তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না পেলে খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে

অভিন্ন নদী তিস্তার পানি উজানের দেশ ভারত একতরফাভাবে ও খেয়ালখুশি মতো ব্যবহার করায় ভাটির দেশ বাংলাদেশের সার্বিক কৃষি খাত কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং কৃষকরা কীভাবে সর্বস্বান্ত হচ্ছে সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের অংশে তিস্তার পানি একচেটিয়াভাবে প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশ অংশে নদীটিতে পানির অভাবে বোরো মৌসুমে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের দিনাজপুর ও রংপুরের কমান্ড এলাকায় গত কয়েক বছরে হাজার হাজার হেক্টর জমি সেচ কার্যক্রম থেকে বাদ পড়ে গেছে। বোরো সেচনির্ভর ফসল এবং দেশে চাল উৎপাদনে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। দেশের শস্যভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত উত্তরাঞ্চলে বোরো আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হলে চাল তথা খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা অপূর্ণ থেকে যাবে। শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশে তিস্তার পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় শুধু সার্বিক কৃষি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, হুমকির সম্মুখীন হয়েছে জীববৈচিত্র্য। তাছাড়া শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদী পানির প্রবাহ ভীষণভাবে কমে যাওয়ায় দেশের উত্তরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। সার্বিকভাবে পরিবেশ বিপর্যয়ের সমূহ আশংকা দেখা দিয়েছে। হিমালয়ের সিকিম অংশে উৎপত্তি হওয়া তিস্তা নদী সিকিমের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশের পর পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রবেশ করেছে। ভারতের সিকিমে নির্মাণাধীন বিশালাকৃতির তিস্তা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ছাড়াও রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য ড্যামের নেটওয়ার্ক। ভারতের জলপাইগুড়িতে নির্মিত গজলডোবা ব্যারাজ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং-কালিম্পং অঞ্চলে রয়েছে তিস্তা লো-ড্যাম্প নামে বিভিন্ন জলবিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্প। এসব প্রকল্পের মূল সম্পদ হচ্ছে তিস্তার খরস্রোতা পানি (আসিফ নজরুল, প্রথম আলো, ৭ এপ্রিল)। এসব প্রকল্প তিস্তার পানি নিঃশেষ করে দিচ্ছে। কাজেই বাংলাদেশে প্রবেশকালে তিস্তায় পানি থাকছে না। সমতল ভূমিতে তিস্তা অববাহিকার পরিমাণ ৪ হাজার ১০৮ বর্গকিলোমিটার, যার প্রায় অর্ধেক পড়েছে বাংলাদেশ সীমানায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ২০১৪-১৫ সালে বোরো মৌসুমে রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলার ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু তিস্তায় পানির অভাবে সেচ দেয়া সম্ভব হয় মাত্র ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে।
অর্থাৎ ওই বছর সেচ সুবিধা থেকে বাদ পড়ে ৪৭ হাজার হেক্টর জমি। ২০১৫-২০১৬ সালে বোরো মৌসুমে আরও কমিয়ে সেচ সুবিধা দেয়া হয় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। চলতি ২০১৬-১৭ সালে তা আরও কমিয়ে মাত্র ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দিনাজপুর ও রংপুরের কমান্ড এলাকা ৫৭ হাজার হেক্টর জমি সেচ কার্যক্রম থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। বাদ পড়া এলাকার কিছু কিছু জমিতে কৃষকরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সেচ দিয়ে বোরো আবাদ করলেও তাদের হেক্টরপ্রতি বাড়তি ব্যয় হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। উৎপাদিত ধান বিক্রি করে এই অতিরিক্ত ব্যয়ের খরচ উঠাতে পারবে না জেনে তারা ভীষণভাবে চিন্তিত। আগেই উল্লেখ করেছি, শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে তিস্তা নদীর পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় দেশের উত্তরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলে পরিবেশ বিপর্যয়ের সমূহ আশংকা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় সরকার বাধ্য হয়ে উত্তরাঞ্চলে বোরোর আবাদ সংকুচিত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। সরকারি তথ্য মোতাবেক ২০১৪-১৫ অর্থবছরের ১ কোটি ৯১ লাখ ৯২ হাজার টন বোরোর উৎপাদন গত অর্থবছর (২০১৫-১৬) উত্তরাঞ্চলে জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় ১ কোটি ৮৯ লাখ ৩৭ হাজার টনে নেমে এসেছে। অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বোরোর উৎপাদন কমেছে ২ লাখ ৫৫ হাজার টন। উল্লেখ্য, দেশে উৎপাদিত মোট চালের ৫৬ শতাংশ আসে বোরো থেকে। দেশ যে আজ চাল উৎপাদনে স্বনির্ভরতার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে তার পেছনে মূল অবদান বোরোর। শুকনো মৌসুমে তিস্তার পানি না পাওয়ার কারণে উত্তরাঞ্চলে বোরোর আবাদ সংকুচিত করতে হলে খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্য শুধু অপূর্ণ থেকে যাবে না, বরং দেশ আবার চাল আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের সব সরকার ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর পানির ন্যায্য