব্রিফিংয়ে নাছির আরও বলেন, উনি ১৭ বছর মেয়র ছিলেন।
উনি নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। আমি সাধারণ সম্পাদক। আমাদের ফোরাম আছে, সেখানে বক্তব্য দিতে পারতেন। যদি ফোরামে আলোচনার সুযোগ না পান, তবে কেন্দ্রকে জানাতে পারতেন। এসব না করে তিনি প্রকাশ্য সমাবেশ করেছেন আমার বিরুদ্ধে। যাদের নিয়ে সমাবেশ করেছেন তাদের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত ও সরকারবিরোধী লোকজন ছিল। আউটার স্টেডিয়ামের সুইমিংপুল নির্মাণকাজ বন্ধে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ১৫ দিনের আলটিমেটাম প্রসঙ্গে নাছির বলেন, এগুলো উনার স্টান্টবাজি। ইরাকে ১০ হাজার যোদ্ধা পাঠাবেন বলেছিলেন। পাঠাননি। কাস্টমসের দুর্নীতিবাজদের তালিকা করবেন বলেছিলেন। করেননি। এমএ লতিফের মাথায় লাঠি মারবেন বলেছেন। মারেননি। উনার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। চউক চেয়ারম্যান ছালাম সাহেবের ফাঁসি দাবি করেছিলেন, আবার উনার পারিবারিক মেজবানে সবার আগে গিয়ে বসে থাকেন। তাই আমি উনার কথায় তটস্থ নই। মহিউদ্দিন চৌধুরীর বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আ জ ম নাছির যুগান্তরকে বলেন, মহিউদ্দিন চৌধুরী আমার বিরুদ্ধে যে মিথ্যাচার করছেন গোয়েবলস বেঁচে থাকলে তা দেখে তিনিও লজ্জা পেতেন। একটি মিথ্যা বারবার বললে তা সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা হয়নি। চট্টগ্রামবাসী সেই মিথ্যাচারে বিশ্বাস করেনি। মানুষ আমাকে ভোট দিয়ে মেয়র বানিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আমাকে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বানিয়েছেন। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম শহরে থাকার মতো মাথা গোঁজার ঠাঁই উনার ছিল না। এগুলো বলতে চাই না আমি। সত্যের জয় একদিন হবেই।
No comments