বণ্টনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নয়াদিল্লিতে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির প্রস্তাবনায় পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে দু’দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানিবণ্টনের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এর আগে ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণদানকালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানির ন্যায্য বণ্টনে ভারতের অসহযোগিতার কথা উল্লেখ করেন এবং বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তারও আগে ১৯৮৪ সালের ২১ মার্চ ভারতের লোকসভায় এক বিতর্কে অংশ নিয়ে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিভি নরসিমা রাও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন (সূত্র : India-Bangladesh Relations, Volume 1, Edited by Avtar Sing Bhasin)। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে তিস্তা নদীর পানিবণ্টনের বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া প্রয়োজন মর্মে যৌথ ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে এ দেশের মানুষ, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের মানুষ তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার আশায় বুক বাঁধলেও তাদের সে আশা পূরণ হয়নি। সর্বশেষ ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে তিস্তার পানির ন্যায্য বণ্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে দেশের জনগণ আশা করেছিল। মোদির ওই সফরে ১৯টি চুক্তি,
প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলেও তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। মোদির ওই সফরে ভারত যা চেয়েছিল তা পেয়ে যায়। চুক্তির ফলে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা উন্মুক্ত হওয়ায় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় পণ্য পরিবহনে ভারতের ব্যয় কমে গেছে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি। এ ছাড়া সময় লাগছে আগের তুলনায় ২৫ শতাংশ বা চার ভাগের এক ভাগ। আর যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হল, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় যে রাজ্যগুলোয় ভারত পণ্য নিয়ে যাচ্ছে, সেসব রাজ্য এতদিন ছিল বাংলাদেশের বহু শিল্পপণ্যের বাজার। সেই বাজার সংকুচিত হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরে ১৬টি সমঝোতা স্মারক ও ৬টি চুক্তি হলেও হয়নি তিস্তা চুক্তি। এবারও ভারত যা চেয়েছে তা পেয়েছে। শেখ হাসিনার ভারত সফর শুরুর অনেক আগেই ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব দেয়। ভারতের চাওয়া মোতাবেক প্রতিরক্ষা বিষয়ে স্বাক্ষরিত হয়েছে ৪টি সমঝোতা স্মারক। এগুলো হল- ১. প্রতিরক্ষা সহযোগিতা কাঠামো ২. বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতে ভারতের ৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ ৩. তামিলনাড়ুর ওয়েলিংটন (নিলগিরিস) ডিফেন্স সার্ভিসেস স্টাফ কলেজ এবং মিরপুরের ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজের মধ্যে কৌশলগত ও অপারেশনাল স্টাডিজ বিষয়ে সহযোগিতা বৃদ্ধি ৪. ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, ঢাকা এবং ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, নয়াদিল্লির মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও কৌশলগত বিষয়ে সহযোগিতা জোরদার করা। এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হল, ভারত নিজে অস্ত্র আমদানিকারক দেশ হয়েও সেদেশ থেকে সমরাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ে বাংলাদেশকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ প্রদান। এর অর্থ হল, সমরাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের মধ্য দিয়ে ভারত বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভারতনির্ভর করে তুলতে চায়। প্রতিরক্ষা সহযোগিতা কাঠামো সমঝোতা স্মারকে কী আছে সে সম্পর্কে এ দেশের জনগণ সম্পূর্ণ অন্ধকারে। তবে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ক স্মারকগুলো স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ভারত যে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় খবরদারি করতে চায় তা অনেকটা জোর দিয়েই বলা যায়। শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরে বহু কাক্সিক্ষত তিস্তা চুক্তি যেমন স্বাক্ষরিত হয়নি, তেমনি স্বাক্ষরিত হয়নি বহু প্রত্যাশিত সীমান্ত হত্যা বন্ধ চুক্তি। সবশেষে যা বলতে চাই তা হল, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না পেলে আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য চালসহ সার্বিক কৃষি খাতের (সার্বিক কৃষি খাত বলতে শস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং বন উপখাতগুলোকে বোঝায়) উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে। ফলে বিঘ্নিত হবে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা। তাই খাদ্য উৎপাদন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণের স্বার্থে তিস্তাসহ সব অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পেতে আমাদের ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসতে এবং চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.